Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Rabindranath Tagore

Classics

0  

Rabindranath Tagore

Classics

গোরা ৫

গোরা ৫

94 mins
3.9K


সুচরিতার মাসি হরিমোহিনীকে লইয়া পরেশের পরিবারে একটা গুরুতর অশান্তি উপস্থিত হইল। তাহা বিবৃত করিয়া বলিবার পূর্বে, হরিমোহিনী সুচরিতার কাছে নিজের যে পরিচয় দিয়াছিলেন তাহাই সংক্ষেপ করিয়া নীচে লেখা গেল–

আমি তোমার মায়ের চেয়ে দুই বছরের বড়ো ছিলাম। বাপের বাড়িতে আমাদের দুইজনের আদরের সীমা ছিল না। কেননা, তখন আমাদের ঘরে কেবল আমরা দুই কন্যাই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম–বাড়িতে আর শিশু কেহ ছিল না। কাকাদের আদরে আমাদের মাটিতে পা ফেলিবার অবকাশ ঘটিত না।

আমার বয়স যখন আট তখন পালসার বিখ্যাত রায়চৌধুরীদের ঘরে আমার বিবাহ হয়। তাঁহারা কুলেও যেমন ধনেও তেমন। কিন্তু আমার ভাগ্যে সুখ ঘটিল না। বিবাহের সময় খরচ-পত্র লইয়া আমার শ্বশুরের সঙ্গে পিতার বিবাদ বাধিয়াছিল। আমার পিতৃগৃহের সেই অপরাধ আমার শ্বশুরবংশ অনেক দিন পর্যন্ত ক্ষমা করিতে পারেন নাই। সকলেই বলিত–আমাদের ছেলের আবার বিয়ে দেব, দেখি ও মেয়েটার কী দশা হয়। আমার দুর্দশা দেখিয়াই বাবা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, কখনো ধনীর ঘরে মেয়ে দিবেন না। তাই তোমার মাকে গরিবের ঘরেই দিয়াছিলেন।

বহু পরিবারের ঘর ছিল, আমাকে আট-নয় বৎসর বয়সের সময়েই রান্না করিতে হইত। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক খাইত। সকলের পরিবেশনের পরে কোনোদিন শুধু ভাত, কোনোদিন বা ডালভাত খাইয়াই কাটাইতে হইত। কোনোদিন বেলা দুইটার সময়ে, কোনোদিন বা একেবারে বেলা গেলে আহার করিতাম। আহার করিয়াই বৈকালের রান্না চড়াইতে যাইতে হইত। রাত এগারোটা বারোটার সময় খাইবার অবকাশ ঘটিত। শুইবার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। অন্তঃপুরে যাহার সঙ্গে যেদিন সুবিধা হইত তাহার সঙ্গেই শুইয়া পড়িতাম। কোনোদিন বা পিঁড়ি পাতিয়া নিদ্রা দিতে হইত।

বাড়িতে আমার প্রতি সকলের যে অনাদর ছিল আমার স্বামীর মনও তাহাতে বিকৃত না হইয়া থাকিতে পারে নাই। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি আমাকে দূরে দূরেই রাখিয়াছিলেন।

এমন সময়ে আমার বয়স যখন সতেরো তখন আমার কন্য মনোরমা জনন্মগ্রহণ করে। মেয়েকে জন্ম দেওয়াতে শ্বশুরকুলে আমার গঞ্জনা আরো বাড়িয়া গিয়াছিল। আমার সকল অনাদর সকল লাঞ্ছনার মধ্যে এই মেয়েটিই আমার একমাত্র সান্ত্বনা ও আনন্দ ছিল। মনোরমাকে তাহার বাপ এবং আর কেহ তেমন করিয়া আদর করে নাই বলিয়াই সে আমার প্রাণপণ আদরের সামগ্রী হইয়া উঠিয়াছিল।

তিন বৎসর পরে যখন আমার একটি ছেলে হইল তখন হইতে আমার অবস্থার পরিবর্তন হইতে লাগিল। তখন আমি বাড়ির গৃহিনী বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য হইলাম। আমার শাশুড়ি ছিলেন না–আমার শ্বশুরও মনোরমা জন্মিবার দুই বৎসর পরেই মারা যান। তাঁহার মৃত্যুর পরেই বিষয় লইয়া দেবরদের সঙ্গে মকদ্দমা বাধিয়া গেল। অবশেষে মামলায় অনেক সম্পত্তি নষ্ট করিয়া আমরা পৃথক হইলাম।

মনোরমার বিবাহের সময় আসিল। পাছে তাহাকে দূরে লইয়া যায়, পাছে তাহাকে আর দেখিতে না পাই, এই ভয়ে পালসা হইতে পাঁচ-ছয় ক্রোশ তফাতে সিমুলে গ্রামে তাহার বিবাহ দিলাম। ছেলেটিকে কার্তিকের মতো দেখিতে। যেমন রঙ তেমনি চেহারা–খাওয়াপরার সংগতিও তাহাদের ছিল।

একদিন আমার যেমন অনাদর ও কষ্ট গিয়াছে, কপাল ভাঙিবার পূর্বে বিধাতা কিছু দিনের জন্য আমাকে তেমনি সুখ দিয়াছিলেন। শেষাশেষি আমার স্বামী আমাকে বড়োই আদর ও শ্রদ্ধা করিতেন, আমার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া কোনো কাজই করিতেন না। এত সৌভাগ্য আমার সহিবে কেন? কলেরা হইয়া চারি দিনের ব্যবধানে আমার ছেলে ও স্বামী মারা গেলেন। যে দুঃখ কল্পনা করিলেও অসহ্য বোধ হয় তাহাও যে মানুষের সয় ইহাই জানাইবার জন্য ঈশ্বর আমাকে বাঁচাইয়া রাখিলেন।

ক্রমেই জামাইয়ের পরিচয় পাইতে লাগিলাম। সুন্দর ফুলের মধ্যে যে এমন কাল-সাপ লুকাইয়া থাকে তাহা কে মনে করিতে পারে? সে যে কুসংসর্গে পড়িয়া নেশা ধরিয়াছিল তাহা আমার মেয়েও কোনোদিন আমাকে বলে নাই। জামাই যখন-তখন আসিয়া নানা অভাব জানাইয়া আমার কাছে টাকা চাহিয়া লইয়া যাইত। সংসারে আমার তো আর-কাহারো জন্য টাকা জমাইবার কোনো প্রয়োজন ছিল না, তাই জামাই যখন আবদার করিয়া আমার কাছ হইতে কিছু চাহিত সে আমার ভালোই লাগিত। মাঝে মাঝে আমার মেয়ে আমাকে বারণ করিত, আমাকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিত–তুমি অমনি করিয়া উঁহাকে টাকা দিয়া উঁহার অভ্যাস খারাপ করিয়া দিতেছ, টাকা হাতে পাইলে উনি কোথায় যে কেমন করিয়া উড়াইয়া দেন তাহার ঠিকানা নাই। আমি ভাবিতাম, তাহার স্বামী আমার কাছে এমন করিয়া টাকা লইলে তাহার শ্বশুরকুলের অগৌরব হইবে এই ভয়েই বুঝি মনোরমা আমাকে টাকা দিতে নিষেধ করে।

তখন আমার এমন বুদ্ধি হইল আমি আমার মেয়েকে লুকাইয়া জামাইকে নেশার কড়ি জোগাইতে লাগিলাম। মনোরমা যখন তাহা জানিতে পারিল তখন সে একদিন আমার কাছে আসিয়া কাঁদিয়া তাহার স্বামীর কলঙ্কের কথা সমস্ত জানাইয়া দিল। তখন আমি কপাল চাপড়াইয়া মরি। দুঃখের কথা কী আর বলিব, আমার একজন দেওরই কুসঙ্গ এবং কুবুদ্ধি দিয়া আমার জামাইয়ের মাথা খাইয়াছে।

টাকা দেওয়া যখন বন্ধ করিলাম এবং জামাই যখন সন্দেহ করিল যে, আমার মেয়েই আমাকে নিষেধ করিয়াছে তখন তাহার আর কোনো আবরণ রহিল না। তখন সে এত অত্যাচার আরম্ভ করিল, আমার মেয়েকে পৃথিবীর লোকের সামনে এমন করিয়া অপমান করিতে লাগিল যে, তাহাই নিবারণ করিবার জন্য আবার আমি আমার মেয়েকে লুকাইয়া তাহাকে টাকা দিতে লাগিলাম। জানিতাম আমি তাহাকে রসাতলে দিতেছি, কিন্তু মনোরমাকে সে অসহ্য পীড়ন করিতেছে এ সংবাদ পাইলে আমি কোনোমতে স্থির থাকিতে পারিতাম না।

অবশেষে একদিন–সে দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। মাঘ মাসের শেষাশেষি, সে বছর সকাল সকাল গরম পড়িয়াছে, আমরা বলাবলি করিতেছিলাম এরই মধ্যে আমাদের খিড়কির বাগানের গাছগুলি আমের বোলে ভরিয়া গেছে। সেই মাঘের অপরাহে্‌ণ আমাদের দরজার কাছে পালকি আসিয়া থামিল। দেখি, মনোরমা হাসিতে হাসিতে আসিয়া আমাকে প্রণাম করিল। আমি বলিলাম, কী মনু, তোদের খবর কী? মনোরমা হাসিমুখে বলিল, খবর না থাকলে বুঝি মার বাড়িতে শুধু শুধু আসতে নেই?

আমার বেয়ান মন্দ লোক ছিলেন না। তিনি আমাকে বলিয়া পাঠাইলেন, বউমা পুত্রসম্ভাবিতা,সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তাহার মার কাছে থাকিলেই ভালো। আমি ভাবিলাম, সেই কথাটাই বুঝি সত্য। কিন্তু জামাই যে এই অবস্থাতেই মনোরমাকে মারধোর করিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং বিপৎপাতের আশঙ্কাতেই বেয়ান তাঁহার পুত্রবধূকে আমার কাছে পাঠাইয়া দিয়াছেন তাহা আমি জানিতেও পারি নাই। মনু এবং তাহার শাশুড়িতে মিলিয়া আমাকে এমনি করিয়া ভুলাইয়া রাখিল। মেয়েকে আমি নিজের হাতে তেল মাখাইয়া স্নান করাইতে চাহিলে মনোরমা নানা ছুতায় কাটাইয়া দিত; তাহার কোমল অঙ্গে যে-সব আঘাতের দাগ পড়িয়াছিল সে তাহা তাহার মায়ের দৃষ্টির কাছেও প্রকাশ করিতে চাহে নাই।

জামাই মাঝে মাঝে আসিয়া মনোরমাকে বাড়ি ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য গোলমাল করিত। মেয়ে আমার কাছে থাকাতে টাকার আবদার করিতে তাহার ব্যাঘাত ঘটিত। ক্রমে সে বাধাও আর সে মানিল না। টাকার জন্য মনোরমার সামনেই আমার প্রতি উপদ্রব করিতে লাগিল। মনোরমা জেদ করিয়া বলিত–কোনোমতেই টাকা দিতে পারিবে না। কিন্তু আমার বড়ো দুর্বল মন, পাছে জামাই আমার মেয়ের উপর অত্যন্ত বেশি বিরক্ত হইয়া উঠে এই ভয়ে আমি তাহাকে কিছু না দিয়া থাকিতে পারিতাম না।

মনোরমা একদিন বলিল, মা, তোমার টাকাকড়ি সমস্ত আমিই রাখিব। বলিয়া আমার চাবি ও বাক্স সব দখল করিয়া বসিল। জামাই আসিয়া যখন আমার কাছে আর টাকা পাইবার সুবিধা দেখিল না এবং যখন মনোরমাকে কিছুতেই নরম করিতে পারিল না, তখন সুর ধরিল–মেজোবউকে বাড়িতে লইয়া যাইব। আমি মনোরমাকে বলিতাম, দে মা, ওকে কিছু টাকা দিয়েই বিদায় করে দে–নইলে ও কী করে বসে কে জানে। কিন্তু আমার মনোরমা এক দিকে যেমন নরম আর-এক দিকে তেমনি শক্ত ছিল। সে বলিত, না, টাকা কোনোমতেই দেওয়া হবে না।

জামাই একদিন আসিয়া চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিল, কাল আমি বিকালবেলা পালকি পাঠিয়ে দেব। বউকে যদি ছেড়ে না দাও তবে ভালো হবে না, বলে রাখছি।

পরদিন সন্ধ্যার পূর্বে পালকি আসিলে আমি মনোরমাকে বলিলাম, মা, আর দেরি করে কাজ নেই, আবার আসছে হপ্তায় তোমাকে আনবার জন্য লোক পাঠাব।

মনোরমা কহিল, আজ থাক্‌, আজ আমার যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না মা, আর দুদিন বাদে আসতে বলো।

আমি বলিলাম, মা, পালকি ফিরিয়ে দিলে কি আমার খেপা জামাই রক্ষা রাখবে? কাজ নেই, মনু, তুমি আজই যাও।

মনু বলিল, না, মা, আজ নয়–আমার শ্বশুর কলিকাতায় গিয়েছেন, ফাল্গুনের মাঝামাঝি তিনি ফিরে আসবেন, তখন আমি যাব।

আমি তবু বলিলাম, না, কাজ নাই মা।

তখন মনোরমা প্রস্তুত হইতে গেল। আমি তাহার শ্বশুরবাড়ির চাকর ও পালকির বেহারাদিগকে খাওয়াইবার আয়োজনে ব্যস্ত রহিলাম। যাইবার আগে একটু যে তাহার কাছে থাকিব, সেদিন যে একটু বিশেষ করিয়া তাহার যত্ন লইব, নিজের হাতে তাহাকে সাজাইয়া দিব, সে যে খাবার ভালোবাসে তাহাই তাহাকে খাওয়াইয়া দিয়া বিদায় দিব, এমন অবকাশ পাইলাম না। ঠিক পালকিতে উঠিবার আগে আমাকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা হইয়া কহিল, মা, আমি তবে চলিলাম।

সে যে সত্যই চলিল সে কি আমি জানিতাম! সে যাইতে চাহে নাই, আমি জোর করিয়া তাহাকে বিদায় করিয়াছি–এই দুঃখে বুক আজ পর্যন্ত পুড়িতেছে, সে আর কিছুতেই শীতল হইল না।

সেই রাত্রেই গর্ভপাত হইয়া মনোরমার মৃত্যু হইল। এই খবর যখন পাইলাম তাহার পূর্বেই গোপনে তাড়াতাড়ি তাহার সৎকার শেষ হইয়া গেছে।

যাহার কিছু বলিবার নাই, করিবার নাই, ভাবিয়া যাহারা কিনারা পাওয়া যায় না, কাঁদিয়া যাহার অন্ত হয় না, সেই দুঃখ যে কী দুঃখ, তাহা তোমরা বুঝিবে না–সে বুঝিয়া কাজ নাই।

আমার তো সবই গেল কিন্তু তবু আপদ চুকিল না। আমার স্বামীপুত্রের মৃত্যুর পর হইতেই দেবররা আমার বিষয়ের প্রতি লোভ দিতেছিল। তাহারা জানিত আমার মৃত্যুর পরে বিষয়সম্পত্তি সমুদয় তাহাদেরই হইবে, কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তাহাদের সবুর সহিতেছিল না। ইহাতে কাহারো দোষ দেওয়া চলে না; সত্যই আমার মতো অভাগিনীর বাঁচিয়া থাকাই যে অপরাধ। সংসারে যাহাদের নানা প্রয়োজন আছে, আমার মতো প্রয়োজনহীন লোক বিনা হেতুতে তাহাদের জায়গা জুড়িয়া বাঁচিয়া থাকিলে লোকে সহ্য করে কেমন করিয়া।

মনোরমা যতদিন বাঁচিয়া ছিল ততদিন আমি দেবরদের কোনো কথায় ভুলি নাই। আমার বিষয়ের অধিকার লইয়া যতদূর সাধ্য তাহাদের সঙ্গে লড়িয়াছি। আমি যতদিন বাঁচি মনোরমার জন্য টাকা সঞ্চয় করিয়া তাহাকে দিয়া যাইব, এই আমার পণ ছিল। আমি আমার কন্যার জন্য টাকা জমাইবার চেষ্টা করিতেছি ইহাই আমার দেবরদের পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল–তাহাদের মনে হইত আমি তাহাদেরই ধন চুরি করিতেছি। নীলকান্ত বলিয়া কর্তার একজন পুরাতন বিশ্বাসী কর্মচারী ছিল,সেই আমার সহায় ছিল। আমি যদি বা আমার প্রাপ্য কিছু ছাড়িয়া দিয়া আপসে নিষ্পত্তির চেষ্টা করিতাম সে কোনোমতেই রাজি হইত না; সে বলিত–আমাদের হকের এক পয়সা কে লয় দেখিব। এই হকের লড়াইয়ের মাঝখানেই আমার কন্যার মৃত্যু হইল। তাহার পরদিনেই আমার মেজো দেবর আসিয়া আমাকে বৈরাগ্যের উপদেশ দিলেন। বলিলেন–বৌদিদি, ঈশ্বর তোমার যা অবস্থা করিলেন তাহাতে তোমার আর সংসারে থাকা উচিত হয় না। যে কয়দিন বাঁচিয়া থাক তীর্থে গিয়া ধর্মকর্মে মন দাও, আমরা তোমার খাওয়াপরার বন্দোবস্ত করিয়া দিব।

আমি আমাদের গুরুঠাকুরকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। বলিলাম–ঠাকুর, অসহ্য দুঃখের হাত হইতে কী করিয়া বাঁচিব আমাকে বলিয়া দাও–উঠিতে বসিতে আমার কোথাও কোনো সান্ত্বনা নাই–আমি যেন বেড়া-আগুনের মধ্যে পড়িয়াছি; যেখানেই যাই, যে দিকেই ফিরি, কোথাও আমার যন্ত্রণার এতটুকু অবসানের পথ দেখিতে পাই না।

গুরু আমাকে আমাদের ঠাকুর-ঘরে লইয়া গিয়া কহিলেন–এই গোপীবল্লভই তোমার স্বামী পুত্র কন্যা সবই। ইঁহার সেবা করিয়াই তোমার সমস্ত শূন্য পূর্ণ হইবে।

আমি দিনরাত ঠাকুর-ঘরেই পড়িয়া রহিলাম। ঠাকুরকেই সমস্ত মন দিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, কিন্তু তিনি নিজে না লইলে আমি দিব কেমন করিয়া? তিনি লইলেন কই?

নীলকান্তকে ডাকিয়া কহিলাম–নীলুদাদা, আমার জীবনস্বত্ব আমি দেবরদেরই লিখিয়া দিব স্থির করিয়াছি। তাহারা খোরাকি-বাবদ মাসে মাসে কিছু করিয়া টাকা দিবে।

নীলকান্ত কহিল–সে কখনো হইতেই পারে না। তুমি মেয়েমানুষ এ-সব কথায় থাকিয়ো না।

আমি বলিলাম–আমার আর সম্পত্তিতে প্রয়োজন কী?

নীলকান্ত কহিল–তা বলিলে কি হয়! আমাদের যা হক তা ছাড়িব কেন? এমন পাগলামি করিয়ো না।

নীলকান্ত হকের চেয়ে বড়ো আর কিছুই দেখিতে পায় না। আমি বড়ো মুশকিলেই পড়িলাম। বিষয়কর্ম আমার কাছে বিষের মতো ঠেকিতেছে–কিন্তু জগতে আমার ঐ একমাত্র বিশ্বাসী নীলকান্তই আছে, তাহার মনে আমি কষ্ট দিই কী করিয়া! সে যে বহু দুঃখে আমার ঐ এক “হক’ বাঁচাইয়া আসিয়াছে।

শেষকালে একদিন নীলকান্তকে গোপন করিয়া একখানা কাগজে সহি দিলাম। তাহাতে কী যে লেখা ছিল তাহা ভালো করিয়া বুঝিয়া দেখি নাই। আমি ভাবিয়াছিলাম, আমার সই করিতে ভয় কী–আমি এমন কী রাখিতে চাই যাহা আর-কেহ ঠকাইয়া লইলে সহ্য হইবে না! সবই তো আমার শ্বশুরের, তাঁহার ছেলেরা পাইবে, পাক।

লেখাপড়া রেজেস্‌টি হইয়া গেলে আমি নীলকান্তকে ডাকিয়া কহিলাম–নীলুদাদা, রাগ করিয়ো না, আমার যাহা-কিছু ছিল লিখিয়া পড়িয়া দিয়াছি। আমার কিছুতেই প্রয়োজন নাই।

নীলকান্ত অস্থির হইয়া উঠিয়া কহিল–অ্যাঁ, করিয়াছ কী!

যখন দলিলের খসড়া পড়িয়া দেখিল সত্যই আমি আমার সমস্ত স্বত্ব ত্যাগ করিয়াছি তখন নীলকান্তের ক্রোধের সীমা রহিল না। তাহার প্রভুর মৃত্যুর পর হইতে আমার ঐ “হক’ বাঁচানোই তাহার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল। তাহার সমস্ত বুদ্ধি সমস্ত শক্তি ইহাতেই অবিশ্রাম নিযুক্ত ছিল। এ লইয়া মামল্‌-মকদ্দমা, উকিলবাড়ি-হাঁটাহাঁটি, আইন খুঁজিয়া বাহির করা, ইহাতেই সে সুখ পাইয়াছে–এমন-কি, তাহার নিজের ঘরের কাজ দেখিবারও সময় ছিল না। সেই “হক’ যখন নির্বোধ মেয়েমানুষের কলমের এক আঁচড়েই উড়িয়া গেল তখন নীলকান্তকে শান্ত করা অসম্ভব হইয়া উঠিল।

সে কহিল–যাক, এখানকার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্বন্ধ চুকিল, আমি চলিলাম।

অবশেষে নীলুদাদা এমন করিয়া রাগ করিয়া আমার কাছ হইতে বিদায় হইয়া যাইবে শ্বশুরবাড়ির ভাগ্যে এই কি আমার শেষ লিখন ছিল। আমি তাহাকে অনেক মিনতি করিয়া ডাকিয়া বলিলাম–দাদা, আমার উপর রাগ করিয়ো না। আমার কিছু জমানো টাকা আছে তাহা হইতে তোমাকে এই পাঁচশো টাকা দিতেছি–তোমার ছেলের বউ যেদিন আসিবে সেইদিন আমার আশীর্বাদ জানাইয়া এই টাকা হইতে তাহার গহনা গড়াইয়া দিয়ো।

নীলকান্ত কহিল–আমার আর টাকায় প্রয়োজন নাই। আমার মনিবের সবই যখন গেল তখন ও পাঁচশো টাকা লইয়া আমার সুখ হইবে না। ও থাক।

এই বলিয়া আমার স্বামীর শেষ অকৃত্রিম বন্ধু আমাকে ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

আমি ঠাকুর-ঘরে আশ্রয় লইলাম। আমার দেবররা বলিল–তুমি তীর্থবাসে যাও।

আমি কহিলাম–আমার শ্বশুরের ভিটাই আমার তীর্থ, আর আমার ঠাকুর যেখানে আছে সেইখানেই আমার আশ্রয়।

কিন্তু আমি যে বাড়ির কোনো অংশ অধিকার করিয়া থাকি তাহাও তাহাদের পক্ষে অসহ্য হইতে লাগিল। তাহারা ইতিমধ্যেই আমাদের বাড়িতে জিনিসপত্র আনিয়া কোন্‌ ঘর কে কী ভাবে ব্যবহার করিবে তাহা সমস্তই ঠিক করিয়া লইয়াছিল। শেষকালে তাহারা বলিল–তোমার ঠাকুর তুমি লইয়া যাইতে পারো, আমরা তাহাতে আপত্তি করিব না।

যখন তাহাতেও আমি সংকোচ করিতে লাগিলাম তখন তাহারা কহিল–এখানে তোমার খাওয়াপরা চলিবে কী করিয়া?

আমি বলিলাম–কেন, তোমরা যা খোরাকি বরাদ্দ করিয়াছ তাহাতেই আমার যথেষ্ট হইবে।

তাহারা কহিল–কই, খোরাকির তো কোনো কথা নাই।

তাহার পর আমার ঠাকুর লইয়া আমার বিবাহের ঠিক চৌত্রিশ বৎসর পরে একদিন শ্বশুরবাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। নীলুদাদার সন্ধান লইতে গিয়া শুনিলাম, তিনি আমারে পূর্বেই বৃন্দাবনে চলিয়া গেছেন।

গ্রামের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আমি কাশীতে গেলাম। কিন্তু পাপমনে কোথাও শান্তি পাইলাম না। ঠাকুরকে প্রতিদিন ডাকিয়া বলি, ঠাকুর, আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়ে আমার কাছে যেমন সত্য ছিল তুমি আমার কাছে তেমনি সত্য হয়ে ওঠো! কিন্তু কই, তিনি তো আমার প্রার্থনা শুনিলেন না। আমার বুক যে জুড়ায় না, আমার সমস্ত শরীর-মন যে কাঁদিতে থাকে। বাপ রে বাপ! মানুষের প্রাণ কী কঠিন।

সেই আট বৎসর বয়সে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছি, তাহার পরে একদিনের জন্যও বাপের বাড়ি আসিতে পাই নাই। তোমার মায়ের বিবাহে উপস্থিত থাকিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছিলাম, কোনো ফল হয় নাই। তাহার পর বাবার চিঠিতে তোমাদের জন্মের সংবাদ পাইলাম, আমার বোনের মৃত্যুসংবাদও পাইয়াছি। মায়ের-কোল-ছাড়া তোদের যে আমার কোলে টানিব, ঈশ্বর এপর্যন্ত এমন সুযোগ ঘটান নাই।

তীর্থে ঘুরিয়া যখন দেখিলাম মায়া এখনো মন ভরিয়া আছে, কোনো-একটা বুকের জিনিসকে পাইবার জন্য বুকের তৃষ্ণা এখনো মরে নাই–তখন তোদের খোঁজ করিতে লাগিলাম। শুনিয়াছিলাম তোদের বাপ ধর্ম ছাড়িয়া, সমাজ ছাড়িয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন। তা কী করিব! তোদের মা যে আমার এক মায়ের পেটের বোন।

কাশীতে এক ভদ্রলোকের কাছে তোমাদের খোঁজ পাইয়া এখানে আসিয়াছি। পরেশবাবু শুনিয়াছি ঠাকুর-দেবতা মানেন না, কিন্তু ঠাকুর যে উঁহার প্রতি প্রসন্ন সে উঁহার মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। পূজা পাইলেই ঠাকুর ভোলেন না, সে আমি খুব জানি–পরেশবাবু কেমন করিয়া তাঁহাকে বশ করিলেন সেই খবর আমি লইব। যাই হোক বাছা, একলা থাকিবার সময় এখানো আমার হয় নাই–সে আমি পারি না–ঠাকুর যেদিন দয়া করেন করিবেন, কিন্তু তোমাদের কোলের কাছে না রাখিয়া আমি বাঁচিব না।

পরেশ বরদাসুন্দরীর অনুপস্থিতিকালে হরিমোহিনীকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। ছাতের উপরকার নিভৃত ঘরে তাঁহাকে স্থান দিয়া যাহাতে তাঁহার আচার রক্ষা করিয়া চলার কোনো বিঘ্ন না ঘটে তাহার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন।

বরদাসুন্দরী ফিরিয়া আসিয়া তাঁহার ঘরকন্নার মধ্যে এই একটি অভাবনীয় প্রাদুর্ভাব দেখিয়া একেবারে হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া গেলেন। তিনি পরেশকে খুব তীব্র স্বরেই কহিলেন, “এ আমি পারব না।”

পরেশ কহিলেন, “তুমি আমাদের সকলকেই সহ্য করতে পারছ, আর ঐ একটি বিধবা অনাথাকে সইতে পারবে না?”

