STORYMIRROR

Itz Nizam

Others

4  

Itz Nizam

Others

KAMI

KAMI

12 mins
16

KAMI








পৃথিবী তখন হাপিয়ে উঠেছে। চারপাশে শুধু ঘন জঙ্গল, কিন্তু সেই জঙ্গলের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে আগ্নেয়গিরির লাভা।

পাহাড়ের চূড়ার ভেতর থেকে গলগল করে ঝরে পড়ছে আগুনে গলিত পাথর।

চারপাশ জুড়ে ধোঁয়া, অগ্নিশিখা আর তীব্র গরম।


অসংখ্য পশু আতঙ্কে দৌড়াতে চেষ্টা করছে, কিন্তু লাভা এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে তাদের অনেকেই তাতে গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসস্তূপে ছড়িয়ে আছে বড় বড় জন্তুর মৃতদেহ।

পৃথিবী যেন এক বিশাল মৃত্যুভূমি হয়ে উঠেছে।


 সবকিছু শান্ত হওয়ার পর কিছু আদি মানুষ, যারা অনেক কষ্টে নিজেদের সুরক্ষিত আশ্রয়ে রেখেছিল, অবশেষে বাইরে বেরিয়ে আসে।

তারা চারপাশের ভাঙাচোরা দৃশ্য দেখে একে অপরের দিকে তাকায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই, শুধু চোখ বেয়ে নেমে আসে জল।

সৃষ্টিকর্তার এত সুন্দর পৃথিবী—কীভাবে এভাবে এলোমেলো হয়ে গেল?


ঠিক তখনই তাদের একজন চিৎকার করে ওঠে,


..দেখো ওদিকে!



সবার দৃষ্টি গিয়ে থামে ফুটন্ত লাভার উপর।

সেখানে, জ্বলন্ত আগুনের মাঝে শুয়ে আছে এক নবজাতক শিশু। তার দেহে কোনো কাপড় নেই, সে কাঁদছে—কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আগুনে ভরা লাভা তার গায়ে এক বিন্দু ক্ষতও করতে পারছে না।


মানুষগুলো বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে সাহসী এক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে তুলে আনে।

তারা দেখে, শিশুটি জ্বলন্ত লাভার উপর থেকেও সম্পূর্ণ ঠান্ডা। কোনো দগ্ধ দাগ নেই 


তখন দলের এক প্রবীণ মানুষ—ইডেন—ধীরে ধীরে বলে ওঠে,


....এটি হয়তো সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। হয়তো তিনি আমাদের জন্যই এ শিশুকে পাঠিয়েছেন। আমাদের আবার নতুন করে শুরু করতে হবে 


সবাই মাথা নাড়ে। তারা দূরে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। গাছ কেটে, পাথর জোগাড় করে ধীরে ধীরে নতুন আবাস গড়ে তোলে।

তাদের খাবার সংগ্রহ, ঘর বানানো, শিকার করা— সকল কিছুই তারা নতুন করে শুরু করছিল



ইডেন দায়িত্ব নেয় শিশুটিকে লালনপালন করার। শিশুটির নাম দেওয়া হয়—কামি।


কিন্তু কামি ছিল আলাদা। অন্য শিশুদের মতো নয়।

যেখানে সাধারণ নবজাতক মাসে মাসে বড় হয়, সেখানে কামি কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েক মাস বয়সী শিশুর মতো হয়ে উঠল।

মাত্র দুই-তিন দিনেই সে প্রায় সাত-আট মাস বয়সী শিশুর মতো দেখতে লাগল।

তার দেহ বেড়ে উঠছিল দ্রুত, আর সেই সঙ্গে বাড়ছিল তার শক্তি।


কামি এক হাতে বিশাল পাথর তুলতে পারত—যা বহন করতে পাঁচ-ছয়জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একসঙ্গে পেরে উঠত না ।


সে তার শক্তি দিয়ে মানুষদের সাহায্য করত—কাঠ টেনে আনত, পাথর সরাত, আশ্রয় গড়তে সাহায্য করত।


ইডেন সবসময় তাকে শেখাত:


