চিঠি
চিঠি
সেদিন সকালে ঠিক যেমন ভাবা হয়নি, তেমনই কিছু ঘটে গেল। হঠাৎ হাতে এল এক পুরনো চিরকুট। প্রথমে ভাবলাম, হয়তো কোনো জিনিসপত্র ফেলে গিয়েছিলাম, কিন্তু খোলার পর মনে হলো যেন সময় নিজেই থেমে গেছে। চিরকুটটি ছোট, সাধারণ খাতার কাগজে লেখা, কিন্তু তাতে যে শক্তি ছিল, তা অল্প কয়েক লাইনেই আমার হৃদয় কেঁপে উঠল।
চিরকুটে শুধু তার নাম লেখা—আমার প্রিয়জনের নাম। একটি ছোট গোলাপ আঁকা, গোলাপের কোণে লেখা ছিল “র-ফলাবিহীন প্রিয়।” সেই মুহূর্তে মনে হলো, বহু বছর ধরে হারানো একটা স্মৃতি হঠাৎ চোখের সামনে হাজির হয়েছে।
আমি চেয়েছিলাম চিরকুটটি যত্নসহকারে হাতে রাখব। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল—কীভাবে আমরা ছোটবেলায় চিঠি লিখতাম, একে অপরের প্রতি আমাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে। প্রতিটি চিঠি ছিল যেন এক রহস্যময় বিশ্ব। আমি তখন কতটা নির্ভয়ে তাকে চিঠি লিখতাম, আর সে কীভাবে প্রতিবার আমার চিঠি হাতে পেত, তা ভাবলে এখনো হৃদয় গা ঝাঁপিয়ে ওঠে।
সেই চিরকুটটা হাতে নিয়ে আমি বসলাম বারান্দায়। বাতাসে ভেসে আসছে প্রিয় দিনের স্মৃতি। মনে পড়ল, প্রথম খামটা পাওয়ার দিনটা। সেই ছোটখাটো খামে ছিল শুধু তার নাম। কিন্তু সেই নামের মধ্যেই লুকানো ছিল তার সমস্ত অনুভূতি। আমি তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি—সে নামটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে নরম ছোঁয়া।
চিরকুটের লাইনগুলো পড়তে পড়তে হঠাৎ আমার চোখ ভিজে এল। মনে পড়ল, আমরা একসাথে কাটিয়েছি কতটা সুন্দর সময়। স্কুলের উঠোন, গ্রীষ্মের বিকেল, অচেনা নদীর ধারে বসে হাত ধরে কথা বলা। আমরা কত স্বপ্ন দেখেছি, কত স্বপ্ন একে অপরের হাতে ধরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু জীবন আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সময় গেছে, বহু বছর কেটে গেছে।
কিন্তু এই ছোট চিরকুটে সব স্মৃতি ফিরে এসেছে। হঠাৎ মনে হলো, সে আজও কোনো না কোনোভাবে আমার সঙ্গে আছে। মনে হলো, যদি এই চিরকুটটি না পেতাম, হয়তো এতদিন পরে এই স্মৃতির গভীরতা অনুভব করতে পারতাম না।
আমি চিরকুটটি ধরে বসলাম। মনে পড়ল, আমরা ছোটবেলায় একে অপরকে চিঠি লিখতাম, ছোট ছোট শব্দে অনুভূতি ব্যক্ত করতাম। আমি আজও মনে করতে পারি, কত উত্তেজনা আর নার্ভাসনেস ছিল চিঠি পাঠানোর আগে। আর সেই উত্তেজনা আজও চিরকুটে ফিরে এসেছে।
বয়স যত বাড়ছে, অনুভূতির প্রকাশ তত কমে যায়। কিন্তু এই চিরকুট আমাকে মনে করিয়ে দিল—প্রকৃত ভালোবাসা সময়ের সীমারেখা মানে না। আমরা হয়তো একে অপরের কাছে নেই, কিন্তু এই স্মৃতি, এই ছোট চিরকুট আমাদের মনের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
আমি চিরকুটটি ধীরে ধীরে খুলে পড়ি। প্রতিটি লাইন মনে হলো, হঠাৎ আবার সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ রেখে, শুধু হাসছে। সে হাসি, সেই মৃদু হাসি, যেটা বহু বছর ধরে আমার হৃদয়ে ছিল। মনে হলো, সময় ভাঙা হলেও, ভালোবাসা কখনো ভাঙে না।
চিরকুটের সেই গোলাপটি আজও মনে রেখেছি। ছোট্ট সেই অঙ্কন, যা কেবল তার হৃদয়ের প্রতিফলন। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি কোণ যেন বলছে—“আমি এখানে আছি, তোমার সঙ্গে।” আমি বুঝতে পারি, জীবন যতই ব্যস্ত হোক, মানুষ যতই বদলাক, কিছু অনুভূতি চিরকাল অক্ষুণ্ণ থাকে।
সে দিন দুপুর পর্যন্ত আমি বসে থাকলাম। বারান্দার বাতাসে মিশে গেছে নস্টালজিয়ার সুর। মনে হলো, সবকিছু ঠিক যেমন ছিল—আমরা, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের চিঠি আর ছোট ছোট অনুভূতি। এই চিরকুট একটিমাত্র বার্তা, যা সময়ের ব্যবধান অতিক্রম করে আমার হাতে এসেছে।
আমি চিরকুটটি আবার খাতার মধ্যে রেখেছি। মনে হলো, এটি শুধু একটি জিনিস নয়—এটি একটি স্মৃতি, একটি অনুভূতি, যা আজও আমাকে শিহরিত করতে পারে। হয়তো একদিন আমি তাকে দেখাবো, হয়তো নয়। কিন্তু এই মুহূর্ত, এই অনুভূতি, আজও আমার হৃদয়কে উজ্জীবিত করছে।
চিরকুটের সেই সহজ খাতার কাগজ, ছোট্ট লেখা, এক গোলাপ—সবকিছু একসাথে মিলিয়ে আমাকে শেখালো, ভালোবাসা কখনো হারায় না। তা হয়তো চুপচাপ, কিন্তু সব সময় বেঁচে থাকে। আর আমি, সেই অনুভূতিগুলোকে কষ্টের মধ্যে বা সময়ের মধ্যে হারাইনি—বরং আজও তা আমার হৃদয়ে জীবন্ত।
সেই দিন শেষ হওয়ার আগে আমি চিরকুটটি হাতে নিয়ে একটিমাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছি—এই ছোট্ট স্মৃতিটা কখনো হারাব না। এটিই আমার অতীত, আমার ভালোবাসা, আর আমার হৃদয়ের এক বিশেষ কোণ। আর হয়তো, একদিন, সময়ের কোনো মোড়ে, আমরা আবার সেই চিরকুটের মতো মিলিত হবো—যেন হারানো দিনের গান ফিরে এসেছে।

