অদ্ভুত সেই দিনটা
অদ্ভুত সেই দিনটা


জানুয়ারির কনকনে ঠান্ডা বইছে, আবার তার সঙ্গে অকাল নিম্নচাপের মিশেল ঘটেছে। ছাতা মাথায় দিয়ে মায়ের সাথে আসছে প্রবীর। আজ্ঞে, হাই স্কুলে ভর্তি হতে। স্কুলের নাম ক্ষিতীশপুকুর জ্ঞানমন্দির (উঃ মাঃ)। এলাকার নামী স্কুল, লটারিতে নাম না ওঠায় প্রবীরকে ডিসেম্বরের বদলে জানুয়ারিতে ভর্তি হতে হয়। প্রবীরের কাছে এ-সব কিছুই নতুন। বছরের শুরুতেই তার সঙ্গে যার পরিচয় ঘটে ---তা হলো 'মনিটর প্রথা'; শিশুমনের কাছে এটা শুনতে অনেকটা নিষ্ঠুর 'দাস প্রথা'-এর মতো লাগলেও এ জিনিস সম্পূর্ণ আলাদা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক সেকশনে চারজন ছাত্র নিযুক্ত থাকত, যারা নাকি ক্লাস পরিচালনায় স্যার-ম্যামদের সাহায্য করত---তবে এ সর্বৈব সত্য নহে! যখন প্রবীর প্রথম এই স্কুলে পা রাখল, সেদিন সে তার ব্যাগ একদম ফার্স্ট বেঞ্চে কোনায় রেখেছিল। প্রেয়ার সেরে আসার পর তো তার চক্ষু চড়কগাছ। তার ব্যাগের কোনো অস্তিত্ব নেই, সেই স্থানে অন্য করোর ব্যাগ! অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে দেখল যে তার ব্যাগ একদম লাস্ট বেঞ্চের নীচে লুটিয়ে আছে। আবার, ব্যাগের বোতল ভেঙে চারিদিক জলে জলময়---বোতলের ছিপিও উধাও! প্রবীর তো বেজায় রেগে যায়। আগে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় কেউ তো তার ব্যাগ এমনভাবে ছুড়ে ফেলে দেয়নি, ফলে রাগ আসাটাই স্বাভাবিক। তখন সে তার নিজের ব্যাগটা নিয়ে আবার সেই ফার্স্ট বেঞ্চে অন্য ব্যাগটা সরিয়ে সেই জায়গায় রেখে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে এক মূর্তিমান সাহেব এসে তার ব্যাগটা আবার মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল এবং বলল-"ওই! কে রে তুই? এখানে ব্যাগ রাখছিস কেন?" প্রবীর তখন জবাব দিল-"আমি সবচেয়ে আগে এসে এখানে আমার ব্যাগ রেখেছি। তুমি কেন আমার ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছ?" "বাহ্! 'তুমি' করে বলছিস। ভালোই তো সন্মান দিয়ে কথা বলবি। জানিস আমি কে? এই সেকশনের থার্ড মনিটর! আমার কথা শুনে চলবি, নইলে ম্যামের কাছে কাছে একদম কেস দিয়ে দেব।"-মনিটরটা বলল। এভাবে তাদের দুজনের মধ্যে হাতাহাতি বেঁধে গেল। যখন সে দেখল প্রবীরের সঙ্গে পেরে উঠবে না, তখন সে তার হৃষ্টপুষ্ট দেহবিশিষ্ট সাঙ্গোপাঙ্গদের ডাকল। তাদের বডির মাসেল-টাসেল দেখে ছোটখাটো প্রবীরের আর এগোনোর সাহস কুলোয় নি। তাই সে তার নিজের ব্যাগ নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল। ফলে, শেষমেষ লাস্ট বেঞ্চেই তার ঠাই হলো। এতেই শেষ নয়; প্রবীর আরও বুঝতে পারে যে, এইসব মনিটররা যতটা নিষ্ঠুর, ততটাই নিষ্ঠুর ছিল এদের 'অ্যাসিস্টেন্ট'-রা। তাদের পোস্ট আসলে 'অফিসিয়াল' নয়; যে যত মনিটরদের বিশ্বস্ত