Rangana Chowdhuri

Others

3  

Rangana Chowdhuri

Others

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে ,পড়ুক ঝরে

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে ,পড়ুক ঝরে

6 mins
58


"আচ্ছা দিদি এখন যদি কোন রাজপুত্র এসে এখান তোকে নিয়ে যেতে চায়?" ছোট বোনের কথা শুনে কোয়েনা হো হো করে হেসে উঠলো। 

"ধুর পাগলি মেয়ে,, আমাকে কোন রাজপুত্র নিতে আসবে না।আর এলেও আমি যাবো না।"


কোয়েনার থেকে প্রায় আট বছরের ছোট এই বোন। 

সুবর্ণরেখা ওরফে সুবি।আর ছয় বছরের ছোট ভাই, আকাশ। কোয়েনা র মনে পড়ে,

কোয়েনার বাবা প্রতাপ মিত্র। ছোটখাটো স্পেয়ার পার্টস এর ব্যাবসা করতেন।। আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যেই ওরা তিন ভাই বোন বড়ো হচ্ছিল। নিজেদের বাড়ি, ভালো স্কুল , জামাকাপড়,কোন কিছুরই অভাব ছিল না। 

মাও স়ংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতো,। কোন রকম অশুভ ইঙ্গিত মাকে স্পর্শ করে নি।


 একদিন রাতে বাবা ফিরলেন না। পুলিশে রিপোর্ট লেখা হোল। কয়েকদিন পর পুলিশ জানাল তল্লাশি চালিয়েও বাবার কোন হদিস পাওয়া যায় নি। বাবার আলমারি খুলে টাকা পয়সা এমনকি কোম্পানির মালিকানা সংক্রান্ত কোন রকম কাগজ পত্র কিছুই পাওয়া গেলনা।বাবার পার্টনার ভরত জয়সোয়াল পুলিশ কে জানালেন কোম্পানি বিশাল টাকা ঋন নিয়েছিল। সেই ঋন শোধ দিতে না পারায় কম্পানির দলিল বাজেয়াপ্ত করা হয়।

কয়েকমাস পড়ে জয়সোয়ালের এ ব্যাপারে হাত ছিল, এরকম উড়ো খবর আমরা পেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু কিছু প্রমাণ হয় নি।


সেই বারো বছর বয়সে শুরু হোল জীবন সংগ্রাম। ঘটনার আকস্মিকতায় মা আর আমি দুজনেই দিশেহারা।ব্যাঙ্কের খুব সামান্য জমানো টাকা আর বুদ্ধি সম্বল করে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানো থেকে শুরু করে ,পাড়া প্রতিবেশীর ফাই ফরমাশ খাটা , কিছুই বাদ গেলনা।

ভাগ্যিস মাথার ওপর ছাদটা ছিল! মাও টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করছিল।পাড়ার এক কাকিমা সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন।তার বদলে বিকেলের দিকে ওনার বাড়িতে একটু কাজকম্ম করতে হবে ওই আর কি!! ছোট ভাই আকাশ তখনও ভালো স্কুলেই পড়তো।

           ********

তিন ভাই বোনের মধ্যে আমার মাথাটাই সবচেয়ে পরিষ্কার ছিল। সময় তো আর থেমে থাকে না। স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে চাকরির চেষ্টা শুরু করলাম।


আকাশের ইঞ্জিনিয়ারিং এর খরচা চালাতে জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো,, হঠাৎ মা এলেন হাতে ছোট একটা পুটুলি নিয়ে।

কিছু বলবে? 

শোন কোয়েনা,এই কটা গয়না তোর বাবা তোর বিয়ের জন্য রেখেছিলেন। আকাশের জন্য এগুলো ভাবছিলাম বিক্রি করে দেবো। ও একবার পাশ করে চাকরি পেলে এরকম অনেক গয়নাই তোকে গড়িয়ে দেবে। তোর মত আছে তো?


কিন্তু মা, আমার ভাবনা আমিও ভাবছি না, সুবির বিয়ে দিলে তখন‌ তো এগুলো লাগবে!


"ও নিয়ে তুই ভাবিস না।সুবি তোর মত নয়।ওর রূপ দেখলে লোকে এমনিই পছন্দ করবে। এই তো গতকাল ওবাড়ির বড় বৌ একটা সম্বন্ধ দিয়ে গেল। ছেলেরা নাকি খুব বড়োলোক। তা আমি বললাম সুবি কলেজের গন্ডি টা পেরোক তখন না হয় দেখা যাবে।" মায়ের কথায় আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,


"কই এসব কথা আমাকে আগে কখনো বলনি!"

