ঐশ্বরিক
ঐশ্বরিক
এত দিনে গোপাল বেশ ভালই বুঝতে পেরেছে যে তাকে কেউ কোনওদিন বকবে না | যত খুশি দুষ্টুমি করার পূর্ণ স্বাধীনতা সে পেয়েছে, আর সেই স্বাধীনতার আনন্দ-সমুদ্র সে মনের সুখে সাঁতার কেটেই চলেছে | নিজের মা ছাড়া তাকে কেউই কিছু বলে না | কিছু চাইলে কেউ না করে না, উল্টে খুশিই হয় | গোপাল কে কিছু দিতে পেরেও যেন সবাই ধন্য | এরম জীবন যে সে পাবে তা কি সে নিজেও কোনওদিন কল্পনা করেছিল ? কিন্তু এসবের পেছনে আছে এক ভারি অদ্ভুত গল্প |
গোপালের যখন জন্ম হয় তখন তার বাবা মার আতঙ্কে যাকে বলে রক্ত একেবারে জল | তাদের সদ্যোজাত শিশুর গায়ের রঙ ছিল নীল | সামান্য কালচে নীল, অথচ খুব গাঢ় নয় | তার বাবা মার তো দেখেই কান্নাকাটি শুরু... তারা ধরেই নিয়েছিল তাদের সন্তান সুস্থ নয় | পরে ডাক্তাররা অনেক রকম টেস্ট করে জানালো তাদের সন্তানের কোনওরকম শারীরিক সমস্যা নেই বা হবে না, এবং এই নীলচে রঙ এক ধরণের জেনেটিক ব্যামো যার সঠিক অর্থে কোনো ওষুধ হয়না | ডাক্তাররা বার বার আশ্বাস দিয়েছিলেন এতে ঘাবড়াবার কিছুই নেই | "এতে আপনার ছেলের কোনো অসুবিধে হবেনা | মনে করবেন আপনার ছেলের গায়ের রঙ কালো, তাহলেই হল | আপনাদের মনের ভেতর থেকে এই ভয়টাও আসতে আসতে কেটে যাওয়াটা খুব দরকার... আপনার ছেলে বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনারাও ওকে বোঝাবেন যে আর পাঁচটা চাপা গায়ের রঙের ছেলের সাথে ওর যে একটা পার্থক্য আছে সেটাকে যেন একেবারেই অগ্রাহ্য় করে...কারণ পার্থক্যটা চামড়ার রঙ বাদে আর কিন্তু কোত্থাও নেই |"
গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসার পর সবার মুখে একই কথা – ঘরে গোপাল এসেছে | একরকম বাধ্য হয়েই রাণু তার ছেলের নাম রেখেছিল গোপাল | তার নিজের যে সেই কথা একবারও মনে হয়নি তা নয় | বাড়ি ফিরে এসে মহিম ও রাণু দুজনেই ছেলেকে কে কোলে করে নিয়ে নারায়ণ মন্দিরে পুজো দিয়ে এলো | ইশ্বরের কাছে একটাই কামনা – ডাক্তারবাবু যা বললেন তাই যেন ঠিক হয় | গোপালের যেন কোনদিন কোনওরকম সমস্যা না হয় – শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সমস্যা ও | ওদের ভয় হয়েছিল লোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে, ফিসফিস করবে, অন্য়ান্য় ছেলেরা গোপালের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছুক হবে না... কিন্তু শেষটায় তারা অবাক হয়ে গেল |
এমনিতেই সবাই গোপাল কে একটু অন্য চোখেই দেখত | 'অন্য চোখে' কে ঠিক ঠিক ব্যাখ্যা করতে গেলে এটাই বলতে হয় যে তাকে লোকজন শ্রীকৃষ্ণ রূপেই দেখত | অনেকেরই এই ধারণা ছিল যে গোপাল-এর মধ্যে সত্যিকারের গোপাল, মানে শ্রীকৃষ্ণ বাস করেন | তার খিল-খিল করে অকারণেই হেসে ওঠা, মা কে সর্বত্র এটা-সেটা ভেঙে জ্বালানো, চোখের গভীরে সারাক্ষণ দুষ্টুমির চেনা এক রঙের খেলা করা, এসব দেখে সবার এই ধারণা দিনে দিনে যেন আরই বদ্ধমূল হতে লাগল |
