পলাশ মাহাত

Children Stories

3.2  

পলাশ মাহাত

Children Stories

আমি ইস্কুল যাব না ( শারদ সংখ্যা )

আমি ইস্কুল যাব না ( শারদ সংখ্যা )

9 mins
431


(১)

সকালের চা জল খেয়ে আবার দু- তলায় ওঠে গেল মনোহর । তখনও অঘোরে ঘুমাচ্ছে অয়ন আর অবন্তিকা । মনোহরের ছেলে , মেয়ে । অবন্তিকার বয়েস ছয় বছর , অয়নের চার । অবন্তিকা একটা প্রাইভেট ইস্কুলে পড়ে । এই বছর ওয়ান । অয়ন সবে স্কুল যেতে শিখছে ।

মনোহরের কাজ , সকাল সন্ধে ছেলে মেয়েকে পড়তে বসানো । বিকেলেও একটা প্রাইভেট মাস্টার আছে তাদের ।

পাড়ার ছেলে মেয়ে যখন খেলাধুলার আনন্দে মেতে থাকে তখন এদের ডুবে থাকতে হয় জ্ঞানসমুদ্রে । যা অল্পও ভাল লাগে না । ইচ্ছে করে পাড়ার সংগী সাথীর সংগে একটু আধটু খেলা করতে । নিজের মত করে সময় কাটাতে । কিন্তু উপায় নেই । বারবার বাবা মার কাছে আর্জি জানিয়েও ব্যর্থ হতে হয় ।

মনোহর দোতলায় যেতেই পুস্পিতা কলতলা থেকে থালা বাসন মাজতে মাজতে হাক পাড়ে , ছেলে মেয়েকে ঘুম থেকে ওঠাও । কখন পড়তে বসাবে ?

 মনোহরের বউয়ের নাম পুস্পিতা । বউকে ভয় করে মনোহর । ভয়ে ভয়ে বলে , তারা এখন ঘুমাচ্ছে ।

- ঘুমাচ্ছে বললে হয় ? এখনই তো নটা বেজে যাবে । পড়বে কখন ? শুধু ইস্কুল গেলেই কি পড়া হয় না কি ?

মনোহর ছেলে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে । আঃ কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে মেয়ে দুটো । কী সুন্দর মুখ , যেন ভোরের শিশির স্নাত পবিত্র ফুল । কোন পাপ নেই এই মুখে । এই মুখ জানেই না বাস্তবতার বিরুদ্ধে কি কঠিন সংগ্রাম করতে হয় । কত ক্ষত বিক্ষত হওয়ার মুহূর্ত , জ্বালা যন্ত্রনার লড়াই অপেক্ষা করছে তাদের জন্য । ভাবতে ভাবতে পিতৃস্নেহ উথলে ওঠে মনোহরের বুকে । ইচ্ছে করে না ছেলেমেয়ের ঘুম ভাঙাতে । তবু না ডেকেও যে উপায় নেই । আস্তে করে ডাকে মনোহর , এই বাচ্চাগুলো ওঠ রে , কতক্ষন সকাল হয়েছে । আর কত ঘুমাবি , ওঠ ?

অবন্তিকা গা মোড়া দিতে দিতে ওঠে । আর ওঠেই বলে , বাবা আজ আমি ইস্কুল যাব নাই ।

- কেন , মা আমার , যাবি না কেন ?

- রোজ রোজ যেতে কি আর ভাল লাগে ।

- ইস্কুল না গেলে বাড়িতে কি করবি ?

- আজ শুধু খেলব । আমি তুমি আর অয়ন ।

- ইস্কুল না গেলে মা বকবে । তাছাড়া সারা দিন কি খেলা যায় ?

বাপ –বেটির গল্প কলতলা চলে যায় পর্যন্ত । শুনে পুস্পিতা বলে , অবন্তিকাকে নিচে পাঠাও , ব্রাশ করবে ।

 মার গলা শুনে অবন্তিকা মনোহরকে শক্ত করে ধরে । বলে , বাবা তুমি বলে দাও আমি ইস্কুলে যাব নাই ।

মনোহরও বলতে পারবে না সেটা । সে -ও শুধু মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে । মেয়ের অসহায় পাংশু বর্ণ মুখ দেখে দয়া আসে তার । বলে , ঠিক আছে , পরে বলে দেব তোর মা’কে । এখন তুই যা মুখ ধুবি ।

অবন্তিকা অনিচ্ছুক মনে মুখ ধুতে নিচে নেমে যায় । তারপর চা রুটি খেয়ে আবার উপরে আসে দোতলায় , বাবার কাছে । এসেই ওই এক আবদার , বাবা আজ আমি ইস্কুল যাব নাই ।

- কেন ? যাবি না কেন ?