বরদাসুন্দরী জানিতেন পরেশের কাণ্ডজ্ঞান কিছুমাত্র নাই, সংসারে কিসে সুবিধা ঘটে বা অসুবিধা ঘটে সে সম্বন্ধে তিনি কোনোদিন বিবেচনামাত্র করেন না–হঠাৎ এক-একটা কাণ্ড করিয়া বসেন। তাহার পরে রাগই করো, বকো আর কাঁদো, একেবারে পাষাণের মূর্তির মতো স্থির হইয়া থাকেন। এমন লোকের সঙ্গে কে পারিয়া উঠিবে বলো। প্রয়োজন হইলে যাহার সঙ্গে ঝগড়া করাও অসম্ভব তাহার সঙ্গে ঘর করিতে কোন্‌ স্ত্রীলোক পারে!

সুচরিতা মনোরমার প্রায় একবয়সী ছিল। হরিমোহিনীর মনে হইতে লাগিল সুচরিতাকে দেখিতেও যেন অনেকটা সেই মনোরমারই মতো; আর স্বভাবটিও তাহার সঙ্গে মিলিয়াছে। তেমনি শান্ত অথচ তেমনি দৃঢ়। হঠাৎ পিছন হইতে তাহাকে দেখিয়া এক-এক সময় হরিমোহিনীর বুকের ভিতরটা যেন চমকিয়া উঠে। এক-এক দিন সন্ধ্যাবেলায় অন্ধকারে তিনি একলা বসিয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছেন, এমন সময় সুচরিতা কাছে আসিলে চোখ বুজিয়া তাহাকে দুই হাতে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন, “আহা আমার মনে হচ্ছে, যেন আমি তাকেই বুকের মধ্যে পেয়েছি। সে যেতে চায় নি, আমি তাকে জোর করে বিদায় করে দিয়েছি, জগৎ-সংসারে কি কোনো দিন কোনোমতেই আমার সে শাস্তির অবসান হবে না! দণ্ড যা পাবার তা পেয়েছি–এবার সে এসেছে; এই-যে ফিরে এসেছে; তেমনি হাসিমুখ করে ফিরে এসেছে; এই-যে আমার মা, এই-যে আমার মণি, আমার ধন! এই বলিয়া সুচরিতার সমস্ত মুখে হাত বুলাইয়া, তাহাকে চুমো খাইয়া, চোখের জলে ভাসিতে থাকেন; সুচরিতারও দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িত। সে তাঁহার গলা জড়াইয়া বলিত, “মাসি, আমিও তো মায়ের আদর বেশি দিন ভোগ করতে পারি নি; আজ আবার সেই হারানো মা ফিরে এসেছেন। কত দিন কত দুঃখের সময় যখন ঈশ্বরকে ডাকবার শক্তি ছিল না, যখন মনের ভিতরটা শুকিয়ে গিয়েছিল, তখন আমার মাকে ডেকেছি। সেই মা আজ আমার ডাক শুনে এসেছেন।”

হরিমোহিনী বলিতেন, “অমন করে বলিস নে, বলিস নে। তোর কথা শুনলে আমার এত আনন্দ হয় যে আমার ভয় করতে থাকে। হে ঠাকুর, দৃষ্টি দিয়ো না ঠাকুর! আর মায়া করব না মনে করি– মনটাকে পাষাণ করেই থাকতে চাই কিন্তু পারি নে যে। আমি বড়ো দুর্বল, আমাকে দয়া করো, আমাকে আর মেরো না! ওরে রাধারানী, যা, যা, আমার কাছ থেকে ছেড়ে যা। আমাকে আর জড়াস নে রে, জড়াস নে! ও আমার গোপীবল্লভ, আমার জীবননাথ, আমার গোপাল, আমার নীলমণি, আমাকে এ আবার কী বিপদে ফেলছ!”

সুচরিতা কহিত, “আমাকে তুমি জোর করে বিদায় করতে পারবে না মাসি! আমি তোমাকে কখনো ছাড়ব না– আমি বরাবর তোমার এই কাছেই রইলুম।”

বলিয়া তাঁহার বুকের মধ্যে মাথা রাখিয়া শিশুর মতো চুপ করিয়া থাকিত।

দুই দিনের মধ্যেই সুচরিতার সঙ্গে তাহার মাসির এমন একটা গভীর সম্বন্ধ বাধিয়া গেল যে ক্ষুদ্র কালের দ্বারা তাহার পরিমাপ হইতে পারে না।

বরদাসুন্দরী ইহাতেও বিরক্ত হইয়া গেলেন। “মেয়েটার রকম দেখো। যেন আমরা কোনোদিন উহার কোনো আদর-যত্ন করি নাই। বলি, এতদিন মাসি ছিলেন কোথায়! ছোটোবেলা হইতে আমরা যে এত করিয়া মানুষ করিলাম আর আজ মাসি বলিতেই একেবারে অজ্ঞান। আমি কর্তাকে বরাবর বলিয়া আসিয়াছি, ঐ-যে সুচরিতাকে তোমরা সবাই ভালো ভালো কর, ও কেবল বাহিরে ভালোমানুষি করে, কিন্তু উহার মন পাবার জো নাই। আমরা এতদিন উহার যা করিয়াছি সব বৃথাই হইয়াছে।’

পরেশ যে বরদাসুন্দরীর দরদ বুঝিবেন না তাহা তিনি জানিতেন। শুধু তাই নহে, হরিমোহিনীর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করিলে তিনি যে পরেশের কাছে খাটো হইয়া যাইবেন ইহাতেও তাঁহার সন্দেহ ছিল না। সেইজন্যই তাঁর রাগ আরো বাড়িয়া উঠিল। পরেশ যাহাই বলুন, কিন্তু অধিকাংশ বুদ্ধিমান লোকের সঙ্গেই যে বরদাসুন্দরীর মত মেলে ইহাই প্রমাণ করিবার জন্য তিনি দল বাড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের সমাজের প্রধান-অপ্রধান সকল লোকের কাছেই হরিমোহিনীর ব্যাপার লইয়া সমালোচনা জুড়িয়া দিলেন। হরিমোহিনীর হিঁদুয়ানি, তাঁহার ঠাকুরপূজা, বাড়িতে ছেলেমেয়ের কাছে তাঁহার কুদৃষ্টান্ত, ইহা লইয়া তাঁহার আক্ষেপ-অভিযোগের অন্ত রহিল না।

শুধু লোকের কাছে অভিযোগ নহে, বরদাসুন্দরী সকল প্রকারে হরিমোহিনীর অসুবিধা ঘটাইতে লাগিলেন। হরিমোহিনীর রন্ধনাদির জল তুলিয়া দিবার জন্য যে একজন গোয়ালা বেহারা ছিল তাহাকে তিনি ঠিক সময় বুঝিয়া অন্য কাজে নিযুক্ত করিয়া দিতেন। সে সম্বন্ধে কোনো কথা উঠিলে বলিতেন, “কেন, রামদীন আছে তো?’ রামদীন জাতে দোসাদ; তিনি জানিতেন তাহার হাতের জল হরিমোহিনী ব্যবহার করিবেন না। সে কথা কেহ বলিলে বলিতেন, “অত বামনাই করতে চান তো আমাদের ব্রাহ্ম-বাড়িতে এলেন কেন? আমাদের এখানে ও-সমস্ত জাতের বিচার করা চলবে না। আমি কোনোমতেই এতে প্রশ্রয় দেব না।’ এইরূপ উপলক্ষে তাঁহার কর্তব্যবোধ অত্যন্ত উগ্র হইয়া উঠিত। তিনি বলিতেন, ব্রাহ্মসমাজে ক্রমে সামাজিক শৈথিল্য অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিতেছে; এইজন্যই ব্রাহ্মসমাজ যথেষ্ট-পরিমাণে কাজ করিতে পারিতেছে না। তাঁহার সাধ্যমত তিনি এরূপ শৈথিল্যে যোগ দিতে পারিবেন না। না, কিছুতেই না। ইহাতে যদি কেহ তাঁহাকে ভুল বোঝে তবে সেও স্বীকার, যদি আত্মীয়েরাও বিরুদ্ধ হইয়া উঠে তবে সেও তিনি মাথা পাতিয়া লইবেন। পৃথিবীতে মহাপুরুষেরা, যাঁহারা কোনো মহৎ কর্ম করিয়াছেন, তাঁহাদের সকলকেই যে নিন্দা ও বিরোধ সহ্য করিতে হইয়াছে সেই কথাই তিনি সকলকে স্মরণ করাইতে লাগিলেন।

কোনো অসুবিধায় হরিমোহিনীকে পরাস্ত করিতে পারিত না। তিনি কৃচ্ছ্রসাধনের চূড়ান্ত সীমায় উঠিবেন বলিয়াই যেন পণ করিয়াছিলেন। তিনি অন্তরে যে অসহ্য দুঃখ পাইয়াছেন বাহিরেও যেন তাহার সহিত ছন্দ রক্ষা করিবার জন্য কঠোর আচারের দ্বারা অহরহ কষ্ট সৃজন করিয়া চলিতেছিলেন। এইরূপে দুঃখকে নিজের ইচ্ছার দ্বারা বরণ করিয়া তাহাকে আত্মীয় করিয়া লইয়া তাহাকে বশ করিবার এই সাধনা।

হরিমোহিনী যখন দেখিলেন জলের অসুবিধা হইতেছে তখন তিনি রন্ধন একেবারে ছাড়িয়াই দিলেন। তাঁহার ঠাকুরের কাছে নিবেদন করিয়া প্রসাদস্বরূপে দুধ এবং ফল খাইয়া কাটাইতে লাগিলেন। সুচরিতা ইহাতে অত্যন্ত কষ্ট পাইল। মাসি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলিলেন, “মা, এ আমার বড়ো ভালো হয়েছে। এই আমার প্রয়োজন ছিল। এতে আমার কোনো কষ্ট নেই, আমার আনন্দই হয়।”

সুচরিতা কহিল, “মাসি, আমি যদি অন্য জাতের হাতে জল বা খাবার না খাই তা হলে তুমি আমাকে তোমার কাজ করতে দেবে?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “কেন মা, তুমি যে ধর্ম মান সেই মতেই তুমি চলো– আমার জন্যে তোমাকে অন্য পথে যেতে হবে না। আমি তোমাকে কাছে পেয়েছি, বুকে রাখছি, প্রতিদিন দেখতে পাই, এই আমার আনন্দ। পরেশবাবু তোমার গুরু, তোমার বাপের মতো, তিনি তোমাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন তুমি সেই মেনে চলো, তাতেই ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন।”

হরিমোহিনী বরদাসুন্দরীর সমস্ত উপদ্রব এমন করিয়া সহিতে লাগিলেন যেন তাহা তিনি কিছুই বুঝিতে পারেন নাই। পরেশবাবু যখন প্রত্যহ আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন– কেমন আছেন, কোনো অসুবিধা হইতেছে না তো– তিনি বলিতেন, “আমি খুব সুখে আছি।”

কিন্তু বরদাসুন্দরীর সমস্ত অন্যায় সুচরিতাকে প্রতি মুহূর্তে জর্জরিত করিতে লাগিল। সে তো নালিশ করিবার মেয়ে নয়; বিশেষত পরেশবাবুর কাছে বরদাসুন্দরীর ব্যবহারের কথা বলা তাহার দ্বারা কোনোমতেই ঘটিতে পারে না। সে নিঃশব্দে সমস্ত সহ্য করিতে লাগিল– এ সম্বন্ধে কোনোপ্রকার আক্ষেপ প্রকাশ করিতেও তাহার অত্যন্ত সংকোচ বোধ হইত।

ইহার ফল হইল এই যে, সুচরিতা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণভাবেই তাহার মাসির কাছে আসিয়া পড়িল। মাসির বারংবার নিষেধসত্ত্বেও আহার-পান সম্বন্ধে সে তাঁহারই সম্পূর্ণ অনুবর্তী হইয়া চলিতে লাগিল। শেষকালে সুচরিতার কষ্ট হইতেছে দেখিয়া দায়ে পড়িয়া হরিমোহিনীকে পুনরায় রন্ধনাদিতে মন দিতে হইল। সুচরিতা কহিল, “মাসি, তুমি আমাকে যেমন করে থাকতে বল আমি তেমনি করেই থাকব, কিন্তু তোমার জল আমি নিজে তুলে দেব, সে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “মা, তুমি কিছুই মনে কোরো না, কিন্তু ঐ জলে যে আমার ঠাকুরের ভোগ হয়।”

সুচরিতা কহিল, “মাসি, তোমার ঠাকুরও কি জাত মানেন? তাঁকেও কি পাপ লাগে? তাঁরও কি সমাজ আছে না কি?’

অবশেষে একদিন সুচরিতার নিষ্ঠার কাছে হরিমোহিনীকে হার মানিতে হইল। সুচরিতার সেবা তিনি সম্পূর্ণভাবেই গ্রহণ করিলেন। সতীশও দিদির অনুকরণে “মাসির রান্না খাইব’ বলিয়া ধরিয়া পড়িল। এমনি করিয়া এই তিনটিতে মিলিয়া পরেশবাবুর ঘরের কোণে আর-একটি ছোটো সংসার জমিয়া উঠিল। কেবল ললিতা এই দুটি সংসারের মাঝখানে সেতুস্বরূপে বিরাজ করিতে লাগিল। বরদাসুন্দরী তাঁহার আর-কোনো মেয়েকে এ দিকে ঘেঁষিতে দিতেন না– কিন্তু ললিতাকে নিষেধ করিয়া পারিয়া উঠিবার শক্তি তাঁহার ছিল না।

বরদাসুন্দরী তাঁহার ব্রাহ্মিকাবন্ধুদিগকে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে তাঁহাদের ছাদের উপরেই সভা হইত। হরিমোহিনী তাঁহার স্বাভাবিক গ্রাম্য সরলতার সহিত মেয়েদের আদর-অভ্যর্থনা করিতে চেষ্টা করিতেন, কিন্তু ইহারা যে তাঁহাকে অবজ্ঞা করে তাহা তাঁহার কাছে গোপন রহিল না। এমন-কি, হিন্দুদের সামাজিক আচার-ব্যবহার লইয়া তাঁহার সমক্ষেই বরদাসুন্দরী তীব্র সমালোচনা উত্থাপিত করিতেন এবং অনেক রমণী হরিমোহিনীর প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখিয়া সেই সমালোচনায় যোগ দিতেন।

সুচরিতা তাহার মাসির কাছে থাকিয়া এ-সমস্ত আক্রমণ নীরবে সহ্য করিত। কেবল, সেও যে তাহার মাসির দলে ইহাই সে যেন গায়ে পড়িয়া প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিত। যেদিন আহারের আয়োজন থাকিত সেদিন সুচরিতাকে সকলে খাইতে ডাকিলে সে বলিত, “না, আমি খাই নে।”

“সে কী! তুমি বুঝি আমাদের সঙ্গে বসে খাবে না!”

“না!”

বরদাসুন্দরী বলিতেন, “আজকাল সুচরিতা যে মস্ত হিঁদু হয়ে উঠেছেন, তা বুঝি জান না? উনি যে আমাদের ছোঁওয়া খান না।”

“সুচরিতাও হিঁদু হয়ে উঠল! কালে কালে কতই যে দেখতে হবে তাই ভাবি।”

হরিমোহিনী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিতেন, “রাধারানী মা, যাও মা! তুমি খেতে যাও মা!”

দলের লোকের কাছে যে সুচরিতা তাঁহার জন্য এমন করিয়া খোঁটা খাইতেছে ইহা তাঁহার কাছে অত্যন্ত কষ্টকর হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু সুচরিতা অটল হইয়া থাকিত। একদিন কোনো ব্রাহ্ম মেয়ে কৌতূহলবশত হরিমোহিনীর ঘরের মধ্যে জুতা লইয়া প্রবেশ করিতে প্রবৃত্ত হইলে সুচরিতা পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “ও ঘরে যেয়ো না।”

“কেন?”

“ও ঘরে ওঁর ঠাকুর আছে।”

“ঠাকুর আছে! তুমি বুঝি রোজ ঠাকুর পুজো কর।”

হরিমোহিনী বলিলেন, “হাঁ মা, পুজো করি বৈকি।”

“ঠাকুরকে তোমার ভক্তি হয়?”

“পোড়া কপাল আমার! ভক্তি আর কই হল! ভক্তি হলে তো বেঁচেই যেতুম।”

সেদিন ললিতা উপস্থিত ছিল। সে মুখ লাল করিয়া প্রশ্নকারিণীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি যাঁর উপাসনা কর তাঁকে ভক্তি কর?”

“বাঃ, ভক্তি করি নে তো কী!”

ললিতা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, “ভক্তি তো করই না, আর ভক্তি যে কর না সেটা তোমার জানাও নেই।”

সুচরিতা যাহাতে আচার-ব্যবহারে তাহার দল হইতে পৃথক না হয় সেজন্য হরিমোহিনী অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না।

ইতিপূর্বে হারানবাবুতে বরদাসুন্দরীতে ভিতরে ভিতরে একটা বিরোধের ভাবই ছিল। বর্তমান ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে খুব মিল হইল। বরদাসুন্দরী কহিলেন– যিনি যাই বলুন-না কেন, ব্রাহ্মসমাজের আদর্শকে বিশুদ্ধ রাখিবার জন্য যদি কাহারো দৃষ্টি থাকে তো সে পানুবাবুর। হারানবাবুও– ব্রাহ্মপরিবারকে সর্বপ্রকারে নিষ্কলঙ্ক রাখিবার প্রতি বরদাসুন্দরীর একান্ত বেদনাপূর্ণ সচেতনতাকে ব্রাহ্মগৃহিণীমাত্রেরই পক্ষে একটি সুদৃষ্টান্ত বলিয়া সকলের কাছে প্রকাশ করিলেন। তাঁহার এই প্রশংসার মধ্যে পরেশবাবুর প্রতি বিশেষ একটু খোঁচা ছিল।

হারানবাবু একদিন পরেশবাবুর সম্মুখেই সুচরিতাকে কহিলেন, “শুনলুম নাকি আজকাল তুমি ঠাকুরের প্রসাদ খেতে আরম্ভ করেছ।”

সুচরিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল, কিন্তু যেন সে কথাটা শুনিতেই পাইল না এমনিভাবে টেবিলের উপরকার দোয়াতদানিতে কলমগুলা গুছাইয়া রাখিতে লাগিল। পরেশবাবু একবার করুণনেত্রে সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া হারানবাবুকে কহিলেন, “পানুবাবু, আমরা যা-কিছু খাই সবই তো ঠাকুরের প্রসাদ।”

হারানবাবু কহিলেন, “কিন্তু সুচরিতা যে আমাদের ঠাকুরকে পরিত্যাগ করবার উদ্যোগ করছেন।”

পরেশবাবু কহিলেন, “তাও যদি সম্ভব হয় তবে তা নিয়ে উৎপাত করলে কি তার কোনো প্রতিকার হবে?”

হারানবাবু কহিলেন, “স্রোতে যে লোক ভেসে যাচ্ছে তাকে কি ডাঙায় তোলবার চেষ্টাও করতে হবে না?”

পরেশবাবু কহিলেন, “সকলে মিলে তার মাথার উপর ঢেলা ছুঁড়ে মারাকেই ডাঙায় তোলবার চেষ্টা বলা যায় না। পানুবাবু, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমি এতটুকুবেলা থেকেই সুচরিতাকে দেখে আসছি। ও যদি জলেই পড়ত তা হলে আমি আপনাদের সকলের আগেই জানতে পারতুম এবং আমি উদাসীন থাকতুম না।”

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা তো এখানেই রয়েছেন। আপনি ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন-না। শুনতে পাই উনি সকলের ছোঁওয়া খান না। সে কথা কি মিথ্যা?”

সুচরিতা দোয়াতদানের প্রতি অনাবশ্যক মনোযোগ দূর করিয়া কহিল, “বাবা জানেন আমি সকলের ছোঁওয়া খাই নে। উনি যদি আমার এই আচরণ সহ্য করে থাকেন তা হলেই হল। আপনাদের যদি ভালো না লাগে আপনারা যত খুশি আমার নিন্দা করুন, কিন্তু বাবাকে বিরক্ত করছেন কেন? উনি আপনাদের কত ক্ষমা করে চলেন তা আপনারা জানেন? এ কি তারই প্রতিফল?”

হারানবাবু আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিলেন– সুচরিতাও আজকাল কথা কহিতে শিখিয়াছে!

পরেশবাবু শান্তিপ্রিয় লোক; তিনি নিজের বা পরের সম্বন্ধে অধিক আলোচনা ভালোবাসেন না। এপর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজে তিনি কোনো কাজে কোনো প্রধান পদ গ্রহণ করেন নাই; নিজেকে কাহারো লক্ষগোচর না করিয়া নিভৃতে জীবন যাপন করিয়াছেন। হারানবাবু পরেশের এই ভাবকেই উৎসাহহীনতা ও ঔদাসীন্য বলিয়া গণ্য করিতেন, এমন-কি, পরেশবাবুকে তিনি ইহা লইয়া ভর্ৎসনাও করিয়াছেন। ইহার উত্তরে পরেশবাবু বলিয়াছিলেন– “ঈশ্বর, সচল এবং অচল এই দুই শ্রেণীর পদার্থই সৃষ্টি করিয়াছেন। আমি নিতান্তই অচল। আমার মতো লোকের দ্বারা যে কাজ পাওয়া সম্ভব ঈশ্বর তাহা আদায় করিয়া লইবেন। যাহা সম্ভব নহে, তাহার জন্য চঞ্চল হইয়া কোনো লাভ নাই। আমার বয়স যথেষ্ট হইয়াছে; আমার কী শক্তি আছে আর কী নাই তাহার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে। এখন আমাকে ঠেলাঠেলি করিয়া কোনো ফল পাওয়া যাইবে না।’

হারানবাবুর ধারণা ছিল তিনি অসাড় হৃদয়েও উৎসাহ সঞ্চার করিতে পারেন; জড়চিত্তকে কর্তব্যের পথে ঠেলিয়া দেওয়া এবং স্খলিত জীবনকে অনুতাপে বিগলিত করা তাঁহার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা তাঁহার অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং একাগ্র শুভ ইচ্ছাকে কেহই অধিক দিন প্রতিরোধ করিতে পারে না এইরূপ তাঁহার বিশ্বাস। তাঁহার সমাজের লোকের ব্যক্তিগত চরিত্রে যে-সকল ভালো পরিবর্তন ঘটিয়াছে তিনি নিজেকেই কোনো-না-কোনো প্রকারে তাহার প্রধান কারণ বলিয়া নিশ্চয় স্থির করিয়াছেন। তাঁহার অলক্ষ্য প্রভাবও যে ভিতরে ভিতরে কাজ করে ইহাতে তাঁহার সন্দেহ নাই। এ পর্যন্ত সুচরিতাকে যখনই তাঁহার সম্মুখে কেহ বিশেষরূপে প্রশংসা করিয়াছে তিনি এমন ভাব ধারণ করিয়াছেন যেন সে প্রশংসা সম্পূর্ণই তাঁহার। তিনি উপদেশ দৃষ্টান্ত এবং সঙ্গতেজের দ্বারা সুচরিতার চরিত্রকে এমন করিয়া গড়িয়া তুলিতেছেন যে এই সুচরিতার জীবনের দ্বারাই লোকসমাজে তাঁহার আশ্চর্য প্রভাব প্রমাণিত হইবে এইরূপ তাঁহার আশা ছিল।

সেই সুচরিতার শোচনীয় পতনে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁহার গর্ব কিছুমাত্র হ্রাস হইল না, তিনি সমস্ত দোষ চাপাইলেন পরেশবাবুর স্কন্ধে। পরেশবাবুকে লোকে বরাবর প্রশংসা করিয়া আসিয়াছে, কিন্তু হারানবাবু কখনো তাহাতে যোগ দেন নাই; ইহাতেও তাঁহার কতদূর প্রাজ্ঞতা প্রকাশ পাইয়াছে তাহা এইবার সকলে বুঝিতে পারিবে এইরূপ তিনি আশা করিতেছেন।

হারানবাবুর মতো লোক আর-সকলই সহ্য করিতে পারেন, কিন্তু যাহাদিগকে বিশেষরূপে হিতপথে চালাইতে চেষ্টা করেন তাহারা যদি নিজের বুদ্ধি অনুসারে স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করে তবে সে অপরাধ তিনি কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না। সহজে তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া তাঁহার পক্ষে অসাধ্য; যতই দেখেন তাঁহার উপদেশে ফল হইতেছে না ততই তাঁহার জেদ বাড়িয়া যাইতে থাকে; তিনি ফিরিয়া ফিরিয়া বারংবার আক্রমণ করিতে থাকেন। কল যেমন দম না ফুরাইলে থামিতে পারে না তিনিও তেমনি কোনোমতেই নিজেকে সংবরণ করিতে পারেন না; বিমুখ কর্ণের কাছে এক কথা সহস্র বার আবৃত্তি করিয়াও হার মানিতে চাহেন না।

ইহাতে সুচরিতা বড়ো কষ্ট পাইতে লাগিল– নিজের জন্য নহে, পরেশবাবুর জন্য। পরেশবাবু যে ব্রাহ্মসমাজের সকলের সমালোচনার বিষয় হইয়া উঠিয়াছেন এই অশান্তি নিবারণ করা যাইবে কী উপায়ে? অপর পক্ষে সুচরিতার মাসিও প্রতিদিন বুঝিতে পারিতেছিলেন যে, তিনি একান্ত নম্র হইয়া নিজেকে যতই আড়ালে রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন ততই এই পরিবারের পক্ষে উপদ্রবস্বরূপ হইয়া উঠিতেছেন। এজন্য তাহার মাসির অত্যন্ত লজ্জা ও সংকোচ সুচরিতাকে প্রত্যহ দগ্ধ করিতে লাগিল। এই সংকট হইতে উদ্ধারের যে পথ কোথায় তাহা সুচরিতা কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না।

এ দিকে সুচরিতার শীঘ্র বিবাহ দিয়া ফেলিবার জন্য বরদাসুন্দরী পরেশবাবুকে অত্যন্ত পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। তিনি কহিলেন, “সুচরিতার দায়িত্ব আর আমাদের বহন করা চলে না, সে এখন নিজের মতে চলতে আরম্ভ করেছে। তার বিবাহের যদি দেরি থাকে তা হলে মেয়েদের নিয়ে আমি অন্য কোথাও যাব– সুচরিতার অদ্ভুত দৃষ্টান্ত মেয়েদের পক্ষে বড়োই অনিষ্টের কারণ হচ্ছে। দেখো এর জন্যে পরে তোমাকে অনুতাপ করতে হবেই। ললিতা আগে তো এরকম ছিল না; এখন ও যে আপন ইচ্ছামত যা খুশি একটা কাণ্ড করে বসে, কাকেও মানে না, তার মূলে কে? সেদিন যে ব্যাপারটা বাধিয়ে বসল, যার জন্যে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি, তুমি কি মনে কর তার মধ্যে সুচরিতার কোনো হাত ছিল না? তুমি নিজের মেয়ের চেয়ে সুচরিতাকে বরাবর বেশি ভালোবাস তাতে আমি কোনোদিন কোনো কথা বলি নি, কিন্তু আর চলে না, সে আমি স্পষ্টই বলে রাখছি।”

সুচরিতার জন্য নহে, কিন্তু পারিবারিক অশান্তির জন্য পরেশবাবু চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। বরদাসুন্দরী যে উপলক্ষটি পাইয়া বসিয়াছেন ইহা লইয়া তিনি যে হুলস্থূল কাণ্ড বাধাইয়া বসিবেন এবং যতই দেখিবেন, আন্দোলনে কোনো ফল হইতেছে না ততই দুর্বার হইয়া উঠিতে থাকিবেন, ইহাতে তাঁহার কোনো সন্দেহ ছিল না। যদি সুচরিতার বিবাহ সত্বর সম্ভবপর হয় তবে বর্তমান অবস্থায় সুচরিতার পক্ষেও তাহা শান্তিজনক হইতে পারে তাহাতে সন্দেহ নাই। তিনি বরদাসুন্দরীকে বলিলেন, “পানুবাবু যদি সুচরিতাকে সম্মত করতে পারেন তা হলে আমি বিবাহ সম্বন্ধে কোনো আপত্তি করব না।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আবার কতবার করে সম্মত করতে হবে? তুমি তো অবাক করলে! এত সাধাসাধিই বা কেন? পানুবাবুর মতো পাত্র উনি পাবেন কোথায় তাই জিজ্ঞাসা করি। তুমি রাগ কর আর যাই কর সত্যি কথা বলতে কি, সুচরিতা পানুবাবুর যোগ্য মেয়ে নয়।”

পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবুর প্রতি সুচরিতার মনের ভাব যে কী তা আমি স্পষ্ট করে বুঝতে পারি নি। অতএব তারা নিজেদের মধ্যে যতক্ষণ কথাটা পরিষ্কার করে না নেবে ততক্ষণ আমি এ বিষয়ে কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারব না।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “বুঝতে পার নি! এত দিন পরে স্বীকার করলে! ঐ মেয়েটিকে বোঝা বড়ো সহজ নয়। ও বাইরে একরকম– ভিতরে একরকম!”