"ভগবানের সিংহাসনে চাপাতে হবে না...আমার ছেলেটা কে মানুষের মত দেখুক, তার বেশি আমার আর কিছু চাইনা," রাণু বার বার এই কথা বলত, আর উত্তরে মহিম মুচকি হেসে বলত, "তুমি বৃথাই এত চিন্তা কর |" আর এদিকে গোপালের তো সারা বছর পৌষ মাস ! সে প্রথম প্রথম ভাবত – এই যে সেদিন রাখাল হরি কাকার দোকানে বল মেরে কাঁচ ভেঙে দিল, হরি কাকা তো আচ্ছা করে কান মুলে দিয়েছিল তার! কিন্তু সে নিজে যেদিন মোরব্বার এত বড় শিশিটা ভেঙে চুরমার করে দিল, হরি কাকা কিছুই বলল না তাকে! উল্টে কেমন যেন হাসি হাসি মুখে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গোপালকে "দুষ্টু কোথাকার!" বলে মাথায় তার ওই দৈত্যাকার হাত বুলিয়ে সব চুল এলোমেলো করে দিয়েছিল | তারপর থেকে যখনই কোনো কেলেঙ্কারী হত, সবাই গোপালের নামে দোষ দিয়ে দিত, কারণ বাকি ছেলেরাও বুঝে গিয়েছিল গোপাল সত্যি ভগবান – তাকে কেউ বকেনা, মারেনা.... তাই সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে সে সবাইকে সবসময় উদ্ধার করে |
ভালই চলছিল সবকিছু... কিন্তু বাড়াবাড়িটা শুরু হল যখন, তখন গোপাল সবে দশে পা ফেলেছে | একদিন খবর পাওয়া গেল মল্লিকদের বাড়ির বাছুরটা কিছুই খাচ্ছেনা | কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন | শহর থেকে গরুর ডাক্তার ধরে আনা হল, কী সমস্ত ইনজেকসান দিয়ে গেল, কিন্তু ফল কিছুই হল না | ওদের বাড়ির মেয়ে মিলি বাছুর-টা কে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসত.... আর বলাই বাহুল্য তখন তার কেঁদে কেঁদে অবস্থা এমন যে কদিনের মধ্যে হয়ত তার জন্যেও ডাক্তার ডাকতে হতে পারে | অনেকের বাড়িতেই গরু ছিল... তারা সকলেই মনে মনে ভয় পেল, এ কোনো রকম নতুন রোগ নয় তো? একদিন বিকেল বেলায় মহিম তার ছেলে কে নিয়ে ইস্কুল থেকে ফেরার পথে ভাবল একবার মল্লিকদের বাড়িতে গিয়ে খবর নিয়ে আসি | গোপাল বলল তার খেলতে যাবার কথা, কিন্তু কি বেশ একটা ভেবে সে বলল, "না থাক, মিলিদের বাড়িতেই চল | একবার হরু কে দেখে আসি |"
যখন তারা পৌঁছলো তখন মল্লিক্ মশাই বাইরে বসে ছিলেন |
"এসো এসো মহিম...|"
"একটু খবর নিতে এলাম মল্লিকদা | মিলির জ্বর নেমেছে ? আজ ইস্কুল এ দেখলাম না |"
"হ্যাঁ, তা কমেছে, তবে আমিই বললাম দুটো দিন বিশ্রাম করুক |"
"ঠিকই বলেছেন | হরুর কী খবর?"
"কী আর বলি মহিম... চোখের সামনে হরুটা এই ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে... আর দেখতে পারছিনা গো... বড্ড কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না... |"
মহিম হরুর দিকে এগিয়ে গেল | সত্যিই... দেখে বড় মায়া হল মহিমের | কেমন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, আর ঝিমিয়ে পড়ে আছে এক ধারে |
"বসো মহিম, তোমার বৌদিকে চা করতে বলি | আরে শুনছ...? কই গেলে....?"
