Poushali Ghosh

Children Stories Fantasy Others

4  

Poushali Ghosh

Children Stories Fantasy Others

তিন্নির দুর্গাপুজো

তিন্নির দুর্গাপুজো

5 mins
249


শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের আনাগোনা, বাড়ির উঠোনে শিউলি গাছের নিচটা ফুলের চাদরে ঢেকে গেছে।ছোট্ট তিন্নি এই সময়ে রোজ ঠাকুমার সাথে শিউলি ফুল তুলে সাজি ভর্তি করে। তারপর ঠাকুমা যখন ঠাকুরঘরে বসে মালা তৈরি করে দেয় তখন তিন্নি একটা একটা করে ফুল এগিয়ে দেয় ঠাকুমার হাতে। কী সুন্দর দেখতে ফুলটা। সাদা কমলায় কী অপূর্ব মেলবন্ধন। আবার জবা ফুলগুলো কি টকটকে লাল। সবুজ গাছে লাল ফুল যেন একে অপরের পরিপূরক। 


--" ঠাম্মি এই ফুলগুলো কে তৈরী করেছে ? একেকটা ফুল একেক রকম দেখতে। কে ভরে ফুলগুলোতে রঙ?" 

ছোট্ট তিন্নির সরল প্রশ্নে হেসে ফেলেন ঠাম্মি। সিংহাসনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন -

--" ঐ যে বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি তিনিই সৃষ্টিকর্তা। উনিই তো করেন যা কিছু করার।"


--" আর মা দুর্গা।" 


--" তিনি করেন দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন।" 


তিন্নির মাথায় কিছু ঢোকে কিছু ঢোকেনা। সে শুধু বোঝে আর কদিন বাদেই দুর্গাপুজো। স্কুলে ছুটি পড়ে যাবে। বাড়িতে যে দিদি পড়াতে আসে সেও ছুটি নেবে।বাড়িতে এক এক করে পিসিমনি, দাদুন, বড় মাসিমনি আসবে আর সাথে করে নিয়ে আসবে তিন্নির জন্য নতুন জামা। শুধু কী তারা বাড়িতে যারা আছেন, মানে তিন্নির দুই জেঠু আর ছোটকা তারাও তো তিন্নিকে জামা কিনে দেন, দেন ঠাকুমাও। নয় নয় করে অনেক কটা জামা হয় তিন্নির। তিন্নি তো নতুন জামা পরে পঞ্চমীর দিন স্কুলেও যায়। ঐদিন ওদের স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ে।এরপর বাড়ির সামনে মাঠে যেখানে পুজো মণ্ডপ তৈরি শুরু হয়েছে বাঁশের খাঁচা গড়ে সেখানে পূর্ণ মণ্ডপে কদিন বাদেই ঠাকুর আসবে। যখন ঠাকুর আসে দুই জেঠিমার সাথে মা'ও যায় শাঁখ হাতে নিয়ে। শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে মঞ্চে তোলা হয় ঠাকুর প্রতিমা। তিন্নি এবেলা ওবেলা নতুন জামা পরে বন্ধুদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে। মণ্ডপের চারিদিকে কত দোকানের মেলা বসে। রঙিন চুড়ি,মাথার ক্লিপ, আইসক্রিম, ফুচকা, পাপড়ি চাট আরও কত কিছু। তিন্নিকে আইসক্রিম খেতে তখন কেউ বারণ করে না। নাগরদোলাও তো থাকে। সবাই কেমন চিৎকার করতে করতে বন বন করে ওপর নিচে ঘুরতে থাকে। তিন্নি হাঁ করে দ্যাখে। নিজে চড়তে ভয় পায়। ওর দুই জ্যাঠতুতো দিদি বিন্নি আর মুন্নি চড়ে অবশ্য আর বড় জেঠুর ছেলে বুকান দাদা মণ্ডপে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে বুকে একটা ব্যাচ লাগিয়ে একটা দড়ির একপ্রান্ত টানটান করে ধরে যারা ঠাকুর দেখতে আসে তাদের অল্প করে করে ভেতরে ঢোকায় আর হাতের আঙুলগুলো মাঝে মাঝে চুলের ভেতর চালান করে। বিন্নি দিদি বলে ওটা নাকি লোকদেখানো স্টাইল।