এতে বলার কি আছে?মা বেশ নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিলেন।"


মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার ভবিষ্যতের একটা ইঙ্গিত যেন দেখতে পেলাম।

     ***********

"যে শাখায় ফুল ফোটে না,ফল ধরে না একেবারে

তোমার ওই বাদল বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।"


আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।মা চাকরি টা হয়ে গেছে।এই দেখ কল লেটার। তিনমাস আগে ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

মা, আকাশ, সুবি ছুটে এল।

কপালে হাত ঠেকিয়ে মা বললেন,",তা আর না হয়ে যায়,এই তো গতমাসে তোর নামে পূজো দিলাম।'


"দিদি আমার কিন্তু একটা দামি মোবাইল ফোন চাই ", আকাশ আবদার জানালো।


"আমার লাহেঙ্গা" ,,সুবির চাহিদা।


চোখের পাতা ভিজে গেল। আবছা মনে পড়ে সেদিন সকালে কাজে বেরোনোর আগে বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, "কোয়েনা জীবনে কোনদিন সহজে হেরে যাসনা । যুদ্ধ করে হারাটা জয়ী হওয়ার চেয়েও দামি।"


দেখ বাবা আজ তোমার দায়িত্ব গুলো পালন করে, তোমাকে একটু একটু করে জিতিয়ে দিচ্ছি


       *********

আমার কাজের জন্য ব্যাঙ্কে আমায় সবাই আপন করে নিল।তিন বছর পর প্রোমোশনের সাথে ট্রান্সফার এল।ম্যানেজারের হাতে পায়ে ধরলাম।" না আমার প্রমোশন দরকার নেই। আমার পরিবারের অভিভাবক আমি। যদি পারেন একটা লোনের বন্দোবস্ত করে দিন,, বাড়িটা মেরামত করার খুব প্রয়োজন।"

ম্যানেজার মিস্টার আহুজা বেশ অবাক হলেন। "বললেন লোন আপনি এক্ষুনি পাবেন।ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন মিস্ মিত্র। আমি দুনিয়াটাকে আপনার থেকে একটু বেশি দেখেছি। এত ভালো সুযোগ বারবার আসে না।"

 পাশের চেয়ারের গৌরব কুলকার্নি, মনে মনে আমায় পছন্দ করেন। বললেন , "কোয়েনা আমার ওই একই জায়গায় ট্রান্সফার হয়েছে। ভেবেছিলাম তোমায় সাহস করে বলেই ফেলবো। কিন্তু তুমি সে পথ বন্ধ করে দিলে। তবুও বলবো ভেবে দেখ। বিয়েটা করে একসাথে একই জায়গায়,,,,"

 গৌরবকে থামিয়ে দিলাম।" সবকিছু সবার জন্য নয় গৌরব। "আপাতত অনেক দায়িত্ব পালন করার আছে। তোমাকে আমারও খুব ভালো লাগে। কিন্তু তাই বলে কথা দিয়ে আটকে রাখতে চাই না।"


চোখের কোনটা ভিজে উঠলো।


"পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে।

নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে।"

      


          ********

আজ সুবির বিয়ে। বাড়িটা ঝলমল করছে। আকাশ প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার। সুবির ভালোবাসার বিয়ে। ছেলেরা শুধু একটা গাড়ির দাবি জানিয়েছিল। "না " বলেছিলাম বলে মা বললেন,তুই এত স্বার্থপর কি করে হলি? লোন নিয়ে একটা গাড়ি নিজের ছোট বোনকে দিতে পারবিনা?"

অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। 

আমার পঁয়ত্রিশের আইবুড়ো চোখে জল এলোনা। মায়ের বোধ হয় ধারনাও নেই আমার ঝুলিতে শুধু লোনই আছে। তবে তাই হোক!


           *********

অষ্ট মঙ্গলায় সুবি আর ওর বর সাগর এলো। ওদের দুজনকে খুশিতে দেখে সব দুখ ভুলে গেলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর হঠাৎ আকাশ বললো "তোমাদের সবার সামনে আমার কিছু বলার আছে। আগামী মাসে আমি সিমি কে বিয়ে করছি।আমরা একসাথে ইঞ্জিনিয়ারিং করেছি। আর হ্যা এখান থেকে অফিস যাতাওয়াত করতে সিমির অসুবিধে হবে। তাই অফিসের কাছে নরিম্যান পয়েন্টে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি‌।"


অবাক বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। এই আমার ছোট ভাই?যে কিনা একটা চকোলেট কিনতে গেলে দশবার দিদিকে জিজ্ঞেস করতো?


