অজানার সন্ধানে
অজানার সন্ধানে
আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। চুপচাপ বসে থাকলেই ঝিমুনি এসে যায়। আর বাসে বা ট্রেনে উঠে একটু বসার জায়গা পেয়ে গেলে তো কথাই নেই, মুহূর্তের মধ্যে চোখ লেগে যাবে। ব্যাপারটাকে অভ্যাস বলাটা ঠিক হবে না, কারণ অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিন্তু আমার এই ঝিমুনিকে অনেক চেষ্টা করেও বাগ মানাতে পারিনি। যাতায়াতের পথে আমার মাথা সহযাত্রীর কাঁধে সাময়িক আশ্রয় নেওয়াতে অনেক সময় দু কথা শুনতে হয়েছে তবু তন্দ্রা কখনো আমাকে ছেড়ে যায় নি। শুনেছি যাদের সাউন্ড স্লিপ হয় না তারাই নাকি থেকে থেকে তন্দ্রার বলয়ে পাক খায়। আমার ক্ষেত্রে ত্তত্বটা অনেকটাই প্রযোজ্য। কেবল তন্দ্রাই নয়, পাতলা ঘুম হলে চোখ বুজলেই শুরু হয়ে যায় স্বপ্নের মিছিল। শো এর পর শো চলতে থাকে, চোখ খোলার পর যার অধিকাংশটাই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না। তবে কিছু কিছু স্বপ্ন ভেতরে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন মনে ছেয়ে থাকে।
সেদিন ছিল রোববার, ছুটির দিন। দুপুরে ভালমন্দ খাওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাঙালির সাধের ভাতঘুম দিলাম। শোয়ার সাথে সাথেই চোখ লেগে গেল আর অচিরেই পৌঁছে গেলাম এক স্বপ্নরাজ্যে। অচেনা অজানা এক জায়গায় বসে আছি। বড় সুন্দর জায়গাটা। চারিদিকে রং বেরং এর নানা রকম ফুল ফুটে আছে। মৃদু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে তার সুগন্ধ। গাছে গাছে পাখীরা মিষ্টি সুরে গান শোনাচ্ছে। মোহময় পরিবেশ। তবে সেখানে আমি একা, একেবারেই একা, কোথাও কোন মনুষ্য বসতির চিহ্ন নেই। মহানন্দে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম অনেক দূর থেকে কিছু একটা যেন আমার দিকে আসছে। অবয়বটা একটু স্পষ্ট হতে বুঝলাম একজন মানুষ। তাহলে এখানেও মানুষ আছে। আর একটু কাছে আসতে দেখি আমার অতি কাছের মানুষ ‘নবেন্দু’।
একেবারে কাছটায় এসে জিজ্ঞেস করল, “দাদা ভাল আছ?”
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়েছিলাম।
--দাদা ওভাবে কি দেখছ?
--কতকাল বাদে তোকে দেখলাম রে নবেন্দু। প্রায় কুড়ি, না না আরো বেশি, তেইশ চব্বিশ বছর হবে।
--তেইশ বছর, সাত মাস, চার দিন।
--তোর চেহারাটা এক্কেবারে আগের মতই আছে, একটুও বদলায়নি।
--মানুষ যেমন যেমন এগোয় তার চেহারা তেমন তেমন বদলায়। কারো কম কারো বেশি। তোমার সাথে শেষ দেখা হওয়ার পর আমি তো আর এগোইনি, চেহারা পালটাবে কি করে?