মহিম গিয়ে মল্লিক মশাইয়ের পাশে গিয়ে বসল, কিন্তু গোপাল তখনও হরুর পাশে দাঁড়িয়ে | তার খুব কষ্ট হচ্ছিল | এই কদিন আগে অবধি সে দেখেছে মিলি হরু কে নিয়ে মাঠে ছুটোছুটি করছে... আর আজ হরুর এই অবস্থা | সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো হরুর মুমূর্ষু দুই চোখের দিকে | তার বাবা আর মল্লিক জেঠু গল্প করছে , কিন্তু সেইদিকে তার মন নেই | সে নিচে বসে আলতো করে হরুর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো | হরু একবার চোখ মেলে তার দিকে চেয়ে আবার চোখ বুজে ফেলল | কিছুক্ষণ হাত বোলানোর পর বাবার ডাক পেয়ে সে সেখান থেকে চলে গেল | মিলির সঙ্গে দেখা করে তারা সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ি ফিরল |
খবরটা পাওয়া গেল পরের দিন সকালে | মল্লিক মশাই ছুটতে ছুটতে গোপালদের বাড়ি এসে হাজির | তখন সকাল সাত-টা | মহিম একটু ভয় পেয়েই জিজ্ঞেস করল, "কী ব্যাপার মল্লিকদা? মিলির শরীর ঠিক আছে তো? এত সকালে এইভাবে...?"
"আরে সব ঠিক আছে! তোমার ছেলে কই? এক্ষুনি ডাক ওকে!"
গোপাল কে ডাকতে সে ঘরে থেকে বেরিয়ে এলো | ইতিমধ্যে রাণুও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে | মল্লিক মশাই গোপাল কে ধরে কোলে তুলে নিলেন আর বললেন, "কাল তুই কি করেছিলি হরু কে ?"
গোপাল আমতা আমতা করে বলল, "কই, কিছু না তো..."
"আরে যখন তোর বাবা আর আমি গল্প করছিলাম, তুই তো ছিলি হরুর পাশে | কিছু খেতে দিয়েছিলি ওকে?"
"এমা না না ... আমি তো শুধু একটু ওর মাথায় হাত বুলিয়েছিলাম |"
মল্লিক মশাই হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন গোপালের দিকে | "সত্যি? শুধু হাত বুলিয়েছিলি?"
"ব্যাপার কী মল্লিকদা?" মহিম থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল |
"তোমাদের ছেলে সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ !! হরু আজ সকালে শুধু যে পেট ভরে খেয়েছে তাই নয়, তাকে নিয়ে মিলি মাঠে গেল এখন ! মাঠেও নাকি মনের সুখে ঘাস খেয়েছে সে ! হঠাৎ করে ভেল্কিবাজির মত এ কী হল? আমরা তো দেখে হাঁ ! একে চমৎকার ছাড়া কী বলবে তুমি?"
ব্যাস | পরের দিনই গ্রামের প্রায় সকলেই জেনে গেল ব্যাপারটা | গায়ের রঙ কালচে নীল, নাম গোপাল, মাথায় হাত বুকিয়ে এক বাছুর কে রাতারাতি সরিয়ে তুলেছে | আর কী চাই ? গোপাল কে নিয়ে হঠাৎ করে যেই পরিমান মাতামাতি শুরু হল, তাতে তো রাণু আর মহিম রীতিমত ঘাবড়েই গেল | কতজন যে তাদের বাড়ি এলো 'খবর নেওয়ার' অজুহাতে গোপাল কে একটিবার কোলে তুলবে বলে | লোকে যেন তাকে কোলে তুলে তার গালে চুমু খেয়ে একেবারে ধন্য !
"এরা এখন এরম করছে... দিয়ে একদিন গোপাল ভুল করে এমন কিছু একটা করে বসবে... তারপর সবাই তাকে ...তাকে... " রাণু বলতে বলতে থেমে যেত | মহিম তার স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে বলত, "তাকে কী?"
"তুমি জানো না.. মানুষ যেমন কাউকে রাতারাতি মাথায় তুলতে পারে, ঠিক তেমনি রাতারাতি তাকে পদপৃষ্ট ও করতে পারে |"
"রাণু, গোপাল ছোট্ট ছেলে | একদিন লোকে বুঝবে এইসব ঐশ্বরিক ব্যাপার-স্যাপার সবই তাদের কল্পনা, কিন্তু সেইদিন কেউই আমাদের ছেলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেনা তুমি দেখো |"
"কিন্তু তখন গোপাল আর পাঁচটা ছেলের মত থাকবে কি? এই যে এরা এত এত মিষ্টি আনে, ফল আনে, তখন কথা শোনাবে না? যাকে তুমি আজ পুজো করছ, কাল যদি হঠাৎ জানতে পারো সে একেবারেই সাধারণ, তখন তোমার প্রতিক্রিয়া কী হবে?"
