Dipika Majumdar

Others Abstract

2  

Dipika Majumdar

Others Abstract

যোগিনীর জলসত্র

যোগিনীর জলসত্র

12 mins
10.2K


সারাদিন গ্রীষ্মের দাবদাহের পর শীতল চাঁদনী রাতের রূপোলী আলো চারদিকে যেন প্লাবন নামিয়ে এনেছে। ধু ধু প্রান্তরের উপরে মৃদুমন্দ বাতাস মাঝে মাঝে তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায়। দেশের পশ্চিম প্রান্তের গুজরাট রাজ্যের সাদা নুনের মরুভূমি, কচ্ছের রণ। বৃষ্টির পূর্বাভাস যদিও নেই, তবুও ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু মেঘ এসে গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদকে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে, আবার তারপরেই চাঁদের জ্যোৎস্না ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। সাদা নুনের মরুভূমির উপরে জ্যোৎস্নার এই অদ্ভুত খেলা দেখতে দীপ্যমানের কি যে ভালো লাগছিল তা বোধয় সে ভাষায় বোঝাতে পারবেনা কাউকে। সেই কোন ছোট বেলায় স্কুলের ভূগোল বইতে সে পড়েছিল এই কচ্ছের রণের কথা, আজ সেই রণের ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। 

দীপ্যমান হালদার পেশায় একজন ভূবিজ্ঞানী, সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে মাটির চরিত্র পরীক্ষা করাই তার কাজ। সেই পেশার সুত্রেই এসে পড়েছে কচ্ছের মাটিতে। দুদিন ধরে এই লবণের মাটিতে তাঁবু খাটিয়ে বাস করছে। আজকেই শেষ রাত্রি, আগামীকাল বিকেলেই রণ-ক্ষেত্র থেকে বিদায় নেবে সে, তাই শেষ মুহূর্তের কাজগুলো রাত জেগে গুছিয়ে নিচ্ছিল। তাঁবুর ভেতরে তার সিনিয়ার হলধর সাহু ঘুমিয়ে আছেন। দীপ্যমান কাজের ফাঁকে তাঁবুর বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল সবে, তখনই বিশাল একটা মেঘের ফালি ছিঁড়ে রজত শুভ্র চাঁদনী আলো এসে চারদিক যেন ভাসিয়ে দিলো। তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে দীপ্যমান এই আলো আঁধারের লুকোচুরি দেখছিল একমনে। 

হাতের সিগারেট শেষ হতেই দীপ্যমানের মনে হোল একটু জল খাওয়া দরকার, গলাটা বড্ড ঘনঘন শুকিয়ে যায় এই শুষ্ক মরুভূমিতে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হোল- বিকেলে ভৈরব সিং বলেছিল সন্ধ্যের আগে জলের ঘড়াটা ভরে দিয়ে যাবে। দেয়নি! নির্ঘাত কোথাও নেশা করে পড়ে আছে। রণের শেষ প্রান্তে যেকটা বস্তি আছে তার কোন একটায় ভৈরব সিংএর আস্তানা। দুদিন ধরে ভৈরবই টাকার বিনিময়ে দীপ্যমানদের খাবার আর জলের যোগান দিয়েছে। খাবার বলতেও- চামড়ার মতো শুকনো বাজরার রুটি আর অল্প একটু দই দিয়ে তৈরি পাতলা এক গ্লাস শরবত, যার স্থানীয় নাম- ছাস্। ভৈরবের কথায় সে নাকি এই রণের চাপ্পা চাপ্পা জানে। কোথায় জলের লেভেল উপরের দিকে, কোথায় একেবারে নেমে গেছে। রণের কোথায় কোথায় আলগা মাটি, কোনদিকে পয়দল যাওয়া যাবে, কোনদিকে গাড়ি যাবে। ভৈরবের কথা মতোই দীপ্যমানরা এখানে তাঁবু ফেলেছে। ভৈরব বলেছিল- 'ইধার ইহাপে যো মন্দির হ্যায়, গাঁও ইহাপে খতম হোতা হ্যায়। আউর আগে সে মিঠো জমিন শুরু হোতা হ্যায়। আগে জমিন হালকি হ্যায় সাহাব, আগে কাহি জানা হো তো কিসিকো বুলা লিজিয়েগা, আকেলে মত জানা।" কচ্ছের গুজরাতি ভাষায় 'মিঠো' মানে যে নুন, সেটা এই কদিনে দীপ্যমান বুঝেছে, তবে হালকা জমি মানে ভৈরব কি বলতে চাইছে তা দীপ্যমান ভালই জানে। আরব সাগরের এই অংশে নুনের পরিমান এতো বেশি যে প্রায় ১৮০০০বর্গ কিমি জুড়ে কর্দমাক্ত এলাকার সৃষ্টি করেছে। আদতে এটি আরব সাগরের অংশ, বৃহৎ কচ্ছের রণ।