বরদাসুন্দরী হারানবাবুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।

সেদিন কাগজে ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান দুর্গতির আলোচনা ছিল। তাহার মধ্যে পরেশবাবুর পরিবারের প্রতি এমনভাবে লক্ষ করা ছিল যে, কোনো নাম না থাকা সত্ত্বেও আক্রমণের বিষয় যে কে তাহা সকলের কাছেই বেশ স্পষ্ট হইয়াছিল; এবং লেখক যে কে তাহাও লেখার ভঙ্গিতে অনুমান করা কঠিন হয় নাই। কাগজখানায় কোনোমতে চোখ বুলাইয়াই সুচরিতা তাহা কুটিকুটি করিয়া ছিঁড়িতেছিল। ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে কাগজের অংশগুলিকে যেন পরমাণুতে পরিণত করিবার জন্য তাহার রোখ চড়িয়া যাইতেছিল।

এমন সময় হারানবাবু ঘরে প্রবেশ করিয়া সুচরিতার পাশে একটা চৌকি টানিয়া বসিলেন। সুচরিতা একবার মুখ তুলিয়াও চাহিল না, সে যেমন কাগজ ছিঁড়িতেছিল তেমনি ছিঁড়িতেই লাগিল।

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা, আজ একটা গুরুতর কথা আছে। আমার কথায় একটু মন দিতে হবে।”

সুচরিতা কাগজ ছিঁড়িতেই লাগিল। নখে ছেঁড়া যখন অসম্ভব হইল তখন থলে হইতে কাঁচি বাহির করিয়া কাঁচিটা দিয়া কাটিতে লাগিল। ঠিক এই মুহূর্তে ললিতা ঘরে প্রবেশ করিল।

হারানবাবু কহিলেন, “ললিতা, সুচরিতার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।”

ললিতা ঘর হইতে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই সুচরিতা তাহার আঁচল চাপিয়া ধরিল। ললিতা কহিল, “তোমার সঙ্গে পানুবাবুর যে কথা আছে!”

সুচরিতা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া ললিতার আঁচল চাপিয়াই রহিল– তখন ললিতা সুচরিতার আসনের এক পাশে বসিয়া পড়িল।

হারানবাবু কোনো বাধাতেই দমিবার পাত্র নহেন। তিনি আর ভূমিকামাত্র না করিয়া একেবারে কথাটা পাড়িয়া বসিলেন। কহিলেন, “আমাদের বিবাহে আর বিলম্ব হওয়া উচিত মনে করি নে। পরেশবাবুকে জানিয়েছিলাম; তিনি বললেন, তোমার সম্মতি পেলেই আর কোনো বাধা থাকবে না। আমি স্থির করেছি, আগামী রবিবারের পরের রবিবারেই”–

সুচরিতা কথা শেষ করিতে না দিয়াই কহিল, “না।”

সুচরিতার মুখে এই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সুস্পষ্ট এবং উদ্ধত “না” শুনিয়া হারানবাবু থমকিয়া গেলেন। সুচরিতাকে তিনি অত্যন্ত বাধ্য বলিয়া জানিতেন। সে যে একমাত্র “না” বাণের দ্বারা তাঁহার প্রস্তাবটিকে এক মুহূর্তে অর্ধপথে ছেদন করিয়া ফেলিবে, ইহা তিনিও মনে করেন নাই। তিনি বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “না! না মানে কী? তুমি আরো দেরি করতে চাও?”

সুচরিতা কহিল, “না।”

হারানবাবু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “তবে?”

সুচরিতা মাথা নত করিয়া কহিল, “বিবাহে আমার মত নেই।”

হারানবাবু হতবুদ্ধির ন্যায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মত নেই? তার মানে?”

ললিতা ঠোকর দিয়া কহিল, “পানুবাবু, আপনি আজ বাংলা ভাষা ভুলে গেলেন নাকি?”

হারানবাবু কঠোর দৃষ্টির দ্বারা ললিতাকে আঘাত করিয়া কহিলেন, “বরঞ্চ মাতৃভাষা ভুলে গেছি এ কথা স্বীকার করা সহজ, কিন্তু যে মানুষের কথায় বরাবর শ্রদ্ধা করে এসেছি তাকে ভুল বুঝেছি এ কথা স্বীকার করা সহজ নয়।”

ললিতা কহিল, “মানুষকে বুঝতে সময় লাগে, আপনার সম্বন্ধেও হয়তো সে কথা খাটে।”

হারানবাবু কহিলেন, “প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত আমার কথার বা মতের বা ব্যবহারের কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি– আমি আমাকে ভুল বোঝবার কোনো উপলক্ষ কাউকে দিই নি এ কথা আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি– সুচরিতাই বলুন আমি ঠিক বলছি কি না।”

ললিতা আবার কী একটা উত্তর দিতে যাইতেছিল– সুচরিতা তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিল, “আপনি ঠিক বলেছেন। আপনাকে আমি কোনো দোষ দিতে চাই নে।”

হারানবাবু কহিলেন, “দোষ যদি না দেবে তবে আমার প্রতি অন্যায়ই বা করবে কেন?”

সুচরিতা দৃঢ়স্বরে কহিল, “যদি একে অন্যায় বলেন তবে আমি অন্যায়ই করব– কিন্তু–”

বাহির হইতে ডাক আসিল, “দিদি, ঘরে আছেন?”

সুচরিতা উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি কহিল, “আসুন, বিনয়বাবু, আসুন।”

“ভুল করছেন দিদি, বিনয়বাবু আসেন নি, আমি বিনয় মাত্র, আমাকে সমাদর করে লজ্জা দেবেন না”– বলিয়া বিনয় ঘরে প্রবেশ করিয়াই হারানবাবুকে দেখিতে পাইল। হারানবাবুর মুখের অপ্রসন্নতা লক্ষ্য করিয়া কহিল, “অনেক দিন আসি নি বলে রাগ করেছেন বুঝি!”

হারানবাবু পরিহাসে যোগ দিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “রাগ করবারই কথা বটে। কিন্তু আজ আপনি একটু অসময়ে এসেছেন– সুচরিতার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ কথা হচ্ছিল।”

বিনয় শশব্যস্ত হইয়া উঠিল; কহিল, “ঐ দেখুন, আমি কখন এলে যে অসময়ে আসা হয় না তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতেই পারলুম না! এইজন্যই আসতে সাহসই হয় না।”

বলিয়া বিনয় বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল।

সুচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু, যাবেন না। আমাদের যা কথা ছিল শেষ হয়ে গেছে। আপনি বসুন।”

বিনয় বুঝিতে পারিল সে আসাতে সুচরিতা একটা বিশেষ সংকট হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে। খুশি হইয়া একটা চৌকিতে বসিয়া পড়িল এবং কহিল, “আমাকে প্রশ্রয় দিলে আমি কিছুতেই সামলাতে পারি নে। আমাকে বসতে বললে আমি বসবই এইরকম আমার স্বভাব। অতএব, দিদির প্রতি নিবেদন এই যে, এ-সব কথা যেন বুঝে-সুঝে বলেন, নইলে বিপদে পড়বেন।”

হারানবাবু কোনো কথা না বলিয়া আসন্ন ঝড়ের মতো স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তিনি নীরবে প্রকাশ করিলেন– “আচ্ছা বেশ, আমি অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলাম, আমার যা কথা আছে তাহা শেষ পর্যন্ত বলিয়া তবে আমি উঠিব।’

দ্বারের বাহির হইতে বিনয়ের কণ্ঠস্বর শুনিয়াই ললিতার বুকের ভিতরকার সমস্ত রক্ত যেন চমক খাইয়া উঠিয়াছিল। সে বহুকষ্টে আপনার স্বাভাবিক ভাব রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই পারিল না। বিনয় যখন ঘরে প্রবেশ করিল ললিতা বেশ সহজে তাহাদের পরিচিত বন্ধুর মতো তাহাকে কোনো কথা বলিতে পারিল না। কোন্‌ দিকে চাহিবে, নিজের হাতখানা লইয়া কী করিবে, সে যেন একটা ভাবনার বিষয় হইয়া পড়িল। একবার উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু সুচরিতা কোনোমতেই তাহার কাপড় ছাড়িল না।

বিনয়ও যাহা-কিছু কথাবার্তা সমস্ত সুচরিতার সঙ্গেই চালাইল, ললিতার নিকট কোনো কথা ফাঁদা তাহার মতো বাক্‌পটু লোকের কাছেও আজ শক্ত হইয়া উঠিল। এইজন্যই সে যেন ডবল জোরে সুচরিতার সঙ্গে আলাপ করিতে লাগিল, কোথাও কোনো ফাঁক পড়িতে দিল না।

কিন্তু হারানবাবুর কাছে ললিতা ও বিনয়ের এই নূতন সংকোচ অগোচর রহিল না। যে ললিতা তাঁহার সম্বন্ধে আজকাল এমন প্রখর ভাবে প্রগল্‌ভা হইয়া উঠিয়াছে সে আজ বিনয়ের কাছে এমন সংকুচিত ইহা দেখিয়া তিনি মনে মনে জ্বলিতে লাগিলেন এবং ব্রাহ্মসমাজের বাহিরের লোকের সহিত কন্যাদের অবাধ পরিচয়ের অবকাশ দিয়া পরেশবাবু যে নিজের পরিবারকে কিরূপ কদাচারের মধ্যে লইয়া যাইতেছেন তাহা মনে করিয়া পরেশবাবুর প্রতি তাঁহার ঘৃণা আরো বাড়িয়া উঠিল এবং পরেশবাবুকে যেন একদিন এজন্য বিশেষ অনুতাপ করিতে হয় এই কামনা তাঁহার মনের মধ্যে অভিশাপের মতো জাগিতে লাগিল।

অনেকক্ষণ এইভাবে চলিলে পর স্পষ্টই বুঝা গেল হারানবাবু উঠিবেন না। তখন সুচরিতা বিনয়কে কহিল, “মাসির সঙ্গে অনেক দিন আপনার দেখা হয় নি। তিনি আপনার কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন। একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না?”

বিনয় চৌকি হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “মাসির কথা আমার মনে ছিল না এমন অপবাদ আমাকে দেবেন না।”

সুচরিতা যখন বিনয়কে তাহার মাসির কাছে লইয়া গেল তখন ললিতা উঠিয়া কহিল, “পানুবাবু, আমার সঙ্গে আপনার বোধ হয় বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই।”

হারানবাবু কহিলেন, “না। তোমার বোধ হয় অন্যত্র বিশেষ প্রয়োজন আছে। তুমি যেতে পারো।”

ললিতা কথাটার ইঙ্গিত বুঝিতে পারিল। সে তৎক্ষণাৎ উদ্ধত ভাবে মাথা তুলিয়া ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করিয়া দিয়া কহিল, “বিনয়বাবু আজ অনেক দিন পরে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে গল্প করতে যাচ্ছি। ততক্ষণ আপনি নিজের লেখা যদি পড়তে চান তা হলে– না ঐ যা, সে কাগজখানা দিদি দেখছি কুটি কুটি করে ফেলেছেন। পরের লেখা যদি সহ্য করতে পারেন তা হলে এইগুলি দেখতে পারেন।”

বলিয়া কোণের টেবিল হইতে সযত্নরক্ষিত গোরার রচনাগুলি আনিয়া হারানবাবুর সম্মুখে রাখিয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

হরিমোহিনী বিনয়কে পাইয়া অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করিলেন। কেবল যে এই প্রিয়দর্শন যুবকের প্রতি স্নেহবশত তাহা নহে। এ বাড়িতে বাহিরের লোক যে-কেহ হরিমোহিনীর কাছে আসিয়াছে সকলেই তাঁহাকে যেন কোনো এক ভিন্ন শ্রেণীর প্রাণীর মতো দেখিয়াছে। তাহারা কলিকাতার লোক, প্রায় সকলেই ইংরেজি ও বাংলা লেখাপড়ায় তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ– তাহাদের দূরত্ব ও অবজ্ঞার আঘাতে তিনি অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া পড়িতেছিলেন। বিনয়কে তিনি আশ্রয়ের মতো অনুভব করিলেন। বিনয়ও কলিকাতার লোক, হরিমোহিনী শুনিয়াছেন লেখাপড়াতেও সে বড়ো কম নয়– অথচ এই বিনয় তাঁহাকে কিছুমাত্র অশ্রদ্ধা করে না, তাঁহাকে আপন লোকের মতো দেখে, ইহাতে তাঁহার আত্মসম্মান একটা নির্ভর পাইল। বিশেষ করিয়া এইজন্যই অল্প পরিচয়েই বিনয় তাঁহার নিকট আত্মীয়ের স্থান লাভ করিল। তাঁহার মনে হইতে লাগিল, বিনয় তাঁহার বর্মের মতো হইয়া অন্য লোকের ঔদ্ধত্য হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিবে। এ বাড়িতে তিনি অত্যন্ত বেশি প্রকাশ্য হইয়া পড়িয়াছিলেন– বিনয় যেন তাঁহার আবরণের মতো হইয়া তাঁহাকে আড়াল করিয়া রাখিবে।

হরিমোহিনীর কাছে বিনয় যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই ললিতা সেখানে কখনোই সহজে যাইত না– কিন্তু আজ হারানবাবুর গুপ্ত বিদ্রূপের আঘাতে সে সমস্ত সংকোচ ছিন্ন করিয়া যেন জোর করিয়া উপরের ঘরে গেল। শুধু গেল তাহা নহে, গিয়াই বিনয়ের সঙ্গে অজস্র কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিল। তাহাদের সভা খুব জমিয়া উঠিল; এমন-কি, মাঝে মাঝে তাহাদের হাসির শব্দ নীচের ঘরে একাকী আসীন হারানবাবুর কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া বিদ্ধ করিতে লাগিল। তিনি বেশিক্ষণ একলা থাকিতে পারিলেন না, বরদাসুন্দরীর সঙ্গে আলাপ করিয়া মনের আক্ষেপ নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। বরদাসুন্দরী শুনিলেন যে, সুচরিতা হারানবাবুর সঙ্গে বিবাহে অসম্মতি জ্ঞাপন করিয়াছে। শুনিয়া তাঁহার পক্ষে ধৈর্য রক্ষা করা একেবারে অসম্ভব হইল। তিনি কহিলেন, “পানুবাবু, আপনি ভালোমানষি করলে চলবে না। ও যখন বার বার সম্মতি প্রকাশ করেছে এবং ব্রাহ্মসমাজ-সুদ্ধ সকলেই যখন এই বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছে তখন ও আজ মাথা নাড়ল বলেই যে সমস্ত উল্‌টে যাবে এ কখনোই হতে দেওয়া চলবে না। আপনার দাবি আপনি কিছুতেই ছাড়বেন না বলে রাখছি, দেখি ও কী করতে পারে।”

এ সম্বন্ধে হারানবাবুকে উৎসাহ দেওয়া বাহুল্য– তিনি তখন কাঠের মতন শক্ত হইয়া বসিয়া মাথা তুলিয়া মনে মনে বলিতেছিলেন– “অন প্রিন্সিপ্‌ল্‌ এ দাবি ছাড়া চলিবে না– আমার পক্ষে সুচরিতাকে ত্যাগ করা বেশি কথা নয়, কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের মাথা হেঁট করিয়া দিতে পারিব না।’

বিনয় হরিমোহিনীর সহিত আত্মীয়তাকে পাকা করিয়া লইবার অভিপ্রায়ে আহারের আবদার করিয়া বসিয়াছিল। হরিমোহিনী তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হইয়া একটি ছোটো থালায় কিছু ভিজানো ছোলা, ছানা, মাখন, একটু চিনি, একটি কলা, এবং কাঁসার বাটিতে কিছু দুধ আনিয়া সযত্নে বিনয়ের সম্মুখে ধরিয়া দিয়াছেন। বিনয় হাসিয়া কহিল, “অসময়ে ক্ষুধা জানাইয়া মাসিকে বিপদে ফেলিব মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু আমি ঠকিলাম”– এই বলিয়া খুব আড়ম্বর করিয়া বিনয় আহারে বসিয়াছে এমন সময় বরদাসুন্দরী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিনয় তাহার থালার উপরে যথাসম্ভব নত হইয়া নমস্কারের চেষ্টা করিয়া কহিল, “অনেকক্ষণ নীচে ছিলুম; আপনার সঙ্গে দেখা হল না।” বরদাসুন্দরী তাহার কোনো উত্তর না করিয়া সুচরিতার প্রতি লক্ষ করিয়া কহিলেন, “এই-যে ইনি এখানে! আমি যা ঠাউরেছিলুম তাই। সভা বসেছে। আমোদ করছেন। এ দিকে বেচারা হারানবাবু সক্কাল থেকে ওঁর জন্যে অপেক্ষা করে বসে রয়েছেন, যেন তিনি ওঁর বাগানের মালী। ছেলেবেলা থেকে ওদের মানুষ করলুম– কই বাপু, এত দিন তো ওদের এরকম ব্যবহার কখনো দেখি নি। কে জানে আজকাল এ-সব শিক্ষা কোথা থেকে পাচ্ছে। আমাদের পরিবারে যা কখনো ঘটতে পারত না আজকাল তাই আরম্ভ হয়েছে– সমাজের লোকের কাছে যে আমাদের মুখ দেখাবার জো রইল না। এত দিন ধরে এত করে যা শেখানো গেল সে সমস্তই দু দিনে বিসর্জন দিলে। এ কী সব কাণ্ড!”

হরিমোহিনী শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া সুচরিতাকে কহিলেন, “নীচে কেউ বসে আছেন আমি তো জানতেম না। বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে তো। মা, যাও তুমি শীঘ্র যাও। আমি অপরাধ করে ফেলেছি।”

অপরাধ যে হরিমোহিনীর লেশমাত্র নহে ইহাই বলিবার জন্য ললিতা মুহূর্তের মধ্যে উদ্যত হইয়া উঠিয়াছিল। সুচরিতা গোপনে সবলে তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া তাহাকে নিরস্ত করিল এবং কোনো প্রতিবাদমাত্র না করিয়া নীচে চলিয়া গেল।

পূর্বেই বলিয়াছি বিনয় বরদাসুন্দরীর স্নেহ আকর্ষণ করিয়াছিল। বিনয় যে তাঁহাদের পরিবারের প্রভাবে পড়িয়া ক্রমে ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিবে এ সম্বন্ধে তাঁহার সন্দেহ ছিল না। বিনয়কে তিনি যেন নিজের হাতে গড়িয়া তুলিতেছেন বলিয়া একটা বিশেষ গর্ব অনুভব করিতেছিলেন; সে গর্ব তিনি তাঁহার বন্ধুদের মধ্যে কারো কারো কাছে প্রকাশও করিয়াছিলেন। সেই বিনয়কে আজ শত্রুপক্ষের শিবিরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া তাঁহার মনের মধ্যে যেন একটা দাহ উপস্থিত হইল এবং নিজের কন্যা ললিতাকে বিনয়ের পুনঃপতনের সহায়কারী দেখিয়া তাঁহার চিত্তজ্বালা যে আরো দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল সে কথা বলা বাহুল্য। তিনি রুক্ষস্বরে কহিলেন, “ললিতা, এখানে কি তোমার কোনো কাজ আছে?”

ললিতা কহিল, “হাঁ, বিনয়বাবু এসেছেন তাই–”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “বিনয়বাবু যাঁর কাছে এসেছেন তিনি ওঁর আতিথ্য করবেন, তুমি এখন নীচে এসো, কাজ আছে।”

ললিতা স্থির করিল, হারানবাবু নিশ্চয়ই বিনয় ও তাহার দুইজনের নাম লইয়া মাকে এমন কিছু বলিয়াছেন যাহা বলিবার অধিকার তাঁহার নাই। এই অনুমান করিয়া তাহার মন অত্যন্ত শক্ত হইয়া উঠিল। সে অনাবশ্যক প্রগল্‌ভতার সহিত কহিল, “বিনয়বাবু অনেক দিন পরে এসেছেন, ওঁর সঙ্গে একটু গল্প করে নিয়ে তার পরে আমি যাচ্ছি।”

বরদাসুন্দরী ললিতার কথার স্বরে বুঝিলেন, জোর খাটিবে না। হরিমোহিনীর সম্মুখেই পাছে তাঁহার পরাভব প্রকাশ হইয়া পড়ে এই ভয়ে তিনি আর-কিছু না বলিয়া এবং বিনয়কে কোনোপ্রকার সম্ভাষণ না করিয়া চলিয়া গেলেন।

ললিতা বিনয়ের সঙ্গে গল্প করিবার উৎসাহ তাহার মার কাছে প্রকাশ করিল বটে, কিন্তু বরদাসুন্দরী চলিয়া গেলে সে উৎসাহের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তিন জনেই কেমন একপ্রকার কুণ্ঠিত হইয়া রহিল এবং অল্পক্ষণ পরেই ললিতা উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

এ বাড়িতে হরিমোহিনীর যে কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে তাহা বিনয় স্পষ্টই বুঝিতে পারিল। কথা পাড়িয়া ক্রমশ হরিমোহিনীর পূর্ব-ইতিহাস সমস্তই সে শুনিয়া লইল। সকল কথার শেষে হরিমোহিনী কহিলেন, “বাবা, আমার মতো অনাথার পক্ষে সংসার ঠিক স্থান নয়। কোনো তীর্থে গিয়ে দেবসেবায় মন দিতে পারলেই আমার পক্ষে ভালো হত। আমার অল্প যে ক’টি টাকা বাকি রয়েছে তাতে আমার কিছুদিন চলে যেত, তার পরেও যদি বেঁচে থাকতুম তো পরের বাড়িতে রেঁধে খেয়েও আমার কোনোমতে দিন কেটে যেত। কাশীতে দেখে এলুম, এমন তো কত লোকের বেশ চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমি পাপিষ্ঠা বলে সে কোনোমতেই পেরে উঠলুম না। একলা থাকলেই আমার সমস্ত দুঃখের কথা আমাকে যেন ঘিরে বসে, ঠাকুর-দেবতা কাউকে আমার কাছে আসতে দেয় না। ভয় হয় পাছে পাগল হয়ে যাই। যে মানুষ ডুবে মরছে তার পক্ষে ভেলা যেমন, রাধারানী আর সতীশ আমার পক্ষে তেমনি হয়ে উঠেছে– ওদের ছাড়বার কথা মনে করতে গেলেই দেখি আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। তাই আমার দিনরাত্রি ভয় হয় ওদের ছাড়তেই হবে– নইলে সব খুইয়ে আবার এই কদিনের মধ্যেই ওদের এত ভালোবাসতে গেলুম কী জন্যে? বাবা, তোমার কাছে বলতে আমার লজ্জা নেই, এদের দুটিকে পাওয়ার পর থেকে ঠাকুরের পুজো আমি মনের সঙ্গে করতে পেরেছি– এরা যদি যায় তবে আমার ঠাকুর তখনই কঠিন পাথর হয়ে যাবে।”

এই বলিয়া বস্ত্রাঞ্চলে হরিমোহিনী দুই চক্ষু মুছিলেন।

সুচরিতা নীচের ঘরে আসিয়া হারানবাবুর সম্মুখে দাঁড়াইল– কহিল, “আপনার কী কথা আছে বলুন।”

হারানবাবু কহিলেন, “বসো।”

সুচরিতা বসিল না, স্থির দাঁড়াইয়া রহিল।

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা, তুমি আমার প্রতি অন্যায় করছ।”

সুচরিতা কহিল, “আপনিও আমার প্রতি অন্যায় করছেন।”

হারানবাবু কহিলেন, “কেন, আমি তোমাকে যা কথা দিয়েছি এখনো তা–”

সুচরিতা মাঝখানে বাধা দিয়া কহিল, “ন্যায় অন্যায় কি শুধু কেবল কথায়? সেই কথার উপর জোর দিয়ে আপনি কাজে আমার প্রতি অত্যাচার করতে চান? একটা সত্য কি সহস্র মিথ্যার চেয়ে বড়ো নয়? আমি যদি এক শো বার ভুল করে থাকি তবে কি আপনি জোর করে আমার সেই ভুলকেই অগ্রগণ্য করবেন? আজ আমার যখন সেই ভুল ভেঙেছে তখন আমি আমার আগেকার কোনো কথাকে স্বীকার করব না– করলে আমার অন্যায় হবে।”

সুচরিতার যে এমন পরিবর্তন কী করিয়া সম্ভব হইতে পারে তাহা হারানবাবু কোনোমতেই বুঝিতে পারিলেন না। তাহার স্বাভাবিক স্তব্ধতা ও নম্রতা আজ এমন করিয়া ভাঙিয়া গেছে ইহা যে তাঁহারই দ্বারা ঘটিতে পারে তাহা অনুমান করিবার শক্তি ও বিনয় তাঁহার ছিল না। সুচরিতার নূতন সঙ্গীগুলির প্রতি মনে মনে দোষারোপ করিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কী ভুল করেছিলে?”