আমি বলেই ফেললাম "আকাশ এত বড় সিদ্ধান্ত নিলি আর জানালি না পর্যন্ত! তাছাড়া এই সবে সুবির বিয়েতে এত খরচা হয়েছে।"


আকাশ কেমন ঝাঁঝিয়ে উঠলো, "প্লিস দিদি সব ব্যাপারে তোমার নাক গলানো টা বন্ধ করো। বিয়ের সমস্ত খরচা সিমির বাবা দেবে। আর হ্যা আরো একটা কথা , দিদি তোমরা তো ব্যাঙ্কের থেকে কোয়ার্টার পাও থাকার জন্য? তাইনা? 

দিন সাতেকের মধ্যে তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে উঠে যেও কেমন? কিছু সাহায্য লাগলে বলো।


এবার মরিয়া হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মা মুখটাকে এমন করলেন যেন কিছুই হয়নি।


আকাশ আরো একবার মুখ খুললো। মা আমাকে এ বাড়ি লিখে দিয়েছে।

সুবির বর সাগর কিছু বলতে যাচ্ছিল, "কিন্তু দিদিকে এভাবে একা ছেড়ে দিয়ে তোমরা,,,,"

সুবি এক ধমকে সাগর কে চুপ করিয়ে দিল।" আহ্ সাগর যা বোঝোনা তাই নিয়ে কথা বলতে এসোনা।"


মায়ের দিকে তাকালাম,, মা তুমিও কি এই চাও?

"দেখ কোয়েনা তুই তো চাকরি করছিস,,তোর তো কোন অসুবিধা নেই।" মা বেশ নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিল।,,,

"আর দিদি তোকে তো আমরা বিয়ে করতে বারণ করিনি",,,সুবি মুখ খুললো।"বড় বলে দায়িত্ব পালন করেছিস মাত্র,,"

"বাঃ খুব সম্মান দিলিরে সুবি, দিদিকে",, তোদের কথা ভেবে,,আর বলতে পারলাম না। গলাটা বুজে এল।


হঠাৎ বাবার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল।"কোয়েনা, হারতে হলে যুদ্ধ করে হার,,মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নয়।" 

'"কিন্তু আকাশ আমি যে পণ করেছি এ বাড়ি ছেড়ে উঠবো না"। পিন পড়লেও বোধ হয় তার আওয়াজ শোনা যেত।

অকাশ আর সুবি একসাথে জিজ্ঞেস করলো ,মানে?


"মানে এ বাড়িতে থাকার আমার পূর্ণ অধিকার আছে।" 

এবার আকাশ যেন প্যাঁচে পড়লো।

"দেখ দিদি সিমির বাবার কনস্ট্রাকশনের ব্যাবসা। তুই বললে তোকে কিছু টাকা দিয়ে দিচ্ছি,,এই ধর লাখ দশেক।তাছাড়া এতখানি জমি তুই একা মেইনটেইন করতেও পারবি না।"


"এটা আমার বাবার বাড়ি,তাই দায়িত্ব টা আমার। সারাজীবন শুধু বাবার হয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছি। আজ না হয় বাবার হয়ে নয়,, নিজেকে বাবার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দায়িত্ব নেভাবো। "


"মা চিৎকার করে উঠলেন, কোয়েনা তুই এতো হিংসুটে, ছিঃ", 

বাইরে আকাশ টা তখন ঘন কালো। প্রকৃতিও যেন সহ্যের সীমার বাইরে।

        *********


আজ কয়েক ঘণ্টা আগে ওরা সবাই আমাকে ফেলে চলে গেল,আকাশের কেনা নতুন ফ্ল্যাটে। 


নিস্তব্ধ বাড়ির প্রতিটি কোনা থেকে আকাশ ,আর সুবির আওয়াজ কানে আসছে।দি -দি, আমাদের ছেড়ে যাবিনা তো ওওও,,,

আমি যাইনি দেখ ,,মা দেখো আমি আমার ভালোবাসা কেও ফিরিয়ে দিয়েছি , শুধু তোমাদের জন্য। একি আমার চোখ এমন ঝাপসা হয়ে আসছে কেন?


"বাবা আমি পেরেছি,, এসে দেখে যাও। কোয়েনা পেরেছে।বাবা তোমার তৈরী করা বাড়ি আমি 

আঁকড়ে ধরে রেখেছি।"


"যা কিছু জীর্ন আমার দীর্ন আমার জীবন হারা

তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা,

নিশিদিন এই জীবনের তৃষার পরে ভুখের পরে

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে।"


Rate this content
Log in