-- তা ঠিক। তোর চলে যাওয়াটা আমরা কেউ মেনে নিতে পারিনি রে। সকলে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
--এলে আনন্দ আর গেলে দুঃখ, এতো চিরকালের নিয়ম দাদা। আমার ক্ষেত্রেও আপনজনদের তাই হয়েছে।
--আসা যাওয়া আপন নিয়মে চলে। ব্যক্তি বিশেষের তাতে কোন ভূমিকা থাকে না। কিন্তু তোর তো তা নয়, তুই স্বইচ্ছায় চলে গেলি। কষ্টটা ওইজন্য আরো বেশি হয়।
--সবই ওই নিয়মের মধ্যে পড়ে। ফাঁসিতে ঝুলে যে মৃত্যু, তা তো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। লোকটা তো আরো কিছুদিন বাঁচতে পারত। কিন্তু ওই মৃত্যুই ওই আসামী মানুষটার ভবিতব্য ছিল।
--তোর তো কোন সমস্যা আমাদের কারো কখনও চোখে পড়েনি। হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল ছেলে, ক্লাবে খেলাধুলা করতিস, গল্প গুজব হাসি ঠাট্টা করতিস, এমনকি ক্লাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও তুই সক্রিয় ভাবে থাকতিস। এটা বলতে পারিস যে তুই চাকরি করতিস না, কিন্তু তাতে তো তোর কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। গৃহ শিক্ষক হিসাবে তোর যথেষ্ট সুনাম ছিল। টিউশনির জন্য তোর কাছে ছাত্রছাত্রীর লাইন লেগে থাকত। সাধারণ চাকরি করে লোকে যা মাইনে পায় তোর রোজগার তার থেকে বেশি বই কম ছিল না। আর তোর বাড়ির লোকজন এতই ভাল যে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগের প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কেন এমন করলি রে? কার ওপর তোর অভিমান, কি তোর কষ্ট? অনেক ভেবেও আজ অবধি আমরা কোন কারন খুঁজে পাইনি।
--অনেক দিন তো হয়ে গেল, ওসব নিয়ে নতুন করে ঘাঁটাঘাঁটি করে আর কি লাভ দাদা, বাদ দাও না। তবে তুমি ঠিকই বলেছ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা, ক্লাব, টিউশনি, এসব নিয়ে আনন্দেই কাটত আমার দিনগুলো।
--এটাই তো আমাদের সকলের কাছে তোর চেনা ছবি। কিন্তু এমন মানুষ তো জীবনকে উপভোগ করতে চায়, প্রস্থানের অঙ্ক তো এরা কষে না। এই সুন্দর জীবনের আড়ালে নিশ্চই কোন ব্যাথা ছিল যা তোকে বাধ্য করেছিল ওই চরম সিদ্ধান্ত নিতে। তোর কি সেই কষ্ট যার জন্য এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিলি? শিক্ষক হয়ে এটা তো তোর জানা উচিৎ ছিল যে শেয়ার করলে কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয় এমন কি অনেক সময় উত্তরণের পথেরও সন্ধান পাওয়া যায়। কেন, কেন তুই অমন বোকার মতন কাজ করলি?
--কতখানি ভালবাসা থাকলে তবে গত হওয়ার এত বছর পরেও কাউকে নিয়ে মানুষ এত ভাবে। ভালবাসার এই বাঁধন ছিঁড়ে চলে যাওয়াটা অত সহজ নয়। অপরিবর্তনীয়, দুর্লঙ্ঘ, অসমাধেয়, রূঢ় বাস্তব কখনো কখনো মানুষকে একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখান থেকে পতনই নিষ্ক্রমণের একমাত্র পথ। ধরে নাও আমিও এমন বাস্তবের সম্মুখীন হয়েছিলাম যা গ্রহণ বা বর্জন কোনটাই আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না, অগত্যা প্রস্থান।
--কি সেই বাস্তব যার সামান্যতম ইঙ্গিত আমাদের কাছে ছিল না!
--ছাত্রছাত্রীদের সাথে আমার বন্ধুর মত সম্পর্ক ছিল। পড়া ছেড়ে দেওয়ার পরেও অনেকে আমার কাছে আসত, কখনো বইপত্র কিছু নিত কখনো শুধুই গল্প করত। আমি তো নয়ই আমার বাড়ির লোকেরাও কখনো বিরক্ত হয়নি, বরং সকলে খুশিই হত। এমনই এক ছাত্রী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরও মাঝে মাঝে আমার কাছে আসত। নামটা জানতে চেও না, বলাটা উচিৎ হবে না। প্রথমদিকে বন্ধুদের সাথে এলেও পরে একাই আসত। আসত, কিছুক্ষণ গল্প করে বাড়ি ফিরে যেত। অনেকেই আসে তাই ওর আসাটা যে বিশেষ কোন কারণে তা বুঝতে পারিনি। বুঝলাম কিছুদিন পরে। অনেক কিন্তু কিন্তু করে একদিন নিজের মনের কথাটা ও আমাকে বলে ফেলল। মৃদু ধমক দিয়ে সেদিন ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটি হাল ছাড়েনি। দিনের পর দিন অনুরোধ,উপরোধ, কান্নাকাটি করে আদায় করে নিয়েছিল আমার সম্মতি। ধীরে ধীরে মেয়েটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লাম। আমাদের এই মন দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটা আমরা দুজন ছাড়া তৃতীয় কেউ কখনো জানতে পারেনি।
-- এইরকমই একটা কিছু আমি সন্দেহ করেছিলাম। পরে নিশ্চই মেয়েটির কাছ থেকে বড় রকমের কোন আঘাত পেয়েছিলি?