প্রতিদিন সন্ধ্যের আগে জলের ঘড়াটা ভরে দিয়ে যাওয়া ভৈরবের কাজ, আজ শেষ দিনে দীপ্যমানের কাছে পাওনা টাকাটা পেয়ে কেটে পড়েছে সে। অগত্যা একহাতে নিজের পানীয় জল রাখার প্লাস্টিকের বোতল আর অন্য হাতে একটা তিন ব্যাটারির টর্চ ঝুলিয়ে দীপ্যমান নিজেই রওনা দিলো গ্রামের দিকে। দীপ্যমানদের তাঁবুর পূর্ব দিকে একটা মন্দির আছে, ভৈরবের কাছে শুনেছে- যোগিনী মায়ের মন্দির। যোগিনী মায়ের কথায় ভৈরব বলে- 'বহুত জিন্দা দেবী হ্যায় যোগিনীমা। কচ্ছমে জিতনা নামজাদা বানিয়া হ্যায় সব ইহাপে আতে হ্যায় কুছ না খুছ মাঙনেকে লিয়ে। মাতা কিসিকো খালি হাত নেহি লউটাতে হ্যায় সাহাব। পাস মে হ্যায় মন্দির, জানে সে পেহেলে ঘুমকে জানা।' মন্দিরের আশে পাশে জল পাওয়া গেলেও যেতে পারে, এই ভেবে দীপ্যমান মন্দিরের দিকে পা বাড়াল।

মন্দির এলাকা হলেও জায়গাটা বেশ নির্জন, তার উপরে চাঁদনী রাতে সাদা মরুভূমির উপরে নুন আর বালি চিকচিক করে বাবলা গাছের ফাঁকে ফাঁকে। পশ্চিম দিকে আরব সাগরের উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে মন্দির চূড়ার উপরের গেরুয়া পতাকা উড়ে চলেছে। বিশাল লোহার গেট ঠেলে এগিয়ে গেলো দীপ্যমান, ছোট্ট মন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গন। জ্যোৎস্নার আলোতে দেখা যায় মন্দিরের গায়ের রংবেরঙের কারুকার্য। মন্দির প্রাঙ্গনের পাশেই একটা বিশাল জলাশয়। খোলা জলাশয়ের পাশেই পানীয় জলাধারের ব্যাবস্থা, বড় বড় করে গুজরাতি ভাষায় লেখা- ‘পিবানা পানি’ (পানীয় জল) জলাধারের কল খুলে বোতলে জল ভরে দীপ্যমান। খোলা জলাশয়ে নেমে খানিকটা ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দেয় চোখে মুখে। মন্দির চত্বরটা বেশ খোলামেলা, বড় বড় গাছও আছে, নীচে বসার জায়গাও। সকালে এসে ভালো করে নাহয় দেখা যাবে, এই ভেবে দীপ্যমান গেটের দিকে পা বাড়াল। হঠাৎ মনে হোল পেছনে কেউ যেন ডাকল তাকে। ঠিক ডাকল না, কিছু চাইল। দীপ্যমান পেছন ঘুরে কাউকে দেখতে পেল না, এদিক ওদিক তাকিয়ে জানতে চাইল- “কে?”