.....কখনো কারো ক্ষতি করো না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের একে অপরকে সাহায্য করার জন্য পাঠিয়েছেন। মিলেমিশে থাকা, এটাই সবচেয়ে বড় শক্তি।”


দিন যায়, কামি বেড়ে ওঠে। তার শক্তি ক্রমেই বাড়তে থাকে।


একদিন, কামি কিছু বন্ধুর সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় খেলছিল। হঠাৎ পা পিছলে সে পাহাড় থেকে নিচের দিকে পড়ে যায়।


বন্ধুরা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু অবিশ্বাস্য দৃশ্য—কামি নিচে পড়ছে না।

সে বাতাসের মাঝে ভেসে আছে!


বন্ধুরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তারা দৌড়ে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনে।

মানুষরা জড়ো হয়, চোখ বড় বড় করে সেই দৃশ্য দেখে।


কিন্তু ইডেন একটুও অবাক হয় না।

সে ধীরে ধীরে বলে,


.....হ্যাঁ… আমি জানতাম। সৃষ্টিকর্তা কোনো কারণেই তাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।”




দেখতে দেখতে বছরের পর বছর কেটে গেল।

লাভার ভেতর থেকে পাওয়া সেই শিশু কামি এখন সতেরো বছরের এক কিশোর।


ইডেন—যাকে সে বাবা বলে মানত—এখন খুবই অসুস্থ।

দিনের পর দিন শয্যাশায়ী, ক্ষীণ কণ্ঠে শ্বাস নেয়।

কামি সারাদিন তার পাশে থাকে, খাবার জোগাড় করে, জল খাওয়ায়—সবকিছু করে যেন নিজের প্রাণ দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।


এই সময়ের মধ্যে কামি অনেক কিছু শিখেছে।

সে উড়তে পারে,

সে পশু-পাখির ভাষা বোঝে,

এমনকি তাদের সাথে কথা বলতেও পারে।


রাতে, যখন ইডেন ঘুমিয়ে থাকে, কামি চুপিচুপি জঙ্গলের ভেতর চলে যায়।

পশু-পাখিদের সাথে বসে, তাদের দুঃখ-কষ্ট শোনে।

কোথাও যদি খাদ্য না পায়, সে ব্যবস্থা করে দেয়।

সবাই তাকে আপন মনে করে—মানুষ না হলেও সে যেন প্রকৃতিরই একজন সন্তান


কিন্তু একদিন, ইডেনের অবস্থা আরো খারাপ হলো।

সে কথা বলতে পারছিল না, তবু কষ্ট করে কামিকে কাছে ডাকল


ভাঙা গলায় বলল—


.....আমি জানি… তোমার ভেতরে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এমন কিছু আছে, যা পৃথিবীর দরকার।

মনে রেখো, কখনো ভুল পথে যেয়ো না।

সবসময় পৃথিবীর ভালোর জন্য লড়াই করবে।


কামি কেঁপে উঠল।

তার চোখ ভিজে গেল, সে বলল—


......বাবা… এসব কথা বলছ কেন? আমি তো আছি তোমার পাশে। তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি তোমাকে কখনো একা ছাড়ব না।


এ কথা বলে সে ইডেনের হাত শক্ত করে ধরে রাখল।


ইডেন হালকা হাসল।

তার ক্লান্ত মুখে এক ধরনের শান্তি নেমে এলো।

হঠাৎ করেই সে চোখ বন্ধ করল—আর কোনো সাড়া নেই


কামি স্থির হয়ে বসে রইল।

চোখে জল এলেও সে কাঁদল না।

শুধু ইডেনের নিস্তব্ধ দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না


পরের দিন মানুষজন মিলে ইডেনকে পাশের জঙ্গলে কবর দিল।

তাদের প্রথা ছিল—যে-ই মারা যাক, তাকে জঙ্গলের বুকে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়।

ইডেনও ফিরে গেল সেই মাটির কাছেই 


কিন্তু ইডেন চলে যাওয়ার পর কামি আর মানুষের সঙ্গে থাকেনি।

সে একেবারে একা হয়ে গেল।


এখন সে জঙ্গলের গভীরে থাকে

ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকে।

পশু-পাখিদের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব, তাদের সাথেই তার কথা-বার্তা