মহিম এর পর আর কিছু বলতে পারেনা | এসব তারা কখনই চায়নি | তারা যেমন খারাপটা চায়নি, তেমন বাড়াবাড়ি রকম ভালোটাও চায়নি, কারণ খারাপের সঙ্গে তার পার্থক্য আসলে সামান্যই | এদিকে লোকজন জন্মাষ্টমীর দিনেও গোপালদের বাড়ি এসে মিষ্টি দেওয়া আরম্ভ করল | রানুর হাজার বারণ কে তোয়াক্কাই করল না কেউ | "এই নাড়ু গুলো আজ সকালেই বানালাম... আর তুমি বলছ এসব কেন আনলাম ? গোপাল তো আমার রাখালের-ই বয়সী ! ওর জন্য আনলাম একটু !"
"তোমরা কিন্তু ওকে মাথায় তুলছ! এই সেদিন গোপাল ইস্কুল ফাঁকি দিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়েছিল | ইস্কুলের মাস্টারমশাই পরের দিন ওকে কিছুই বললেন না! তুমিই বল ভাই, এসব কি ঠিক? "
"আহা চটছ কেন? ছেলে তো তোমারই ! তুমিই কর না শাসন!"
"বাবা মার শাসনের বাইরেও তো একটা শাসন হয়, সেটারও তো প্রয়োজন ..."
"আহা ! তুমি মিছিমিছি বিচলিত হও ! একটু ডেকে দাও দেখি গোপাল কে... দুটো নাড়ু নিজের হাতে খাইয়ে তবেই আমি যাব !"
গোপাল কিন্তু দিব্যি ছিল ! ছোট হওয়ার এই এক মস্ত সুবিধে – বড়দের মত কথায় -কথায় চিন্তা করার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা ! লোকে নিজের ইচ্ছায় এত কিছু দিচ্ছে তাকে, এতে প্রশ্ন করার আছেই বা কী ? নানা রকম নাড়ু, সন্দেশ, পায়েস, ক্ষীরের গজা, লাড্ডু, কিছুই বাদ যায়না তার | তার বন্ধুরাও তার দৌলতে বাহারের মিষ্টান্ন মনের সুখে উপভোগ করে !
কিন্তু আবার মুশকিল শুরু হল | এবার একে একে লোকজন এসে ডেকে নিয়ে যেতে লাগলো গোপাল কে | "একটিবার আমার বুড়ো বাবার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিক গোপাল.... বাবা কে বাঁচানো যাবেনা..." রমেন একদিন সন্ধ্যেবেলায় মহিম কে চা দোকানে বাইরে পাকড়াও করে বলল | রাণু শুনে রেগে আগুন | "কী ভেবেছে ওরা আমার ছেলে কে? এত বারণ সত্ত্বেওআমার কথা শোনে না কেন এরা? গোপাল গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই কি সবাই বেঁচে যাবে, সুস্থ হয়ে উঠবে? সত্যিকারের শ্রীকৃষ্ণও কি তা করেন? করেন না! যার যাওয়ার সে তো যাবেই ! মাঝখান থেকে আমার ছেলে কে নিয়ে হাজার রকম সমালোচনা !"
মহিম তার স্ত্রী কে শান্ত করে বলল, "শোন, শোন, যেখানে লোকে নিয়ে যায় যাক | একটা জিনিস তো মানো... মানুষ ইশ্বরে বিশাস করে ঠিকই, কিন্তু সে বিশ্বাস তো হাজার বার ধাক্কা খাওয়ার পর ও করে? ওরাও জানে গোপাল যাছে মানেই যে তারা যা চাইছে তাই হবে, তা একেবারেই নয় ! কিন্তু এটা ওদের মনের সান্তনা... সব ওষুধ সব আশা ভরসা যেখানে শেষ সেখানে দাঁড়িয়ে তোমার ছেলে | তাতে যদি তারা একটু সামান্য সান্তনা পায়, পাক | তাতে বাধা দিওনা |"
গোপাল সেদিন রাতে রমেনের বাড়ি গিয়ে তার বুড়ো বাবার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়েছিল অনেকক্ষণ | সে তো বুঝতেও পারছিল না তাতে আদৌ লাভটা কী হবে | "সব চেষ্টাই আমরা করেছি গোপাল | তুমি ভয় পেওনা কিন্তু | এটা তোমার পরীক্ষা নয় | তুমি যে এসছ এতেই আমরা খুশি | তুমি শুধু একটু চেষ্টা কর যাতে বাবা যেন একটু সুস্থ বোধ করেন |"
রমেনের বাবা সেই রাতেই মারা গেলেন | গোপালের মন খারাপ হয়ে গেল | মিষ্টি আসা বন্ধ হতে পারে সেই ভয়ে না; সে যে মনে প্রাণে চেয়েও সবাইকে সুস্থ করে তুলতে পারবেনা সেটা উপলব্ধি করে | রাণু ভাবল এবার হয়ত লোকের পাগলামো কিছুটা কমবে, কিন্তু তা হল না | লোকের আশা বন্ধ হল না | কারুর ছেলে, কারুর মা, কারুর ছাগল.... ডাক পড়া থামলই না |