হতে পারত, তারাই তো অ্যাসিস্টেন্ট। এরা নাম লেখার কাজ করত---মানে যারা ক্লাসে পড়াশোনার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত, এরা তাদের নাম লিখে মনিটরদের কাছে জমা দিত এবং মনিটরেরা তা স্যার-ম্যামদের কাছে জমা দিত। কিন্তু প্রবীরের মতে এসব আসলে ভাঁওতাবাজি ---যাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাদের নাম তো লিখবেই না, বরং যাদের সাথে শত্রুতা আছে, আজ্ঞে যাদের সঙ্গে প্রায়শই ঝগড়া হয়, তাদের নাম তো ফলাও করে লিখবে। এদের জন্য প্রবীরের ক্লাসে ঠিকভাবে বসবারও জো নেই। পিছনের বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসলেই, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে উঠত-"তুই আবার হেলান দিয়েছিস! দাঁড়া, তোর নামটা লিখতে হবে।" আবার করোর সঙ্গে শুধুমাত্র 'কথা' বললেও তারা বলে উঠত-"অ্যাই! গল্প করছিস কেন? দাঁড়া তোর নামের পাশে দুটো স্টার বসাচ্ছি।" এমনকি টয়লেট যেতে হলেও এদের পারমিশন লাগবে। এদের সঙ্গে সবসময় সমঝোতা করে চলতে হয়, শত্রুতা করলেই হুমকি আসে-"একদম বেশি কথা নয়! নইলে কেস দিয়ে দেব.... ম্যামকে বলে 'ফরম্যাটিভ'-এ নাম্বার কমিয়ে দেব।" আসলে মনিটর ও তাদের স্বনামধন্য অ্যাসিস্টেন্ট উভয়ই এর জন্য দায়ী। এই অ্যাসিস্টেন্টর
া হলো মনিটরদের পা-চাটা 'পোষ্য সারমেয়'-র মতো। মনিটরদের তুষ্ট করাই হলো এদের একমাত্র প্রধান উদ্দেশ্য। বিনিময়ে তারা ক্লাসে নামমাত্র কিছুটা প্রতিপত্তি লাভ করত। তবে, তাদের সেইদিনের সেইসব অতিরঞ্জিত হুমকিগুলোর সত্যতা যে কতখানি --- প্রবীর তা ভালোই বুঝতে পারে। কারণ "অতি লোভে তাঁতি নষ্ট"। সেই সময়কার আর এক আকর্ষণ ছিল প্রবীরদের স্কুলের পিকে স্যার ---সম্পূর্ণ নাম প্রদীপকুমার মিত্র। তিনি একটু আজব ধরনের ছিলেন। মানে, উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট, বেশ মোটাসোটা, ব্ল্যাক-কমপ্লেক্সনড, তার উপর চোখে মোটা ফ্রেমের গোল-গোল পিংক কালারের চশমা। অর্থাৎ, এক অদ্ভুত ব্যক্তিত প্রকাশ পেত। তিনি বেশ মোটাসোটা হলেও ভালোই ফিজিক্যাল এডুকেশনের ক্লাসটা নিতেন। তবে, প্রবীরের মতে সমস্যাটা ছিল তার ইতিহাস ক্লাস। আসলে সেই সময়ে বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভূগোল ---এই তিনটি বিষয়ের একটাই বই ছিল "আমাদের পরিবেশ"। এই বইতে বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে নানা কনভারসেশনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। এখানেই তো আসল বিপত্তি। মানে তিনি প্রশ্ন করেতেন, কে কী বলেছিল? সৌভিক কী বলেছিল? তার উত্তরে সপ্না কী বলেছিল? আজ্ঞে হ্যাঁ! ফলে প্রবীরেরা তাঁর ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতাম। কারণ, পড়া না পারলেই ক্লাসের বাইরে গিয়ে কান ধরে উঠবস! সেই দিনের