সুচরিতা কহিল, “সে কথা কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন? পূর্বে মত ছিল, এখন আমার মত নেই এই কি যথেষ্ট নয়?”

হারানবাবু কহিলেন, “ব্রাহ্মসমাজের কাছে যে আমাদের জবাবদিহি আছে। সমাজের লোকের কাছে তুমিই বা কী বলবে আমিই বা কী বলব?”

সুচরিতা কহিল, “আমি কোনো কথাই বলব না। আপনি যদি বলতে ইচ্ছা করেন তবে বলবেন, সুচরিতার বয়স অল্প, ওর বুদ্ধি নেই, ওর মতি অস্থির। যেমন ইচ্ছা তেমনি বলবেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে এই আমাদের শেষ কথা হয়ে গেল।”

হারানবাবু কহিলেন, “শেষ কথা হতেই পারে না। পরেশবাবু যদি–”

বলিতে বলিতেই পরেশবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন; কহিলেন, “কী পানুবাবু, আমার কথা কী বলছেন?”

সুচরিতা তখন ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেছিল। হারানবাবু ডাকিয়া কহিলেন, “সুচরিতা, যেয়ো না, পরেশবাবুর কাছে কথাটা হয়ে যাক।”

সুচরিতা ফিরিয়া দাঁড়াইল। হারানবাবু কহিলেন, “পরেশবাবু, এতদিন পরে আজ সুচরিতা বলছেন বিবাহে ওঁর মত নেই! এত বড়ো গুরুতর বিষয় নিয়ে কি এতদিন ওঁর খেলা করা উচিত ছিল? এই-যে কদর্য উপসর্গটা ঘটল এজন্য কি আপনাকেও দায়ী হতে হবে না?”

পরেশবাবু সুচরিতার মাথায় হাত বুলাইয়া স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “মা, তোমার এখানে থাকবার দরকার নেই, তুমি যাও।”

এই সামান্য কথাটুকু শুনিবামাত্র এক মুহূর্তে অশ্রুজলে সুচরিতার দুই চোখ ভাসিয়া গেল এবং সে তাড়াতাড়ি সেখান হইতে চলিয়া গেল।

পরেশবাবু কহিলেন, “সুচরিতা যে নিজের মন ভালো করে না বুঝেই বিবাহে সম্মতি দিয়েছিল এই সন্দেহ অনেক দিন থেকে আমার মনে উদয় হওয়াতেই, সমাজের লোকের সামনে আপনাদের সম্বন্ধ পাকা করার বিষয়ে আমি আপনার অনুরোধ পালন করতে পারি নি।”

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা তখন নিজের মন ঠিক বুঝেই সম্মতি দিয়েছিল, এখনই না বুঝে অসম্মতি দিচ্ছে– এরকম সন্দেহ আপনার মনে উদয় হচ্ছে না?”

পরেশবাবু কহিলেন, “দুটোই হতে পারে, কিন্তু এরকম সন্দেহের স্থলে তো বিবাহ হতে পারে না।”

হারানবাবু কহিলেন, “আপনি সুচরিতাকে সৎপরামর্শ দেবেন না?”

পরেশবাবু কহিলেন, “আপনি নিশ্চয় জানেন, সুচরিতাকে আমি কখনো সাধ্যমত অসৎপরামর্শ দিতে পারি নে।”

হারানবাবু কহিলেন, “তাই যদি হত, তা হলে সুচরিতার এরকম পরিণাম কখনোই ঘটতে পারত না। আপনার পরিবারে আজকাল যে-সব ব্যাপার আরম্ভ হয়েছে এ যে সমস্তই আপনার অবিবেচনার ফল, এ কথা আমি আপনাকে মুখের সামনেই বলছি।”

পরেশবাবু ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “এ তো আপনি ঠিক কথাই বলছেন– আমার পরিবারের সমস্ত ফলাফলের দায়িত্ব আমি নেব না তো কে নেবে?”

হারানবাবু কহিলেন, “এজন্যে আপনাকে অনুতাপ করতে হবে– সে আমি বলে রাখছি।”

পরেশবাবু কহিলেন, “অনুতাপ তো ঈশ্বরের দয়া। অপরাধকেই ভয় করি, পানুবাবু, অনুতাপকে নয়।”

সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়া পরেশবাবুর হাত ধরিয়া কহিল, “বাবা, তোমার উপাসনার সময় হয়েছে।”

পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবু, তবে কি একটু বসবেন?”

হারানবাবু কহিলেন, “না।”

বলিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন।

একই সময়ে নিজের অন্তরের সঙ্গে, আবার নিজের বাহিরের সঙ্গে সুচরিতার যে সংগ্রাম বাধিয়া উঠিয়াছে তাহাতে তাহাকে ভীত করিয়া তুলিয়াছে। গোরার প্রতি তাহার যে মনের ভাব এতদিন তাহার অলক্ষ্যে বল পাইয়া উঠিয়াছিল এবং গোরার জেলে যাওয়ার পর হইতে যাহা তাহার নিজের কাছে সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট এবং দুর্নিবাররূপে দেখা দিয়াছে তাহা লইয়া সে যে কী করিবে, তাহার পরিণাম যে কী, তাহা সে কিছুই ভাবিয়া পায় না– সে কথা কাহাকেও বলিতে পারে না, নিজের কাছে নিজে কুণ্ঠিত হইয়া থাকে। এই নিগূঢ় বেদনাটাকে লইয়া সে গোপনে বসিয়া নিজের সঙ্গে যে একটা বোঝাপড়া করিয়া লইবে তাহার সে নিভৃত অবকাশটুকুও নাই– হারানবাবু তাহার দ্বারের কাছে তাঁহাদের সমস্ত সমাজকে জাগ্রত করিয়া তুলিবার উপক্রম করিয়াছেন, এমন-কি, ছাপার কাগজের ঢাকেও কাঠি পড়িবার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। ইহার উপরেও তাহার মাসির সমস্যা এমন হইয়া উঠিয়াছে যে অতি সত্বর তাহার একটা কোনো মীমাংসা না করিলে একদিনও আর চলে না। সুচরিতা বুঝিয়াছে এবার তাহার জীবনের একটা সন্ধিক্ষণ আসিয়াছে, চিরপরিচিত পথে চিরাভ্যস্ত নিশ্চিন্তভাবে চলিবার দিন আর নাই।

এই তাহার সংকটের সময় তাহার একমাত্র অবলম্বন ছিল পরেশবাবু। তাঁহার কাছে সে পরামর্শ চাহে নাই, উপদেশ চাহে নাই; অনেক কথা ছিল যাহা পরেশবাবুর সম্মুখে সে উপস্থিত করিতে পারিত না এবং এমন অনেক কথা ছিল যাহা লজ্জাকর হীনতাবশতই পরেশবাবুর কাছে প্রকাশের অযোগ্য। কেবল পরেশবাবুর জীবন, পরেশবাবুর সঙ্গমাত্র তাহাকে যেন নিঃশব্দে কোন্‌ পিতৃক্রোড়ে কোন্‌ মাতৃবক্ষে আকর্ষণ করিয়া লইত।

এখন শীতের দিনে সন্ধ্যার সময় পরেশবাবু বাগানে যাইতেন না। বাড়ির পশ্চিম দিকের একটি ছোটো ঘরে মুক্ত দ্বারের সম্মুখে একখানি আসন পাতিয়া তিনি উপাসনায় বসিতেন, তাঁহার শুক্লকেশমণ্ডিত শান্তমুখের উপর সূর্যাস্তের আভা আসিয়া পড়িত। সেই সময়ে সুচরিতা নিঃশব্দপদে চুপ করিয়া তাঁহার কাছে আসিয়া বসিত। নিজের অশান্ত ব্যথিত চিত্তটিকে সে যেন পরেশের উপাসনার গভীরতার মাঝখানে নিমজ্জিত করিয়া রাখিত। আজকাল উপাসনান্তে প্রায়ই পরেশ দেখিতে পাইতেন তাঁহার এই কন্যাটি, এই ছাত্রীটি স্তব্ধ হইয়া তাঁহার কাছে বসিয়া আছে; তখন তিনি একটি অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক মাধুর্যের দ্বারা এই বালিকাটিকে পরিবেষ্টিত দেখিয়া সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়া নিঃশব্দে ইহাকে আশীর্বাদ করিতেন।

ভূমার সহিত মিলনকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করিয়াছিলেন বলিয়া যাহা শ্রেয়তম এবং সত্যতম পরেশের চিত্ত সর্বদাই তাহার অভিমুখ ছিল। এইজন্য সংসার কোনোমতেই তাঁহার কাছে অত্যন্ত গুরুতর হইয়া উঠিতে পারিত না। এইরূপে নিজের মধ্যে তিনি একটি স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিলেন বলিয়াই মত বা আচরণ লইয়া তিনি অন্যের প্রতি কোনোপ্রকার জবর্দস্তি করিতে পারিতেন না। মঙ্গলের প্রতি নির্ভর এবং সংসারের প্রতি ধৈর্য তাঁহার পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। ইহা তাঁহার এত অধিক পরিমাণে ছিল যে সাম্প্রদায়িক লোকের কাছে তিনি নিন্দিত হইতেন, কিন্তু নিন্দাকে তিনি এমন করিয়া গ্রহণ করিতে পারিতেন যে হয়তো তাহা তাঁহাকে আঘাত করিত, কিন্তু তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া থাকিত না। তিনি মনের মধ্যে এই কথাটাই কেবলই থাকিয়া থাকিয়া আবৃত্তি করিতেন– “আমি আর-কাহারো হাত হইতে কিছুই লইব না, আমি তাঁহার হাত হইতেই সমস্ত লইব।’

পরেশের জীবনের এই গভীর নিস্তব্ধ শান্তির স্পর্শ লাভ করিবার জন্য আজকাল সুচরিতা নানা উপলক্ষেই তাঁহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হয়। এই অনভিজ্ঞ বালিকাবয়সে তাহার বিরুদ্ধ হৃদয় এবং বিরুদ্ধ সংসার যখন তাহাকে একেবারে উদ্‌ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে তখন সে বার বার কেবল মনে করিয়াছে, “বাবার পা দুখানা মাথায় চাপিয়া ধরিয়া খানিকক্ষণের জন্য যদি মাটিতে পড়িয়া থাকিতে পারি তবে আমার মন শান্তিতে ভরিয়া উঠে।’

এইরূপে সুচরিতা মনে ভাবিতেছিল, সে মনের সমস্ত শক্তিকে জাগ্রত করিয়া অবিচলিত ধৈর্যের সহিত সমস্ত আঘাতকে ঠেকাইয়া রাখিবে, অবশেষে সমস্ত প্রতিকূলতা আপনি পরাস্ত হইয়া যাইবে। কিন্তু সেরূপ ঘটিল না, তাহাকে অপরিচিত পথে বাহির হইতে হইল।

বরদাসুন্দরী যখন দেখিলেন রাগ করিয়া, ভর্ৎসনা করিয়া, সুচরিতাকে টলানো সম্ভব নহে এবং পরেশকেও সহায়রূপে পাইবার কোনো আশা নাই, তখন হরিমোহিনীর প্রতি তাঁহার ক্রোধ অত্যন্ত দুর্দান্ত হইয়া উঠিল। তাঁহার গৃহের মধ্যে হরিমোহিনীর অস্তিত্ব তাঁহাকে উঠিতে বসিতে যন্ত্রণা দিতে লাগিল।

সেদিন তাঁহার পিতার মৃত্যুদিনের বার্ষিক উপাসনা উপলক্ষে তিনি বিনয়কে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। উপাসনা সন্ধ্যার সময় হইবে, তৎপূর্বেই তিনি সভাগৃহ সাজাইয়া রাখিতেছিলেন; সুচরিতা এবং অন্য মেয়েরাও তাঁহার সহায়তা করিতেছিল।

এমন সময় তাঁহার চোখে পড়িল বিনয় পাশের সিঁড়ি দিয়া উপরে হরিমোহিনীর নিকট যাইতেছে। মন যখন ভারাক্রান্ত থাকে তখন ক্ষুদ্র ঘটনাও বড়ো হইয়া উঠে। বিনয়ের এই উপরের ঘরে যাওয়া এক মুহূর্তে তাঁহার কাছে এমন অসহ্য হইয়া উঠিল যে তিনি ঘর সাজানো ফেলিয়া তৎক্ষণাৎ হরিমোহিনীর কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, বিনয় মাদুরে বসিয়া আত্মীয়ের ন্যায় বিশ্রব্ধভাবে হরিমোহিনীর সহিত কথা কহিতেছে।

বরদাসুন্দরী বলিয়া উঠিলেন, “দেখো, তুমি আমাদের এখানে যতদিন খুশি থাকো, আমি তোমাকে আদর যত্ন করেই রাখব। কিন্তু আমি বলছি, তোমার ঐ ঠাকুরকে এখানে রাখা চলবে না।”

হরিমোহিনী চিরকাল পাড়াগাঁয়েই থাকিতেন। ব্রাহ্মদের সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা ছিল যে, তাহারা খৃস্টানেরই শাখাবিশেষ, সুতরাং তাহাদেরই সংস্রব সম্বন্ধে বিচার করিবার বিষয় আছে। কিন্তু তাহারাও যে তাঁহার সম্বন্ধে সংকোচ অনুভব করিতে পারে ইহা তিনি এই কয়দিনে ক্রমশই বুঝিতে পারিতেছিলেন। কী করা কর্তব্য ব্যাকুল হইয়া চিন্তা করিতেছিলেন, এমন সময়ে আজ বরদাসুন্দরীর মুখে এই কথা শুনিয়া তিনি বুঝিলেন যে, আর চিন্তা করিবার সময় নাই– যাহা হয় একটা-কিছু স্থির করিতে হইবে। প্রথমে ভাবিলেন কলিকাতায় একটা কোথাও বাসা লইয়া থাকিবেন, তাহা হইলে মাঝে মাঝে সুচরিতা ও সতীশকে দেখিতে পাইবেন। কিন্তু তাঁহার যে অল্প সম্বল তাহাতে কলিকাতার খরচ চলিবে না।

বরদাসুন্দরী অকস্মাৎ ঝড়ের মতো আসিয়া যখন চলিয়া গেলেন, তখন বিনয় মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “আমি তীর্থে যাব, তোমরা কেউ আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবে বাবা?”

বিনয় কহিল, “খুব পারব। কিন্তু তার আয়োজন করতে তো দু-চার দিন দেরি হবে, ততদিন চলো মাসি, তুমি আমার মার কাছে গিয়ে থাকবে।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “বাবা, আমার ভার বিষম ভার। বিধাতা আমার কপালের উপর কি বোঝা চাপিয়েছেন জানি নে, আমাকে কেউ বইতে পারে না। আমার শ্বশুরবাড়িতেও যখন আমার ভার সইল না তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু বড়ো অবুঝ মন বাবা– বুক যে খালি হয়ে গেছে, সেইটে ভরাবার জন্যে কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমার পোড়া ভাগ্যও যে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। আর থাক্‌ বাবা, আর-কারো বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই– যিনি বিশ্বের বোঝা ব’ন তাঁরই পাদপদ্মে এবার আমি আশ্রয় গ্রহণ করব– আর আমি পারি নে।”

বলিয়া বার বার করিয়া দুই চক্ষু মুছিতে লাগিলেন।

বিনয় কহিল, “সে বললে হবে না মাসি! আমার মার সঙ্গে অন্য-কারো তুলনা করলে চলবে না। যিনি নিজের জীবনের সমস্ত ভার ভগবানকে সমর্পণ করতে পেরেছেন, তিনি অন্যের ভার বইতে ক্লেশ বোধ করেন না। যেমন আমার মা– আর যেমন এখানে দেখলেন পরেশবাবু। সে আমি শুনব না– একবার আমার তীর্থে তোমাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসব, তার পরে তোমার তীর্থ আমি দেখতে যাব।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তাদের তা হলে তো একবার খবর দিয়ে–”

বিনয় কহিল, “আমরা গেলেই মা খবর পাবেন– সেইটেই হবে পাকা খবর।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তা হলে কাল সকালে–”

বিনয় কহিল, “দরকার কী? আজ রাত্রেই গেলে হবে।”

সন্ধ্যার সময় সুচরিতা আসিয়া কহিল, “বিনয়বাবু, মা আপনাকে ডাকতে পাঠালেন। উপাসনার সময় হয়েছে।”

বিনয় কহিল, “মাসির সঙ্গে কথা আছে, আজ আমি যেতে পারব না।”

আসল কথা, আজ বিনয় বরদাসুন্দরীর উপাসনার নিমন্ত্রণ কোনোমতে স্বীকার করিতে পারিল না। তাহার মনে হইল সমস্তই বিড়ম্বনা।

হরিমোহিনী ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন, “বাবা বিনয়, যাও তুমি। আমার সঙ্গে কথাবার্তা সে পরে হবে। তোমাদের কাজকর্ম আগে হয়ে যাক, তার পরে তুমি এসো।”

সুচরিতা কহিল, “আপনি এলে কিন্তু ভালো হয়।”

বিনয় বুঝিল সে সভাক্ষেত্রে না গেলে এই পরিবারে যে বিপ্লবের সূত্রপাত হইয়াছে তাহাকে কিছু পরিমাণে আরো অগ্রসর করিয়া দেওয়া হইবে। এইজন্য সে উপাসনাস্থলে গেল, কিন্তু তাহাতেও সম্পূর্ণ ফললাভ হইল না।

উপাসনার পর আহার ছিল– বিনয় কহিল, “আজ আমার ক্ষুধা নেই।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “ক্ষুধার অপরাধ নেই। আপনি তো উপরেই খাওয়া সেরে এসেছেন।”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “হাঁ, লোভী লোকের এইরকম দশাই ঘটে। উপস্থিতের প্রলোভনে ভবিষ্যৎ খুইয়ে বসে।” এই বলিয়া বিনয় প্রস্থানের উদ্যোগ করিল।

বরদাসুন্দরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “উপরে যাচ্ছেন বুঝি?”

বিনয় সংক্ষেপে কেবল “হাঁ’ বলিয়া বাহির হইয়া গেল। দ্বারের কাছে সুচরিতা ছিল, তাহাকে মৃদুস্বরে কহিল, “দিদি, একবার মাসির কাছে যাবেন, বিশেষ কথা আছে।”

ললিতা আতিথ্যে নিযুক্ত ছিল। এক সময় সে হারানবাবুর কাছে আসিতেই তিনি অকারণে বলিয়া উঠিলেন, “বিনয়বাবু তো এখানে নেই, তিনি উপরে গিয়েছেন।”

শুনিয়াই ললিতা সেখানে দাঁড়াইয়া তাঁহার মুখের দিকে চোখ তুলিয়া অসংকোচে কহিল, “জানি। তিনি আমার সঙ্গে না দেখা করে যাবেন না। আমার এখানকার কাজ সারা হলেই উপরে যাব এখন।”

ললিতাকে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত করিতে না পারিয়া হারানের অন্তররুদ্ধ দাহ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। বিনয় সুচরিতাকে হঠাৎ কী একটা বলিয়া গেল এবং সুচরিতা অনতিকাল পরেই তাহার অনুসরণ করিল, ইহাও হারানবাবুর লক্ষ্য এড়াইতে পারে নাই। তিনি আজ সুচরিতার সহিত আলাপের উপলক্ষ সন্ধান করিয়া বারংবার অকৃতার্থ হইয়াছেন– দুই-এক বার সুচরিতা তাঁহার সুস্পষ্ট আহ্বান এমন করিয়া এড়াইয়া গেছে যে সভাস্থ লোকের কাছে হারানবাবু নিজেকে অপদস্থ জ্ঞান করিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার মন সুস্থ ছিল না।

সুচরিতা উপরে গিয়া দেখিল হরিমোহিনী তাঁহার জিনিসপত্র গুছাইয়া এমনভাবে বসিয়া আছেন যেন এখনই কোথায় যাইবেন। সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “মাসি, এ কী?”

হরিমোহিনী তাহার কোনো উত্তর দিতে না পারিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন এবং কহিলেন, “সতীশ কোথায় আছে তাকে একবার ডেকে দাও মা!”

সুচরিতা বিনয়ের মুখের দিকে চাহিতেই বিনয় কহিল, “এ বাড়িতে মাসি থাকলে সকলেরই অসুবিধে হয়, তাই আমি ওঁকে মার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সেখান থেকে আমি তীর্থে যাব মনে করেছি! আমার মতো লোকের কারো বাড়িতে এরকম করে থাকা ভালো হয় না। চিরদিন লোকে আমাকে এমন করে সহ্যই বা করবে কেন?”

সুচরিতা নিজেই এ কথা কয়েক দিন হইতে ভাবিতেছিল। এ বাড়িতে বাস করা যে তাহার মাসির পক্ষে অপমান তাহা সে অনুভব করিয়াছিল, সুতরাং সে কোনো উত্তর দিতে পারিল না। চুপ করিয়া তাঁহার কাছে গিয়া বসিয়া রহিল। রাত্রি হইয়াছে। ঘরে প্রদীপ জ্বালা হয় নাই। কলিকাতার হেমন্তের অস্বচ্ছ আকাশে তারাগুলি বাষ্পাচ্ছন্ন। কাহাদের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল তাহা সেই অন্ধকারে দেখা গেল না।

সিঁড়ি হইতে সতীশের উচ্চকণ্ঠে “মাসিমা’ ধ্বনি শুনা গেল। “কী বাবা, এসো বাবা” বলিয়া হরিমোহিনী তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িলেন। সুচরিতা কহিল, “মাসিমা, আজ রাত্রে কোথাও যাওয়া হতেই পারে না, কাল সকালে সমস্ত ঠিক করা যাবে। বাবাকে ভালো করে না বলে তুমি কী করে যেতে পারবে বলো। সে যে বড়ো অন্যায় হবে।”

বিনয় বরদাসুন্দরী-কর্তৃক হরিমোহিনীর অপমানে উত্তেজিত হইয়া এ কথা ভাবে নাই। সে স্থির করিয়াছিল এক রাত্রিও মাসির এ বাড়িতে থাকা উচিত হইবে না– এবং আশ্রয়ের অভাবেই যে হরিমোহিনী সমস্ত সহ্য করিয়া এ বাড়িতে রহিয়াছেন বরদাসুন্দরীর সেই ধারণা দূর করিবার জন্য বিনয় হরিমোহিনীকে এখান হইতে লইয়া যাইতে লেশমাত্র বিলম্ব করিতে চাহিতেছিল না। সুচরিতার কথা শুনিয়া বিনয়ের হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল যে, এ বাড়িতে বরদাসুন্দরীর সঙ্গেই যে হরিমোহিনীর একমাত্র এবং সর্বপ্রধান সম্বন্ধ তাহা নহে। যে ব্যক্তি অপমান করিয়াছে তাহাকেই বড়ো করিয়া দেখিতে হইবে আর যে লোক উদারভাবে আত্মীয়ের মতো আশ্রয় দিয়াছে তাহাকে ভুলিয়া যাইতে হইবে এ তো ঠিক নহে।

বিনয় বলিয়া উঠিল, “সে ঠিক কথা। পরেশবাবুকে না জানিয়ে কোনোমতেই যাওয়া যায় না।”

সতীশ আসিয়াই কহিল, “মাসিমা, জান, রাশিয়ানররা ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে আসছে? ভারি মজা হবে।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কার দলে?”

সতীশ কহিল, “আমি রাশিয়ানের দলে।”

বিনয় কহিল, “তা হলে রাশিয়ানের আর ভাবনা নেই।”

এইরূপে সতীশ মাসিমার সভা জমাইয়া তুলিতেই সুচরিতা আস্তে আস্তে সেখান হইতে উঠিয়া নীচে চলিয়া গেল।

সুচরিতা জানিত, শুইতে যাইবার পূর্বে পরেশবাবু তাঁহার কোনো একটি প্রিয় বই খানিকটা করিয়া পড়িতেন। কতদিন এইরূপ সময়ে সুচরিতা তাঁহার কাছে আসিয়া বসিয়াছে এবং সুচরিতার অনুরোধে পরেশবাবু তাহাকেও পড়িয়া শুনাইয়াছেন।

আজও তাঁহার নির্জন ঘরে পরেশবাবু আলোটি জ্বালাইয়া এমার্সনের গ্রন্থ পড়িতেছিলেন। সুচরিতা ধীরে ধীরে তাঁহার পাশে চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল। পরেশবাবু বইখানি রাখিয়া একবার তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। সুচরিতার সংকল্প ভঙ্গ হইল– সে সংসারের কোনো কথাই তুলিতে পারিল না। কহিল, “বাবা, আমাকে পড়ে শোনাও।”

পরেশবাবু তাহাকে পড়িয়া বুঝাইয়া দিতে লাগিলেন। রাত্রি দশটা বাজিয়া গেলে পড়া শেষ হইল। তখনো সুচরিতা নিদ্রার পূর্বে পরেশবাবু মনে কোনোপ্রকার ক্ষোভ পাছে জন্মে এইজন্য কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া যাইতেছিল।

পরেশবাবু তাহাকে স্নেহস্বরে ডাকিলেন, “রাধে!”

সে তখন ফিরিয়া আসিল। পরেশবাবু কহিলেন, “তুমি তোমার মাসির কথা আমাকে বলতে এসেছিলে?”