তবু একটা রহস্য স্পষ্ট হয়ে উঠল—

সতেরো বছর বয়সের পর থেকে তার বয়স চেহারা আর কোন পরিবর্তন হয়নি

দিন যায়, বছর যায়, দশক কেটে যায়—

মানুষ বদলাচ্ছে, পৃথিবী বদলাচ্ছে, জঙ্গল কমে যাচ্ছে—

কিন্তু কামি একই রকম রয়ে গেছে।


সে চুপচাপ, নিরব, এক অদ্ভুত শান্ত ছায়ার মতো।

যেন ইডেনের শেষ কথা তার হৃদয়ে গভীরভাবে খোদাই হয়ে গেছে




সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২


গ্রিক সাম্রাজ্যের এক ঘন জঙ্গলে সূর্যের আলো ছায়া ফেলে দিচ্ছে গাছের পাতায়


সেখানে এক তরুণী দৌড়াচ্ছিল !

তার বয়স সতেরো কিংবা আঠারো হবে।

গায়ে হালকা নীল রঙের সুন্দর পোশাক, মাথায় সোনালি অলঙ্কার

সে রাজকন্যা এলিস


কিছুক্ষণ ছুটে যাওয়ার পর হঠাৎ তার পথ আটকে দিল এক ভয়ঙ্কর নেকড়ে।

লালচে চোখে জ্বলজ্বল করছে, দাঁত বের করে গর্জন করছে।

এলিস ভয়ে কেঁপে উঠল।


সে কাঁপা গলায় বলল—


......দয়া করে… আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। আমাকে ছেড়ে দাও…


কিন্তু নেকড়েটি ক্রমশ এগিয়ে আসছিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে, মাথার ওপরের ডাল থেকে হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি নেমে এলো।


সে ছিল সতেরো বছরের এক কিশোর।

শরীরে কালো চাদর, মাথায় কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা।



সে ধীরে নেকড়ের কানে ফিসফিস করে বলল—


......বন্ধু… সে তোমার চেয়ে দুর্বল। দুর্বলের উপর আক্রমণ করা কি শক্তির কাজ? তাকে ছেড়ে দাও


নেকড়ে থেমে গেল।

মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখ শান্ত হলো।

তারপর সে ঘুরে জঙ্গলের ভেতর চলে গেল


এ দৃশ্য দেখে এলিস হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।


সে কিশোরকে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল—


.....তুমি কে?”


কিশোর উত্তর দিল—


.....আমি কামি। এই জঙ্গলই আমার ঘর।


এলিস অবাক হয়ে তাকাল।


.....তুমি জঙ্গলে থাকো? তোমার ভয় করে না?


কামি হেসে বলল—


.....না, এ জঙ্গল আমারই পরিবার।


এলিস তখন লাজুকভাবে বলল—


......আমি রাজা ফিলিপের কন্যা, রাজকন্যা এলিস। আজ আমার বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে এসেছিলাম। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলেছি। ভাগ্যিস তুমি বাঁচালে।


সে একটু থেমে আবার বলল—


......তুমি কি আমায় রাস্তা দেখাতে পারবে? তুমি তো এ জঙ্গল চেনো।”


কামি হাত বাড়িয়ে দিল।


.....এসো, আমার হাত ধরো


এলিস প্রথমে দ্বিধা করল।

কিন্তু কামির শান্ত চোখ দেখে তার ভয় কেটে গেল

ধীরে ধীরে সে হাত বাড়িয়ে দিল।


হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গেই কামি আকাশে লাফ দিল।

এলিস চমকে উঠল—তারা দুজনেই ভেসে উঠেছে বাতাসে!


....এ…এটা কী হচ্ছে?” এলিস চিৎকার করে উঠল।


কামি মৃদু হেসে বলল


.....ভয় পেয়ো না। শুধু আমার হাত শক্ত করে ধরো।


এলিস চোখ বন্ধ করে ফেলল।

সে অনুভব করছিল, তারা বাতাস কেটে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে দিকে।


কিছুক্ষণ পর কামি বলল—


.....চোখ খুলো।


এলিস চোখ মেলে যা দেখল, তাতে সে স্তব্ধ হয়ে গেল।

তারা এখন তার রাজপ্রাসাদের ছাদে।


সামনের বিশাল রাজ্য, আকাশের নিচে ছড়িয়ে আছে।

অলৌকিক দৃশ্য দেখে তার চোখ ভিজে উঠল।



......আমি কখনো এই ছাদে আসিনি,” এলিস বলল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে।


......এখান থেকে পুরো রাজ্যকে দেখা যাচ্ছে… কত সুন্দর!