গোপালের যখন বারো বছর বয়স, তখন লোকের পাগলামো কিছুটা কমল | দেরী করে হলেও মানুষ বুঝল যে হয়ত তারা একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিল | এখন কথায়-কথায় কেউ গোপাল কে ডাকে না, বা জন্মাষ্টমী হলেই সবাই তার বাড়ি এসে হুল্লোড় ও করে না | কিন্তু গোপালের নীল গায়ের রঙের জন্যেই হোক বা তার নিজেস্য গুণের জন্যেই হোক, লোকে তাকে সত্যই ভালবাসে | সেই ভালবাসা দরকারের পর ফুরিয়ে যাবার ভালবাসা একেবারেই নয়, কোনওদিনই তেমনটা ছিলও না | তার পড়াশোনা ভালোই চলছিল, আর তার সঙ্গে খেলা-ধূলো ও | গ্রামের ফুটবল টিমের গোলকিপার সে | বড় দাদারা যখন খেলে তখন তারাও গোপালের গোলকিপিং এক রকম মুগ্ধ হয়েই দেখে | "খেলে যা গোপাল, একদিন আমাদের ক্লাবের ক্যাপ্টেন হবি তুই !" তারা বলত |
একদিন স্কুল থেকে হেঁটে ফিরছিল গোপাল | আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে | জোরে জোরে পা চালিয়েও ঠিক সময় পৌঁছতে পারলনা সে | ছাতাটা মা বার বার করে নিয়ে যেতে বলেছিল কিন্তু শেষমেষ ভুলেই গিয়েছিল সে | একটা জোর থাপ্পড় আর ছুলির মুঠি ধরে দু-চার বার ঘোরানোর মধ্যে কোনটায় লাগবে কম সেই ভাবতে ভাবতে যখন গোপাল ঘরে ঢুকল, তখন দেখল তার বাবার সামনে চেয়ারে একজন বসে |
"আরে ! কানাই কাকা..." বলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করতে গেল গোপাল | কানাই চট করে তাকে বাধা দিয়ে পাশে বসতে বললেন | "ভালো আছো গোপাল?"
গোপাল হেসে মাথা নাড়ল |
"তুমি তো পুরো ভিজে গেছ! যাও আগে জামা কাপড় ছেড়ে শুকনো হয়ে এসো, নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে |"
যাক, কানাই কাকার জন্য চুলের মুঠি বা গালে থাপ্পড় দুটো থেকেই রেহাই | রাণু গামছা দিয়ে তার গা ও মাথা ভালো করে মুছতে লাগলো |
"আমি জানি আপনি না করবেন না ," কানাই চায়ে চুকু দিতে দিতে বলল |
"কিন্তু ব্যাপার কী সেটা তো বললেন না এখনো ," মহিম বলল |
মিনিট পাঁচেক পর গোপাল ঘরে এসে তার বাবার পাশে বসল | কানাই তার দিকে একটা ক্যাডবেরির চকলেট এগিয়ে দিল | গোপাল হাসিমুখে 'থ্যান্ক ইউ!' বলে সেটা নিয়ে খুলতে যাছিল, কিন্তু রান্নাঘরে থেকে মা তার দিকেই চেয়ে আছে দেখে চকলেট-এর প্যাকেটটা না খুলে এক পাশে রেখে দিল |
"মহিম বাবু, আপনাকে পুরোটা খুলেই বলি | আমার মায়ের বয়স আটাত্তর | গত এক সপ্তাহ ধরে মা সয্যাশায়ী | মানে কোনো বড় রকমের রোগ যে হয়েছে তা না... বয়স হলে শরীর যেমন ভেঙ্গে যায় এও তেমন | গত সোমবার হঠাৎ করেই মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে গেল | যাই খাচ্ছে বমি করে ফেলছে | ডাক্তাররা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন এই অবস্থায় মা কে বাড়িতেই রাখতে, হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না | এখন শুধুই অপেক্ষা | সত্যি বলতে মায়ের যা বয়স হয়েছ, ভগবানের কাছে আমার একটা প্রার্থনা, মা যেন কোনো রকম কষ্ট না পেয়ে চলে যেতে পারে | এর বেশি কিছুই চাইনা বা আশা করি না |"
মহিম বুঝতে পারল না কানাই আসলে ঠিক কী চাইছে |
"আমি গোপাল কে আমার সঙ্গে আজ আমার বাড়ি নিয়ে যেতে চাই |"
মহিম এবার একটু ইতস্থত করে বলল, "কিন্তু কানাই...মানে তুমিই তো বললে...যে ডাক্তাররা বলেছে..."
