অনুভূতির কবিতা
অনুভূতির কবিতা


ঝুলন্ত কড়িকাঠে ঘুন ধরে গেছে '-মাটির দেওয়ালে রাজত্ব করছে একরাশ আনকোরা উইপোকার ঢিবি,
আমার সেই ফেলে আসা পুরানো বাড়িটা- ,
সামনের বারান্দায় সেই কাঠের বেঞ্চটা রুগ্নাবস্থায় কেমন অনাথের মতো পড়ে আছে -
তাকিয়ে থাকে সবুজ ক্ষেত বরাবর ঐ সামনের রাস্তার দিকে ।
বারংবার আমার মনে হয় সে যেন আমায় বলতে চায় ' আমায় এসে নিয়ে যা ।'
ভগ্ন মৃতপ্রায় বাড়ি টির সদর দরজায় আজও পাহারা রত সেই সাবেকী তালা ।
একদিন যে টালির ছাউনিতে আমাদের মাথা বাঁচত -
আজ সেই টালিগুলোই আশ্রয়হীন হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে আছে ।
কয়েকটি কচি কচি ছেলে মেয়ের সেই লুকোচুরি খেলা বাড়ি টির প্রতিটি আনাচ কানাচ কে এখনও খুব কাঁদায়।
কোনায় কোনায় জমা জলে আমি তার প্রমাণ পেয়েছি ।
সেই তক্তোপোশের ওপর বিছানো মাদুর টা আজ হয়তো বিশ্রীভাবে পচে গেছে,
অথচ একদিন ঐ জায়গাটা ছিল আমাদের ভীষণ প্রিয় --
সন্ধ্যার আড্ডাটা জমে উঠত ঐ তক্তোপোশের ওপরেই ,
আর তার সাথে থাকত মায়ের হাতে বানানো তেলেভাজা আর তেল মাখানো মুড়ি ।
আমচুরের হাঁড়ি গুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে অগুন্তি মাকড়সার জাল ।
আমার সেই পুরোনো বাড়িটা;
পৌষ পার্বণ কিংবা তালনবমীর দিন মা খুড়িমার হাতে তৈরী পিঠে পুলির সুগন্ধে সারা বাড়িটা ম ম করত ।
আমাদের ভাইবোনদের কত না পিঠে চুরির সাক্ষী রান্নাঘরের সেই সিকেগুলো ।
ঝুলন্ত সিকেগুলো আজ হয়তো কোন গভীরে মিশে গেছে ।
পেছনের বারান্দায় স্তূপাকারে জমে থাকা নারকেলের খোলাগুলো থেকে
আজ হয়তো পিঁপড়েরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, বাসা বেঁধেছে বিষাক্ত বিছের দল ।
সামনের ঐ পাতকুঁয়োতে আজও ব্যাঙ পড়ে -- পড়তেই থাকে, উঠতে আর পারেনা -
কারণ দড়ির টান ই তো জলের তলায় হারিয়ে গেছে ।
সেই গোলাবাড়ি গোয়ালঘর আর টোপাকুলের গাছটা আমাদের সেই বাড়িটাকে ঘিরে ঠিক যেন মেলা মেলা খেলত,
টোপাকুলের গাছটা বছর কয়েক আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে,
গোলাবাড়ি আর গোয়ালঘর ভাঙতে ভাঙতে অবশিষ্ট এক টিলার আকার ধারণ করেছে ।
আমার মায়ের বড় প্রিয় সেই হাঁস মুরগির ঘরগুলো আজ সাপের আস্তানা।
আমার সেই পুরোনো বাড়িটা --- আজ একাকীত্বে ধুকছে অল্প নিঃশ্বাসেও ;
আধুনিকতার ছাপ নিয়ে আমরা চলে এলাম বড় রাস্তার ধারে পাকাবাড়ি --
নতুন নতুন আসবাবপত্র, লোহার সিন্দুক থেকে গয়না গুলো তো বের করে নিলাম,
কেবল সিন্দুক টা পড়ে রইল একাধিক অবহেলায় ।
যে বাড়িটা কয়েকটা প্রজন্মকে নিরাপদে একত্রে বেঁধে রাখল বছরের পর বছর --
তাকেই একলা করে চলে এলাম নিঃসংকোচে ।
আমার সেই পুরোনো বাড়িটা -- একবুক হতাশা আর একরাশ নিরাশা নিয়ে জীর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে
উপেক্ষিত অপেক্ষায় আজও দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের না ফেরার প্রতীক্ষায় ।
বাড়ন্ত আগাছা ও বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় খেয়েও এখনও নিঃশ্বাস ফেলছে --
আমার সেই পুরানো বাড়িটা ।