STORYMIRROR

সারোওয়ারে জুলফিকার

Others

4.5  

সারোওয়ারে জুলফিকার

Others

প্রতিশোধ

প্রতিশোধ

5 mins
273


তখন চলছিল সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। আমরা গভীর রাত পর্যন্ত পড়তাম। পরীক্ষা মানেই প্রচুর পড়া, পড়া মানেই মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ। সেই চাপ কাটাতে রাতে আমাদের চায়ের নেশা পেয়ে বসল। কিন্তু সমস্যা হল বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে ভুতের ভয়ে গভীর রাতের বেলা কেউ বের হয়না। যদিও আমরা কোনদিন ভৌতিক কিছু দেখিনি। বেশি সাহস করে যারা বেরিয়েছে তারা নাকি অনেক খারাপ কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। আমরা তিন জন বন্ধু সেদিন রাতে সাহস করে বেরিয়ে চা খেয়ে ফিরছিলাম। তখন ছিলাম ক্যাম্পাসের মুল ফটকের অদূরে। তিন জনই গল্প করতে করতে হাটছিলাম। জাফর হঠাৎ করেই দেখলাম রাস্তার উল্টো দিকে বাপাশের ঝোপের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। আমি বললাম, কিরে কোন সমস্যা? জাফর মুখ কালো করে বলল, বন্ধু আমাদের এখান থেকে যেতে হবে। ঝামেলা আছে। আমি ওর গায়ে হাত রেখে বললাম, কিরে কিসের ঝামেলা? জাফরের গায়ে হাত দিয়ে টের পেলাম ওর সারা শরীর কাপছে। ওর দেখাদেখি আমিও রাস্তার উল্টো দিকে তাকালাম। বেশ অন্ধকার জায়গাটা। তারপরও আবছা যতটুকু মনে হলো একটা সাদা কাপড় পরিহিতা মেয়ের মত কিছু একটা দাড়িয়ে আছে। গা শিউরে উঠলো। তাড়াতাড়ি মোবাইলের ফ্লাস জালিয়ে ওদিকে ধরলাম। না, কিচ্ছু নেই। কিন্তু আলো নেভাতেই সেই আবার একই দৃশ্য। মেয়েটি ঠিক যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। আমি আর নিল দ্রুত জাফরকে নিয়ে ক্যাম্পাসের গেটের দিকে হাটা দিলাম। গেটে পৌছতেই দেখলাম আলীম ভাই চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। পাশের বেঞ্চে বসে আমরা তিন জন পানি খেয়ে স্বাভাবিক হলাম। তারপর ওনার কাছে সবার ভুতের ভয়ের কারনটা জানতে চাইতেই প্রথমে না জানার ভান করলেন তারপর চাপাচাপিতে আর সিগেরেটের একটা প্যাকেট দিতেই উনি নিজেই ঘটনাটা বললেন।

.

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পাহাড়ায় থাকা আলীম ভাইয়ের সপ্তাহের রাত কাটত বেশ ভয়ে। যদিও ধীরে ধীরে তার ব্যাপারটা তার অভ্যাসে পরিনত হচ্ছিল। প্রত্যেক বৃহষ্পতিবার রাত ঠিক একটা'য় ঘটনাটা ঘটে। প্রথম দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গেটের পাশে চেয়ারে বসে রোজকারের মত ঝিমুচ্ছিলেন আলীম ভাই। কুকুরগুলোও আজ যেন একটু বেশি ডাকছিল। হঠাৎ কোথাথেকে যেন একটা কান্নার শব্দে তার ঝিমুনিটা কেটে যায়। ভয়ে শিরশিরিয়ে ওঠে তার শরীর। গেটের ডান পাশেই অডিটরিয়াম। সম্ভবত শব্দটা অডিটরিয়ামের পেছন থেকে আসছে। সাহস করে টর্চ আর লাঠিটা হাতে নিয়ে হাটতে হাটতে অডিটরিয়ামের পেছনে গেলেন। বলে রাখা ভাল অডিটরিয়ামের পেছনে সামন্য একটু ফাকা জায়গা তারপর উচু প্রাচির। পেছনে যেতেই তিনি দেখতে পেলেন সাদা পোশাকে আবৃত একটা মেয়ে একটা গাছের পাশে বসে কাদছে। মেয়েটার চুলগুলো সামনের দিকে ছড়িয়ে দেওয়া। আলীম ভাই সাহস করে বললেন কে ওখানে। আচমকাই মেয়েটার চুলগুলো সরে যায়। মেয়েটাকে আলীম ভাই চেনেন। তিন্নি। বছরখানেক আগে মেয়েদের হোস্টেলের পেছনে একটা গাছে দড়ি দিয়ে ফাস লাগিয়ে আত্নহত্যা করে। আজ তিন্নির গলায় দড়ির দাগটা বেশ গাড় দেখাচ্ছে, চোখে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। মেয়েটা মুখ তুলে একটা কথাই বলল। "আলীম ভাই, আমার অনেক কষ্ট "। এর বেশি আর আলীম ভাইয়ের মনে নেই কারন তার আগেই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। এরপর বিষয়টা নিয়ে ভিসি স্যারের অফিস পর্যন্ত গড়িয়েছে। এরপর বেশ ক'দিন আলীম ভাইয়ের সাথে ডিউটিতে আরও একজন ছিলেন। প্রায় এক বছর কোন সমস্যা হয় নি। কিন্তু আলীম ভাইয়ের মাঝেই মাঝেই মনে হত তিন্নির বোধহয় কিছু একটা বলার ছিল। 

.