পরেশবাবু তাহার মনের কথা জানিতে পারিয়াছেন জানিয়া সুচরিতা বিস্মিত হইয়া বলিল, “হাঁ বাবা, কিন্তু আজ থাক্‌, কাল সকালে কথা হবে।”

পরেশবাবু কহিলেন, “বোসো।”

সুচরিতা বসিলে তিনি কহিলেন, “তোমার মাসির এখানে কষ্ট হচ্ছে সে কথা আমি চিন্তা করেছি। তাঁর ধর্মবিশ্বাস ও আচরণ লাবণ্যর মার সংস্কারে যে এত বেশি আঘাত দেবে তা আমি আগে ঠিক জানতে পারি নি। যখন দেখছি তাঁকে পীড়া দিচ্ছে তখন এ বাড়িতে তোমার মাসিকে রাখলে তিনি সংকুচিত হয়ে থাকবেন।”

সুচরিতা কহিল, “আমার মাসি এখান থেকে যাবার জন্যেই প্রস্তুত হয়েছেন।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমি জানতুম যে তিনি যাবেন। তোমরা দুজনেই তাঁর একমাত্র আত্মীয়– তোমরা তাঁকে এমন অনাথার মতো বিদায় দিতে পারবে না সেও আমি জানি। তাই আমি এ কয়দিন এ সম্বন্ধে ভাবছিলুম।”

তাহার মাসি কী সংকটে পড়িয়াছেন পরেশবাবু যে তাহা বুঝিয়াছেন ও তাহা লইয়া ভাবিতেছেন এ কথা সুচরিতা একেবারেই অনুমান করে নাই। পাছে তিনি জানিতে পারিয়া বেদনা বোধ করেন এই ভয়ে সে এতদিন অত্যন্ত সাবধানে চলিতেছিল– আজ পরেশবাবুর কথা শুনিয়া সে আশ্চর্য হইয়া গেল এবং তাহার চোখের পাতা ছল্‌ছল্‌ করিয়া আসিল।

পরেশবাবু কহিলেন, “তোমার মাসির জন্যে আমি একটি বাড়ি ঠিক করে রেখেছি।”

সুচরিতা কহিল, “কিন্তু, তিনি তো–”

পরেশবাবু। ভাড়া দিতে পারবেন না। ভাড়া তিনি কেন দেবেন? তুমি ভাড়া দেবে।

সুচরিতা অবাক হইয়া পরেশবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরেশবাবু হাসিয়া কহিলেন, “তোমারই বাড়িতে থাকতে দিয়ো, ভাড়া দিতে হবে না।”

সুচরিতা আরো বিস্মিত হইল। পরেশবাবু কহিলেন, “কলকাতায় তোমাদের দুটো বাড়ি আছে জান না! একটি তোমার, একটি সতীশের। মৃত্যুর সময়ে তোমার বাবা আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে যান। আমি তাই খাটিয়ে বাড়িয়ে তুলে কলকাতায় দুটো বাড়ি কিনেছি। এতদিন তার ভাড়া পাচ্ছিলুম, তাও জমছিল। তোমার বাড়ির ভাড়াটে অল্পদিন হল উঠেও গেছে– সেখানে তোমার মাসির থাকবার কোনো অসুবিধা হবে না।”

সুচরিতা কহিল, “সেখানে তিনি কি একলা থাকতে পারবেন?”

পরেশবাবু কহিলেন, “তোমরা তাঁর আপনার লোক থাকতে তাঁকে একলা থাকতে হবে কেন?”

সুচরিতা কহিল, “সেই কথাই তোমাকে বলবার জন্যে আজ এসেছিলুম। মাসি চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন, আমি ভাবছিলুম আমি একলা কী করে তাঁকে যেতে দেব। তাই তোমার উপদেশ নেব বলে এসেছি। তুমি যা বলবে আমি তাই করব।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমাদের বাসার গায়েই এই-যে গলি, এই গলির দুটো-তিনটে বাড়ির পরেই তোমার বাড়ি– ঐ বারান্দায় দাঁড়ালে সে বাড়ি দেখা যায়। সেখানে তোমরা থাকলে নিতান্ত অরক্ষিত অবস্থায় থাকতে হবে না। আমি তোমাদের দেখতে শুনতে পারব।”

সুচরিতার বুকের উপর হইতে একটা মস্ত পাথর নামিয়া গেল। “বাবাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া যাইব’ এই চিন্তার সে কোনো অবধি পাইতেছিল না। কিন্তু যাইতেই হইবে ইহাও তাহার কাছে নিশ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল।

সুচরিতা আবেগপরিপূর্ণ হৃদয় লইয়া চুপ করিয়া পরেশবাবুর কাছে বসিয়া রহিল। পরেশবাবুও স্তব্ধ হইয়া নিজের অন্তঃকরণের মধ্যে নিজেকে গভীরভাবে নিহিত করিয়া বসিয়া রহিলেন। সুচরিতা শিষ্যা, তাঁহার কন্যা, তাঁহার সুহৃদ। সে তাঁহার জীবনের, এমন-কি, তাঁহার ঈশ্বরোপাসনার সঙ্গে জড়িত হইয়া গিয়াছিল। যেদিন সে নিঃশব্দে আসিয়া তাঁহার উপাসনার সহিত যোগ দিত সেদিন তাঁহার উপাসনা যেন বিশেষ পূর্ণতা লাভ করিত। প্রতিদিন সুচরিতার জীবনকে মঙ্গলপূর্ণ স্নেহের দ্বারা গড়িতে গড়িতে তিনি নিজের জীবনকে একটি বিশেষ পরিণতি দান করিতেছিলেন। সুচরিতা যেমন ভক্তি যেমন একান্ত নম্রতার সহিত তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল এমন করিয়া আর-কেহ তাঁহার কাছে আসে নাই; ফুল যেমন করিয়া আকাশের দিকে তাকায় সে তেমনি করিয়া তাঁহার দিকে তাহার সমস্ত প্রকৃতিকে উন্মুখ এবং উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছিল। এমন একাগ্রভাবে কেহ কাছে আসিলে মানুষের দান করিবার শক্তি আপনি বাড়িয়া যায়– অন্তঃকরণ জলভারনম্র মেঘের মতো পরিপূর্ণতার দ্বারা নত হইয়া পড়ে। নিজের যাহা-কিছু সত্য, যাহা-কিছু শ্রেষ্ঠ তাহা কোনো অনুকূল চিত্তের নিকট প্রতিদিন দান করিবার সুযোগের মতো এমন শুভযোগ মানুষের কাছে আর কিছু হইতেই পারে না; সেই দুর্লভ সুযোগ সুচরিতা পরেশকে দিয়াছিল। এজন্য সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধ অত্যন্ত গভীর হইয়াছিল। আজ সেই সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার বাহ্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে– ফলকে নিজের জীবনরসে পরিপক্ক করিয়া তুলিয়া তাহাকে নিজের নিকট হইতে মুক্ত করিয়া দিতে হইবে। এজন্য তিনি মনের মধ্যে যে বেদনা অনুভব করিতেছিলেন সেই নিগূঢ় বেদনাটিকে তিনি অন্তর্যামীর নিকট নিবেদন করিয়া দিতেছিলেন। সুচরিতার পাথেয় সঞ্চয় হইয়াছে, এখন নিজের শক্তিতে প্রশস্ত পথে সুখে দুঃখে আঘাতে-প্রতিঘাতে নূতন অভিজ্ঞতা লাভের দিকে যে তাহার আহ্বান আসিয়াছে তাহার আয়োজন কিছুদিন হইতেই পরেশ লক্ষ করিতেছিলেন; তিনি মনে মনে বলিতেছিলেন, “বৎসে, যাত্রা করো– তোমার চিরজীবন যে কেবল আমার বুদ্ধি এবং আমার আশ্রয়ের দ্বারাই আচ্ছন্ন করিয়া রাখিব এমন কখনোই হইতে পারিবে না– ঈশ্বর আমার নিকট হইতে তোমাকে মুক্ত করিয়া বিচিত্রের ভিতর দিয়া তোমাকে চরম পরিণামে আকর্ষণ করিয়া লইয়া যান–তাঁহার মধ্যে তোমার জীবন সার্থক হউক।’ এই বলিয়া আশৈশব-স্নেহপালিত সুচরিতাকে তিনি মনের মধ্যে নিজের দিক হইতে ঈশ্বরের দিকে পবিত্র উৎসর্গসামগ্রীর মতো তুলিয়া ধরিতেছিলেন। পরেশ বরদাসুন্দরীর প্রতি রাগ করেন নাই, নিজের সংসারের প্রতি মনকে কোনোপ্রকার বিরোধ অনুভব করিতে প্রশ্রয় দেন নাই। তিনি জানিতেন সংকীর্ণ উপকূলের মাঝখানে নূতন বর্ষণের জলরাশি হঠাৎ আসিয়া পড়িলে অত্যন্ত একটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়– তাহার একমাত্র প্রতিকার তাহাকে প্রশস্ত ক্ষেত্রে মুক্ত করিয়া দেওয়া। তিনি জানিতেন অল্পদিনের মধ্যে সুচরিতাকে আশ্রয় করিয়া এই ছোটো পরিবারটির মধ্যে যে-সকল অপ্রত্যাশিত সমাবেশ ঘটিয়াছে তাহা এখানকার বাঁধা সংস্কারকে পীড়িত করিতেছে, তাহাকে এখানে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা না করিয়া মুক্তিদান করিলেই তবেই স্বভাবের সহিত সামঞ্জস্য ঘটিতে পারে নীরবে তাহারই আয়োজন করিতেছিলেন।

দুইজনে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে ঘড়িতে এগারোটা বাজিয়া গেল। তখন পরেশবাবু উঠিয়া দাঁড়াইয়া সুচরিতার হাত ধরিয়া তাহাকে গাড়িবারান্দার ছাদে লইয়া গেলেন। সন্ধ্যাকাশের বাষ্প কাটিয়া গিয়া তখন নির্মল অন্ধকারের মধ্যে তারাগুলি দীপ্তি পাইতেছিল। সুচরিতাকে পাশে লইয়া পরেশ সেই নিস্তব্ধ রাত্রে প্রার্থনা করিলেন– সংসারের সমস্ত অসত্য কাটিয়া পরিপূর্ণ সত্য আমাদের জীবনের মাঝখানে নির্মল মূর্তিতে উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠুন।

পরদিন প্রাতে হরিমোহিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া পরেশকে প্রণাম করিতেই তিনি ব্যস্ত হইয়া সরিয়া গিয়া কহিলেন, “করেন কী?”

হরিমোহিনী অশ্রুনেত্রে কহিলেন, “তোমাদের ঋণ আমি কোনো জন্মে শোধ করতে পারব না। আমার মতো এত বড়ো নিরুপায়ের তুমি উপায় করে দিয়েছ, এ তুমি ভিন্ন আর কেহ করতে পারত না। ইচ্ছা করলেও আমার ভালো কেউ করতে পারে না এ আমি দেখেছি– তোমার উপর ভগবানের খুব অনুগ্রহ আছে তাই তুমি আমার মতো লোকের উপরেও অনুগ্রহ করতে পেরেছ।”

পরেশবাবু অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, “আমি বিশেষ কিছুই করি নি– এ-সমস্ত রাধারানী–”

হরিমোহিনী বাধা দিয়া কহিলেন, “জানি জানি– কিন্তু রাধারানীই যে তোমার–ও যা করে সে যে তোমারই করা। ওর যখন মা গেল, ওর বাপও রইল না, তখন ভেবেছিলুম মেয়েটা বড়ো দুর্ভাগিনী– কিন্তু ওর দুঃখের কপালকে ভগবান যে এমন ধন্য করে তুলবেন তা কেমন করে জানব বলো। দেখো, ঘুরে ফিরে শেষে আজ তোমার দেখা যখন পেয়েছি তখন বেশ বুঝতে পেরেছি ভগবান আমাকেও দয়া করেছেন।”

“মাসি, মা এসেছেন তোমাকে নেবার জন্যে” বলিয়া বিনয় আসিয়া উপস্থিত হইল। সুচরিতা উঠিয়া পড়িয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কোথায় তিনি?”

বিনয় কহিল, “নীচে আপনার মার কাছে বসে আছেন।”

সুচরিতা তাড়াতাড়ি নীচে চলিয়া গেল।

পরেশবাবু হরিমোহিনীকে কহিলেন, “আমি আপনার বাড়িতে জিনিসপত্র সমস্ত গুছিয়ে দিয়ে আসি গে।”

পরেশবাবু চলিয়া গেলে বিস্মিত বিনয় কহিল, “মাসি, তোমার বাড়ির কথা তো জানতুম না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “আমিও যে জানতুম না বাবা! জানতেন কেবল পরেশবাবু। আমাদের রাধারানীর বাড়ি।”

বিনয় সমস্ত বিবরণ শুনিয়া কহিল, “ভেবেছিলুম পৃথিবীতে বিনয় একজন কারো একটা কোনো কাজে লাগবে। তাও ফসকে গেল। এ পর্যন্ত মায়ের তো কিছুই করতে পারি নি, যা করবার সে তিনিই আমার করেন– মাসিরও কিছু করতে পারব না, তাঁর কাছ থেকেই আদায় করব। আমার ঐ নেবারই কপাল, দেবার নয়।”

কিছুক্ষণ পরে ললিতা ও সুচরিতার সঙ্গে আনন্দময়ী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হরিমোহিনী অগ্রসর হইয়া গিয়া কহিলেন, “ভগবান যখন দয়া করেন তখন আর কৃপণতা করেন না– দিদি, তোমাকেও আজ পেলুম।”

বলিয়া হাত ধরিয়া তাঁহাকে আনিয়া মাদুরের ‘পরে বসাইলেন।

হরিমোহিনী কহিলেন, “দিদি, তোমার কথা ছাড়া বিনয়ের মুখে আর কোনো কথা নেই।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “ছেলেবেলা থেকেই ওর ঐ রোগ, যে কথা ধরে সে কথা শীঘ্র ছাড়ে না। শীঘ্র মাসির পালাও শুরু হবে।”

বিনয় কহিল, “তা হবে, সে আমি আগে থাকতেই বলে রাখছি। আমার অনেক বয়সের মাসি, নিজে সংগ্রহ করেছি, এতদিন যে বঞ্চিত ছিলুম নানারকম করে সেটা পুষিয়ে নিতে হবে।”

আনন্দময়ী ললিতার দিকে চাহিয়া সহাস্যে কহিলেন, “আমাদের বিনয় ওর যা অভাব তা সংগ্রহ করতেও জানে আর সংগ্রহ করে প্রাণমনে তার আদর করতেও জানে। তোমাদের ও যে কী চোখে দেখেছে সে আমিই জানি– যা কখনো ভাবতে পারত না তারই যেন হঠাৎ সাক্ষাৎ পেয়েছে। তোমাদের সঙ্গে ওদের জানাশোনা হওয়াতে আমি যে কত খুশি হয়েছি সে আর কী বলব মা! তোমাদের এই ঘরে যে এমন করে বিনয়ের মন বসেছে তাতে ওর ভারি উপকার হয়েছে। সে কথা ও খুব বোঝে আর স্বীকার করতেও ছাড়ে না।”

ললিতা একটা কিছু উত্তর করিবার চেষ্টা করিয়াও কথা খুঁজিয়া পাইল না, তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। সুচরিতা ললিতার বিপদ দেখিয়া কহিল, “সকল মানুষের ভিতরকার ভালোটি বিনয়বাবু দেখতে পান, এইজন্যই সকল মানুষের যেটুকু ভালো সেটুকু ওঁর ভোগে আসে। সে অনেকটা ওঁর গুণ।”

বিনয় কহিল, “মা, তুমি বিনয়কে যত বড়ো আলোচনার বিষয় বলে ঠিক করে রেখেছ সংসারে তার তত বড়ো গৌরব নেই। এ কথাটা তোমাকে বোঝাব মনে করি, নিতান্ত অহংকারবশতই পারিনে। কিন্তু আর চলল না। মা, আর নয়, বিনয়ের কথা আজ এই পর্যন্ত।”

এমন সময় সতীশ তাহার অচিরজাত কুকুর-শাবকটাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া লাফাইতে লাফাইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। হরিমোহিনী ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বাবা সতীশ, লক্ষ্ণী বাপ আমার, ও-কুকুরটাকে নিয়ে যাও বাবা!”

সতীশ কহিল, “ও কিছু করবে না মাসি! ও তোমার ঘরে যাবে না। তুমি ওকে একটু আদর করো, ও কিছু বলবে না।”

হরিমোহিনী সরিয়া গিয়া কহিলেন, “না বাবা, না, ওকে নিয়ে যাও।”

তখন আনন্দময়ী কুকুর-সুদ্ধ সতীশকে নিজের কাছে টানিয়া লইলেন। কুকুরকে কোলের উপর লইয়া সতীশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি সতীশ না? আমাদের বিনয়ের বন্ধু?”

বিনয়ের বন্ধু বলিয়া নিজের পরিচয়কে সতীশ কিছুই অসংগত মনে করিত না, সুতরাং সে অসংকোচে বলিল, “হাঁ।”

বলিয়া আনন্দময়ীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমি যে বিনয়ের মা হই।”

কুকুর-শাবক আনন্দময়ীর হাতের বালা চর্বণের চেষ্টা করিয়া আত্মবিনোদনে প্রবৃত্ত হইল। সুচরিতা কহিল, “বক্তিয়ার, মাকে প্রণাম কর্‌।”

সতীশ লজ্জিতভাবে কোনোমতে প্রণামটা সারিয়া লইল।

এমন সময়ে বরদাসুন্দরী উপরে আসিয়া হরিমোহিনীর দিকে দৃক্‌পাতমাত্র না করিয়া আনন্দময়ীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি আমাদের এখানে কিছু খাবেন?

আনন্দময়ী কহিলেন, “খাওয়াছোঁওয়া নিয়ে আমি কিছু বাছ-বিচার করি নে। কিন্তু আজকে থাক্‌– গোরা ফিরে আসুক, তার পরে খাব।”

আনন্দময়ী গোরার অসাক্ষাতে গোরার অপ্রিয় কোনো আচরণ করিতে পারিলেন না।

বরদাসুন্দরী বিনয়ের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “এই যে বিনয়বাবু এখানে! আমি বলি আপনি আসেন নি বুঝি।”

বিনয় তৎক্ষণাৎ বলিল, “আমি যে এসেছি সে বুঝি আপনাকে না জানিয়ে যাব ভেবেছেন?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “কাল তো নিমন্ত্রণের খাওয়া ফাঁকি দিয়েছেন, আজ নাহয় বিনা নিমন্ত্রণের খাওয়া খাবেন।”

বিনয় কহিল, “সেইটেতেই আমার লোভ বেশি। মাইনের চেয়ে উপরি-পাওনার টান বড়ো।”

হরিমোহিনী মনে মনে বিস্মিত হইলেন। বিনয় এ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে– আনন্দময়ীও বাছ-বিচার করেন না। ইহাতে তাঁহার মন প্রসন্ন হইল না।

বরদাসুন্দরী চলিয়া গেলে হরিমোহিনী সসংকোচে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, তোমার স্বামী কি–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার স্বামী খুব হিন্দু।”

হরিমোহিনী অবাক হইয়া রহিলেন। আনন্দময়ী তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “বোন, যতদিন সমাজ আমার সকলের চেয়ে বড়ো ছিল ততদিন সমাজকেই মেনে চলতুম, কিন্তু একদিন ভগবান আমার ঘরে হঠাৎ এমন করে দেখা দিলেন যে আমাকে আর সমাজ মানতে দিলেন না। তিনি নিজে এসে আমার জাত কেড়ে নিয়েছেন, তখন আমি আর কাকে ভয় করি।”

হরিমোহিনী এ কৈফিয়তের অর্থ বুঝিতে না পারিয়া কহিলেন, “তোমার স্বামী–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার স্বামী রাগ করেন।”

হরিমোহিনী। ছেলেরা?

আনন্দময়ী। ছেলেরাও খুশি নয়। কিন্তু তাদের খুশি করেই কি বাঁচব? বোন, আমার এ কথা কাউকে বোঝাবার নয়– যিনি সব জানেন তিনিই বুঝবেন।

বলিয়া আনন্দময়ী হাত জোড় করিয়া প্রণাম করিলেন।

হরিমোহিনী ভাবিলেন হয়তো কোনো মিশনারির মেয়ে আসিয়া আনন্দময়ীকে খৃস্টানি ভজাইয়া গেছে। তাঁহার মনের মধ্যে অত্যন্ত একটা সংকোচ উপস্থিত হইল।

পরেশবাবুর বাসার কাছেই সর্বদা তাঁহার তত্ত্বাবধানে থাকিয়া বাস করিতে পাইবে এই কথা শুনিয়া সুচরিতা অত্যন্ত আরামবোধ করিয়াছিল। কিন্তু যখন তাহার নূতন বাড়ির গৃহসজ্জা সমাপ্ত এবং সেখানে উঠিয়া যাইবার সময় নিকটবর্তী হইল তখন সুচরিতার বুকের ভিতর যেন টানিয়া ধরিতে লাগিল। কাছে থাকা না-থাকা লইয়া কথা নয়, কিন্তু জীবনের সঙ্গে জীবনের যে সর্বাঙ্গীণ যোগ ছিল তাহাতে এত দিন পরে একটা বিচ্ছেদ ঘটিবার কাল আসিয়াছে, ইহা আজ সুচরিতার কাছে যেন তাহার এক অংশের মৃত্যুর মতো বোধ হইতে লাগিল। এই পরিবারের মধ্যে সুচরিতার যেটুকু স্থান ছিল, তাহার যে-কিছু কাজ ছিল, প্রত্যেক চাকরটির সঙ্গেও তাহার যে সম্বন্ধ ছিল, সমস্তই সুচরিতার হৃদয়কে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে লাগিল।

সুচরিতার যে নিজের কিছু সংগতি আছে এবং সেই সংগতির জোরে আজ সে স্বাধীন হইবার উপক্রম করিতেছে এই সংবাদে বরদাসুন্দরী বার বার করিয়া প্রকাশ করিলেন যে, ইহাতে ভালোই হইল, এতদিন এত সাবধানে যে দায়িত্বভার বহন করিয়া আসিতেছিলেন তাহা হইতে মুক্ত হইয়া তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন। কিন্তু মনে মনে সুচরিতার প্রতি তাঁহার যেন একটা অভিমানের ভাব জন্মিল; সুচরিতা যে তাঁহাদের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আজ নিজের সম্বলের উপর নির্ভর করিয়া দাঁড়াইতে পারিতেছে এ যেন তাহার একটা অপরাধ। তাঁহারা ছাড়া সুচরিতার অন্য কোনো গতি নাই ইহাই মনে করিয়া অনেক সময় সুচরিতাকে তিনি আপন পরিবারের একটা আপদ বলিয়া নিজের প্রতি করুণা অনুভব করিয়াছেন, কিন্তু সেই সুচরিতার ভার যখন লাঘব হইবার সংবাদ হঠাৎ পাইলেন তখন তো মনের মধ্যে কিছুমাত্র প্রসন্নতা অনুভব করিলেন না। তাঁহাদের আশ্রয় সুচরিতার পক্ষে অত্যাবশ্যক নহে ইহা জানিয়া সে যে গর্ব অনুভব করিতে পারে, তাঁহাদের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য না হইতে পারে, এই কথা মনে করিয়া তিনি আগে হইতেই তাহাকে অপরাধী করিতে লাগিলেন। এ কয়দিন বিশেষভাবে তাহার প্রতি দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিলেন। পূর্বে তাহাকে ঘরের কাজ-কর্মে যেমন করিয়া ডাকিতেন এখন তাহা একেবারে ছাড়িয়া দিয়া গায়ে পড়িয়া তাহাকে অস্বাভাবিক সম্ভ্রম দেখাইতে লাগিলেন। বিদায়ের পূর্বে সুচরিতা ব্যথিতচিত্তে বেশি করিয়াই বরদাসুন্দরীর গৃহকার্যে যোগ দিতে চেষ্টা করিতেছিল, নানা উপলক্ষে তাঁহার কাছে কাছে ফিরিতেছিল, কিন্তু বরদাসুন্দরী যেন পাছে তাহার অসম্মান ঘটে এইরূপ ভাব দেখাইয়া তাহাকে দূরে ঠেকাইয়া রাখিতেছিলেন। এতকাল যাঁহাকে মা বলিয়া যাঁহার কাছে সুচরিতা মানুষ হইয়াছে আজ বিদায় লইবার সময়ও তিনি যে তাহার প্রতি চিত্তকে প্রতিকূল করিয়া রহিলেন, এই বেদনাই সুচরিতাকে সব চেয়ে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল।

লাবণ্য ললিতা লীলা সুচরিতার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিতে লাগিল। তাহারা অত্যন্ত উৎসাহ করিয়া তাহার নূতন বাড়ির ঘর সাজাইতে গেল, কিন্তু সেই উৎসাহের ভিতরেও অব্যক্ত বেদনার অশ্রুজল প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল।

এতদিন পর্যন্ত সুচরিতা নানা ছুতা করিয়া পরেশবাবুর কত-কী ছোটোখাটো কাজ করিয়া আসিয়াছে। হয়তো ফুলদানিতে ফুল সাজাইয়াছে, টেবিলের উপর বই গুছাইয়াছে, নিজের হাতে বিছানা রৌদ্রে দিয়াছে, স্নানের সময় প্রত্যহ তাঁহাকে খবর দিয়া স্মরণ করাইয়া দিয়াছে– এই-সমস্ত অভ্যস্ত কাজের কোনো গুরুত্বই প্রতিদিন কোনো পক্ষ অনুভব করে না। কিন্তু এ-সকল অনাবশ্যক কাজও যখন বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার সময় উপস্থিত হয় তখন এই-সকল ছোটোখাটো সেবা, যাহা একজনে না করিলে অনায়াসে আর-এক জনে করিতে পারে, যাহা না করিলেও কাহারো বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না, এইগুলিই দুই পক্ষের চিত্তকে মথিত করিতে থাকে। সুচরিতা আজকাল যখন পরেশের ঘরের কোনো সামান্য কাজ করিতে আসে তখন সেই কাজটা পরেশের কাছে মস্ত হইয়া দেখা দেয় ও তাহর বক্ষের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস জমা হইয়া উঠে। এবং এই কাজ আজ বাদে কাল অন্যের হাতে সম্পন্ন হইতে থাকিবে এই কথা মনে করিয়া সুচরিতার চোখ ছল্‌ছল্‌ করিয়া আসে।

যেদিন মধ্যাহ্নে আহার করিয়া সুচরিতাদের নূতন বাড়িতে উঠিয়া যাইবার কথা সেদিন প্রাতঃকালে পরেশবাবু তাহার নিভৃত ঘরটিতে উপাসনা করিতে আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার আসনের সম্মুখদেশ ফুল দিয়া সাজাইয়া ঘরের এক প্রান্তে সুচরিতা অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। লাবণ্য-লীলারাও উপাসনাস্থলে আজ আসিবে এইরূপ তাহারা পরামর্শ করিয়াছিল, কিন্তু ললিতা তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া আসিতে দেয় নাই। ললিতা জানিত, পরেশবাবুর নির্জন উপাসনায় যোগ দিয়া সুচরিতা যেন বিশেষভাবে তাঁহার আনন্দের অংশ ও আশীর্বাদ লাভ করিত– আজ প্রাতঃকালে সেই আশীর্বাদ সঞ্চয় করিয়া লইবার জন্য সুচরিতার যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাহাই অনুভব করিয়া ললিতা অদ্যকার উপাসনার নির্জনতা ভঙ্গ করিতে দেয় নাই।

উপাসনা শেষ হইয়া গেল। তখন সুচরিতার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে, পরেশবাবু কহিলেন, “মা, পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ো না, সম্মুখের পথে অগ্রসর হয়ে যাও– মনে সংকোচ রেখো না। যাই ঘটুক, যাই তোমার সম্মুখে উপস্থিত হোক, তার থেকে সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতে ভালোকে গ্রহণ করবে এই পণ করে আনন্দের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ো। ঈশ্বরকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে তাঁকেই নিজের একমাত্র সহায় করো– তা হলে ভুল ত্রুটি ক্ষতির মধ্যে দিয়েও লাভের পথে চলতে পারবে– আর যদি নিজেকে আধা-আধি ভাগ করো, কতক ঈশ্বরে কতক অন্যত্রে, তা হলে সমস্ত কঠিন হয়ে উঠবে। ঈশ্বর এই করুন, তোমার পক্ষে আমাদের ক্ষুদ্র আশ্রয়ের আর যেন প্রয়োজন না হয়।”

উপাসনার পরে উভয়ে বাহিরে আসিয়া দেখিলেন বসিবার ঘরে হারানবাবু অপেক্ষা করিয়া আছেন। সুচরিতা আজ কাহারো বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহভাব মনে রাখিবে না পণ করিয়া হারানবাবুকে নম্রভাবে নমস্কার করিল। হারানবাবু তৎক্ষণাৎ চৌকির উপরে নিজেকে শক্ত করিয়া তুলিয়া অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে কহিলেন, “সুচরিতা, এতদিন তুমি যে সত্যকে আশ্রয় করে ছিলে আজ তার থেকে পিছিয়ে পড়তে যাচ্ছ, আজ আমাদের শোকের দিন।”

সুচরিতা কোনো উত্তর করিল না। কিন্তু যে রাগিণী তাহার মনের মধ্যে আজ শান্তির সঙ্গে করুণা মিশাইয়া সংগীতে জমিয়া উঠিতেছিল তাহাতে একটা বেসুর আসিয়া পড়িল।

পরেশবাবু কহিলেন, “অন্তর্যামী জানেন কে এগোচ্ছে, কে পিছোচ্ছে, বাইরে থেকে বিচার করে আমরা বৃথা উদ্‌বিগ্ন হই।”

হারানবাবু কহিলেন, “তা হলে আপনি কি বলতে চান আপনার মনে কোনো আশঙ্কা নেই? আর আপনার অনুতাপেরও কোনো কারণ ঘটে নি?”

পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবু, কাল্পনিক আশঙ্কাকে আমি মনে স্থান দিই নে এবং অনুতাপের কারণ ঘটেছে কি না তা তখনই বুঝব যখন অনুতাপ জন্মাবে।”

হারানবাবু কহিলেন, “এই-যে আপনার কন্যা ললিতা একলা বিনয়বাবুর সঙ্গে স্টীমারে করে চলে এলেন এটাও কি কাল্পনিক?”

সুচরিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল। পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবু, আপনার মন যে-কোনো কারণে হোক উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, এইজন্যে এখন এ সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে আলাপ করলে আপনার প্রতি অন্যায় করা হবে।”

হারানবাবু মাথা তুলিয়া বলিলেন, “আমি উত্তেজনার বেগে কোনো কথা বলি নে– আমি যা বলি সে সম্বন্ধে আমার দায়িত্ববোধ যথেষ্ট আছে; সেজন্য আপনি চিন্তা করবেন না। আপনাকে যা বলছি সে আমি ব্যক্তিগতভাবে বলছি নে, আমি ব্রাহ্মসমাজের তরফ থেকে বলছি– না বলা অন্যায় বলেই বলছি। আপনি যদি অন্ধ হয়ে না থাকতেন, তা হলে ঐ-যে বিনয়বাবুর সঙ্গে ললিতা একলা চলে এল এই একটি ঘটনা থেকেই আপনি বুঝতে পারতেন আপনার এই পরিবার ব্রাহ্মসমাজের নোঙর ছিঁড়ে ভেসে চলে যাবার উপক্রম করছে। এতে যে শুধু আপনারই অনুতাপের কারণ ঘটবে তা নয়, এতে ব্রাহ্মসমাজেরও অগৌরবের কথা আছে।”

পরেশবাবু কহিলেন, “নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। কেবল ঘটনা থেকে মানুষকে দোষী করবেন না।”

হারানবাবু কহিলেন, “ঘটনা শুধু শুধু ঘটে না, তাকে আপনারা ভিতরের থেকেই ঘটিয়ে তুলেছেন। আপনি এমন-সব লোককে পরিবারের মধ্যে আত্মীয়ভাবে টানছেন যারা আপনার পরিবারকে আপনার আত্মীয়সমাজ থেকে দূরে নিয়ে যেতে চায়। দূরেই তো নিয়ে গেল, সে কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?”

পরেশবাবু একটু বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “আপনার সঙ্গে আমার দেখবার প্রণালী মেলে না।”

হারানবাবু কহিলেন, “আপনার না মিলতে পারে। কিন্তু আমি সুচরিতাকেই সাক্ষী মানছি, উনিই সত্য করে বলুন দেখি, ললিতার সঙ্গে বিনয়ের যে সম্বন্ধ দাঁড়িয়েছে সে কি শুধু বাইরের সম্বন্ধ? তাদের অন্তরকে কোনোখানেই স্পর্শ করে নি? না সুচরিতা, তুমি চলে গেলে হবে না– এ কথার উত্তর দিতে হবে। এ গুরুতর কথা।”

সুচরিতা কঠোর হইয়া কহিল, “যতই গুরুতর হোক এ কথায় আপনার কোনো অধিকার নেই।”

হারানবাবু কহিলেন, “অধিকার না থাকলে আমি যে শুধু চুপ করে থাকতুম তা নয়, চিন্তাও করতুম না। সমাজকে তোমরা গ্রাহ্য না করতে পার, কিন্তু যতদিন সমাজে আছ ততদিন সমাজ তোমাদের বিচার করতে বাধ্য।”

ললিতা ঝড়ের মতো ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিল, “সমাজ যদি আপনাকেই বিচারক পদে নিযুক্ত করে থাকেন তবে এ সমাজ থেকে নির্বাসনই আমাদের পক্ষে শ্রেয়।”

হারানবাবু চৌকি হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “ললিতা, তুমি এসেছ আমি খুশি হয়েছি। তোমার সম্বন্ধে যা নালিশ তোমার সামনেই তার বিচার হওয়া উচিত।”

ক্রোধে সুচরিতার মুখ চক্ষু প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, সে কহিল, “হারানবাবু, আপনার ঘরে গিয়ে আপনার বিচারশালা আহ্বান করুন। গৃহস্থের ঘরের মধ্যে চড়ে তাদের অপমান করবেন আপনার এ অধিকার আমরা কোনোমতেই মানব না। আয় ভাই ললিতা!”

ললিতা এক পা নড়িল না; কহিল, “না দিদি, আমি পালাব না। পানুবাবুর যা-কিছু বলবার আছে সব আমি শুনে যেতে চাই। বলুন কী বলবেন, বলুন।”

হারানবাবু থমকিয়া গেলেন। পরেশবাবু কহিলেন, “মা ললিতা, আজ সুচরিতা আমাদের বাড়ি থেকে যাবে– আজ সকালে আমি কোনোরকম অশান্তি ঘটতে দিতে পারব না। হারানবাবু, আমাদের যতই অপরাধ থাক্‌, তবু আজকের মতো আমাদের মাপ করতে হবে।”

হারানবাবু চুপ করিয়া গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন। সুচরিতা যতই তাঁহাকে বর্জন করিতেছিল সুচরিতাকে ধরিয়া রাখিবার জেদ ততই তাঁহার বাড়িয়া উঠিতেছিল। তাঁহার ধ্রুব বিশ্বাস ছিল অসামান্য নৈতিক জোরের দ্বারা তিনি নিশ্চয়ই জিতিবেন। এখনো তিনি যে হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু মাসির সঙ্গে সুচরিতা অন্য বাড়িতে গেলে সেখানে তাঁহার শক্তি প্রতিহত হইতে থাকিবে এই আশঙ্কায় তাঁহার মন ক্ষুব্ধ ছিল। এইজন্য আজ তাঁহার ব্রহ্মাস্ত্রগুলিকে শান দিয়া আনিয়াছিলেন। কোনোমতে আজ সকালবেলাকার মধ্যেই খুব কড়া রকম করিয়া বোঝাপড়া করিয়া লইতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। আজ সমস্ত সংকোচ তিনি দূর করিয়াই আসিয়াছিলেন– কিন্তু অপর পক্ষেও যে এমন করিয়া সংকোচ দূর করিতে পারে, ললিতা সুচরিতাও যে হঠাৎ তূণ হইতে অস্ত্র বাহির করিয়া দাঁড়াইবে তাহা তিনি কল্পনাও করেন নাই। তিনি জানিতেন, তাঁহার নৈতিক অগ্নিবাণ যখন তিনি মহাতেজে নিক্ষেপ করিতে থাকিবেন অপর পক্ষের মাথা একেবারে হেঁট হইয়া যাইবে। ঠিক তেমনটি হইল না– অবসরও চলিয়া গেল। কিন্তু হারানবাবু হার মানিবেন না। তিনি মনে মনে কহিলেন, সত্যের জয় হইবেই, অর্থাৎ হারানবাবুর জয় হইবেই। কিন্তু জয় তো শুধু শুধু হয় না। লড়াই করিতে হইবে। হারানবাবু কোমর বাঁধিয়া রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন।

সুচরিতা কহিল, “মাসি, আজ আমি সকলের সঙ্গে একসঙ্গে খাব– তুমি কিছু মনে করলে চলবে না।” হরিমোহিনী চুপ করিয়া রহিলেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন সুচরিতা সম্পূর্ণই তাঁহার হইয়াছে– বিশেষত নিজের সম্পত্তির জোরে স্বাধীন হইয়া সে স্বতন্ত্র ঘর করিতে চলিয়াছে, এখন হরিমোহিনীকে আর কোনো সংকোচ করিতে হইবে না, ষোলো-আনা নিজের মতো করিয়া চলিতে পারিবেন। তাই, আজ যখন সুচরিতা শুচিতা বিসর্জন করিয়া আবার সকলের সঙ্গে একত্রে অন্নগ্রহণ করিবার প্রস্তাব করিল তখন তাঁহার ভালো লাগিল না, তিনি চুপ করিয়া রহিলেন।

সুচরিতা তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি এতে ঠাকুর খুশি হবেন। সেই আমার অন্তর্যামী ঠাকুর আমাকে সকলের সঙ্গে আজ একসঙ্গে খেতে বলে দিয়েছেন। তাঁর কথা না মানলে তিনি রাগ করবেন। তাঁর রাগকে আমি তোমার রাগের চেয়ে ভয় করি।”

যতদিন হরিমোহিনী বরদাসুন্দরীর কাছে অপমানিত হইতেছিলেন ততদিন সুচরিতা তাঁহার অপমানের অংশ লইবার জন্য তাঁহার আচার গ্রহণ করিয়াছিল এবং আজ সেই অপমান হইতে যখন নিষ্কৃতির দিন উপস্থিত হইল তখন সুচরিতা যে আচার সম্বন্ধে স্বাধীন হইতে দ্বিধা বোধ করিবে না, হরিমোহিনী তাহা ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। হরিমোহিনী সুচরিতাকে সম্পূর্ণ বুঝিয়া লন নাই, বোঝাও তাঁহার পক্ষে শক্ত ছিল।

হরিমোহিনী সুচরিতাকে স্পষ্ট করিয়া নিষেধ করিলেন না কিন্তু মনে মনে রাগ করিলেন। ভাবিতে লাগিলেন– “মা গো, মানুষের ইহাতে যে কেমন করিয়া প্রবৃত্তি হইতে পারে তাহা আমি ভাবিয়া পাই না। ব্রাহ্মণের ঘরে তো জন্ম বটে!’

খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “একটা কথা বলি বাছা, যা কর তা কর, তোমাদের ঐ বেহারাটার হাতে জল খেয়ো না।”

সুচরিতা কহিল, “কেন মাসি, ঐ রামদীন বেহারাই তো তার নিজের গোরু দুইয়ে তোমাকে দুধ দিয়ে যায়।”

হরিমোহিনী দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “অবাক করলি– দুধ আর জল এক হল!”

সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা মাসি, রামদীনের ছোঁওয়া জল আজ আমি খাব না। কিন্তু সতীশকে যদি তুমি বারণ কর তবে সে ঠিক তার উল্‌টো কাজটি করবে।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সতীশের কথা আলাদা।”

হরিমোহিনী জানিতেন পুরুষমানুষের সম্বন্ধে নিয়মসংযমের ত্রুটি মাপ করিতেই হয়।

হারানবাবু রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন।

আজ প্রায় পনেরো দিন হইয়া গিয়াছে ললিতা স্টীমারে করিয়া বিনয়ের সঙ্গে আসিয়াছে। কথাটা দুই-এক জনের কানে গিয়াছে এবং অল্পে অল্পে ব্যাপ্ত হইবারও চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু সম্প্রতি দুই দিনের মধ্যেই এই সংবাদ শুকনো খড়ে আগুন লাগার মতো ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

ব্রাহ্মপরিবারের ধর্মনৈতিক জীবনের প্রতি লক্ষ রাখিয়া এই প্রকারের কদাচারকে যে দমন করা কর্তব্য হারানবাবু তাহা অনেককেই বুঝাইয়াছেন। এ-সব কথা বুঝাইতেও বেশি কষ্ট পাইতে হয় না। যখন আমরা “সত্যের অনুরোধে’ “কর্তব্যের অনুরোধে’ পরের স্খলন লইয়া ঘৃণাপ্রকাশ ও দণ্ডবিধান করিতে উদ্যত হই, তখন সত্যের ও কর্তব্যের অনুরোধ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত ক্লেশকর হয় না। এইজন্য ব্রাহ্মসমাজে হারানবাবু যখন “অপ্রিয়’ সত্য ঘোষণা ও “কঠোর’ কর্তব্য সাধন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন তখন এত বড়ো অপ্রিয়তা ও কঠোরতার ভয়ে তাঁহার সঙ্গে উৎসাহের সহিত যোগ দিতে অধিকাংশ লোক পরাঙ্‌মুখ হইল না। ব্রাহ্মসমাজের হিতৈষী লোকেরা গাড়ি পালকি ভাড়া করিয়া পরস্পরের বাড়ি গিয়া বলিয়া আসিলেন আজকাল যখন এমন-সকল ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে তখন ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই সঙ্গে, সুচরিতা যে হিন্দু হইয়াছে এবং হিন্দু মাসির ঘরে আশ্রয় লইয়া যাগযজ্ঞ তপজপ ও ঠাকুরসেবা লইয়া দিন যাপন করিতেছে, এ কথাও পল্লবিত হইয়া উঠিতে লাগিল।

অনেক দিন হইতে ললিতার মনে একটা লড়াই চলিতেছিল। সে প্রতি রাত্রে শুইতে যাইবার আগে বলিতেছিল “কখনোই আমি হার মানিব না’ এবং প্রতিদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানায় বসিয়া বলিয়াছে “কোনোমতেই আমি হার মানিব না’। এই-যে বিনয়ের চিন্তা তাহার সমস্ত মনকে অধিকার করিয়া বসিয়াছে, বিনয় নীচের ঘরে বসিয়া কথা কহিতেছে জানিতে পারিলে তাহার হৃৎপিণ্ডের রক্ত উতলা হইয়া উঠিতেছে, বিনয় দুই দিন তাহাদের বাড়িতে না আসিলে অবরুদ্ধ অভিমানে তাহার মন নিপীড়িত হইতেছে, মাঝে মাঝে সতীশকে নানা উপলক্ষে বিনয়ের বাসায় যাইবার জন্য উৎসাহিত করিতেছে এবং সতীশ ফিরিয়া আসিলে বিনয় কী করিতেছিল, বিনয়ের সঙ্গে কী কথা হইল, তাহার আদ্যোপান্ত সংবাদ সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতেছে– ইহা ললিতার পক্ষে যতই অনিবার্য হইয়া উঠিতেছে ততই পরাভবের গ্লানিতে তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। বিনয় ও গোরার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ে বাধা দেন নাই বলিয়া এক-এক বার পরেশবাবুর প্রতি তাহার রাগও হইত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে লড়াই করিবে, মরিবে তবু হারিবে না, এই তাহার পণ ছিল। জীবন যে কেমন করিয়া কাটাইবে সে সম্বন্ধে নানাপ্রকার কল্পনা তাহার মনের মধ্যে যাতায়াত করিতেছিল। য়ুরোপের লোকহিতৈষিণী রমণীদের জীবনচরিতে যে-সকল কীর্তিকাহিনী সে পাঠ করিয়াছিল সেইগুলি তাহার নিজের পক্ষে সাধ্য ও সম্ভবপর বলিয়া মনে হইতে লাগিল।

একদিন সে পরেশবাবুকে গিয়া কহিল, “বাবা, আমি কি কোনো মেয়ে-ইস্কুলে শেখাবার ভার নিতে পারি নে?”

পরেশবাবু তাঁহার মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ক্ষুধাতুর হৃদয়ের বেদনায় তাহার সকরুণ দুটি চক্ষু যেন কাঙাল হইয়া এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে। তিনি স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “কেন পারবে না মা? কিন্তু তেমন মেয়ে-ইস্কুল কোথায়?”

যে সময়ের কথা হইতেছে তখন মেয়ে-ইস্কুল বেশি ছিল না, সামান্য পাঠশালা ছিল এবং ভদ্রঘরের মেয়েরা শিক্ষয়িত্রীর কাজে তখন অগ্রসর হন নাই। ললিতা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “ইস্কুল নেই বাবা?”

পরেশবাবু কহিলেন, “কই, দেখি নে তো।”

ললিতা কহিল, “আচ্ছা, বাবা, মেয়ে-ইস্কুল কি একটা করা যায় না?”

পরেশবাবু কহিলেন, “অনেক খরচের কথা এবং অনেক লোকের সহায়তা চাই।”

ললিতা জানিত সৎকর্মের সংকল্প জাগাইয়া তোলাই কঠিন, কিন্তু তাহা সাধন করিবার পথেও যে এত বাধা তাহা সে পূর্বে ভাবে নাই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া সে আস্তে আস্তে উঠিয়া চলিয়া গেল। তাঁহার এই প্রিয়তমা কন্যাটির হৃদয়ের ব্যথা কোন্‌খানে পরেশবাবু তাহাই বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। বিনয়ের সম্বন্ধে হারানবাবু সেদিন যে ইঙ্গিত করিয়া গিয়াছেন তাহাও তাঁহার মনে পড়িল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নিজেকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন– “আমি কি অবিবেচনার কাজ করিয়াছি?’ তাঁহার অন্য কোনো মেয়ে হইলে বিশেষ চিন্তার কারণ ছিল না– কিন্তু ললিতার জীবন যে ললিতার পক্ষে অত্যন্ত সত্য পদার্থ, সে তো আধা-আধি কিছুই জানে না, সুখদুঃখ তাহার পক্ষে কিছু-সত্য কিছু-ফাঁকি নহে।

ললিতা প্রতিদিন নিজের জীবনের মধ্যে ব্যর্থ ধিক্কার বহন করিয়া বাঁচিয়া থাকিবে কেমন করিয়া? সে যে সম্মুখে কোথাও একটা প্রতিষ্ঠা, একটা মঙ্গল-পরিণাম দেখিতে পাইতেছে না। এমনভাবে নিরুপায় ভাসিয়া চলিয়া যাওয়া তাহার স্বভাবসিদ্ধ নহে।

সেইদিনই মধ্যাহ্নে ললিতা সুচরিতার বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘরে গৃহসজ্জা বিশেষ কিছুই নাই। মেঝের উপর একটি ঘর-জোড়া শতরঞ্চ, তাহারই এক দিকে সুচরিতার বিছানা পাতা ও অন্য দিকে হরিমোহিনীর বিছানা। হরিমোহিনী খাটে শোন না বলিয়া সুচরিতাও তাঁহার সঙ্গে এক ঘরে নীচে বিছানা করিয়া শুইতেছে। দেয়ালে পরেশবাবুর একখানি ছবি টাঙানো। পাশের একটি ছোটো ঘরে সতীশের খাট পড়িয়াছে এবং এক ধারে একটি ছোটো টেবিলের উপর দোয়াত কলম খাতা বই স্লেট বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো রহিয়াছে। সতীশ ইস্কুলে গিয়াছে। বাড়ি নিস্তব্ধ।

আহারান্তে হরিমোহিনী তাঁহার মাদুরের উপর শুইয়া নিদ্রার উপক্রম করিতেছেন, এবং সুচরিতা পিঠে মুক্ত চুল মেলিয়া দিয়া শতরঞ্চে বসিয়া কোলের উপর বালিশ লইয়া এক মনে কী পড়িতেছে। সম্মুখে আরো কয়খানা বই পড়িয়া আছে।

ললিতাকে হঠাৎ ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সুচরিতা যেন লজ্জিত হইয়া প্রথমটা বই বন্ধ করিল, পরক্ষণে লজ্জার দ্বারাই লজ্জাকে দমন করিয়া বই যেমন ছিল তেমনি রাখিল। এই বইগুলি গোরার রচনাবলী।

হরিমোহিনী উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, “এসো, এসো মা, ললিতা এসো। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে সুচরিতার মনের মধ্যে কেমন করছে সে আমি জানি। ওর মন খারাপ হলেই ঐ বইগুলো নিয়ে পড়তে বসে। এখনই আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম তোমরা কেউ এলে ভালো হয়– অমনি তুমি এসে পড়েছ– অনেক দিন বাঁচবে মা!”

ললিতার মনে যে কথাটা ছিল সুচরিতার কাছে বসিয়া সে একেবারেই তাহা আরম্ভ করিয়া দিল। সে কহিল, “সুচিদিদি, আমাদের পাড়ায় মেয়েদের জন্যে যদি একটা ইস্কুল করা যায় তা হলে কেমন হয়।”

হরিমোহিনী অবাক হইয়া কহিলেন, “শোনো একবার কথা! তোমরা ইস্কুল করবে কী!”

সুচরিতা কহিল, “কেমন করে করা যাবে বল্‌। কে আমাদের সাহায্য করবে? বাবাকে বলেছিস কি?”

ললিতা কহিল, “আমরা দুজনে তো পড়াতে পারব। হয়তো বড়দিদিও রাজি হবে।”

সুচরিতা কহিল, “শুধু পড়ানো নিয়ে তো কথা নয়। কী রকম করে ইস্কুলের কাজ চালাতে হবে তার সব নিয়ম বেঁধে দেওয়া চাই, বাড়ি ঠিক করতে হবে, ছাত্রী সংগ্রহ করতে হবে, খরচ জোগাতে হবে। আমরা দুজন মেয়েমানুষ এর কী করতে পারি!”

ললিতা কহিল, “দিদি, ও কথা বললে চলবে না। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই কি নিজের মনখানাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে পড়ে আছাড় খেতে থাকব? পৃথিবীর কোনো কাজেই লাগব না?”

ললিতার কথাটার মধ্যে যে বেদনা ছিল সুচরিতার বুকের মধ্যে গিয়া তাহা বাজিয়া উঠিল। সে কোনো উত্তর না করিয়া ভাবিতে লাগিল।

ললিতা কহিল, “পাড়ায় তো অনেক মেয়ে আছে। আমরা যদি তাদের অমনি পড়াতে চাই বাপ-মা’রা তো খুশি হবে। তাদের যে-কজনকে পাই তোমার এই বাড়িতে এনে পড়ালেই হবে। এতে খরচ কিসের?”

এই বাড়িতে রাজ্যের অপরিচিত ঘরের মেয়ে জড়ো করিয়া পড়াইবার প্রস্তাবে হরিমোহিনী উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। তিনি নিরিবিলি পূজা-অর্চনা লইয়া শুদ্ধ শুচি হইয়া থাকিতে চান, তাহার ব্যাঘাতের সম্ভাবনায় আপত্তি করিতে লাগিলেন।

সুচরিতা কহিল, “মাসি, তোমার ভয় নেই, যদি ছাত্রী জোটে তাদের নিয়ে আমাদের নীচের তলার ঘরেই কাজ চালাতে পারব, তোমার উপরের ঘরে আমরা উৎপাত করতে আসব না। তা ভাই ললিতা, যদি ছাত্রী পাওয়া যায় তা হলে আমি রাজি আছি।”

ললিতা কহিল, “আচ্ছা, দেখাই যাক-না।”

হরিমোহিনী বার বার কহিলে লাগিলেন, “মা, সকল বিষয়েই তোমরা খৃস্টানের মতো হলে চলবে কেন? গৃহস্থ ঘরের মেয়ে ইস্কুলে পড়ায় এ তো বাপের বয়সে শুনি নি।”

পরেশবাবুর ছাতের উপর হইতে আশ-পাশের বাড়ির ছাতে মেয়েদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় চলিত। এই পরিচয়ের একটা মস্ত কণ্টক ছিল, পাশের বাড়ির মেয়েরা এ বাড়ির মেয়েদের এত বয়সে এখনো বিবাহ হইল না বলিয়া প্রায়ই প্রশ্ন এবং বিস্ময় প্রকাশ করিত। ললিতা এই কারণে এই ছাতের আলাপে পারতপক্ষে যোগ দিত না।

এই ছাতে ছাতে বন্ধুত্ব-বিস্তারে লাবণ্যই ছিল সকলের চেয়ে উৎসাহী। অন্য বাড়ির সাংসারিক ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে তাহার কৌতূহলের সীমা ছিল না। তাহার প্রতিবেশীদের দৈনিক জীবনযাত্রার প্রধান ও অপ্রধান অনেক বিষয়ই দূর হইতে বায়ুযোগে তাহার নিকট আলোচিত হইত। চিরুনি হস্তে কেশসংস্কার করিতে করিতে মুক্ত আকাশতলে প্রায়ই তাহার অপরাহ্নসভা জমিত।

ললিতা তাহার সংকল্পিত মেয়ে-ইস্কুলের ছাত্রীসংগ্রহের ভার লাবণ্যের উপর অর্পণ করিল। লাবণ্য ছাতে ছাতে যখন এই প্রস্তাব ঘোষণা করিয়া দিল তখন অনেক মেয়েই উৎসাহিত হইয়া উঠিল। ললিতা খুশি হইয়া সুচরিতার বাড়ির একতলার ঘর ঝাঁট দিয়া, ধুইয়া, সাজাইয়া প্রস্তুত করিতে লাগিল।

কিন্তু তাহার ইস্কুলঘর শূন্যই রহিয়া গেল। বাড়ির কর্তারা তাঁহাদের মেয়েদের ভুলাইয়া পড়াইবার ছলে ব্রাহ্মবাড়িতে লইয়া যাইবার প্রস্তাবে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। এমন-কি, এই উপলক্ষেই যখন তাঁহারা জানিতে পারিলেন পরেশবাবুর মেয়েদের সঙ্গে তাঁহাদের মেয়েদের আলাপ চলে তখন তাহাতে বাধা দেওয়াই তাঁহারা কর্তব্য বোধ করিলেন। তাঁহাদের মেয়েদের ছাতে ওঠা বন্ধ হইবার জো হইল এবং ব্রাহ্ম প্রতিবেশীর মেয়েদের সাধু সংকল্পের প্রতি তাঁহারা সাধুভাষা প্রয়োগ করিলেন না। বেচারা লাবণ্য যথাসময়ে চিরুনি হাতে ছাতে উঠিয়া দেখে পার্শ্ববর্তী ছাতগুলিতে নবীনাদের পরিবর্তে প্রবীণাদের সমাগম হইতেছে এবং তাঁহাদের একজনের নিকট হইতেও সে সাদর সম্ভাষণ লাভ করিল না।

ললিতা ইহাতেও ক্ষান্ত হইল না। সে কহিল– অনেক গরিব ব্রাহ্ম মেয়ের বেথুন ইস্কুলে গিয়া পড়া দুঃসাধ্য, তাহাদের পড়াইবার ভার লইলে উপকার হইতে পারিবে।

এইরূপ ছাত্রী-সন্ধানে সে নিজেও লাগিল, সুধীরকেও লাগাইয়া দিল।

সেকালে পরেশবাবুর মেয়েদের পড়াশুনার খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত ছিল। এমন-কি, সে খ্যাতি সত্যকেও অনেক দূরে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। এজন্য ইঁহারা মেয়েদের বিনা বেতনে পড়াইবার ভার লইবেন শুনিয়া অনেক পিতামাতাই খুশি হইয়া উঠিলেন।

প্রথমে পাঁচ-ছয়টি মেয়ে লইয়া দুই-চার দিনেই ললিতার ইস্কুল বসিয়া গেল। পরেশবাবুর সঙ্গে এই ইস্কুলের কথা আলোচনা করিয়া ইহার নিয়ম বাঁধিয়া ইহার আয়োজন করিয়া সে নিজেকে এক মুহূর্ত সময় দিল না। এমন-কি, বৎসরের শেষে পরীক্ষা হইয়া গেলে মেয়েদের কিরূপ প্রাইজ দিতে হইবে তাহা লইয়া লাবণ্যর সঙ্গে ললিতার রীতিমত তর্ক বাধিয়া গেল– ললিতা যে বইগুলার কথা বলে লাবণ্যর তাহা পছন্দ হয় না, আবার লাবণ্যর সঙ্গে ললিতার পছন্দরও মিল হয় না। পরীক্ষা কে কে করিবে তাহা লইয়াও একটু তর্ক হইয়া গেল। লাবণ্য মোটের উপরে যদিও হারানবাবুকে দেখিতে পারিত না, কিন্তু তাঁহার পাণ্ডিত্যের খ্যাতিতে সে অভিভূত ছিল। হারানবাবু তাহাদের বিদ্যালয়ের পরীক্ষা অথবা শিক্ষা অথবা কোনো-একটা কাজে নিযুক্ত থাকিলে সেটা যে বিশেষ গৌরবের বিষয় হইবে এ বিষয়ে তাহার সন্দেহমাত্র ছিল না। কিন্তু ললিতা কথাটাকে একেবারেই উড়াইয়া দিল– হারানবাবুর সঙ্গে তাহাদের এ বিদ্যালয়ের কোনোপ্রকার সম্বন্ধই থাকিতে পারে না।

দুই-তিন দিনের মধ্যেই তাহার ছাত্রীর দল কমিতে কমিতে ক্লাস শূন্য হইয়া গেল। ললিতা তাহার নির্জন ক্লাসে বসিয়া পদশব্দ শুনিবামাত্র ছাত্রী-সম্ভাবনায় সচকিত হইয়া উঠে, কিন্তু কেহই আসে না। এমন করিয়া দুই প্রহর যখন কাটিয়া গেল তখন সে বুঝিল একটা কিছু গোল হইয়াছে।

নিকটে যে ছাত্রীটি ছিল ললিতা তাহার বাড়িতে গেল। ছাত্রী কাঁদোকাঁদো হইয়া কহিল, “মা আমাকে যেতে দিচ্ছে না।”

মা কহিলেন, অসুবিধা হয়। অসুবিধাটা যে কী তাহা স্পষ্ট বুঝা গেল না। ললিতা অভিমানিনী মেয়ে; সে অন্য পক্ষে অনিচ্ছার লেশমাত্র লক্ষণ দেখিলে জেদ করিতে বা কারণ জিজ্ঞাসা করিতে পারেই না। সে কহিল, “যদি অসুবিধা হয় তা হলে কাজ কী!”