"আপনি ভুল বুঝলেন মহিম মশাই | আমি গোপাল কে একবারও বলছিনা যে আমার মা কে একেবারে সুস্থ করে তুলুক | সে জিনিস হবে না | সে জিনিস নিয়মের বিরুদ্ধে | কিন্তু গোপালের যা সমস্ত গল্প শুনেছি... আমি শুধু চাই ও একটিবার গিয়ে আমার মায়ের পাশে থাকুক | আমার মা গোপাল কে, মানে শ্রীকৃষ্ণ কে একরকম নিজের সন্তানের মত ভালবাসে | আমাদের বাড়িতেও গোপাল আছে | মা রোজ তাকে স্নান করিয়ে সাজিয়ে ঠাকুর ঘরে তার বিছানায় শুইয়ে আসে | আমি গোপাল কে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই কারণ...আমার স্ত্রী আজকেই কলকাতার হাসপাতাল থকে ছাড়া পেয়েছে | আমিও সেখানেই ছিলাম | ঈশ্বরের আশির্বাদে কয়েক দিন আগে আমাদের কন্যা সন্তান জন্মেছে... একেবারেই সুস্থ..."
"বল কী হে! এই কথাটা এতক্ষণ বলনি?"
কানাই হেসে বলল, "আমার মায়ের খুব সখ তার নাতি বা নাতনি কে একটিবার দেখে যাওয়ার | কিন্তু আজ মায়ের শরীরটা আরো খারাপ হওয়ায় সকালে আমি কলকাতা থেকে ফিরে আসি, আর এসে জানি ডাক্তার বলে গেছেন আজ রাতেই হয়ত মা...." এই পর্যন্ত বলে কানাই থামল | তারপর পাসে রাখা গেলাস থেকে দু ঢোক জল খেয়ে বলল, "আমি জানি শুধুমাত্র মানুষের বিশ্বাসের জোরে অনেক সময় অনেক রকম মিরাকেল হয়ে থাকে | তাই আমি ভাবলাম গোপালের পাশে থেকে মা যদি অন্তত একটা দিন... মানে... তাহলে কাল সকালেই আমি শিউলি কে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে এখানে আসতাম | ওর এখন কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়া খুবই প্রয়োজন, কিন্তু ও নিজেই এক রকম জেদ করছে যে মা কে একটিবার অন্তত আমাদের মেয়ের মুখ দেখাবে.... "
এর পর না করার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা | মহিম বলল গোপাল যাচ্ছে যাক, কিন্তু সে প্রার্থনা করবে তার ইচ্ছে যেন পূর্ণ হয় |
"বাবা, যদি আমি না পারি..." গোপাল কানাইয়ের গাড়িতে ঢোকার আগে তার বাবা কে জিজ্ঞেস করল | মহিম হেসে বলল, "তোকে কিছু করতে হবে সে কথা কে বলল? তুই শুধু গিয়ে পাশে বসবি | ঠাকুমা যদি গল্প করে, গল্প করবি |" ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মহিম | বাবা মা কে টাটা করে গাড়িতে উঠলো গোপাল | "আপনার ছেলে রাতে আমার বাড়িতেই খেয়ে নেবে, আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না | কাল সকালে আমি নিজে এসে ঘরে ছেড়ে দিয়ে যাব ওকে | আমার ফোন নাম্বার ও আপনার কাছে আছে |"
গোপাল যখন পৌঁছলো তখন কানাইদের ঘরে বেশ কিছু লোক | সবাই যেন তার দিকেই চেয়ে আছে... সবার চোখেই যেন আশা... কিসের আশা? সে কিছু জাদু করবে তার আশা? বুকটা নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো গোপালের | এত লোকের আশা ভঙ্গ হলে তার জন্যে কি দায়ী হবে সে ?