কামি হালকা কণ্ঠে বলল—


......পৃথিবী আসলেই সুন্দর… যদি আমরা তার যত্ন নিতে পারি।


এলিস বিস্মিত হয়ে তাকাল।


........তুমি অদ্ভুত কথা বলো… তুমি আসলে কে?


কামি চুপ করে গেল।

তারপর বলল—


........এখন নয়। আরেকদিন বলব।


সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল—


......তুমি তাড়াতাড়ি নিচে চলে যাও। না হলে তোমার বাবা পুরো রাজ্যে তোমার নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে দেবে।


এলিস হেসে ফেলল।


......তাহলে… আমাদের আবার দেখা হবে ?


কামি চোখের কোণে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল—


........যদি ভাগ্যে থাকে।


বলেই সে আবার উড়ে গেল জঙ্গলের দিকে


এলিস একা দাঁড়িয়ে রইল প্রাসাদের ছাদে।

তার বুক ধুকপুক করছে দ্রুত।

সেই মুহূর্ত থেকে তার পৃথিবী যেন বদলে গেল


এলিস প্রত্যেকটি মুহূর্ত চারপাশে, প্রতিটি জায়গায় কেবল কামিকেই দেখতে লাগল

তার মনে হলো—সে হয়তো অজান্তেই কামিকে ভালোবেসে ফেলেছে

সেই অনুভূতি তাকে ঘুমোতে দেয় না।


কয়েক দিন পর সে চুপিচুপি আবার গেল সেই জঙ্গলে।

হয়তো আবার দেখা হবে…

কিন্তু যতই খুঁজল, কামিকে আর পেল না।


রাজপ্রাসাদের বাগান ভরে উঠেছিল হালকা বাতাস আর ফুলের গন্ধে। রাজকন্যা এলিস একা বসেছিল, আকাশের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ করেই আকাশ থেকে কালো কাপড়ে মোড়া এক ছায়া নেমে এলো। সে আর কেউ নয়, কামি।


এলিস চোখ মেলতেই থমকে গেল। বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। বুকের ভেতর জমে থাকা আকুলতা যেন অজান্তেই বিস্ফোরিত হলো। সে দৌড়ে গিয়ে কামিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল


কামি হতভম্ব হয়ে গেল—এমন অনুভূতি তার অচেনা।


......কি হয়েছে, এলিস?


এলিস কাঁপা গলায় বলল,


........জানি না… তোমাকে দেখে হঠাৎই মনে হলো জড়িয়ে ধরি।


কামির ঠোঁটে অদ্ভুত এক মৃদু হাসি ফুটে উঠল।


.......তুমিও না… আচ্ছা, বলো, কেমন চলছে তোমার দিনকাল?


বাগানের বেঞ্চে বসে তারা গল্প শুরু করল


এলিস বলল,


.........তুমি চাইলে প্রতিদিন আসতে পারো এখানে। আমি বেশিরভাগ সময় একাই থাকি। চাইলে আমরা প্রতিদিন গল্প করতে পারি।


কামি প্রথমবার কারো চোখের দিকে এত গভীরভাবে তাকালো। রাজকন্যার চোখে ছিল মায়ার সমুদ্র তার হৃদয়ের ভিতরে এমন অনুভূতি আগে কখনো আসেনি।


সে ফিসফিস করে বলতে শুরু করল—


........আমি আদিকাল থেকে আছি এই পৃথিবীতে… আমি অনেক কিছু দেখেছি…


কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল। কণ্ঠ ভারী হয়ে এল, চোখে জল।