ললিতা ইহার পরে যে বাড়িতে গেল সেখানে স্পষ্ট কথাই শুনিতে পাইল। তাহারা কহিল, “সুচরিতা আজকাল হিন্দু হইয়াছে, সে জাত মানে, তাহার বাড়িতে ঠাকুরপূজা হয়, ইত্যাদি।”

ললিতা কহিল, “সেজন্য যদি আপত্তি থাকে তবে নাহয় আমাদের বাড়িতেই ইস্কুল বসবে।”

কিন্তু ইহাতেও আপত্তির খণ্ডন হইল না, আরো-একটা কিছু বাকি আছে। ললিতা অন্য বাড়িতে না গিয়া সুধীরকে ডাকাইয়া পাঠাইল। জিজ্ঞাসা করিল, “সুধীর, কী হয়েছে সত্য করে বলো তো।”

সুধীর কহিল, “পানুবাবু তোমাদের এই ইস্কুলের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছেন।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, দিদির বাড়িতে ঠাকুরপুজো হয় ব’লে?”

সুধীর কহিল, “শুধু তাই নয়।”

ললিতা অধীর হইয়া কহিল, “আর কী, বলোই-না।”

সুধীর কহিল, “সে অনেক কথা।”

ললিতা কহিল, “আমারও অপরাধ আছে বুঝি?”

সুধীর চুপ করিয়া রহিল। ললিতা মুখ লাল করিয়া বলিল, “এ আমার সেই স্টীমার-যাত্রার শাস্তি! যদি অবিবেচনার কাজ করেই থাকি তবে ভালো কাজ করে প্রায়শ্চিত্ত করার পথ আমাদের সমাজে একেবারেই বন্ধ বুঝি! আমার পক্ষে সমস্ত শুভকর্ম এ সমাজে নিষিদ্ধ? আমার এবং আমাদের সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির এই প্রণালী তোমরা ঠিক করেছ!”

সুধীর কথাটাকে একটু নরম করিবার জন্য কহিল, “ঠিক সেজন্যে নয়। বিনয়বাবুরা পাছে ক্রমে এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন ওঁরা সেই ভয় করেন।”

ললিতা একেবারে আগুন হইয়া কহিল, “সে ভয়, না সে ভাগ্য! যোগ্যতায় বিনয়বাবুর সঙ্গে তুলনা হয় এমন লোক ওঁদের মধ্যে কজন আছে!”

সুধীর ললিতার রাগ দেখিয়া সংকুচিত হইয়া কহিল, “সে তো ঠিক কথা। কিন্তু বিনয়বাবু তো–”

ললিতা। ব্রাহ্মসমাজের লোক নন! সেইজন্যে ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে দণ্ড দেবেন। এমন সমাজের জন্যে আমি গৌরব বোধ করি নে।

ছাত্রীদের সম্পূর্ণ তিরোধান দেখিয়া, সুচরিতা ব্যাপারখানা কী এবং কাহার দ্বারা ঘটিতেছে তাহা বুঝিতে পারিয়াছিল। সে এ সম্বন্ধে কোনো কথাটি না কহিয়া উপরের ঘরে সতীশকে তাহার আসন্ন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করিতেছিল।

সুধীরের সঙ্গে কথা কহিয়া ললিতা সুচরিতার কাছে গেল, কহিল, “শুনেছ?”

সুচরিতা একটু হাসিয়া কহিল, “শুনি নি; কিন্তু সব বুঝেছি।”

ললিতা কহিল, “এ-সব কি সহ্য করতে হবে?”

সুচরিতা ললিতার হাত ধরিয়া কহিল, “সহ্য করাতে তো অপমান নেই। বাবা কেমন করে সব সহ্য করেন দেখেছিস তো?”

ললিতা কহিল, “কিন্তু সুচিদিদি, আমার অনেক সময় মনে হয় সহ্য করার দ্বারা অন্যায়কে যেন স্বীকার করে নেওয়া হয়। অন্যায়কে সহ্য না করাই হচ্ছে তার প্রতি উচিত ব্যবহার।”

সুচরিতা কহিল, “তুই কী করতে চাস ভাই বল্‌।”

ললিতা কহিল,”তা আমি কিচ্ছু ভাবি নি– আমি কী করতে পারি তাও জানি নে– কিন্তু একটা-কিছু করতেই হবে। আমাদের মতো মেয়েমানুষের সঙ্গে এমন নীচভাবে যারা লেগেছে তারা নিজেদের যত বড়ো লোক মনে করুক তারা কাপুরুষ। কিন্তু তাদের কাছে আমি কোনোমতেই হার মানব না– কেনোমতেই না। এতে তারা যা করতে পারে করুক।”

বলিয়া ললিতা মাটিতে পদাঘাত করিল। সুচরিতা কোনো উত্তর না করিয়া ধীরে ধীরে ললিতার হাতের উপর হাত বুলাইতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে কহিল, “ললিতা, ভাই, একবার বাবার সঙ্গে কথা কয়ে দেখ্‌।”

ললিতা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমি এখনই তাঁর কাছেই যাচ্ছি।”

ললিতা তাহাদের বাড়ির দ্বারের কাছে আসিয়া দেখিল নতশিরে বিনয় বাহির হইয়া আসিতেছে। ললিতাকে দেখিয়া বিনয় মুহূর্তের জন্য থমকিয়া দাঁড়াইল– ললিতার সঙ্গে দুই-একটা কথা কহিয়া লইবে কি না সে সম্বন্ধে তাহার মনে একটা বিতর্ক উপস্থিত হইল– কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া ললিতার মুখের দিকে না চাহিয়া তাহাকে নমস্কার করিল ও মাথা হেঁট করিয়াই চলিয়া গেল।

ললিতাকে যেন অগ্নিতপ্ত শেলে বিদ্ধ করিল। সে দ্রুতপদে বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই একেবারে তাহার ঘরে গেল। তাহার মা তখন টেবিলের উপর একটা লম্বা সরু খাতা খুলিয়া হিসাবে মনোনিবেশ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন।

ললিতার মুখ দেখিয়াই বরদাসুন্দরী মনে শঙ্কা গনিলেন। তাড়াতাড়ি হিসাবের খাতাটার মধ্যে একেবারে নিরুদ্দেশ হইয়া যাইবার প্রয়াস পাইলেন– যেন একটা কী অঙ্ক আছে যাহা এখনই মিলাইতে না পারিলে তাঁহার সংসার একেবারে ছারখার হইয়া যাইবে।

ললিতা চৌকি টানিয়া টেবিলের কাছে বসিল। তবু বরদাসুন্দরী মুখ তুলিলেন না। ললিতা কহিল, “মা!”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “রোস্‌ বাছা, আমি এই–”

বলিয়া খাতাটার প্রতি নিতান্ত ঝুঁকিয়া পড়িলেন।

ললিতা কহিল, “আমি বেশিক্ষণ তোমাকে বিরক্ত করব না। একটা কথা জানতে চাই। বিনয়বাবু এসেছিলেন?”

বরদাসুন্দরী খাতা হইতে মুখ না তুলিয়া কহিলেন, “হাঁ।”

ললিতা। তাঁর সঙ্গে তোমার কী কথা হল?

“সে অনেক কথা।”

ললিতা। আমার সম্বন্ধে কথা হয়েছিল কি না?

বরদাসুন্দরী পলায়নের পন্থা না দেখিয়া কলম ফেলিয়া খাতা হইতে মুখ তুলিয়া কহিলেন, “তা বাছা, হয়েছিল। দেখলুম যে ক্রমেই বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ছে– সমাজের লোকে চার দিকেই নিন্দে করছে, তাই সাবধান করে দিতে হল।”

লজ্জায় ললিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল, তাহার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করিতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা কি বিনয়বাবুকে এখানে আসতে নিষেধ করেছেন?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তিনি বুঝি এ-সব কথা ভাবেন? যদি ভাবতেন তা হলে গোড়াতেই এ-সমস্ত হতে পারত না।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “পানুবাবু আমাদের এখানে আসতে পারবেন?”

বরদাসুন্দরী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “শোনো একবার! পানুবাবু আসবেন না কেন?”

ললিতা। বিনয়বাবুই বা আসবেন না কেন?

বরদাসুন্দরী পুনরায় খাতা টানিয়া লইয়া কহিলেন, “ললিতা, তোর সঙ্গে আমি পারি নে বাপু! যা, এখন আমাকে জ্বালাস নে– আমার অনেক কাজ আছে।”

ললিতা দুপুরবেলায় সুচরিতার বাড়িতে ইস্কুল করিতে যায় এই অবকাশে বিনয়কে ডাকাইয়া আনিয়া বরদাসুন্দরী তাঁহার যাহা বক্তব্য বলিয়াছিলেন। মনে করিয়াছিলেন, ললিতা টেরও পাইবে না। হঠাৎ চক্রান্ত এমন করিয়া ধরা পড়িল দেখিয়া তিনি বিপদ বোধ করিলেন। বুঝিলেন, পরিণামে ইহার শান্তি নাই এবং সহজে ইহার নিষ্পত্তি হইবে না। নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বামীর উপর তাঁহার সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল। এই অবোধ লোকটিকে লইয়া ঘরকন্না করা স্ত্রীলোকের পক্ষে কী বিড়ম্বনা!

ললিতা হৃদয়-ভরা প্রলয়ঝড় বহন করিয়া লইয়া চলিয়া গেল। নীচের ঘরে বসিয়া পরেশবাবু চিঠি লিখিতেছিলেন, সেখানে গিয়াই একেবারে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, বিনয়বাবু কি আমাদের সঙ্গে মেশবার যোগ্য নন?”

প্রশ্ন শুনিয়াই পরেশবাবু অবস্থাটা বুঝিতে পারিলেন। তাঁহার পরিবার লইয়া সম্প্রতি তাঁহাদের সমাজে যে আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে তাহা পরেশবাবুর অগোচর ছিল না। ইহা লইয়া তাঁহাকে যথেষ্ট চিন্তা করিতেও হইতেছে। বিনয়ের প্রতি ললিতার মনের ভাব সম্বন্ধে যদি তাঁহার মনে সন্দেহ উপস্থিত না হইত তবে তিনি বাহিরের কথায় কিছুমাত্র কান দিতেন না। কিন্তু যদি বিনয়ের প্রতি ললিতার অনুরাগ জন্মিয়া থাকে তবে সে স্থলে তাঁহার কর্তব্য কী সে প্রশ্ন তিনি বারবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। প্রকাশ্যভাবে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লওয়ার পর তাঁহার পরিবারে আবার এই একটা সংকটের সময় উপস্থিত হইয়াছে। সেইজন্য এক দিকে একটা ভয় এবং কষ্ট তাঁহাকে ভিতরে ভিতরে পীড়ন করিতেছে, অন্য দিকে তাঁহার সমস্ত চিত্তশক্তি জাগ্রত হইয়া উঠিয়া বলিতেছে, “ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের সময় যেমন একমাত্র ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হইয়াছি, সত্যকেই সুখ সম্পত্তি সমাজ সকলের ঊর্ধ্বে স্বীকার করিয়া জীবন চিরদিনের মতো ধন্য হইয়াছে, এখনো যদি সেইরূপ পরীক্ষার দিন উপস্থিত হয় তবে তাঁহার দিকেই লক্ষ রাখিয়া উত্তীর্ণ হইব।’

ললিতার প্রশ্নের উত্তরে পরেশবাবু কহিলেন, “বিনয়কে আমি তো খুব ভালো বলেই জানি। তাঁর বিদ্যাবুদ্ধিও যেমন চরিত্রও তেমনি।”

একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া ললিতা কহিল, “গৌরবাবুর মা এর মধ্যে দুদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। সুচিদিদিকে নিয়ে তাঁর ওখানে আজ একবার যাব?”

পরেশবাবু ক্ষণকালের জন্য উত্তর দিতে পারিলেন না। তিনি নিশ্চয় জানিতেন বর্তমান আলোচনার সময় এইরূপ যাতায়াতে তাঁহাদের নিন্দা আরো প্রশ্রয় পাইবে। কিন্তু তাঁহার মন বলিয়া উঠিল, “যতক্ষণ ইহা অন্যায় নহে ততক্ষণ আমি নিষেধ করিতে পারিব না।’ কহিলেন, “আচ্ছা, যাও। আমার কাজ আছে, নইলে আমিও তোমাদের সঙ্গে যেতুম।”

বিনয় যেখানে এই কয়দিন অতিথিরূপে ও বন্ধুরূপে এমন নিশ্চিতভাবে পদার্পণ করিয়াছিল তাহার তলদেশে সামাজিক আগ্নেয়গিরি এমন সচেষ্টভাবে উত্তপ্ত হইয়া আছে তাহা সে স্বপ্নেও জানিত না। প্রথম যখন সে পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে মিশিতেছিল তখন তাহার মনে যথেষ্ট সংকোচ ছিল; কোথায় কতদূর পর্যন্ত তাহার অধিকারের সীমা তাহা সে নিশ্চিত জানিত না বলিয়া সর্বদা ভয়ে ভয়ে চলিত। ক্রমে যখন তাহার ভয় ভাঙিয়া গেল তখন কোথাও যে কিছুমাত্র বিপদের শঙ্কা আছে তাহা তাহার মনেও হয় নাই। আজ হঠাৎ যখন শুনিল তাহার ব্যবহারে সমাজের লোকের নিকট ললিতাকে নিন্দিত হইতে হইতেছে তখন তাহার মাথায় বজ্র পড়িল। বিশেষত সকলের চেয়ে তাহার ক্ষোভের কারণ হইল এইজন্য যে, ললিতার সম্বন্ধে তাহার হৃদয়ের উত্তাপমাত্র সাধারণ বন্ধুত্বের রেখা ছাড়াইয়া অনেক ঊর্ধ্বে উঠিয়াছিল তাহা সে নিজে জানিত এবং বর্তমান ক্ষেত্রে যেখানে পরস্পরের সমাজ এমন বিভিন্ন সেখানে এরূপ তাপাধিক্যকে সে মনে মনে অপরাধ বলিয়াই গণ্য করিত। সে অনেক বার মনে করিয়াছে এই পরিবারের বিশ্বস্ত অতিথিরূপে আসিয়া সে নিজের ঠিক স্থানটি রাখিতে পারে নাই– এক জায়গায় সে কপটতা করিতেছে; তাহার মনের ভাবটি এই পরিবারের লোকের কাছে ঠিকমত প্রকাশ পাইলে তাহার পক্ষে লজ্জার কারণ হইবে।

এমন সময় যখন একদিন মধ্যাহ্নে বরদাসুন্দরী পত্র লিখিয়া বিনয়কে বিশেষ করিয়া ডাকিয়া আনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন– “বিনয়বাবু, আপনি তো হিন্দু?’ এবং বিনয় তাহা স্বীকার করিলে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন– “হিন্দুসমাজ আপনি তো ত্যাগ করিতে পারিবেন না?’ এবং বিনয় তাহা তাহার পক্ষে অসম্ভব জানাইলে বরদাসুন্দরী যখন বলিয়া উঠিলেন “তবে কেন আপনি’– তখন সেই “তবে কেন’র কোনো উত্তর বিনয়ের মুখে জোগাইল না। সে একেবারে মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার মনে হইল সে যেন ধরা পড়িয়াছে; তাহার এমন একটা জিনিস এখানে সকলের কাছে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে যাহা সে চন্দ্রসূর্যবায়ুর কাছেও গোপন করিতে চাহিয়াছিল। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল– পরেশবাবু কী মনে করিতেছেন, ললিতা কী মনে করিতেছে, সুচরিতাই বা তাহাকে কী ভাবিতেছে! দেবদূতের কোন্‌ ভ্রমক্রমে এই-যে স্বর্গলোকে কিছুদিনের মতো তাহার স্থান হইয়াছিল– অনধিকার-প্রবেশের সমস্ত লজ্জা মাথায় করিয়া লইয়া এখান হইতে আজ তাহাকে একেবারে নির্বাসিত হইতে হইবে।

তাহার পরে পরেশের দরজা পার হইয়াই প্রথমেই যেই সে ললিতাকে দেখিতে পাইল তাহার মনে হইল “ললিতার নিকট হইতে এই শেষ-বিদায়ের মুহূর্তে তাহার কাছে একটা মস্ত অপমান স্বীকার করিয়া লইয়া পূর্বপরিচয়ের একটা প্রলয় সমাধান করিয়া দিয়া যাই’–কিন্তু কী করিলে তাহা হয় ভাবিয়া পাইল না; তাই ললিতার মুখের দিকে না চাহিয়া নিঃশব্দে একটি নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল।

এই তো সেদিন পর্যন্ত বিনয় পরেশের পরিবারের বাহিরেই ছিল– আজও সেই বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু এ কী প্রভেদ! সেই বাহির আজ এমন শূন্য কেন? তাহার পূর্বের জীবনে তো কোনো ক্ষতি হয় নাই– তাহার গোরা, তাহার আনন্দময়ী তো আছে। কিন্তু তবু তাহার মনে হইতে লাগিল মাছ যেন জল হইতে ডাঙায় উঠিয়াছে– যে দিকে ফিরিতেছে কোথাও সে যেন জীবনের অবলম্বন পাইতেছে না। এই হর্ম্যসংকুল শহরের জনাকীর্ণ রাজপথে বিনয় সর্বত্রই নিজের জীবনের একটা ছায়াময় পাণ্ডুবর্ণ সর্বনাশের চেহারা দেখিতে লাগিল। এই বিশ্বব্যাপী শুষ্কতায় শূন্যতায় সে নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। কেন এমন হইল, কখন এমন হইল, কী করিয়া এ সম্ভব হইল, এই কথাই সে একটা হৃদয়হীন নিরুত্তর শূন্যের কাছে বার বার প্রশ্ন করিতে লাগিল।

“বিনয়বাবু! বিনয়বাবু!”

বিনয় পিছন ফিরিয়া দেখিল, সতীশ। তাহাকে বিনয় আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। কহিল, “কী ভাই, কী বন্ধু!” বিনয়ের কণ্ঠ যেন অশ্রুতে ভরিয়া আসিল। পরেশবাবুর ঘরে এই বালকটিও যে কতখানি মাধুর্য মিশাইয়াছিল তাহা বিনয় আজ যেমন অনুভব করিল এমন বুঝি কোনোদিন করে নাই।

সতীশ কহিল, “আপনি আমাদের ওখানে কেন যান না? কাল আমাদের ওখানে লাবণ্যদিদি ললিতাদিদি খাবেন, মাসি আপনাকে নেমন্তন্ন করবার জন্যে পাঠিয়েছেন।”

বিনয় বুঝিল মাসি কোনো খবর রাখেন না। কহিল, “সতীশবাবু, মাসিকে আমার প্রণাম জানিয়ো– কিন্তু আমি তো যেতে পারব না।”

সতীশ অনুনয়ের সহিত বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “কেন পারবেন না? আপনাকে যেতেই হবে, কিছুতেই ছাড়ব না।”

সতীশের এত অনুরোধের বিশেষ একটু কারণ ছিল। তাহার ইস্কুলে “পশুর প্রতি ব্যবহার” সম্বন্ধে তাহাকে একটি রচনা লিখিতে দিয়াছিল, সেই রচনায় সে পঞ্চাশের মধ্যে বিয়াল্লিশ নম্বর পাইয়াছিল– তাহার ভারি ইচ্ছা বিনয়কে সেই লেখাটা দেখায়। বিনয় যে খুব একজন বিদ্বান এবং সমজদার তাহা সে জানিত; সে নিশ্চয় ঠিক করিয়াছিল বিনয়ের মতো রসজ্ঞ লোক তাহার লেখার ঠিক মূল্য বুঝিতে পারিবে। বিনয় যদি তাহার লেখার শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করে তাহা হইলে অরসিক লীলা সতীশের প্রতিভা সম্বন্ধে অবজ্ঞা প্রকাশ করিলে অশ্রদ্ধেয় হইবে। নিমন্ত্রণটা মাসিকে বলিয়া সে’ই ঘটাইয়াছিল– বিনয় যখন তাহার লেখার উপরে রায় প্রকাশ করিবে তখন তাহার দিদিরাও সেখানে উপস্থিত থাকে ইহাই তাহার ইচ্ছা।

বিনয় কোনোমতেই নিমন্ত্রণে উপস্থিত হইতে পারিবে না শুনিয়া সতীশ অত্যন্ত মুষড়িয়া গেল।

বিনয় তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “সতীশবাবু, তুমি আমাদের বাড়ি চলো।”

সতীশের পকেটেই সেই লেখাটা ছিল, সুতরাং বিনয়ের আহ্বান সে অগ্রাহ্য করিতে পারিল না। কবিযশঃপ্রার্থী বালক তাহাদের বিদ্যালয়ের আসন্ন পরীক্ষার সময়ে সময় নষ্ট করার অপরাধ স্বীকার করিয়াই বিনয়ের বাসায় গেল।

বিনয় যেন তাহাকে কোনোমতেই ছাড়িতে চাহিল না। তাহার লেখা তো শুনিলই– প্রশংসা যাহা করিল তাহাতে সমালোচকের অপ্রমত্ত নিরপেক্ষতা প্রকাশ পাইল না। তাহার উপরে বাজার হইতে জলখাবার কিনিয়া তাহাকে খাওয়াইল।

তাহার পরে সতীশকে তাহাদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাইয়া দিয়া অনাবশ্যক ব্যাকুলতার সহিত কহিল, “সতীশবাবু, তবে আসি ভাই!”

সতীশ তাহার হাত ধরিয়া টানাটানি করিয়া কহিল, “না, আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন।”

আজ এ অনুনয়ে কোনো ফল হইল না।

স্বপ্নাবিষ্টের মতো চলিতে চলিতে বিনয় আনন্দময়ীর বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিল, কিন্তু তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিল না। ছাতের উপরে যে ঘরে গোরা শুইত সেই নির্জন ঘরে প্রবেশ করিল– এই ঘরে তাহাদের বাল্যবন্ধুত্বের কত সুখময় দিন এবং কত সুখময় রাত্রি কাটিয়াছে; কত আনন্দালাপ, কত সংকল্প, কত গভীর বিষয়ের আলোচনা; কত প্রণয়কলহ এবং সে কলহের প্রীতিসুধাপূর্ণ অবসান! সেই তাহার পূর্বজীবনের মধ্যে বিনয় তেমনি করিয়া আপনাকে ভুলিয়া প্রবেশ করিতে চাহিল– কিন্তু মাঝখানের এই কয়দিনের নূতন পরিচয় পথরোধ করিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে ঠিক সেই জায়গাটিতে ঢুকিতে দিল না। জীবনের কেন্দ্র যে কখন সরিয়া আসিয়াছে এবং কক্ষপথের যে কখন পরিবর্তন ঘটিয়াছে। তাহা এতদিন বিনয় সুস্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারে নাই– আজ যখন কোনো সন্দেহ রহিল না তখন ভীত হইয়া উঠিল।

ছাতে কাপড় শুকাইতে দিয়াছিলেন, অপরাহ্নে রৌদ্র পড়িয়া আসিলে আনন্দময়ী যখন তুলিতে আসিলেন তখন গোরার ঘরে বিনয়কে দেখিয়া তিনি আশ্চর্য হইয়া গেলেন। তাড়াতাড়ি তাহার পাশে আসিয়া তাহার গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “বিনয়, কী হয়েছে বিনয়? তোর মুখ অমন সাদা হয়ে গেছে কেন?”