--এত তাড়াতাড়ি উপসংহারে পৌছে গেলে? জীবনের অঙ্ক বড় জটিল, একই অঙ্কের এক এক সময় এক এক রকম উত্তর বের হয়। দিনগুলো সব মিলিয়ে মন্দ কাটছিল না। একদিন ক্লাবে ক্রিকেট খেলার পর খুব মাথার যন্ত্রণা হল। পাড়ার ডঃ সেনকে দেখালাম। বললেন যে মাঠে রোদ্দুর লেগে হয়েছে। তেমন একটা গুরুত্ব দিলেন না। কিন্তু মাথার যন্ত্রণা মাঝে মাঝেই হতে শুরু হল। বাধ্য হয়ে একদিন কোলকাতায় গিয়ে একজন বড় ডাক্তারকে দেখালাম। বেশ কিছু টেস্ট করাবার পর জানা গেল আমার মাথায় টিউমার হয়েছে এবং তা ম্যালিগন্যান্ট। এই পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনে সেরেছিলাম, একমাত্র মেয়েটি সব জানত। কারণ ওই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে কোলকাতায় ডাক্তার দেখিয়েছিল। মাথার যন্ত্রণার ব্যাপারটা বাড়ির লোকেরা জানত কিন্তু ওইটুকুই, তার বেশি আর কিছু না। ভেবেছিলাম ক্যান্সার হয়েছে জানার পর মেয়েটি আমার থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাবে, কিন্তু ও আরো বেশি করে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়ছিল। ওরই পীড়াপীড়িতে আরো কয়েকজন নামী অঙ্কোলজিস্টকে দেখালাম। কেঊই আশার কথা শোনাতে পারলেন না। অপারেশন করলেও সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। বুঝলাম আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। সব শোনার পরেও মেয়েটি আমাকে বিয়ে করতে বদ্ধপরিকর আর যেহেতু সময় অল্প তাই তা দু এক দিনের মধ্যেই করতে চায়। অনেক বোঝালাম কিন্তু কোন লাভ হল না। শারীরিক সমস্যার সাথে তৈরি হল চরম মানসিক সমস্যা। ভাববার জন্য ওর কাছে দু একদিন সময় চেয়ে নিলাম। দিনরাত অনেক ভাবলাম। মেয়েটির ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করতে গেলে ওর সাথে ঘোর অন্যায় করা হবে। আমি তো কিছুদিন, তারপর। এমন নিখাদ পবিত্র ভালবাসাকে জটিল সমস্যাসংকুল জীবনের পথে ঠেলে দিতে মন সায় দিল না। অনন্যোপায় হয়ে বিদায়ের ক্ষণ একটু এগিয়ে নিয়ে আসতে হল।
কথা শেষ হতেই নবেন্দুকে আর দেখতে পেলাম না। মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আবার সেই সুন্দর বাগানে আমি একা। ক্ষণিকেই অনুভব করলাম পরিচিত স্পর্শ। অবশ্যই সুখস্পর্শ নয়। দংশনের বাসনায় শরীরের উন্মুক্ত অংশে বিচরণ করছে। মশাকে লক্ষ্য করে আমার উড়ে যাওয়া হাত মশারীতে এসে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেল।
চোখ মেলে জানলা দিয়ে দেখি, জ্যোতিষ্মানের আলোকে দিপ্ত প্রভাত সকল অন্ধকারকে অপসারিত করে ধীরে ধীরে আকাশের দখল নিয়ে সূচিত করছে নতুন দিনের আগমনবার্তা।