গোপাল সারা সন্ধ্যা ঠাকুমার বিছানয় তাঁর পাশেই শুয়ে বসে কাটাল, কিন্তু ঠাকুমার ঘুম ভাঙ্গলো না | রাতের দিকে ঠাকুমার ঘুম যখন ভাঙ্গল, তখন পাশ ফিরে তাকিয়ে গোপাল কে দেখেই হকচকিয়ে উঠলেন | ক্ষীন স্বরে বললেন, "গোপাল?"
"হ্যাঁ ঠাকুমা, আমি | কানাই কাকা আমায় নিয়ে এলো | তুমি কেমন আছে৷ এখন?"
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ গোপালের দিকে চেয়ে রইলেন | তার ঠোঁটের কোণে হাসি | তারপর বললেন, "এখন ভালো বোধ করছি দাদুভাই |" তারপর তিনি ইশারা করে বাকিদের ঘরে থেকে চলে যেতে বললেন | একে এক সবাই বেরিয়ে গেল |
"ঠাকুমা, তোমাকে কিন্তু কিছুদিনের জন্যে ভালো হয়ে উঠতে হবেই |"
ঠাকুমা হেসে বললেন, "তাই নাকি? কানাই বলেছে?"
"কানাই কাকার মেয়ে হযেছে | তুমি দেখবেনা?"
"দেখার তো...খুব...খুব ইচ্ছে গো দাদুভাই.... কিন্তু..."
"কিন্তু ?"
বৃদ্ধা খুক খুক করে কেশে বললেন, "কিন্তু আমার যে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে | আমার গোপাল যে আমায় নিতে এসেছে |"
"এমা ... না না আমি তোমায় নিতে চাইনা এখন!" গোপাল প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো ! "আমি চাই তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো ঠাকুমা!"
ঠাকুমা হেসে বললেন, "মানুষের আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা... ঠাকুরের হাতে দাদুভাই.... কিন্তু তুমি এসেছ, আমার যে কী...কী আনন্দ হচ্ছে...."
কঙ্কালসার হাত উঠিয়ে ঠাকুমা চেষ্টা করলেন গোপালের মাথায় হাত বোলানোর, কিন্তু পারলেন না | গোপাল ঠাকুমার হাত তুলে নিজের মাথায় রেখে বলল, "আমায় আশির্বাদ কর ঠাকুমা... কোনওদিন যেন কারুর ক্ষতি না করি..."
"ওমা ! এ কেমন কথা দাদুভাই ? ক্ষতি করবে কেন?"
"লোকে ভাবে আমি কৃষ্ণ... কিন্তু আমি তো ভগবান নই! তাও লোকে এরম আশা করে কেন ? আমি তারপর সবাইকে খুশি করতে পারি না, আর আমার খুব খারাপ লাগে..."
"তোমায় সবাই খুব জ্বালায় না? একটা কথা মনে রাখবে দাদুভাই | ইশ্বর কিন্তু সবার বুকেই রয়েছেন | যার গায়ের রঙ তোমার মত নীল নয় তাদের বুকেও রয়েছেন | তুমি যে মিথ্যে কথা বলার আগে ভয় পাও, তার নামই ঈশ্বর | তুমি যে কোনো কাজ করার আগে বাবা মা কী ভাববে সেটা ভাব, সেই বিবেকের নামই ঈশ্বর |"
গোপাল শুনে একটু যেন হালকা হল | ঠাকুমা বললেন, "তোমায়....তোমায় আজ আমি শুধুই গল্প করার জন্য ডেকেছি | কিচ্ছু করতে হবেনা তোমাকে | তুমি শুধু...শুধু আমার পাশে বসে থাকো কিছুক্ষণ... তোমার কানাই কাকা কেও বল আমার কাছে এসে বসতে |
কানাই এ ঘরে আসতে ঠাকুমা বললেন, "আয় খোকা, বস আমার পাশে | আজ তোদের সাথেই...গল্প করব আমি... আমায় কেউ আটকাবি না... "
"কিছু খাবে মা? অল্প একটু..."
"না রে... তোরা কথা বল... আমি একটু শুনি | বড় হালকা লাগছে এখন..."