তিন্নির ঘটনাটা আলীম ভাইয়ের আজও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। তখন তিন্নি নতুন ছাত্রী। মাস খানেকের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলের সাথে প্রেম হয়। মাঝে মাঝেই হল ছেড়ে ছেলেটের সাথে রাত কাটাত তিন্নি। একদিন আলীম ভাই মেয়েটাকে সাবধান করতে চাইলেন। কারন ছেলেটার বাবা ছিল বেশ প্রভাবশালী আর সেই সুযোগের ব্যাবহার করে যাচ্ছে ছেলেটা। আর তিন্নি ছেলেটার জীবনে প্রথম নয়, ছিল আরও অনেকে। কথাগুলো যেন তিন্নি গায়ে লেগে গেল। অন্যের ব্যাপারে নাকগলানোর অপরাধে সেদিন বুড়ো বয়েসে তিন্নির চড় খেয়েছিলেন আলীম ভাই। এরপর থেকে আর কোনদিন কাউকে আটকান নি। প্রায় আরও কয় মাস পর তিন্নি গভির রাতে আলিম ভাইয়ের সাথে দেখা করে। সেদিন তার চোখে পানি ছিল। 

_আলীম ভাই সেদিনের ঘটনার জন্যে আমি আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছি

_কি হয়েছে মা? তুমি কাদছ কেন?

_আলীম ভাই আমার পেটে বাচ্চা। হাসান তো এখন স্বীকার করছে না। আমার আর কারও কাছে যাওয়ার জায়গা নেই আলীম ভাই।

মেয়েটা এ কথা বলে হলের দিকে হাটা দেয়। সকাল বেলা মেয়েটার ঝুলন্ত লাশ হলের পিছনে পাওয়া যায়। তারপর হাসান তার বাবার প্রভাব খাটিয়ে ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়। এরপরই সে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। 

.

তারপর বছর পাচ কেটে গেছে। মাঝে মাঝে তিন্নি আসে। আলীম ভাই ততদিনে তিন্নির বিষয়ে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মেয়েটি তার কোন ক্ষতি করবে না। তিন্নি মাঝে মাঝেই ভাইয়ের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। তারপর হাওয়ায় মিশে যায়। আরও মাস খানেক পর।সেদিন রাত একটা। আজও তিন্নি এসেছে। আলীম ভাইকে আজ সে জিজ্ঞেস করছে একটা নতুন প্রস্ন। 

-আলীম ভাই, শুনলাম এবার রিইউনিয়নে হাসান আসবে?

-হুম। শুনলাম হেই নাকি বিদেশে বড় চাকুরি পাইছে। কাল রাইতে গেস্টরুমে থাইক্কা দিনের বেলা অনুসঠানে যোগ দিবে।

কথাগুলো শোনার পরপরই তিন্নি একটা অট্ট হাসি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আলীম ভাই অবাক হন। কারন তিন্নি প্রতিবারই দু'একটা কথা বলে হুট করেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু এবার যে ভাবে হাসলো তাতে আলিম ভাই ভয় পেয়ে বসলেন। 

পরদিন রাতে হাসান আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ আর ভবনগুলো সাড়া রাত ধরে সাজানো হয়। এস এম হলের ছাদে সারা রাত হাসান আর সব ব্যাচের সিনিয়রদের পার্টি চলে। বোতলের পর বোতল সাবার হয়, ডিজে পার্টির বক্সের বিটে প্রতিধ্বনিত হয় ক্যাম্পাসের প্রত্যেকটা দেয়া।

তখনো রিইউনিয়নের অনুসঠান শুরু হয়নি। সকাল বেলা পশ্চিমের পুকুরে হাসানের লাশ ভাসতে দেখা যায়। তার সাথে থাকা বাকীরা তখনো হলের রুমে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলো। কীভাবে তার মৃত্যু হল কেউ বলতে পারে না। তার বন্ধুরা সবাই রুমেই ছিলো, অদ্ভুত ভাবে রুম বাইরে থেকে রুম লক করা দিয়েছিলো। তাই পুলিশ বন্ধুদের কাউকেই সন্দেহের তালিকায় রাখতে পারলো না। ময়না তদন্তে পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্যই ছিলো। এরপর নাকি তিন্নিকে আর কোথাও কখনো কোথাও দেখেন নি আলিম ভাই। তবে মাঝে মাঝে সাদা কাপড় পরিহিতা একটা মেয়েকে অনেকেই দেখে ভয় পায়। আর অদ্ভুতভাবে ঘটনাটা ঘটার পর বহু বছর ধরে রাতের বেলা আর কেউ ভুতের ভয়ে বের হয় না। আলীম ভাইয়ের থেকে ঘটনাটা শোনার পর আমাদের গভীর রাতের চা পানের অভ্যাস চিরজীবনের মত ছাড়তে হয়েছিল। 

লেখাটি কাল্পনিক তাই কোন ব্যক্তি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গল্পের মিল খোজার প্রয়োজন নেই


Rate this content
Log in