Shehnaz Rauf

Others

4.0  

Shehnaz Rauf

Others

# হাতে রইলো পেনসিল

# হাতে রইলো পেনসিল

3 mins
391


# হাতে রইলো পেনসিল


"না: এখানেও নেই, ওই ড্রয়ারেও নেই তো। গেলোটা কোথায়!"

সকাল থেকে খোঁজাখুঁজির পর ক্লান্ত মৈনাক ধপাস করে চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিলো। শার্লক হোমস,ব্যোমকেশ ভক্ত মৈনাক ভেবেছিল এই কাজটা হয়তো অনায়াসেই করতে পারবে।কিন্তু নাহ্। পারলনা খুঁজতে। অগত্যা গিন্নির শরণাপন্ন হতেই হবে।

  মৈনাক এমনিতে শান্তশিষ্ট মানুষ। কিন্তু আজ তার অদম্য জেদ চেপেছে। জিনিসটা তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

   ইলা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো একরাশ বিরক্তি নিয়ে।"এখনও খুঁজছো? অদ্ভুত তো গেলো কোথায়?উপরের ক্যাবিনেট এ দেখেছো"? "দেখেছি!" "নিচের ড্রয়ার এ?" "আজ্ঞে!" আচ্ছা টুবলুর ডেস্ক-এ?" "সব জায়গায় দেখে নিয়েছি ইলা, কোথাও নেই!" " ধুর, বাদ দাও তো, আমার আর ভালো লাগছেনা তোমার এই পাগলামি।রেহাই দাও নিজেকেও আর আমাকেও।"

 অগত্যা মৈনাক এর শেষ আশাও হতাশায় পরিণত হলো।এবারে কি করবে সে! বসে ভাবতে ভাবতে নিজের ভেতরের সুপ্ত ডিটেকটিভ সত্তাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করলো। শেষবার কবে দেখেছিল?

ঠিক মনে নেই।আজকাল তো তেমন আর কাজেই লাগেনা। দেখবেই বা কীকরে।

ঘরে তো আমরা তিনটে মোটে প্রাণী। তিনজনের আলমারি, ক্যাবিনেট, ডেস্ক সব চেক করা হয়ে গেছে।তাহলে...তাহলে....

"ইউরেকা! ইউরেকা!"চেঁচিয়ে উঠলো মৈনাক। সে জানে কোথায় পাওয়া যেতে পারে জিনিসটা।সে ছুটলো টুবলুর খেলার ঘরের দিকে। টুবলু, মৈনাক আর ইলার পাঁচ বছরের ছেলে।কিন্তু বয়সের তুলনায় সে বেশ পরিণত আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে।তার কথা বার্তা, হাবভাব, আচার - আচরণ সবই আলাদা। তার একটা অদ্ভুত হবি আছে। জিনিস সংগ্রহ করার। খসে পড়া হলুদ পাতা সযত্নে রাখা তার অ্যালবামে। পুরোনো আলমারির ভাঙা হাতল, গীতবিতান এর ছেঁড়া পাতা, মায়ের ছেঁড়া শাড়ীর টুকরো, চুলের কাঁটা, দাদুর দোয়াত, দিদার পানের কৌটো, যে বাড়ি থেকে যা ভাঙা, পুরোনো, কুড়ানো, বাড়ন্ত দেখেছে সব জমেছে তার খেলার ঘরের একটি বাক্সে। বাক্সটাও পেয়েছে বাবার ফেলে দেওয়া ট্র্যাশ থেকে। 

 মৈনাকের অনেক কষ্টে মনে পড়েছে, ওই বাক্সটার মধ্যেই আছে তার প্রিয় সেই জিনিস। তার পাঁচ বছরের জন্মদিনে ছোটকা দিয়েছিল। 

  টুবলুর ঘরে গিয়ে মৈনাক দেখলো টুবলু যথারীতি ব্যস্ত তার ভাঙা, পুরনো, বাতিলের জগতে। আস্তে করে ছেলের মাথায় বিলি কেটে সে বললো," টুবলু, বাবা তোমার এই বাক্সটা আমায় একবার দেখাবে?"

"কেনো বাবা?তুমি আমায় বকবে নাতো?"

"না বাবা, শুধুই দেখবো একবার!"