মেয়ে আর মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না । হয়ত জানে কেন তার স্কুল যেতে মন করে না ।

মনোহর জিগ্যেস করে , ইস্কুলে গিয়ে পড়তে পারিস না ?

মেয়ে মাথা নাড়ে ।

বাবা আবার বলে , মাস্টার মারে বুঝি ?

এ বারও মেয়ে নাড়ে ।

- তবে যাবি কেন? 

মেয়ে অসহায় ভাবে বলে , রোজ রোজ ভাল লাগে না । কত ছেলে কত কামাই করে । আর তোমরা আমাদের একদিনও কামাই করতে দাও না । রোজ রোজ যেতে বলো । একদিন না গেলেও কিছু হবে না ।

- তখন যে পিছিয়ে যাবি মা । অন্য কেউ ফার্স্ট হয়ে যাবে ।

- কেউ ফার্স্ট হতে পারবে না । কেউ আমার অত পারে না । জানো বাবা , মাস্টার যখনই আমাদের অঙ্ক করতে দেয় না ,তখন আমি সবার আগে খাতা দেখায় । আর আমার সব অঙ্ক রাইট হয় । 

বলতে বলতে হাতেও রাইট চিহ্ন এঁকে দেখায় অবন্তিকা । কিন্তু তখনও চলতেই থাকে তার মুখ । বলে , মাস্টার আমাকে বলে গুড গার্ল ।

- সে তো বলবেই । তুই পারিস কত ! যারা পারে তাদের মাস্টার কেন সবাই বলবে গুড গার্ল । আর এই জন্য তো রোজ রোজ ইস্কুল যেতে হয় । না গেলে পিছিয়ে যাবি মা ।

 ইস্কুল যাওয়ার কথা শুনলেই অবন্তিকার মুখ চোখ দুখে ভারাকান্ত হয়ে যায় ।

গেল বছর অবন্তিকা আপার থেকে ওয়ানে ওঠে । প্রথম হয় । বাংলায় একশোর মধ্যে একশোই পায় । গনিতে নব্বই , ইংরাজিতে পচ্চানব্বই । জি কে ‘তেও নব্বইয়ের ঘরে । মোট কথা , তিরানব্বই পার্সেন্ট নাম্বার পেয়েছে অবন্তিকা , তবু মনোহরের মনঃপূত রেজাল্ট হয়নি । শুধু বাংলায় একশো পেলে চলবে না । গনিতেও পেতে হবে , ইংরাজিতেও । মেয়ের এমন রেজাল্ট হওয়া চাই যেন লোকে শুনে প্রশংশা করার সংগে সঙ্গে বলে , আদর্শ বাবার মত দায়িত্ব পালন করছে মনোহর। ছেলে মেয়েকে তৈরি করছে জালিম পেয়াদার মত ।

মনোহরের শিক্ষাগত যোগ্যতা বি এ পাস । সাধারন পাস । তাই কোন কম্পিটশনে যেতে পারেনি । চাকরি খরার বাজারে তাই একটা কাজ জোটাতে পারে নি । দালালদের পাল্লায় পড়ে কিছু টাকাও গেছে চাকরির আশা । শেষে হতাশ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । কিন্তু স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি । ছেলে মেয়েও এখন তার স্বপ্ন । নিজের মত শুধু সার্টফিকেট পাওয়া পাস করাবে না নিজের ছেলে মেয়েকে । প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম করাবে । যা কমপিটশনের যুগ তাতে পাস সার্টিফিকেটের কোন মূল্য নেই । এখন পার্সেন্টেজ চাই । পচানব্বই , আটানব্বই এমন কি নিরাব্বই , তবে দাম । নাহলে মূল্যহীন । সেভাবেই সে ছেলে মেয়েকে তৈরি করতে চাই । সে জন্য পড়াশোনার সংগে কোন আপোস ন্বেই । সে বুঝতে পারে না ছেলে মাথার ধারন ক্ষমতা অত নেই । সব সময় পড় পড় করলে তাদের চাপ সৃষ্টি হয় । মাথা ব্যথা করে । ছেলে মেয়ে চাই আর একটু বিশ্রাম । রবিবার বাদ দিয়েও আর একটা দিনের বিশ্রাম । একটু খেলা ধূলা করতে । নিজের মন ও শরীর ভাল রাখতে । কিন্তু তা বোঝে না মনোহর । হয়ত বা বোঝে । কিন্তু প্রতি ক্ষেতে প্রতিযোগিতার কথা ভেবে আমল দেয় না নিজের ভাবনাকে , আমল দেয় না ছেলে মেয়ের কথাকে । ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করতে হবে । এমন শিক্ষিত , যাতে করে লোকের চোখে ধাঁধা লাগে যায় । লোকে যেন বলে মনোহরের ছেলে মেয়ে জিনিয়াস বটে ।