কথা এখনো প্রবীরের মনে আছে। একদিন প্রবীর পিকে স্যারের পড়া করে আসে নি, কারণ তাঁর ক্লাস একদম লাস্ট পিরিয়ডে। প্রেয়ার সেরে এসে প্রবীর আর এক কাণ্ড দেখল ---ফার্স্ট পিরিয়ডে হেড স্যার এসে একটা সুখবর দিয়ে গেলেন-"আচ্ছা, তোমাদের আজ টিফিনের পর ক্লাস হবে না। বাইরের কলেজের কয়েকজন ছাত্র আসবে "দূষণ ও পরিবেশের অবক্ষয়"-এর উপর ডিমনেস্ট্রশন দিতে। তোমরা টিফিন পিরিয়ডের পর হলরুমে আসবে। সেখানে ডিমনেস্ট্রশনটি প্রদ্রর্শিত হবে।" প্রবীর তো আল্হাদে আটখানা! সবাই তো চেঁচিয়ে উঠল-
"হুররে....পিকে স্যারের ক্লাস আর করতে হবে না।" ফলে ছাত্ররা যথারীতি টিফিন খেয়ে হলঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। কিন্তু, এ তো তিরে এসে তরী ডুবল। হেড স্যার আবার এসে বললেন যে-"কলেজের ছাত্ররা বিশেষ কারণবশত আজ আসতে পারবে না। তোমরা ক্লাসে যাও, যেভাবে ক্লাস চলছিল, সেইডাবেই চলবে।" এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। ফলে, সবাই আবার ভয়ে তটস্থ হলো। যেহেতু সবাই সবার ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিল, প্রবীর তার ব্যাগ নিয়ে আগে ক্লাসে গিয়ে মাঝখানের একটা বেঞ্চে জায়গা রাখে। কারণ, এতোদিনের অভিজ্ঞতায় সে লক্ষ্য করেছে যে, পিকে স্যার পড়া ধরা শুরু করেন হয় একদম ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে নয় তো একদম লাস্ট বেঞ্চ থেকে। তাই, যতক্ষণে প্রবীরকে পড়া ধরবে, ততক্ষণে ছুটির ঘণ্টা পড়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর পিকে স্যার ক্লাসে আসলেন এবং স্বভাবত বললেন-"দেখি আজ কোন কোন লাড সাহেবকে বাইরে বের করা যায়।" এই বলে তিনি আচমকাই প্রবীরের বেঞ্চ থেকে পড়া ধরা শুরু করলেন এবং যাকে ধরলেন, তার একজন পরেই প্রবীর ছিল। প্রবীরের তো অবস্থা টাইট! ঠিক সেই মুহূর্তে স্কুলের একজন স্টাফ ক্লাসে এসে প্রবীরের নাম ধরে ডেকে বলল-"এখানে প্রবীর কে? তার বাবা তাকে নিতে এসেছে। ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে হেড স্যারের রুমে এসো।" এবার শুধুমাত্র প্রবীরই আহ্লাদে আটখানা। তাড়াতাড়ি ব্যাগ-পট্টর গুছিয়ে ক্লাস থেকে কেটে পড়ে। নীচে নেমে প্রবীর দেখল হেড স্যারের রুমে তার বাবা বসে আছে। কিছু বলার আগেই তার বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল-"তোর দাদু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে!" প্রবীরের যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেল; ক্ষণিক সময়ের সমস্ত আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেল। যে মানুষটার সাথে সে সকালে কথা বলে এসেছিল, তার মৃত্যুর খবর পেয়ে সে কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। সেইদিনটায় প্রবীরকে বরং খুব দুর্ভাগা মনে হচ্ছিল।