এলিস অবাক হয়ে তার চোখের জল মুছে দিল নিজের আঙুল দিয়ে।


........এমনও কি হতে পারে সত্যিই? তাহলে তুমি কি পিরামিডের সময়ও ছিলে? এলিস বলল ,


কামি নরম স্বরে বলল,


......হ্যাঁ… সেগুলোকে আমি শুধু বড় বড় পাথর মনে করতাম। আমি নিজেও শ্রমিকদের সাথে তাদের গড়তে সাহায্য করেছি। শ্রমিকদের উপর অমানবিক নির্যাতন চলত…


দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন… সময় যেন থমকে গিয়েছিল কামি আর এলিসের বাগানের গল্পে


বছর ঘুরতে লাগল। রাজকন্যা এলিস একসময় রানি হয়ে গেল। তার কাছে এল বড় বড় রাজ্যের রাজপুত্রদের বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু তার হৃদয় তো এক জায়গায় বন্দী—কামির কাছে


এক সন্ধ্যায় এলিস চুপচাপ বলল,


.......কিছু মনে করো না, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমরা যদি একসাথে থাকতে পারতাম…


কামি স্তব্ধ হয়ে গেল।


......আমিও চাই… কিন্তু সম্ভব না। আমি অমর। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। কিন্তু তুমি… একদিন চলে যাবে। আর আমি তা সহ্য করতে পারব না। আমি আর কাউকে হারাতে চাই না।”


এলিস চোখ নামিয়ে নিল। তার চোখের কোনে অশ্রু জমে উঠল।


......ঠিক আছে… আমরা বন্ধু হিসেবেই থাকব। কিন্তু জানো… আমি তোমাকে আমার হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসি।


কামি কিছু বলল না, শুধু তার হাত শক্ত করে ধরল।


সময় নদীর মতো বয়ে চলল। বছর, দশক… এলিস বৃদ্ধ হল। কিন্তু সারা জীবন সে আর বিয়ে করেনি। এক রাত, যখন মৃত্যুর ছায়া তার উপর নেমে এসেছে, কামি চুপিচুপি এসে তার বিছানার পাশে বসল।


এলিস দুর্বল কণ্ঠে বলল,


......আমার সময় শেষ… তুমি একটা ওয়াদা করো—আমার জন্য কষ্ট পাবে না। নিজের জীবন, নিজের শক্তি… এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করবে।


কামির চোখে জল ভেসে উঠল। সে মাথা নেড়ে বলল,


......না… আমি প্রতিশ্রুতি রাখতে পারব না। তোমাকে আমি ভুলতে পারব না, এলিস।


দুজনে একে অপরের হাত ধরে বসে রইল। নীরবতায় ভরে গেল ঘর।


পরদিন ভোরে রাজ্য জুড়ে শোকের স্রোত বয়ে গেল—রানি এলিস মারা গেছেন


সবাই দৌড়ে এলো তাকে শেষবার দেখতে। কিন্তু কামি আসেনি। সে সেই পুরোনো জঙ্গলের উঁচু গাছের ডালে বসে ছিল, আকাশের দিকে তাকিয়ে।


একটি ছোট পাখি এসে ডেকে উঠল—


......যাও, তাকে শেষবার দেখো।


কামি ম্লান হাসি দিয়ে বলল,


.....না, বন্ধু… সে তো আমার হৃদয়ে বেঁচে আছে। 


তার চোখ বেয়ে নেমে এলো নীরব অশ্রু



সময় – ১৯৪০


পৃথিবীতে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে , আমেরিকার রাস্তায় সৈন্য সংগ্রহ চলছে। লম্বা লাইনে দাঁড়ানো তরুণদের ভিড়ে ছিল এক কিশোর—মাত্র সতেরো বছরের। তার চোখে ভয় নেই, শুধু দৃঢ়তা।


কমান্ডার তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,


.......তুমি কেন যোগ দিতে চাও এই যুদ্ধে?


কিশোর শান্ত গলায় উত্তর দিল,


.....আমার কাছে হারানোর কিছু নেই। আমি শুধু চাই পৃথিবীর জন্য কিছু করতে… মানবতার জন্য।


কমান্ডার চোখ সরু করে তাকাল।


....তুমি কি পারবে?


.....ইয়েস, স্যার।


....তোমার নাম?