বাইরে তখন মেঘ করছে । হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে আকাশের গায়ে । সূর্য ঢেকে গিয়ে ছায়া নেমে আসে পৃথিবীর বুকে ।মনোহরদের ঘরের জানাল দিয়ে বন্ধ হয়ে যায় আলো ঢোকা । তাই অবন্তিকার মনে ফূর্তির সীমা নেই । সে ভেবে নিয়েছে জল পড়লে তাকে ইস্কুল যেতে হবে না । কি মজাই না হবে । যা তার বাবা মা দিচ্ছে না সে অপার আনন্দ দেবে এই মেঘ । এই প্রকৃতি তাকে রক্ষা করবে বাবা মায়ের নির্দয অত্যাচার থেকে ।

সে বাবার মুখের চেয়ে বলে , বাবা মেঘ করেছে । যদি জল পড়ে ।

- পড়ুক ।

হাসিতে মুখ ভরে ওঠে অবন্তিকার । হয়ত মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রাথর্না জানায় যেন জল পড়ে । কিন্তু হতভাগি দুঃখী মেয়েটা বোঝে না ওপর বাদল মেঘে জল আসে না , আর এলেও সামান্য । যা তাকে ইস্কুল যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে না ।

অয়নও ওঠে গেছে । ওঠেই সে বাবার আর দিদির মুখের তাকায় । দেখে দিদির মুখ ভার । সে বলে , বাবা দিদি এমন মুখ করে আছে কেন ?

- বলেছে ইস্কুল যাবে না ।

- ঠিক তো বলছে ।

অবন্তিকা ইস্কুল না গেলে সেও পেয়ে যাবে সারা দিনের খেলার সংগী । যা তার কাছে আনন্দের ব্যাপার । 

মনোহর বলে , ইস্কুল না গেলে হয় বাবা । ইস্কুল যেতেই হবে । তোদের খুব খুব পড়া শোনা করতে হবে । অনেক পড়তে হবে । আর পড়ে ভাল চাকরি করতে হবে । আমার মত বেকার থাকলে হবে না । তোরা যদি চাকরি না পাস তবে তোদের ফোনে গেম খেলার জন্য রিচার্জ পর্যন্ত করতে পারবি না । 

আর একটু পরেই নটা বেজে যায় ।  

পুস্পিতা নিচের থেকে তাগাদা মারে , অবন্তিকাকে নিচে পাঠাও স্নান করবে । আর অয়নকে বলো মুখ ধুতে । অয়ন্ও তো কাল ইস্কুল যায়নি । আজ সে-ও ইস্কুল যাবে ।

মনোহর ছেলে মেয়ের দিকে তাকায় । দুজনের মুখে নারাজ ভাব । কেউ চাই না ইস্কুল যেতে ।

মনোহর বলে , তোদের আজ দশ টাকা করে দেব ।

অবন্তিকা বলে , না আমাদের পয়সার দরকার নেই ।আজ আমরা ইস্কুল যাব না ।

- তা কি করে হয় ? দেখ , ইস্কুল না গেলে তোর মা খুব রাগ করবে ।

অয়ন বলে , বাবা তুমি মাকে মারতে পারো নাই ? সব সময় আমাদের ধমকায় ।

- সে তো তোদের ভালর জন্যই ।

আবার অয়ন বলে , এই বার আমাদের ধমকালে তুমি মাকে মারবে । 

- মারতে নেই কাউকে ।

- তাহলে সে দিন কেন দিদিকে মেরেছিলে ।

অয়নের কথা মনোহরের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে । সেই দিন বার বার বোঝানোর পরও যখন অবন্তিকা বুঝতে পারছিল না তখন নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি মনোহর । রাগের বশে মেয়ের গায়ে হাত তুলে । মেয়ে কেঁদেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । সে কান্না দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি মনোহরও । সে-ও ছেলেমেয়ের আড়ালে কেঁদেছিল । অনেকক্ষন ধরে কেঁদেছিল । আর সেই দিন সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোন দিন মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না । তাতে যা হয় হবে ।