 সে যাই হোক তিন্নির এখন মনে একটাই চিন্তা এবারে ওর জামাগুলো কোনটা কেমন হবে। ঐ পাশের বাড়ির পিঙ্কির থেকে বেশি ভালো নাকি কম। আগের বছর পিঙ্কি একটা গোলাপি রঙের ঘেরওয়ালা পরীদের মতো জামা পরেছিল। সেটা দেখে তিন্নি মায়ের কাছে এসে গাল ফুলিয়ে অভিযোগ করেছিল --" আমাকে পিঙ্কির মতো জামা কেন কিনে দিলেনা। দোকানে ওরকম জামা ছিলনা বুঝি।"


--" কেন রে তোর জামাটাও তো কতো সুন্দর। কেমন লাল রঙের সিল্কের কাপড়ে লেস লাগানো।বেশ তো লাগছে দেখতে তোকে। আচ্ছা ঠিক আছে পরের বার ঐরকম জামা কিনে দেব কেমন?" তিন্নির মা আশ্বাস দেন । 


--" না ওরকম না। ওরকম কিনলে পিঙ্কির মনে হবে আমি ওকে নকল করছি। তুমি আমাকে এমন জামা কিনে দেবে যেটা ওর নেই।" 


-'" ওমা ওর কেমন জামা নেই আমি বুঝবো কেমন করে । তাছাড়া প্রত্যেক জামাই তো সুন্দর। তোমারটা আলাদা সুন্দর ওরটাও আলাদা সুন্দর। ওর জামা দেখে যেমন তোমার ভালো লেগেছে তেমন তোমারটা দেখে ওরও তো ভালো লাগতে পারে। যে যেমনটা পায় তাকে তেমনটা নিয়েই খুশি থাকতে হয় মা। তাছাড়া কতো মানুষ আছে বলো তো যাদের পুজোতে জামাই হয় না।" 

এই কথাটা শুনে তিন্নির বুকে কেমন চিনচিন করে। ওর তখন ঝুমার কথা মনে পড়েছিল। ওর তো মোটে দুটো জামা হয় পুজোতে। তবুও কত খুশি হয় ও। তবে তিন্নিদের বাড়ি থেকে অনেক গরীব বাচ্চাদের জন্যও জামা কেনা হয় সেটাও তো তিন্নি দেখেছে তাই মনে একটু শান্তিও পেয়েছে। মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে তিন্নির তবুও শিশু মনে জামা নিয়ে প্রতিযোগীতার মনোভাব সহজে কাটে না।


--" তিন্নি এই তিন্নি তাড়াতাড়ি আয় স্কুলে যেতে হবে তো।" 

মায়ের কাছ থেকে ডাক আসে। শুনে ঠাকুমার কাছ থেকেও তাড়া খায় তিন্নি

--" যাও যাও দিদিভাই শিগগিরই যাও নইলে ওদিকে স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে। আর তো কটা দিন তারপর তো ছুটি পড়ে যাবে। তখন অনেক্ষণ বসে থেকো আমার কাছে।


বাড়ির অনতিদূরে আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ে তিন্নি। স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে ঢুকতেই নিচের তলার ঘর থেকে গানের সুর ভেসে আসে। তিন্নি দৌড়ে গিয়ে উঁকি মারে। বিন্নি দিদি মুন্নি দিদি পুজোর ফাংশনের জন্য নাচের মহড়া দিচ্ছে। সাথে পাড়ার অনেক মেয়েরাও আছে। পাশের বাড়ির মৌদিদি গান গাইছে আর তিন্নির ছোটকা তবলা বাজাচ্ছে। এমন দৃশ্য প্রতি বছরই তিন্নি দেখে পুজোর মাসখানেক আগে থেকে। আগের বারেও তো এমন অনুষ্ঠানে নেচেছিল তিন্নির দুই দিদি। দেখে তিন্নিরও শখ হয়েছিল অমন সুন্দর করে সেজে নাচতে কিন্তু ওকে তো নেয় না। তিন্নি ছুটে গিয়ে মায়ের কাছে আবদার করে 