..কামি।


সেদিন থেকেই সে যুক্ত হলো যুদ্ধে




প্রশিক্ষণের ক্যাম্পে বসে কামি সৈন্যদের পোশাক পরে বন্দুক হাতে নীরবে বসে ছিল। হঠাৎ তার পাশে এসে বসল এক যুবক, বয়স বিশ–একুশের মতো। বুক উঁচু করে সে পরিচয় দিল,


.....আমি মার্ক স্টিফেন, কলম্বিয়া থেকে এসেছি। আমার পরিবার সেখানেই থাকে। তোমার পরিবার?


কামি নিঃশব্দে বলল,


.....আমার কোনো পরিবার নেই।


মার্ক থমকে গেল।


.....মানে কেউ বেঁচে নেই?


......হ্যাঁ… কেউ নেই , কামি বলল


মার্ক কণ্ঠ ভারী করে বলল,


......আমি দুঃখিত। কিন্তু তুমি চাইলে আমরা বন্ধু হতে পারি। আমরা একসাথে যুদ্ধ করব, একসাথে পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করব


কামির ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল।


.....হ্যাঁ, অবশ্যই।





কয়েক ঘণ্টা পর তাদের প্রথম মিশন শুরু হলো। স্থান – ফ্রান্স।


চারদিকে অন্ধকার, শীতল হাওয়া আর বন্দুকের গর্জন। কামি ও তার সঙ্গীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। গুলির শব্দে আকাশ ফেটে যাচ্ছিল। সৈন্যরা একে একে পড়ে যাচ্ছিল মাটিতে। কামি শুধু লড়াই করছিল না, আহতদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল নিরাপদ আশ্রয়ে।


তার গায়েও গুলি লাগল। কিন্তু কেউ বুঝল না—কারণ ক্ষত সাথেসাথেই ঠিক হয়ে যাচ্ছিল

মিশন শেষে তারা ফিরে এলো। কিন্তু যারা গিয়েছিল, সবাই আর ফিরে আসেনি। কেউ ফিরল লাশ হয়ে, কেউ ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে


মার্কের পায়ে গুলি লেগেছিল। মেডিকেল তাঁবুতে ব্যান্ডেজ করা হলো। কামি তার পাশে বসে বলল,


.......কি যোদ্ধা, কেমন আছো?


মার্ক ব্যথা লুকিয়ে হেসে বলল


......একদম ভালো। জানো, আমার পরিবার কলম্বিয়ায় আছে। আমার ছোট মেয়ে—লুনা। নামের অর্থ চাঁদ। আমি চাই গর্ব নিয়ে তার কাছে ফিরতে। তার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চাই


কামি চুপচাপ তার কথা শুনছিল,





কিছুদিন পর আবার মিশন। তীব্র ঠাণ্ডার ভেতর তারা এগোতে লাগল। মনে হয়েছিল শত্রু দুর্বল হয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই চারদিক শত্রুরা তাদের ঘিরে ফেলল এবং এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করল


সৈন্যরা একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল। কামির চোখের সামনেই মার্ক অসংখ্য গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

মার্কের চোখে তখনও স্বপ্নের ঝিলিক— তার পরিবারের কাছে ফেরার আকাঙ্ক্ষা


কামি স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা ছিঁড়ে গেল


কিন্তু যুদ্ধ থামে না। কামি দাঁত চেপে বন্দুক তুলে নিল। শত্রুদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অগণিত গুলি তার শরীরে বিঁধল, আবার মিলিয়ে গেল। সে দানবের মতো লড়ল—যতক্ষণ না চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল


শেষে একাই সে ক্যাম্পে ফিরল। ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে এলো তার সঙ্গীদের লাশ


কমান্ডার বিস্মিত হয়ে তাকাল। সাহসিকতার জন্য তাকে মেডেল দেওয়া হলো। কিন্তু কামির মনে শুধু মার্কের হাসি, তার স্বপ্ন আর তার ছোট মেয়ে লুনার নাম প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল



সাল : ১৯৪৫ 


দেখতে দেখতে যুদ্ধ শেষ হলো। পৃথিবী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু কামি পেল শুধু স্মৃতির ভার।