তারপর থেকে সে আর হাত তোলোনি । একবার না পারলে মেয়েকে বারবার বোঝাই । তবু না বুঝতে পারে না যখন , তখন রেগে যায় , কিছুক্ষন চুপ করে থাকে , নিজেকে বোঝায় , শান্ত করে । তারপর আবার বোঝানোর চেষ্টা করে ।

 নিচের থেকে আবার পুস্পিতার রাগ ভরা গলা শোনা যায় , অবন্তিকাকে নিচে পাঠাও তো কি ?

অবন্তিকা বাবাকে শক্ত করে ধরে । মুখের দিকে তাকায় ,। মনোহরও চেয়ে থাকে মেয়ের মুখের দিকে । দেখে , মেয়ের মুখে যত ভয় ঠিক ততটায় দুঃখ । আর মুখে ওই এক অভিব্যক্তি বাবা আমি ইস্কুলে যাব না ।

বাবার কাছে সে যেন একদিনের ছূটি চাইছে । বিশ্রাম চাইছে । পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে তার থেকে মুক্তি চাইছে । অবন্তিকা আবার কাতর স্বরে বলে , বাবা শুধু আজকের দিনটা আমাকে যেতে বলো না , আমি কাল থেকে আবার ইস্কুল যাব । প্রমিস বাবা ।

মেয়ের এমন কাকুতি মিনতি শুনে মনোহর আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না । তার চোখের তলায় জল এসে জমা হয় । কিন্তু সে - ও আর বলতে পারে না ,ঠিক আছে মা আজ আর ইস্কুল যেতে হবে না ।

আবার অবন্তিকা বাবার হাতে ঝাকুনি দিয়ে বলে , বাবা বলো না আজ আর ইস্কুল যেতে হবে না । তুমি তো আমার আচ্ছা বাবা । আমার সব কথা শোন , তবে এটা শুনছ না কেন ?

মনোহর অশ্রু গোপন করে বলে , এ কথা বলিস না । এটা আমি রাখতে পারব না ।

তখন অবন্তিকা আর একটা কথাও বলে না । গম্ভীর হয়ে যায় । তার নিজের মনে চলে যায় নিচে । নিজেই কলতলা থেকে জল নিয়ে স্নান করে । তারপর নিজে খাওয়া দাওয়া করে ইস্কুল যাওয়ার জন্য রেডি হয় ।

মনোহর রোজকার মত বাইক নিয়ে বেরয় । মেয়েকে বলে , বাইকে ওঠ মা ।

মেয়ে অভিমানী গলায় বলে , আমি যেতে পারব ।

মনোহরের চোখে জল চলে আসে । এইটুকু মেয়ে , ঘর থেকে একা একা কোথাও বেরুতে চাই না । আজ সেই মেয়ে কত দুঃখে এই অভিমান করছে । নিজেরও কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু মেয়ের সামনে কাঁদতে পারে না । বলে , দেখ মা এমন করিস না ।

মেয়ে আরও অভিমানী গলায় বলে , বাবা তুমি বাড়ি যাও , আমি যেতে পারব ।

মনোহর বাইক থেকে নামে । মেয়েকে কোল তুলে নেয় মেয়ের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও । গালে কপালে চুমু খেতে খেতে আদরে ভরিয়ে দেয় , নানা রকম প্রলোভনের কথা বলে ভোলায় । তারপর বাইকে নিয়ে ইস্কুল পৌছে দেয় । বাইক থেকে নামার পর মনোহর মেয়েকে একটি দশটাকার নোট দেয় ।

মেয়ে আগের অভিমান ভুলে যায় । টাকা নিতে পরম আনন্দে হাসে । হাসতে হাসতে বলে , আমার লক্ষী বাবা ,আমার সোনা বাবা । আমাকে কত ভালবাসে ।

কথা শেষ করে সে ইস্কুল গেটের দিকে ছুটে যায় ।

 মনোহর চেয়ে থাকে একদৃষ্টে ।


Rate this content
Log in