সময়
সময়
বারোটা তো বাজতেই চললো। অধৈর্য্য হয়ে করিডোরে পায়চারি করছেন প্রমথেশ। গৌরী হাসপাতালে আসেনি। সকাল থেকে ঠায় ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে বসে আছে। ঠাকুর এতটা যখন করেছেন, অপারেশনটা ভালোয় ভালোয় মিটিয়ে ঠিক বাঁচিয়ে দেবেন।
কাল অনেকটা রাত্তিরে হাসপাতাল থেকে যখন ফোনটা পেয়েছিল, মাঝপথে হঠাৎ শেষ হয়ে আসা স্বপ্নগুলো আবার চিকচিক করে উঠেছিল প্রমথেশ আর গৌরীর চোখে। তাদের ছেলেটা আবার বাঁচবে! ডোনার পাওয়া গেছে। লিভারের এক বিরল সমস্যাতে আক্রান্ত হয়ে ছেলেটা গত তিনমাস ধরে হাসপাতালেই। ডাক্তারবাবুরা জানিয়েই দিয়েছেন, লিভার প্রতিস্থাপন করেই একমাত্র রোগমুক্তি সম্ভব।
ছেলেকে বাঁচাতে প্রমথেশ-গৌরী দুঝনেই নিজেদের লিভারের অংশ দান করতে চেয়েছিল। চাইলেই তো আর হবেনা! লিভার দানের জন্য দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে যে সমস্ত মিলগুলো থাকা বাঞ্ছনীয় তার সবগুলো ওদের দুজনের কারও সাথেই মেলেনি। তিনমাস অপেক্ষার পর অবশেষে যেমনটা ডাক্তারবাবুরা চাইছিলেন, ঠিক তেমন ডোনার মিলেছে। এক মা তাঁর ছেলের অকালমৃত্যুর পর, তার অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই মায়ের সন্তান চলে গিয়ে হয়তো বাঁচিয়ে গেল প্রমথেশের সন্তানকে। শুধু প্রমথেশের সন্তানকে কেন! আরও কয়েকজন বাবা-মায়ের সন্তানও হয়তো বেঁচে উঠবে সেই মায়ের মহান সিদ্ধান্তের জন্য।
কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তো ছুটছে। অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। গ্রীন করিডর করে লিভার আসছে। কিন্তু এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা। অপারেশনের পুরোটাই একেবারে সময়ের ছকে বাঁধা। বারোটার মধ্যে না পৌঁছালে অপারেশন টেবিলেই হয়তো মারা যাবে ছেলেটা। আর মাত্র পাঁচমিনিট বাকি।
-আপনার বোধহয় শরীরখারাপ করছে কাকু। একটু বসবেন চলুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
অন্য কোন পেশেন্ট পার্টি হবে হয়তো। তার কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে কানে ঢুকলেও কিছুই যেন বুঝতে পারেনা প্রমথেশ। তার চোখে তখন ভাসছে স্কুল হোস্টেলের সুপারের সেই অ্যালার্ম ঘড়িটা। স্যার সবসময় বলতেন,
---টাইম ডাস নট ওয়েট ফর অ্যানিবডি। সবসময় মনে রাখবে, ঘড়ির ঐ কাঁটা দুটো তোমাদের অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দী। তার সাথে পাল্লা দিয়ে সময়ের কাজটা সময়ে করতে না পারলেই রোজ একটু একটু করে পিছিয়ে পড়বে। পিছিয়ে পড়ার আর এক নাম কি জানো তোমরা? পিছিয়ে পড়া মানে হেরে যাওয়া। জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছো তুমি।
একটা বিশাল ফাঁকা মাঠে ছুটছে প্রমথেশ। ঘড়িতে বারোটা বাজার আগে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। প্রাণপণ জোরে ছুটছে। ধুলোয় আবছা হয়ে আসছে ঘড়িটা। বারোটা কি বেজে গেল!
---স্যার জ্ঞান ফিরেছে ওনার।
কথাটা শুনতে পেলেও কে বলল বুঝতে পারল না প্রমথেশ। চোখ মেলে নিজের অবস্থানটা বোঝার চেষ্টা করে। কৈ কোন মাঠ তো নেই! মনে হচ্ছে এটা তো একটা হসপিটাল। হসপিটালের বেডে কি করে এলো প্রমথেশ!
---এখন কেমন লাগছে প্রমথেশবাবু?
ডাক্তারবাবুর কথায় চোখ মেলে তাকায় প্রমথেশ। ছেলের অপারেশনের কথাটা অতক্ষণে মনে পড়ে। অপারেশনটা কি হয়নি!
মনের কথাগুলো অস্ফুটে উচ্চারণ করে প্রমথেশ।
---ছেলের চিন্তায় নিজেই তো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আপনাকে তো এবার সুস্থ হতে হবে। আপনার ছেলের অপারেশন পুরোপুরি সাকসেসফুল।
ডাক্তারবাবুর কথায় পরম নিশ্চিন্তে চোখ বোজে পরমেশ। স্পোর্টস্ স্যারের ঘড়িটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ঘড়ির দুটো কাঁটাই বারোটার ঘর ছুঁয়ে গেছে। অবশ্য তার আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে প্রমথেশ।
(সমাপ্ত)