মন্দির চত্বরের অন্ধকার বেদীর পেছন থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন, পরনে দেহাতি বেশভূষা। কালো রঙের ঘাগরা, কপাল অব্দি ঢাকা কালো ওড়না। হাতে পায়ে বেড় দেওয়া রূপোর গয়না চকচক করছে রূপোলী আলোতে। মহিলা ক্রমশ এগিয়ে এলেন দীপ্যমানের দিকে। কাছে এসে দেহাতি ভাষায় বললেন,- “জল হবে?” দীপ্যমান বেশ অবাক হোল মহিলার কথায়। এতো রাতে মন্দিরের ভেতরে একাকিনী এই মহিলা এখানে জলের আশায় বসে আছেন! আর জলের ব্যাবস্থা যখন আছে তখন তাকে ডেকে জল কেন চাইছেন! এতো অবাক হওয়া সত্বেও কিছু জিজ্ঞেস করল না দীপ্যমান। সম্মতি সূচক মাথা নাড়াতেই মহিলা দুহাত পেতে সামনে ঝুঁকে দাঁড়ালেন দীপ্যমানের সামনে। দীপ্যমান জলের বোতলের ঢাকনা খুলে জল ঢেলে দিলেন মহিলার আঁজলায়। জল ঢালার সময় দীপ্যমান খেয়াল করল মহিলার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি নেই, সেই কারনে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে বেশীরভাগ জল গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। প্রায় অর্ধেক বোতল জল পান করার পর মহিলা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মহিলাকে দেখে দীপ্যমান বুঝতে পারল যে উনি বেশ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। দীপ্যমান ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে মহিলাকে প্রশ্ন করল- “আপনি এখানে এতো রাতে একা কি করছেন?”

-“আমি তো এখানেই থাকি বাবু।“

-“এখানে?”

-“হ্যাঁ, এই আশ্রমেই।“

দীপ্যমানের খেয়াল হোল ভৈরব তাকে বলেছিল মন্দিরে দুবেলা লঙ্গর লাগে, এখানে একটা ফ্রী চিকিৎসালয় ও থাকার ব্যাবস্থাও আছে বটে। আশ্রমের প্রসঙ্গে ফিরে না গিয়ে দীপ্যমান মহিলাকে জিজ্ঞেস করল- “এখানে পানীয় জলের সুব্যবস্থা আছে দেখলাম। আপনি থাকেনও এখানেই। তাহলে আমার কাছে জল চাইলেন যে? আপনি তো নিজেই জল নিয়ে খেতে পারতেন।“

-“আমি এখানে থাকি বটে বাবু, কিন্তু ওই জলসত্রে আমার হাত দেওয়ারও অধিকার নেই।“

-“অধিকার নেই মানে?”

-“এই মন্দির, এই আশ্রম এখন যাঁদের জিম্মায় আছে তারা কোনদিন চাইবে না যে ওই জলে আমি হাত দিই বাবু।“

-“ চাইবে না? কেন? ওরা কারা?”

-“সে অনেক ঘটনা বাবু। অনেক কাল আগের কথা, তখন এই যে ইমলির গাছ দেখছেন বাবু সমুন্দর এর থেকে দুই তিন মিল দূরে ছিল মাত্র। রণের শেষ গাঁও ছিল- ভিরা। ভিরা গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবার ছিল আহিররা। দুধের ব্যাবসা, নুনের ব্যাবসা কি ছিল না ওদের। এখন তো এই মন্দিরের অধিকারও ওদের হাতে। ভিরা গাঁওয়ের সব গ্রামবাসী ওদের আঙ্গুলের ইশারায় চলত। এই ভিরা গ্রাম তখন এতো রুখা-সুখা ছিল না। সমুন্দরের উপর দিয়ে হাওয়া বয়ে আসতো, সাথে বছরকার বারিশ'ভি হতো। বস্তির লোকজনের এক ফোঁটা পানির জন্যে এতো হাহাকার ছিল না তখন। ক্রমে সময় বদলে যেতে লাগলো। জরুরতের থেকে পানি কম হতে লাগলো, মিট্টির নীচে জল শুকিয়ে কুয়ো দিয়ে কাদা উঠতে শুরু করল। সবার ঘরে ঘরে জলের হাহাকার, কিন্তু আহিরদের ঘরে টাকার বারিশ্ বেড়েই চলেছে। সমুন্দরের পানি খাল কেটে জমিনে ঢুকিয়ে বাঁধ দিয়ে সেই জল শুকিয়ে নমক বানাত আহিররা। সেই নমক সারাদেশে বেচে টাকার কুমির হয়ে উঠেছিল। গ্রামের মাঝে একমাত্র কুয়াতেও আহিররা আগে জল নিতো। ভিরা গ্রামের শেষ প্রান্তে এক যোগিনীর বাস ছিল। সেই যোগিনী একদিন পঞ্চায়েতে গিয়ে আহিরদের কারসাজি ফাঁস করে দিলো। হরসাল বারিশ্ হলে নমকের ব্যবসায়ে ক্ষতি হয়, পানি শুকাবে না। তাই আহিররা তন্তর-মন্তর করে বারিশ্ রুখে দিত। যোগিনী মাতা গাঁওয়ের ভালো করতে চেয়েছিল, কিন্তু আহিররা তাকে ডাইন্ বলে বদনাম করে গাঁও থেকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সেই যোগিনী মাতা এই মন্দিরের কাছে এসে আশ্রয় নেয়। এই মন্দির তো তখন ছিল না, ছিল যোগিনী মাতার কুটিয়া।“