--" ও মা আমাকে নাচ শেখাবে? বিন্নি মুন্নি দিদির মতো আমারও ইচ্ছে করে যে নাচ করতে। ওরা তো নেয় না তুমি শেখাও।"


--" আমি যে নাচ করতে পারি না মা। তবে তুই চাইলে তোকে কবিতা পাঠ শেখাতে পারি। শিখবি?"


--" কবিতা ? কোন কবিতা ? আমি শিখে বলতে পারব তো?"


--" কেন পারবি না। মন দিয়ে শিখলে সব পাড়া যায়।"


এরপর থেকে তিন্নির রোজকার কাজ হল সকাল বিকাল একবার করে মায়ের শিখিয়ে দেওয়া কবিতা আবৃত্তি করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে শোনানো।


"নমস্কার,  

 কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'প্রশ্ন'


''মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্‌,


    সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।


এখন আমি তোমার ঘরে বসে


    করব শুধু পড়া-পড়া খেলা।......'"


রাতে ঘুমতে যাবার আগেও একবার ঝালিয়ে নেওয়া চাই মায়ের কাছে 


''মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্‌,


    সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা .....''


 মা বলেন --" বাঃ এই তো বেশ ভালোই হচ্ছে। স্টেজে উঠে এমনি করেই বলবি। কিন্তু হল আর কৈ। যথারীতি পঞ্চমীর সন্ধ্যেবেলা মণ্ডপের সামনে মঞ্চে উঠে দর্শকাসনে একরাশ মানুষ দেখে কী যে হল তান্নির চার লাইনের পর কিছুতেই বাকিটা মনে পড়ল না। ছোটকা পর্দার আড়াল থেকে কতবার মনে করানোর চেষ্টা করল কিন্তু তিন্নি ততক্ষণে ঘাবড়ে গিয়ে সেদিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকল। বাড়ি ফিরে তার কী মন খারাপ। মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ লাল হয়ে গেছে।কী ভাবল সবাই কী মনে করল পিঙ্কি। তিন্নি কিচ্ছু পারেনা। নিশ্চয়ই ছুটির পর স্কুলে গিয়ে সবাইকে বলে দেবে। এদিকে তিন্নির বাবা শুধু একবার বলেছে কি বলেনি --"এতবার করে শিখলি তাও পারলি না? ভুলে গেলি?" মুখ টিপে হেসে ফেলল মুন্নি দিদি। তখনই পরিত্রাতা হয়ে এলেন বড় জেঠিমা-

--" এই কেউ ওকে কিছু বলবি না,হাসবিও না। তোরা কেউ ওর বয়সে স্টেজে উঠেছিলিস? পাশের বাড়ির পিঙ্কিও তো মায়ের কোলে বসেছিল ওতো তবুও চেষ্টা করেছে, মঞ্চে উঠে চার লাইন হলেও বলেছে আর সেই জন্য আমি ওর জন্য ক্ষীর তৈরি করে এনেছি। তোদের কাউকে দেব না।" তারপর ক্ষীরের বাটিটা তিন্নির মা'র দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন --" নে তো ছোট খাইয়ে দে তো ওকে। দেখুক সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।" তিন্নির মা ওর মাথায় স্নেহের চুমু এঁকে দিয়ে বললেন --" এবার হয়নি তো কী হয়েছে সামনের বছর নিশ্চয়ই হবে" তারপর তিন্নির মুখে এক চামচ ক্ষীর দিতেই ওর মনে জমে থাকা মেঘ এক নিমেষে ছু মন্তর হয়ে শরতের আকাশের মতো নির্মল আলোকজ্জ্বল হয়ে উঠল। কাল ষষ্ঠী মায়ের বোধন হবে এখন কী আর মন খারাপ করার সময়।


Rate this content
Log in