বন্ধুত্বের অভিযোজন
বন্ধুত্বের অভিযোজন


ছোটবেলায় যখন হাফ প্যান্ট পরে, বিকেল বেলায় ফুটবল খেলতে বেরোতাম তখন ভাবতাম এটাই বোধয় জীবনের মোক্ষম সময় | ব্যাগ পিঠে, সাইকেল চড়া কিছু টিউশনের গল্প, আর সাথে ছিল, বৃষ্টি ভেজা কৈশোর ! কাদা মাঠে লুটোপুটি খেয়ে যখন নিজেদের রোনাল্ডো, বাতিস্তুতা মনে হতো, তখন ই কোনোভাবে এক আকুল হৃদয় বলে উঠতো -
বৃষ্টি ভিজে কাদা মাঠের ফুটবলীয় বিকেল,
ছড়িয়েছিলো খেয়াল খুশির ডানা
কাদায় মেখে পুকুরে স্নান করা
আর ফিরে এসে মায়ের বকাঝকা !
সেই সময় ও পেরিয়েছে | স্কুল ছাড়ার সময়, কান্না ও পেয়েছে | কিন্তু কলেজ এ ঢুকে আবার অন্য জীবন পেলাম | বাড়ির থেকে বেরিয়ে একটু স্বাধীনতা, একটু হৈ হুল্লোড় এই সব নিয়েই ৪ টা বছর কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল | কলেজ ছাড়তে মন চায়নি কিছুতেই !! আবার ও কান্না পেলো আগের মত | ভাবলাম আবার সব হারালাম ! একটা মেসঘর, একটা ক্লাস রুম, প্রদীপ দার দোকান, কিছু বন্ধু, একটা বেস্ট ফ্রেন্ড - আরো কতো কি !
কিন্তু বাস্তব জীবন তো অন্য | কেউ যায় আবার কেউ আসে | কেউ আবার ঘুরে ফিরে আসে | চাকরি জীবন ও যে এত মধুর হতে পারে, তা আমাদের 'Chalo lets go' না হলে বুজতেই পারতাম না | ৭ বছর আগে কিছু বন্ধু মিলে শুরু করেছিলাম এক ঘুরতে যাওয়ার গ্রুপ - চলো লেটস গো | স্কুল এর যে ছেলেটার সাথে একটু আধটু কথা হয়েছে সে আজ একান্ত আপন | আবার ঠিক সেই সত্যি টুকু খাটে কলেজ এর কিছু বন্ধুর উপর ও | একের পর এক ট্রিপ চলেছে পরপর | পনেরো জনের ট্রিপ, আজ ছোটো হয়ে ৩ জনে নেমেছে | সবাই যে যার 'বাস্তব' এবং 'কঠিন' জীবনে ব্যস্ত | তবুও এই 'বর্ষা কালে' শুরু হলো এই '৩ ইডিয়টস' এর ট্রিপ |
পরশু সকালবেলা যখন হয়তো কেউ তাড়া দেবেনা বেরোনোর জন্য, 'তখন হয়তো কাউকে মিস করবো' | যখন বলতে পারবো না, 'আর কতো ছবি তুলবি, তাড়াতাড়ি এদিকে এসে আমাদের ছবি তুলে দিয়ে যা' - 'তখন হয়তো কাউকে মিস করবো' | যখন সন্ধ্যে বেলায় গান সোনার ইচ্ছে হবে, 'তখন হয়তো কাউকে মিস করবো' | যখন রাত্রে বেলায় ভুতের গল্প শুনতে ইচ্ছে করবে, 'তখন হয়তো কাউকে মিস করবো' | তবে যাই হোক, ডাক্তার হাজরার মতো 'ভ্যানিশ' হয়ে যাস না | এই মুকুল এখনো এটাকে 'ম্যাজিক' ভাবে | হয়তো সাময়িক কিছু খরা | ম্যাজিক শেষে আবার হয়তো ট্রিপ হবে | এবার আরও বড় করে | ঠিক আগের মতো !
মন খারাপের খরা কাটত কিনা সন্দেহ । তবে আমার বন্ধু বাড়ি থেকে মুরগির কষা মাংস নিয়ে আসায় দুঃখ খানিক ঘুচল বৈকি ! অবাক হওয়ার কিছুই নেই। বাঙালি মাত্রই পেটুক, আর বাঙালির দুঃখ যে শুধুই কষা মাংস, ইলিশ বা মিষ্টি দই এ এসে, নিশ্চিদ্র আনন্দ তে পরিপূর্ণ হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
পরদিন সকাল হলো । রাজগির, বোধগয়া আর নালন্দা - এই হলো আমাদের প্ল্যান । তিন দিনের ট্রিপ এ হাজারো অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়েছে । ভাগ্যস্রি প্রসন্ন হলে, এই গল্পো উপন্যাস এ গিয়ে ও আটকাতে পারে । ভাগ্যের পরিহাসে চাকরি সূত্রে বাধা । তাই সময়ের অভাবে একটা ঘটনার মধ্যেই শেষ করতে হবে আজকের দিন ।
হোটেল থেকে একটু ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়ি রাজগির এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বর্ষাকালে ছোটো পাহাড় দেখার একটা আলাদাই মজা । গড়পঞ্চকোট ঘুরতে গিয়েই সেটা বুঝতে পারি । পাহাড়ের আড়ালে মেঘের সাদা আভা যখন ঘোরাফেরা করে, তখন ছোটো পাহাড়ের মাধুর্য আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পায় ।
রাজগির জায়গাটা ছোটো ছোট পাঁচটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ভৈরভা হিল, বিপুলা হিল, রত্ন হিল, স্বর্ণ হিল আর উদয়া হিল - এই পাঁচ পাহাড় দিয়েই ঘেরা রজগির জায়গা টা । হোটেলের ব্যালকনি থেকে পাহাড়ের মধ্যের মেঘ গুলো বেশ স্পষ্ট । পরিব্রাজক হিইয়েন সাং এর কথা অনুযায়ী বিম্বিসার, রাজগির জায়গার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ।
এখানের আশপাশের জায়গা ঘোরার জন্যে ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা হলো বেস্ট । টাঙ্গা তে ওঠার সময় ভালই বৃষ্টি পড়ছিল। হালকা বৃষ্টি তে ভিজতে ভিজতে টাঙ্গায় কিছু পুরনো বছরের গল্পো আর পাহাড়ের মাঝে মেঘের আনাগোনা - এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে । বর্ষাকাল ছাড়া এই অভিজ্ঞতা কখনও সম্ভব না । কিষান টাঙ্গা তে চড়ে প্রথমেই গেলাম বিম্বিসার কারাগার। কিষান জির কাছে শুনতে পেলাম, প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখান থেকেই ৪০ কেজি ওজনের এক লোহার বেড়ি খুঁজে পায় । আরো অনেক সূত্র ধরে প্রত্নতত্ত্ববিদ দের অনুমান অজাতশত্রু তার বাবা বিম্বিসার কে এখানেই কারাগারে বন্দী করে রাখেন । দেখার মত কিছুই নেই এখানে, শুধু ইতিহাসের বইয়ের পাতার গন্ধ উপলব্ধি করাটাই আসল উদ্যেশ্য।
ইতিহাসের পাতা ঘাটতে ঘাটতে আর ঘোড়ার পায়ের আওয়াজে হারাতে হারাতে আমরা পৌঁছলাম বিশ্ব শান্তি স্তূপ এর কাছে । আজ এইটুকুই থাক । মা আবার খেতে ডাকছে ওদিকে । না গেলে কেলেঙ্কারি হবে । পালাই আজ !