টুবলু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে দিলো তার প্রাণের বাক্সটাকে।

মৈনাক সন্তর্পণে বাক্সটাকে নিয়ে, সযত্নে রাখলো নিজের কোলের উপর।কতদিন পর এই বাক্সটা হাতে ধরেছে সে। খুলে দেখলো, তার ছোটবেলা আজও সযত্নে গচ্ছিত এর মধ্যে। তার প্রিয় নীল পেন্সিলটা আজও সেরকম চকচকেই আছে। একটাও আঁচড় পড়েনি। প্রাণে প্রাণ ফিরে পেলো সে। এটাই তো খুঁজছে সে আজ সকাল থেকে। গত রাতে স্বপ্ন দেখেছে সে, ছোটকা তার হাতে তুলে দিচ্ছে ওই সুন্দর নীল পেন্সিলটা, "বাবা মনু, সদ্ব্যবহার করিস এটার। তোকে দিয়ে গেলাম।" কচি বয়সে সদ্ব্যবহারের মানে বুঝতে পারেনি মৈনাক, আজ বুঝতে পারে কলমের জোর। আজ তো এক প্রতিষ্ঠিত সংবাদ পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক মৈনাক চক্রবর্তী। কাজের চাপে, ব্যস্ততার মাঝে ভুলেই গিয়েছিল সযত্নে তুলে রাখা ওই নীল পেন্সিল টার কথা। আজ স্বপ্নে ছোটকাকে দেখে সামলাতে পারেনি নিজেকে। ঘুম ভাঙ্গা ইস্তক খুঁজেই চলেছে তার সাধের পেনসিল, নাওয়া-খাওয়া ভুলে।

  টুবলু তার বাবার চোখে এরকম মুগ্ধতা আগে দেখেনি। হাতে একটা লম্বা ব্লু রঙের জিনিস নিয়ে বাবা নাড়াচাড়া করেই চলেছে, আর হাসছে। কিছু বলছেনা। "কি হয়েছে বাবা?কি ওটা?"


মৈনাক চমকে ওঠে টুবলুর কথায়। মৈনাক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি জানোনা এটা কি টুবলু!"

"না বাবা!কি এটা?খুব দামী কিছু?"

মৈনাক খুব অবাক হয় তার ছোট্ট ছেলের কথায়। তার ছেলে হয়ে সে জানেনা এটা কি! আমরা কি কিছুই শেখাতে পারিনি টুবলুকে।আসলে ওরই বা দোষ কি। বিগত দুবছর থেকে তো বেচারা বাড়ীতেই আছে। মোবাইলে অনলাইন ক্লাস করছে, লিখছে, পড়ছে, ছবি আঁকছে, রং করছে- সবই মোবাইলে,ল্যাপটপে, ওয়ার্কশীট এ, কালারিং অ্যাপ এ।পেনসিল কি জিনিষ তা আর দেখবেই বা কীকরে, জানবেই বা কীকরে।

"টুবলু, এটাকে বলে পেনসিল!"

"পেন্সিল?সেটা কি জিনিষ বাবা?"

"এটা দিয়ে লেখা হয়।"

"সেটাতো পেন বাবা।পেনসিল টা কিরকম?"

"দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।"

মৈনাক পেন্সিলটা সরু করে ছুলে দিলো। আড়চোখে দেখলো টুবলু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পেনসিলটার দিকে। টুবলু অস্ফুটে বলে উঠলো:"ওয়াও"।মৈনাকের মুখে একটা আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।সে জানে যতই টেকনোলজি আসুক, অ্যাপ আসুক, মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এসব কিছুই নয় এই পেনসিল টার কাছে। এতে লিখে যা সুখ, যে আনন্দ, যে স্বাধীনতা তা আর অন্য কোনো কিছুতেই পেতে পারবোনা আমরা।

" আজ থেকে এটা তোমার। এর সদ্ব্যবহার করো।"

 টুবলু একরাশ বিস্ময় নিয়ে তার ছোট্ট দুটো কাঁপা কাঁপা হাতে ধরলো সেই যাদু পেনসিল।তার খাতায় আঁকিবুকি কাটতে লাগলো আর তাকিয়ে বসে রইলো তার হাতের এই ম্যাজিক এর দিকে। 

"কেমন লাগছে টুবলু?"

" বাবা, এতো ম্যাজিক।কম্পিউটার ছাড়াও লেখা যায়,এত সুন্দর আঁকা যায়?কোনো অ্যাপ লাগবেনা?ওয়ার্কশীট-ও না?"

 যাক, মৈনাক এর পেন্সিলের আজ হয়তো সত্যিই সদ্ব্যবহার হোলো।


Rate this content
Log in