গোপাল নিজে থেকেই ঠাকুমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আর মনে মনে ঠাকুর কে ডাকলো, "ঠাকুর, ঠাকুমা যেন ওঁর নাতনির মুখ দেখতে পায়... আর কিছুটা সময় দিয়ে দাও ঠাকুর.... কিছুটা..." গোপাল ঠাকুমার মাথায় হাত বোলাতে থাকে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন |
***
কানাই কাকা তার মেয়ের নাম রেখেছে সুবর্ণা | যথার্থ নাম | দুধে আলতায় গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ... | ঠাকুমা যখন প্রথম দেখলেন নাতনি কে, তাঁর দু চোখ জলে ভরে গিয়েছিল | আর সারা মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছিল অপরিসীম তৃপ্তির এক হাসি |
হ্যাঁ, ঠাকুমা এক দিন নয়, আরো কয়েক সপ্তাহ বেঁচে ছিলেন | দু হাত ভরে ছেলে কে, বৌমা কে আর নাতনি কে আশির্বাদ করে গেছেন তিনি | ডাক্তার এসে পরের দিন ঠাকুমাকে দেখে এতটাই স্থম্বিত হয়ে গিয়েছিলন যে মিনিটে দশেক কোনো কথায় বলতে পারেননি | শেষে বলেছিলেন, "ডাক্তারি প্রফেশনে মিরাকেলের কথা অনেক শুনেছি কিন্তু স্বচক্ষে এরম একটা ব্যাপার দেখার অভিজ্ঞতা... মানে... পরশু দিন তো ওনার পাল্স প্রায় পাওয়াই যাচ্ছিল না.... এরম হঠাৎ করে কী করে...."
"জানিনা ডাক্তার বাবু | বোধ হয় আমার নাতনির কপালে ঠাকুমাকে দেখাটা লেখা ছিল," কানাই বলেছিল |
ডাক্তার আবার কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন | এই জিনিসের আশা যে তিনি ঘুণাক্ষরেও করেননি সেটা তার মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল | এর কয়েক সপ্তাহ পর কোনো রকম কষ্ট না পেয়ে ঘুমের মধ্যেই ঠাকুমা চলে গেলেন |
কয়েক মাস পর একদিন সকালে কানাই কাকা, কাকিমা আর তাদের মেয়ে কে নিয়ে গোপালদের বাড়িতে এলো | সঙ্গে এক হাঁড়ি মিষ্টি | "শুধু মিষ্টি খেলেই চলবে না, আমরা নেমন্তন্ন করতে এসেছি আপনাদের," শিউলি কাকিমা হাসি মুখে বলেছিল | কানাই কাকা বাবার হাত ধরে বলেছিল, "কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার মত ভাষা আমার জানা নেই মহিম মশাই | শুধু এইটুকু বলতে চাই, আমরা যখনই নিজেদের মেয়ের জন্য ভগবানের কাছে কিছু চাইব, সঙ্গে এও প্রার্থনা করব যেন আপনার ছেলে এভাবেই সারা জীবন মানুষ কে মনের জোর দিয়ে যায়... সারাজীবন সে যেন সুস্থ থাকে, সুখী হয়...|"
দেখতে দেখতে গোপাল বড় হয়ে গেল | কিন্তু সেই রাত্রের ঘটনা এখনও তার মনের মধ্যে একেবারে স্পষ্ট | ঠাকুমার সেই হাসি তার স্মৃতির খাতায় কেউ যেন এমন এক রঙ দিয়ে এঁকে রেখেছে যা সময়ের স্রোতে কখনই মুছে যাবে না | এখনো মাঝে মাঝে সে ভাবে, তার কি সত্যিই কোনো রকম দৈব ক্ষমতা আছে? কোনো ঐশ্বরিক গুন কি সত্যিই আছে তার ছোঁয়ায়? সেদিন যা হয়েছিল, সেটা কি ঠাকুমার মাথায় তার হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য হয়েছিল? নাকি নিজের নাতনি কে একটিবার দেখার তীব্র আকাঙ্খাই মৃত্যু কে কিছুটা দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল?
সেই রহস্য রহস্য় হয়েই থেকে গেল | কিন্তু গোপালের এটাই ভেবে ভালো লাগে যে সেই ধাঁধার সমাধান খোঁজার প্রয়োজন আজ অবধি কেউই বোধ করেনি |