এতদুর বলে শ্বাস নেওয়ার জন্যে মহিলা খানিক থামলেন। দীপ্যমান বলল- “এই মন্দির কি করে হোল? আর এই আশ্রম, চিকিৎসালয়?”

-“যোগিনী মাতার মন সর্বদা সকলের ভালোর জন্যে ভাবতো। এই যে এখান থেকে সামনে যতদূর চোখ যায় দেখছ, তখন খালি পানি আর পানি। কতো ব্যাপারী নাও নিয়ে সমুন্দরে হারিয়ে যেতো, কেউ কখনও দিশা হারিয়ে এলে যোগিনী মাতা তাকে সেবা করে সুস্থ করে তুলত। এই রকম একবার এক রং ব্যবসায়ীর নৌকা মাঝ দরিয়ায় ঝড়ের মুখে পরে দিশা হারিয়ে দেশের পশ্চিম উপকূলে নমকের কাদায় এসে আটকে গেলো। দূর থেকে এক আদমিকে হেঁটে আসতে দেখে যোগিনী মা তাকে জল খাওয়ালেন। তার সঙ্গী-সাথীরা আগেই মারা গেছিলো, সেই রঙের কারবারি যোগিনী মাতার হাতে সেবা পেয়ে এতো সন্তুষ্ট হয়ে গেলো যে তিনি মাতার কুটিয়া লাল, নীলা, হরা, পিলা, গুলাবি রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দিলেন যাতে, কোন হারিয়ে যাওয়া নাওয়ের নাবিক দূর থেকে এই কুটিয়া দেখে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে ওই রং ব্যাপারী এই ভিরা গাঁওতে নিজের কারবার ছড়িয়ে বসলেন। নিজের আয় থেকে বহুত পয়সা এই আশ্রমের জন্যে দান করতেন। ওনার দয়ায় পান্থশালা, চিকিৎসালয় তৈরি হোল, ভিরা গ্রামের লোকজন যোগিনী মাতার আশ্রমে দিনরাত আসা যাওয়া করতে লাগলো। কিন্তু পানির জন্যে হাহাকার দিন দিন বেড়েই চলেছিল। আহিররা এই নিয়ে কোনদিন কিছু ভাবেনি। কিন্তু ভিরার লোকেরা যোগিনী মাতার মন্দিরে আসুক সেটা আহিররা কোনদিন ভালো চোখে দেখেনি। তারা চায়নি যে তাদের উপরে উঠে কেউ গ্রামের ভালো কাজ করুক। সেই কারনে আহিরদের নজর পড়েছিল এই আশ্রমের উপরেও। আশ্রমে লোকজন তখন অনেক, সেবায়েতও অনেক এসেছে। অসুস্থদের দেখাশনা করার জন্যে লোকজনেরও প্রয়োজন ছিল। এইসব লোকজনদের মধ্যে আহিরদের লোকজনও মিশে ছিল। তারা আশ্রমের সব খবরাখবর গোপনে আহিরদের পাচার করতো। আহিররা ফন্দি আঁটত কিভাবে যোগিনী মাতাকে মন্দিরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিজেদের হাতে নেওয়া যায়। 