একদিন সে কলম্বিয়ায় গেল। অনেক খোঁজার পর মার্কের পরিবারের ঠিকানা পেল। মার্কের স্ত্রীর হাতে দিল সেই রক্তে ভেজা ইউনিফর্ম।


নারীর চোখে তখন শুধু অশ্রু। তার পাশে দাঁড়ানো ছোট্ট মেয়ে—লুনা। চার বছরের। কামি তার মাথায় আলতো করে হাত রাখল। মনে হলো, মার্কের স্বপ্ন যেন একটু হলেও বেঁচে আছে এই শিশুর হাসিতে


তারপর চলে গেল সে… একা




সেই রাত। কামি এক গাছের ডালে ঘুমিয়ে পড়েছিল। স্বপ্নে দেখল—এলিস আবার এসেছে। গাছের ডালে বসে আছে দুজন। এলিস মাথা রেখেছে কামির কাঁধে। শান্তি আর ভালোবাসায় ভরা মুহূর্ত


হঠাৎই বন্দুকের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। নিচে এক শিকারি বন্দুক তাক করে আছে একটি হরিণের দিকে


কামি সেখানে উড়ে গিয়ে শিকারির মাথায় এক ঘুষি দিয়ে তাকে অজ্ঞান করল। তারপর তাকে তুলে নিয়ে গেল এক পাহাড়চূড়ায়—যেখানে নামার কোনো পথ নেই


কামি তার কানে ফিসফিস করে বলল,


......যখন যাওয়ার কোনো পথ থাকে না, ভয়ের মানে তখনই বোঝা যায়।


তারপর ফিরে এসে হরিণটির চোখের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল,


.....যাও… তুমি স্বাধীন।


হরিণটি ছুটে চলে গেল অরণ্যের ভেতর




সাল : ২০২৫


নীয়নের আলোতে মোড়া শহর। আকাশচুম্বী দালানগুলো আকাশ ছুঁতে চাইছে নিচে ব্যস্ত রাস্তায় অসংখ্য মানুষ ছুটছে নিজেদের অজানা গন্তব্যে। গাড়ির হর্ন, মানুষের ভিড় আর কংক্রিটের কোলাহলের মাঝে শহরটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে 


সেই শহরের এক দালানের চূড়ায় বসে আছে ১৭ বছরের এক কিশোর। কালো কাপড়ে ঢাকা শরীর


ঠিক তখনই রাস্তার ওপাশে একটি কিশোরী মেয়ে দ্রুত দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে। হঠাৎ সামনের দিক থেকে এক বাস গর্জন তুলে ছুটে আসে মনে হচ্ছিল সব শেষ কিন্তু মানুষ চোখ মেলবার আগেই

কেউ সময়ের চেয়েও দ্রুত এসে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে গেল রাস্তার ধারে। সে বেঁচে গেল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কেউই বোঝেনি ঠিক কী ঘটল। 


রাত নেমে এলো শহরের বুকে।

একই দালানের ছাদে সেই কালো কিশোর বসে আছে। তার পাশে ভেসে এসেছে একটি বাদুর। বাদুরটি বলে উঠল—


.....এখন জঙ্গলের দিকে কেন যাচ্ছো না? ওখানে তোমার আসল বাড়ি


কিশোর গভীর নিঃশ্বাস নিল


......আর কি জঙ্গল আছে? তারা তো সব গাছ কেটে ফেলছে।


বাদুরটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,


......মানুষ আসলেই নিষ্ঠুর।


কিন্তু কিশোর মৃদু হেসে উত্তর দিল,


.....না… তারা বাধ্য হয়েই করছে। তারাও তো আমাদের মতোই বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে কারণ দিনশেষে মানুষ হওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন ।



এই বলে সে ধীরে ধীরে দাঁড়াল। কোনো দ্বিধা ছাড়াই সে দালানের চূড়া থেকে নিচে লাফ দিল। বাতাস চিরে নামতে থাকলো নিচে



বাদুরটিও উড়ে গেল শহর থেকে দূরে




The World Deserves a Beautiful Ending 







Rate this content
Log in

More bengali story from Itz Nizam

KAMI

KAMI

12 mins read