একদিন যোগিনী মাতার আশ্রমে আবার এক ভিনদেশী ব্যাপারী এসে উঠলো। সারা দুনিয়া ঘুরে এসে সেই বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর নাও এই পশ্চিম উপকূলে এসে বেঁধেছে। কিন্তু ব্যাপারীর শারীরিক অবস্থা খুব দুর্বল, তার বয়সও হয়েছিল অনেক। সে নিজেও বুঝতে পারছিল যে তার জীবনের আর বেশিদিন বাকি নেই। সেই বৃদ্ধ ব্যাপারীর একটা বড় ঝোলা ছিল, সবাই মনে করতো তাতে অনেক সোনার অাশরফি আছে, সোনার আশরফির লোভে অনেক সেবায়েত বৃদ্ধকে খুব যত্ন করতো। একদিন রাতে বৃদ্ধ খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সেই রাতই ছিল তার শেষ রাত। সে নিজের সবচেয়ে মুল্যবান জিনিসটা যোগিনী মাতাকে দিয়ে যেতে চায় এই খবর দিয়ে পাঠাল এক সেবায়েতের মাধ্যমে। যোগিনী মা তার সাথে দেখা করতে এলে সেই ব্যাপারী যোগিনী মাতার কানে গোপনে এক গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যায়। গুপ্তধন আসলে কোথায় ছিল একমাত্র যোগিনী মাতা ছাড়া আর কেউ জানত না। কিন্তু কিছু অসৎ সেবায়েতের মাধ্যমে গুপ্তধনের খবর আহিরদের কানে চলে যায়। আহিররা সুযোগ বুঝে যোগিনী মাতাকে সবার অলক্ষ্যে বন্দী বানিয়ে ফেলে। বন্দী অবস্থায় যোগিনী মাতার উপরে অত্যাচার চালায়, জেনে নিতে চায় গুপ্তধনের ঠিকানা। কিন্তু গুপ্তধনের কোন ঠিকানাই তো যোগিনীমায়ের জানা ছিল না।“

দীপ্যমান আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে- “তাহলে বৃদ্ধ ব্যবসায়ী যোগিনী মাতাকে কি বলে গেছিলো?”

দীপ্যমানের প্রশ্নে মহিলার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো- “ব্যাপারী সারা দুনিয়া ঘুরে যোগিনী মাতার কাছে তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা উপহার হিসেবে দিয়ে গেছিলো। বৃদ্ধ বলেছিল যে সে মারা যাওয়ার পর প্রথম যে পুরনমাসি আসবে সেই রাতে কুটিয়ার পাশে ইমলি গাছের তলায় খুঁড়লে এমন গুপ্তধন পাবে যা কোনদিন খতম হবে না।“ কথাটা বলে মহিলা তার ডান হাতের তর্জনী দিয়ে তেঁতুল গাছের নীচের দিকে তাকাতে নির্দেশ করল। দীপ্যমান সেদিকে তাকিয়ে তেমন কিছুই দেখতে পেল না। মহিলা আবার বলে উঠলেন- “ঠিক সে দেখ পুত্তর, ইমলি গাছের নীচে চাঁদনী রাতে অাশরফি ঝিলমিল করছে।“ 

        

ভোরের আলো ফুটে উঠছিল দূর দিগন্ত রেখায়। সাদা নোনা বালি চিকচিক করে উঠেছে সূর্যালোকের প্রথম ছোঁয়ায়। সকাল শুরু হতেই রণের তাপমাত্রা তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পায়। দীপ্যমানের ঘুমন্ত মুখের উপরে শুকনো পাতার ছোঁয়া লাগতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। চোখ খুলেই ঠাহর করতে পারে না সে এই মুহূর্তে কোথায় আছে। চারদিকে নজর ফিরিয়ে ধাতস্থ হয়। এক এক করে তার মনে পড়ে গত রাত্রের ঘটনা। বোতল হাতে নিয়ে জল ভরতে আসা, মন্দিরের চত্বরের কাছে মহিলার ডাক, তাকে জলপান করানো। তারপর সেই যোগিনী মাতার মন্দিরের গল্প। কিন্তু, তারপর আর কিছু মনে নেই দীপ্যমানের, ওই মহিলাই বা কোথায় গেলেন? আর ইমলি গাছের তলায় কি দেখতে বলেছিলেন ওই মহিলা? গুপ্তধন! সেটাই বা কি? হাজার প্রশ্ন এসে ভিড় করে দীপ্যমানের মাথায়। কথা বলতে বলতে কখন যে সিঁড়ির উপরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পাশে জলের বোতলটাও আছে। কিন্তু ওই মহিলা নেই। বলে তো ছিলেন যে উনি এই মন্দিরেই থাকেন। নিশ্চয়ই এই মন্দিরের সেবায়েত হবেন। এতো সকালে কাউকে সেরকম দেখা যাচ্ছে না যদিও। একজন লোক লম্বা লাঠির ডগায় ঝাঁটা বেঁধে মন্দির ঝাড়ু দিচ্ছেন। ওকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো ওই মহিলার খোঁজ মিলবে। 

দীপ্যমান ঝাড়ুদার লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল- “মন্দিরমে যো বুড়ি অউরত রহেতি হ্যায় ও কাহা মিলেগি আভি?”

-“ইহাপে কৌন্অ বুড়ি অউরত নেহি হ্যায় সাহাব।“

-“কাল যো থি?”

-“বিশ সালসে ইহা ঝাড়ু লাগা রাহা হুঁ সাহাব। ম্যায়নে তো কভি নেহি দেখা।“

দীপ্যমান হাল ছেড়ে দিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। মন্দিরের পুরোহিত তখন সকালের পুজোর যোগাড় সেরে সবে নীচে নামছেন। দীপ্যমানকে দেখে বললেন,- “সুবাহ কি আরতি হোনেওয়ালি হ্যায় সাহাব। পুজা করকে যানা।“ পুরোহিতকে দেখে দীপ্যমান বলল- “আচ্ছা, এই মন্দিরে কোন বৃদ্ধ মহিলা থাকেন? আমি আসলে গত রাতে এখানে জল নিতে এসেছিলাম। উনি আমার সাথে ওই সিঁড়িতে বসে এই মন্দিরের ইতিহাসের গল্প বলছিলেন। কিন্তু গল্পটা শেষ না করেই উনি চলে গেলেন। আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উনি কোথায় বলতে পারবেন?” 

দীপ্যমানের কথা শুনে পুরোহিতের চোখমুখের সকালের যে হাসি ভাবটা ছিল সেটা মিলিয়ে গেলো। পুরোহিত মশাই কি যেন একটু ভাবলেন, তারপর ভুরু কুঁচকে দীপ্যমানকে গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করলেন- “ওই বৃদ্ধা কি গতরাত্রে আপনার কাছে জল খেতে চেয়েছিলেন?”

-“হ্যাঁ”

দীপ্যমানের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ- “কবে যে মাতা মুক্তি পাবে কে জানে?”

-“মানে?”

-“গতরাত্রে আপনি যাকে জল খাইয়েছেন, যার সাথে বসে গল্প করেছেন তিনি আর কেউ নয়, স্বয়ং যোগিনী মাতা।“

দীপ্যমান ঠোঁটের কোনে বিদ্রূপ সূচক তির্যক হাসি এনে বলল,- “আপনি আমার সাথে মজাক্ করছেন পুরোহিত মশাই? কবে কোন শতবছর আগে যোগিনী মাতার একটা কাহিনী, এই যুগে তাকে সত্যি বলে ধরে নিতে হবে। আমি শুধু বাকি গল্পটা শোনার জন্যে ওই মহিলাকে খুঁজছিলাম।“

-“তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না তো? কিন্তু আমি জানি উনি তোমাকে কি গল্প বলেছেন। সেই ব্যবসায়ীর নৌকো এই উপকূলে হারিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর গুপ্তধনের খবর চাউর হয়ে যাওয়া, এমনকি আহিররা যোগিনী মাতাকে বন্দী করে অত্যাচার করা। আমি সব জানি।“

-“সে আপনি জানতেই পারেন, এই মন্দিরের পুরোহিত আপনি। তাছাড়া এই মন্দিরের ইতিহাস লোকের মুখে মুখে প্রচার হয়ে গেছে ঠিক। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।“

-“বিশ্বাস অবিশ্বাস তোমার উপরে নির্ভর করছে। আমার হাতে কিছু নেই। তবে গল্পের শেষটুকু যদি শুনতে চাও তাহলে আমি বলতে পারি।“

-“বলুন।“

-“সেদিন আহিররা অনেক অত্যাচার করেও যোগিনী মাতার কাছে গুপ্তধনের খবর পায়নি। যোগিনী মাতাকে দীর্ঘ ন’দিন আহিরদের বন্দিনী হয়ে থাকতে হয়। আহিররা যোগিনী মাতাকে এই ন’দিন জল পর্যন্ত দেয়নি। কিন্তু কোন এক দিব্যশক্তিতে এই নটা দিন যোগিনী মাতা বিনা জলেই বেঁচে ছিলেন। নয়দিন পর ছিল সেই প্রথম পূর্ণিমা, কোনভাবে যোগিনী মাতা বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে এসে ওই তেঁতুল গাছটার নীচে খুঁড়তে শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণ মাটি খোঁড়ার পরে মাটির তলা থেকে সিন্ধুমা দেখা দেন। এই সিন্ধু নদের একটা অংশ কচ্ছের মাটির তলা দিয়ে বয়ে চলেছে। কোন জায়গায় খুঁড়লে সিন্ধু মায়ের সন্ধান পাওয়া যাবে সেই অফুরন্ত গুপ্তধনের খবরই ওই বৃদ্ধ ব্যবসায়ী সেদিন যোগিনী মাতাকে বলে গেছিলেন। আসলে ওই বৃদ্ধ নিজেও একজন তান্ত্রিক ছিলেন। সিন্ধু মা দেখা দেওয়ার পরে যোগিনী মাকে আর কোথাও দেখা যায়নি কোনদিন। ওই যে জলাশয় দেখছ, ওটাই যোগিনী মায়ের জলসত্র। যতোই খরা আসুক, বৃষ্টি না হোক এই জলসত্রের জল কোনদিন শুকাবে না, ওটা মাটির নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া সিন্ধু নদের জল। যে যোগিনী মাতার জন্যে আজকে রণের মানুষেরা জলের অভাব কি বুঝতে পারছে না সেই যোগিনী মা ন'টা দিন জল ছাড়া কষ্ট করে গেছেন। এখনও রাত বিরেতে এই মন্দিরে কাউকে জল নিয়ে যেতে দেখলে দাঁড় করিয়ে জলপান করেন। কিন্তু ওই জলসত্রে কখনও উনি জলপান করেন নি।“

পুরোহিতের কথাগুলো দীপ্যমান গম্ভীর মুখে শুনে নিয়ে বলল,- “বুঝলাম। আপনি কি আমাকে এও বিশ্বাস করতে বলেন যে ওই তেঁতুল গাছটাও ঐখানে এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে?”

-“আরে না না বাবু। এই মন্দির, হাসপাতাল, ওই বাঁধানো জলাধার, আশ্রমের ঘর বাড়ি, মন্দির প্রাঙ্গন সব তো পরে হয়েছে। আহিররাই করেছে বংশ পরম্পরায়। ওরাই এখন এই মন্দিরের ট্রাস্টির মাথা। আর ওই তেঁতুল গাছ তো ওখানে পরে আরও লাগানো হয়েছে। এই রণের মাটিতে এই গাছ অনেক ছায়া দেয় বাবু। এই মন্দিরে যারা আসে এখনও তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হলে মন্দিরকে লাল নীল সবুজ হলুদে রঙ্গিন করে দিয়ে যায়। মাতার জলের পাত্রে জল ঢেলে মনকামনা বলে যায় মাকে। আর এই মন্দির তো যোগিনী মায়ের মন্দির। যান উপরে গিয়ে দর্শন সেরে আসুন। আমি এই যোগাড় সেরে নিয়ে বসব পুজোতে।“

পুরোহিত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে চলে গেলো। দীপ্যমান আর কথা বাড়াতে চাইছিল না। সকাল সকাল এক আজগুবি গল্প শুনে মাথাটাই খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। তাঁবুতে ফিরতে হবে, হলধর বাবু না জানি কখন থেকে খুঁজছেন তাকে, জানিয়েও আসা হয়নি। মন্দিরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ফিরতে মন চাইল না দীপ্যমানের। একবার দর্শন সেরে গেলেই হয়। এতক্ষনে দু একজন দর্শনার্থীর ভিড় হয়েছে মন্দিরে। এক এক করে বাকি সিঁড়ি গুলো ভেঙ্গে উপরে উঠে এলো দীপ্যমান। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি রং করা মন্দির। মাথার উপরে সশব্দে ঘণ্টা বাজিয়ে মাটিতে প্রনাম করে ভেতরে ঢুকল দীপ্যমান। সামনে পদ্মাসনে বসা এক যোগিনীর মূর্তি। যোগিনীর হাতে একটি জলাধার রাখা আছে, তাতে জল ঢেলে দিচ্ছে কেউ কেউ। জলাধার ধরে থাকা হাতের দিকে তাকিয়ে দীপ্যমান চমকে উঠলো- মূর্তির ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি নেই। গত রাত্রে যে মহিলাকে দীপ্যমান জলপান করিয়েছিল তারও ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ছিল না। এমনকি পদ্মাসনে বসা যোগিনীমাতার মূর্তির সাথে হুবহু মিলে যায় গতরাত্রে দেখা মহিলার মুখ। (সমাপ্ত)


Rate this content
Log in