বিনয় উঠিয়া বসিল; কহিল, “মা, আমি পরেশবাবুদের বাড়িতে প্রথম যখন যাতায়াত করতে আরম্ভ করি, গোরা রাগ করত। তার রাগকে আমি তখন অন্যায় মনে করতুম– কিন্তু অন্যায় তার নয়, আমারই নির্বুদ্ধিতা।”

আনন্দময়ী একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, “তুই যে আমাদের খুব সুবুদ্ধি ছেলে তা আমি বলি নে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তোর বুদ্ধির দোষ কিসে প্রকাশ পেলে?”

বিনয় কহিল, “মা, আমাদের সমাজ যে একেবারেই ভিন্ন সে কথা আমি একেবারেই বিবেচনা করি নি। ওঁদের বন্ধুত্বে ব্যবহারে দৃষ্টান্তে আমার খুব আনন্দ এবং উপকার বোধ হচ্ছিল, তাতেই আমি আকৃষ্ট হয়েছিলুম, আর-কোনো কথা যে চিন্তা করবার আছে এক মুহূর্তের জন্য সে আমার মনে উদয় হয় নি।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর কথা শুনে এখনো তো আমার মনে উদয় হচ্ছে না।”

বিনয় কহিল, “মা, তুমি জান না, সমাজে আমি তাঁদের সম্বন্ধে ভারি একটা অশান্তি জাগিয়ে দিয়েছি– লোকে এমন-সব নিন্দা করতে আরম্ভ করেছে যে আমি আর সেখানে–”

আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা একটা কথা বার বার বলে, সেটা আমার কাছে খুব খাঁটি মনে হয়। সে বলে, যেখানে ভিতরে কোথাও একটা অন্যায় আছে সেখানে বাইরে শান্তি থাকাটাই সকলের চেয়ে অমঙ্গল। ওঁদের সমাজে যদি অশান্তি জেগে থাকে তা হলে তোর অনুতাপ করবার কোনো দরকার দেখি নে, দেখবি তাতে ভালোই হবে। তোর নিজের ব্যবহারটা খাঁটি থাকলেই হল।”

ঐখানেই তো বিনয়ের মস্ত খটকা ছিল। তাহার নিজের ব্যবহারটা অনিন্দনীয় কি না সেইটে সে কোনোমতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। ললিতা যখন ভিন্নসমাজভুক্ত, তাহার সঙ্গে বিবাহ যখন সম্ভবপর নহে, তখন তাহার প্রতি বিনয়ের অনুরাগটাই একটা গোপন পাপের মতো তাহাকে ক্লিষ্ট করিতেছিল এবং এই পাপের নিদারুণ প্রায়শ্চিত্তকাল যে উপস্থিত হইয়াছে এই কথাই স্মরণ করিয়া সে পীড়িত হইতেছিল।

বিনয় হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “মা, শশিমুখীর সঙ্গে আমার বিবাহের যে প্রস্তাব হয়েছিল সেটা হয়ে চুকে গেলেই ভালো হত। আমার যেখানে ঠিক জায়গা সেইখানেই কোনোমতে আমার বদ্ধ হয়ে থাকা উচিত– এমন হওয়া উচিত যে, কিছুতেই সেখান থেকে আর নড়তে না পারি।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “অর্থাৎ, শশিমুখীকে তোর ঘরের বউ না করে তোরা ঘরের শিকল করত চাস– শশীর কী সুখেরই কপাল!”

এমন সময় বেহারা আসিয়া খবর দিল, পরেশবাবুর বাড়ির দুই মেয়ে আসিয়াছেন। শুনিয়া বিনয়ের বুকের মধ্যে ধড়াস করিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল, বিনয়কে সতর্ক করিয়া দিবার জন্য তাহারা আনন্দময়ীর কাছে নালিশ জানাইতে আসিয়াছে। সে একেবারে দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি যাই মা!”

আনন্দময়ী উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিলেন, “একেবারে বাড়ি ছেড়ে যাস নে বিনয়! নীচের ঘরে একটু অপেক্ষা কর্‌।”

নীচে যাইতে যাইতে বিনয় বার বার বলিতে লাগিল, “এর তো কোনো দরকার ছিল না। যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তো মরে গেলেও আর সেখানে যেতুম না। অপরাধের শাস্তি আগুনের মতো যখন একবার জ্বলে ওঠে তখন অপরাধী দগ্ধ হয়ে ম’লেও সেই শাস্তির আগুন যেন নিবতেই চায় না।’

একতলায় রাস্তার ধারে গোরার যে ঘর ছিল সেই ঘরে বিনয় যখন প্রবেশ করিতে যাইতেছে এমন সময় মহিম তাঁহার স্ফীত উদরটিকে চাপকানের বোতাম-বন্ধন হইতে মুক্তি দিতে দিতে আপিস হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “এই-যে বিনয়! বেশ! আমি তোমাকে খুঁজছি।”

বলিয়া বিনয়কে গোরার ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া একটা চৌকিতে বসাইয়া নিজেও বসিলেন এবং পকেট হইতে ডিবা বাহির করিয়া বিনয়কে একটি পান খাইতে দিলেন।

“ওরে তামাক নিয়ে আয় রে” বলিয়া একটা হুংকার দিয়া তিনি একেবারেই কাজের কথা পাড়িলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই বিষয়টার কী স্থির হল? আর তো–”

দেখিলেন বিনয়ের ভাবখানা পূর্বের চেয়ে অনেকটা নরম। খুব যে একটা উৎসাহ তাহা নয় বটে, কিন্তু ফাঁকি দিয়া কোনোমতে কথাটাকে এড়াইবার চেষ্টাও দেখা যায় না। মহিম তখনই দিন-ক্ষণ একেবারে পাকা করিতে চান; বিনয় কহিল, “গোরা ফিরে আসুক-না।”

মহিম আশ্বস্ত হইয়া কহিলেন, “সে তো আর দিন কয়েক আছে। বিনয়, কিছু জলখাবার আনতে বলে দিই– কী বল? তোমার মুখ আজ ভারি শুকনো দেখাচ্ছে যে! কিছু অসুখ-বিসুখ করে নি তো?”

জলখাবারের দায় হইতে বিনয় নিষ্কৃতি লাভ করিলে মহিম নিজের ক্ষুধানিবৃত্তির অভিপ্রায়ে বাড়ির ভিতর গমন করিলেন। বিনয় গোরার টেবিলের উপর হইতে যে-কোনো একখানা বই টানিয়া লইয়া পাতা উলটাইতে লাগিল, তাহার পরে বই ফেলিয়া ঘরের এক ধার হইতে আর-এক ধার পর্যন্ত পায়চারি করিতে থাকিল।

বেহারা আসিয়া কহিল, “মা ডাকছেন।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কাকে ডাকছেন?”

বেহারা কহিল, “আপনাকে।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “আর-সকলে আছেন?”

বেহারা কহিল, “আছেন।”

পরীক্ষাঘরের মুখে ছাত্র যেমন করিয়া যায় বিনয় তেমনি করিয়া উপরে চলিল। ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া একটু ইতস্তত করিতেই সুচরিতা পূর্বের মতোই তাহার সহজ সৌহার্দ্যের স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, “বিনয়বাবু, আসুন।” সেই স্বর শুনিয়া বিনয়ের মনে হইল যেন সে একটা অপ্রত্যাশিত ধন পাইল।

বিনয় ঘরে ঢুকিলে সুচরিতা এবং ললিতা তাহাকে দেখিয়া আশ্চর্য হইল। সে যে কত অকস্মাৎ কী কঠিন আঘাত পাইয়াছে তাহা এই অল্প সময়ের মধ্যে তাহার মুখে চিহ্নিত হইয়া গিয়াছে। সে সরস শ্যামল ক্ষেত্রের উপর দিয়া হঠাৎ কোথা হইতে পঙ্গপাল পড়িয়া চলিয়া গিয়াছে বিনয়ের নিত্যসহাস্য মুখের সেই ক্ষেত্রের মতো চেহারা হইয়াছে। ললিতার মনে বেদনা এবং করুণার সঙ্গে একটু আনন্দের আভাসও দেখা দিল।

অন্য দিন হইলে ললিতা সহসা বিনয়ের সঙ্গে কথা আরম্ভ করিত না– আজ যেমনি বিনয় ঘরে প্রবেশ করিল অমনি সে বলিয়া উঠিল, “বিনয়বাবু, আপনার সঙ্গে আমাদের একটা পরামর্শ আছে।”

বিনয়ের বুকে কে যেন হঠাৎ একটা শব্দভেদী আনন্দের বাণ ছুঁড়িয়া মারিল। সে উল্লাসে চকিত হইয়া উঠিল। তাহার বিবর্ণ ম্লান মুখে মুহূর্তেই দীপ্তির সঞ্চার হইল।

ললিতা কহিল, “আমরা কয় বোনে মিলে একটি ছোটোখাটো মেয়ে-ইস্কুল করতে চাই।”

বিনয় উৎসাহিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “মেয়ে-ইস্কুল করা অনেক দিন থেকে আমার জীবনের একটা সংকল্প।”

ললিতা কহিল, “আপনাকে এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করতে হবে।”

বিনয় কহিল, “আমার দ্বারা যা হতে পারে তার কোনো ত্রুটি হবে না। আমাকে কী করতে হবে বলুন।”

ললিতা কহিল, “আমরা ব্রাহ্ম বলে হিন্দু অভিভাবকেরা আমাদের বিশ্বাস করে না। এ বিষয়ে আপনাকে চেষ্টা দেখতে হবে।”

বিনয় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আপনি কিচ্ছু ভয় করবেন না– আমি পারব।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “তা ও খুব পারবে। লোককে কথায় ভুলিয়ে বশ করতে ওর জুড়ি কেউ নেই।”

ললিতা কহিল, “বিদ্যালয়ের কাজকর্ম যে নিয়মে যেরকম করে চালানো উচিত– সময় ভাগ করা, ক্লাস ভাগ করা, বই ঠিক করে দেওয়া, এ-সমস্তই আপনাকে করে দিতে হবে।”

এ কাজটাও বিনয়ের পক্ষে শক্ত নহে, কিন্তু তাহার ধাঁধা লাগিয়া গেল। বরদাসুন্দরী তাঁহার মেয়েদের সহিত তাহাকে মিশিতে নিষেধ করিয়া দিয়াছেন এবং সমাজে তাহাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলিতেছে, এ কথাটা কি ললিতা একেবারেই জানে না? এ স্থলে বিনয় যদি ললিতার অনুরোধ রাখিতে প্রতিশ্রুত হয় তবে সেটা অন্যায় এবং ললিতার পক্ষে অনিষ্ঠকর হইবে কি না এই প্রশ্ন তাহাকে আঘাত করিতে লাগিল। এ দিকে ললিতা যদি কোনো শুভকর্মে তাহার সাহায্য প্রার্থনা করে তবে সমস্ত চেষ্টা দিয়া সেই অনুরোধ পালন না করিবে এমন শক্তি বিনয়ের কোথায়?

এ পক্ষে সুচরিতাও আশ্চর্য হইয়া গেছে। সে স্বপ্নেও মনে করে নাই ললিতা হঠাৎ এমন করিয়া বিনয়কে মেয়ে-ইস্কুলের জন্য অনুরোধ করিবে। একে তো বিনয়কে লইয়া যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি হইয়াছে তাহার পরে এ আবার কী কাণ্ড! ললিতা জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছাপূর্বক এই ব্যাপারটি ঘটাইয়া তুলিতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া সুচরিতা ভীত হইয়া উঠিল। ললিতার মনে বিদ্রোহ জাগিয়া উঠিয়াছে তাহা সে বুঝিল, কিন্তু বেচারা বিনয়কে এই উৎপাতের মধ্যে জড়িত করা কি তাহার উচিত হইতেছে? সুচরিতা উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “এ সম্বন্ধে একবার বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে তো। মেয়ে-ইস্কুলে ইন্‌সপেক্টারি পদ পেলেন বলে বিনয়বাবু এখনই যেন খুব বেশি আশান্বিত হয়ে না ওঠেন।”

সুচরিতা কৌশলে প্রস্তাবটাকে যে বাধা দিল তাহা বিনয় বুঝিতে পারিল, ইহাতে তাহার মনে আরো খটকা বাজিল। বেশ বোঝা যাইতেছে, যে সংকট উপস্থিত হইয়াছে তাহা সুচরিতা জানে, সুতরাং নিশ্চয়ই তাহা ললিতার অগোচর নহে, তবে ললিতা কেন–

কিছুই স্পষ্ট হইল না।

ললিতা কহিল, “বাবাকে তো জিজ্ঞাসা করতেই হবে। বিনয়বাবু সম্মত আছেন জানতে পারলেই তাঁকে বলব। তিনি কখনোই আপত্তি করবেন না– তাঁকেও আমাদের এই বিদ্যালয়ের মধ্যে থাকতে হবে।”

আনন্দময়ীর দিকে ফিরিয়া কহিল, “আপনাকেও আমরা ছাড়ব না।”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “আমি তোমাদের ইস্কুলের ঘর ঝাঁট দিয়ে আসতে পারব। তার বেশি কাজ আমার দ্বারা আর কী হবে?”

বিনয় কহিল, “তা হলেই যথেষ্ট হবে মা! বিদ্যালয় একেবারে নির্মল হয়ে উঠবে।”

সুচরিতা ও ললিতা বিদায় লইলে পর বিনয় একেবারে পদব্রজে ইডেন গার্ডেন অভিমুখে চলিয়া গেল। মহিম আনন্দময়ীর কাছে আসিয়া কহিলেন, “বিনয় তো দেখলুম অনেকটা রাজি হয়ে এসেছে– এখন যত শীঘ্র পারা যায় কাজটা সেরে ফেলাই ভালো– কী জানি আবার কখন মত বদলায়।”

আনন্দময়ী বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে কী কথা! বিনয় আবার রাজি হল কখন? আমাকে তো কিছু বলে নি।”

মহিম কহিলেন, “আজই আমার সঙ্গে তার কথাবার্তা হয়ে গেছে। সে বললে, গোরা এলেই দিন স্থির করা যাবে।”

আনন্দময়ী মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “মহিম, আমি তোমাকে বলছি, তুমি ঠিক বোঝ নি।”

মহিম কহিলেন, “আমার বুদ্ধি যতই মোটা হোক, সাদা কথা বোঝবার আমার বয়স হয়েছে এ নিশ্চয় জেনো।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “বাছা, আমার উপর তুমি রাগ করবে আমি জানি, কিন্তু আমি দেখছি এই নিয়ে একটা গোল বাধবে।”

মহিম মুখ গম্ভীর করিয়া কহিলেন, “গোল বাধালেই গোল বাধে।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “মহিম, আমাকে তোমরা যা বল সমস্তই আমি সহ্য করব, কিন্তু যাতে কোনো অশান্তি ঘটতে পারে তাতে আমি যোগ দিতে পারি নে– সে তোমাদেরই ভালোর জন্যে।”

মহিম নিষ্ঠুরভাবে কহিলেন, “আমাদের ভালোর কথা ভাববার ভার যদি আমাদেরই ‘পরে দাও তা হলে তোমাকেও কোনো কথা শুনতে হয় না, আর আমাদেরও হয়তো ভালোই হয়। বরঞ্চ শশিমুখীর বিয়েটা হয়ে গেলে তার পরে আমাদের ভালোর চিন্তা কোরো। কী বল?”

আনন্দময়ী ইহার পরে কোনো উত্তর না করিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন এবং মহিম পকেটের ডিবা হইতে একটি পান বাহির করিয়া চিবাইতে চিবাইতে চলিয়া গেলেন।

ললিতা পরেশবাবুকে আসিয়া কহিল, “আমরা ব্রাহ্ম বলে কোনো হিন্দু মেয়ে আমাদের কাছে পড়তে আসতে চায় না– তাই মনে করছি হিন্দুসমাজের কাউকে এর মধ্যে রাখলে কাজের সুবিধা হবে। কী বল বাবা?”

পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “হিন্দুসমাজের কাউকে পাবে কোথায়?”

ললিতা খুব কোমর বাঁধিয়া আসিয়াছিল বটে, তবু বিনয়ের নাম করিতে হঠাৎ তাহার সংকোচ উপস্থিত হইল; জোর করিয়া সংকোচ কাটাইয়া কহিল, “কেন, তা কি পাওয়া যাবে না? এই-যে বিনয়বাবু আছেন– কিংবা–”

এই কিংবাটা নিতান্তই একটা ব্যর্থ প্রয়োগ, অব্যয় পদের অপব্যয় মাত্র। ওটা অসমাপ্তই রহিয়া গেল।

পরেশ কহিলেন, “বিনয়! বিনয় রাজি হবেন কেন?”

ললিতার অভিমানে আঘাত লাগিল। বিনয়বাবু রাজি হবেন না! ললিতা এটুকু বেশ বুঝিয়াছে, বিনয়বাবুকে রাজি করানো ললিতার পক্ষে অসাধ্য নহে।

ললিতা কহিল, “তা তিনি রাজি হতে পারেন।”

পরেশ একটু স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া কহিলেন, “সব কথা বিবেচনা করে দেখলে কখনোই তিনি রাজি হবেন না।”

ললিতার কর্ণমূল লাল হইয়া উঠিল। সে নিজের আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা লইয়া নাড়িতে লাগিল।

তাঁহার এই নিপীড়িতা কন্যার মুখের দিকে তাকাইয়া পরেশের হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। কিন্তু কোনো সান্ত্বনার বাক্য খুঁজিয়া পাইলেন না। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে ললিতা মুখ তুলিয়া কহিল, “বাবা, তা হলে আমাদের এই ইস্কুলটা কোনোমতেই হতে পারবে না!”

পরেশ কহিলেন, “এখন হওয়ার অনেক বাধা দেখতে পাচ্ছি। চেষ্টা করতে গেলেই বিস্তর অপ্রিয় আলোচনাকে জাগিয়ে তোলা হবে।”

শেষকালে পানুবাবুরই জিত হইবে এবং অন্যায়ের কাছে নিঃশব্দে হার মানিতে হইবে, ললিতার পক্ষে এমন দুঃখ আর-কিছুই নাই। এ সম্বন্ধে তাহার বাপ ছাড়া আর-কাহারো শাসন সে এক মুহূর্ত বহন করিতে পারিত না। সে কোনো অপ্রিয়তাকে ডরায় না, কিন্তু অন্যায়কে কেমন করিয়া সহ্য করিবে! ধীরে ধীরে পরেশবাবুর কাছ হইতে সে উঠিয়া গেল।

নিজের ঘরে গিয়া দেখিল তাহার নামে ডাকে একখানা চিঠি আসিয়াছে। হাতের অক্ষর দেখিয়া বুঝিল তাহার বাল্যবন্ধু শৈলবালার লেখা। সে বিবাহিত, তাহার স্বামীর সঙ্গে বাঁকিপুরে থাকে।

চিঠির মধ্যে ছিল–

“তোমাদের সম্বন্ধে নানা কথা শুনিয়া মন বড়ো খারাপ ছিল। অনেক দিন হইতে ভাবিতেছি চিঠি লিখিয়া সংবাদ লইব– সময় হইয়া উঠে নাই। কিন্তু পরশু একজনের কাছ হইতে (তাহার নাম করিব না) যে খবর পাইলাম শুনিয়া যেন মাথায় বজ্রাঘাত হইল। এ যে সম্ভব হইতে পারে তাহা মনেও করিতে পারি না। কিন্তু যিনি লিখিয়াছেন তাঁহাকে অবিশ্বাস করাও শক্ত। কোনো হিন্দু যুবকের সঙ্গে নাকি তোমার বিবাহের সম্ভাবনা ঘটিয়াছে। এ কথা যদি সত্য হয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ক্রোধে ললিতার সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করিতে পারিল না। তখনই সে চিঠির উত্তরে লিখিল–

“খবরটা সত্য কিনা ইহা জানিবার জন্য তুমি যে আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইয়াছ ইহাই আমার কাছে আশ্চর্য বোধ হইতেছে। ব্রাহ্মসমাজের লোক তোমাকে যে খবর দিয়াছে তাহার সত্যও কি যাচাই করিতে হইবে! এত অবিশ্বাস! তাহার পরে, কোনো হিন্দু যুবকের সঙ্গে আমার বিবাহের সম্ভাবনা ঘটিয়াছে সংবাদ পাইয়া তোমার মাথায় বজ্রাঘাত হইয়াছে, কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চয় বলিতে পারি ব্রাহ্মসমাজে এমন সুবিখ্যাত সাধু যুবক আছেন যাঁহার সঙ্গে বিবাহের আশঙ্কা বজ্রাঘাতের তুল্য নিদারুণ এবং আমি এমন দুই-একটি হিন্দু যুবককে জানি যাঁহাদের সঙ্গে বিবাহ যে কোনো ব্রাহ্মকুমারীর পক্ষে গৌরবের বিষয়। ইহার বেশি আর একটি কথাও আমি তোমাকে বলিতে ইচ্ছা করি না।’

এ দিকে সেদিনকার মতো পরেশবাবুর কাজ বন্ধ হইয়া গেল। তিনি চুপ করিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন। তাহার পরে ভাবিতে ভাবিতে ধীরে ধীরে সুচরিতার ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। পরেশের চিন্তিত মুখ দেখিয়া সুচরিতার হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। কী লইয়া তাঁহার চিন্তা তাহাও সে জানে এবং এই চিন্তা লইয়াই সুচরিতা কয়দিন উদ্‌বিগ্ন হইয়া রহিয়াছে।

পরেশবাবু সুচরিতাকে লইয়া নিভৃত ঘরে বসিলেন এবং কহিলেন, “মা, ললিতা সম্বন্ধে ভাবনার সময় উপস্থিত হয়েছে।”

সুচরিতা পরেশবাবুর মুখে তাহার করুণাপূর্ণ দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, “জানি বাবা!”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমি সামাজিক নিন্দার কথা ভাবছি নে। আমি ভাবছি– আচ্ছা ললিতা কি–”

পরেশের সংকোচ দেখিয়া সুচরিতা আপনিই কথাটাকে স্পষ্ট করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। সে কহিল, “ললিতা বরাবর তার মনের কথা আমার কাছে খুলে বলে। কিন্তু কিছুদিন থেকে সে আমার কাছে আর তেমন করে ধরা দেয় না। আমি বেশ বুঝতে পারছি–”

পরেশ মাঝখান হইতে কহিলেন, “ললিতার মনে এমন কোনো ভাবের উদয় হয়েছে যেটা সে নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাচ্ছে না। আমি ভেবে পাচ্ছি নে কী করলে ওর ঠিক– তুমি কি বল বিনয়কে আমাদের পরিবারে যাতায়াত করতে দিয়ে ললিতার কোনো অনিষ্ট করা হয়েছে?”

সুচরিতা কহিল, “বাবা, তুমি তো জান বিনয়বাবুর মধ্যে কোনো দোষ নেই– তাঁর নির্মল স্বভাব– তাঁর মতো স্বভাবতই ভদ্রলোক খুব অল্পই দেখা যায়।”

পরেশবাবু যেন একটা কোন্‌ নূতন তত্ত্ব লাভ করিলেন। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ঠিক কথা বলেছ, রাধে, ঠিক কথা বলেছ। তিনি ভালো লোক কিনা এইটেই দেখবার বিষয়– অন্তর্যামী ঈশ্বরও তাই দেখেন। বিনয় যে ভালো লোক, সেখানে যে আমার ভুল হয় নি, সেজন্যে আমি তাঁকে বার বার প্রণাম করি।”

একটা জাল কাটিয়া গেল– পরেশবাবু যেন বাঁচিয়া গেলেন। পরেশবাবু তাঁহার দেবতার কাছে অন্যায় করেন নাই। ঈশ্বর যে তুলাদণ্ডে মানুষকে ওজন করেন সেই নিত্যধর্মের তুলাকেই তিনি মানিয়াছেন– তাহার মধ্যে তিনি নিজের সমাজের তৈরি কোনো কৃত্রিম বাটখারা মিশান নাই বলিয়া তাঁহার মনে আর কোনো গ্লানি রহিল না। এই অত্যন্ত সহজ কথাটা এতক্ষণ তিনি না বুঝিয়া কেন এমন পীড়া অনুভব করিতেছিলেন বলিয়া তাঁহার আশ্চর্য বোধ হইল। সুচরিতার মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন, “তোমার কাছে আমার আজ একটা শিক্ষা হল মা!”

সুচরিতা তৎক্ষণাৎ তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া কহিল, “না না, কী বল বাবা!”

পরেশবাবু কহিলেন, “সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিয়ে দেয়– মানুষ ব্রাহ্ম কি হিন্দু এই সমাজ-গড়া কথাটাকেই বিশ্বসত্যের চেয়ে বড়ো করে তুলে একটা পাক তৈরি করে– এতক্ষণ মিথ্যা তাতে ঘুরে মরছিলুম।”

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া পরেশ কহিলেন, “ললিতা তার মেয়ে-ইস্কুলের সংকল্প কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। সে এ সম্বন্ধে বিনয়ের সাহায্য নেবার জন্যে আমার সম্মতি চায়।”

সুচরিতা কহিল, “না বাবা, এখন কিছুদিন থাক্‌।”

ললিতাকে তিনি নিষেধ করিবামাত্র সে যে তাহার ক্ষুব্ধ হৃদয়ের সমস্ত বেগ দমন করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল সেই ছবিটি পরেশের স্নেহপূর্ণ হৃদয়কে অত্যন্ত ক্লেশ দিতেছিল। তিনি জানিতেন, তাঁহার তেজস্বিনী কন্যার প্রতি সমাজ যে অন্যায় উৎপীড়ন করিতেছে সেই অন্যায়ে সে তেমন কষ্ট পায় নাই যেমন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে বাধা পাইয়া, বিশেষত পিতার নিকট হইতে বাধা পাইয়া। এইজন্য তিনি তাঁহার নিষেধ উঠাইয়া লইবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছিলেন। তিনি কহিলেন, “কেন রাধে, এখন থাকবে কেন?”

সুচরিতা কহিল, “নইলে মা ভারি বিরক্ত হয়ে উঠবেন।”

পরেশ ভাবিয়া দেখিলেন সে কথা ঠিক।

সতীশ ঘরে ঢুকিয়া সুচরিতার কানে কানে কী কহিল। সুচরিতা কহিল, “না ভাই বক্তিয়ার, এখন না। কাল হবে।”

সতীশ বিমর্ষ হইয়া কহিল, “কাল যে আমার ইস্কুল আছে।”

পরেশ স্নেহহাস্য হাসিয়া কহিলেন, “কী সতীশ, কী চাই?”

সুচরিতা কহিল, “ওর একটা–”

সতীশ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া সুচরিতার মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল, “না না, বোলো না, বোলো না।”

পরেশবাবু কহিলেন, “যদি গোপন কথা হয় তা হলে সুচরিতা বলবে কেন?”

সুচরিতা কহিল, “না বাবা, নিশ্চয় ওর ভারি ইচ্ছে যাতে এই গোপন কথাটা তোমার কানে ওঠে।”

সতীশ উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “কক্‌খনো না, নিশ্চয় না।”

বলিয়া সে দৌড় দিল।

বিনয় তাহার যে রচনার এত প্রশংসা করিয়াছিল সেই রচনাটা সুচরিতাকে দেখাইবার কথা ছিল। বলা বাহুল্য পরেশের সামনে সেই কথাটা সুচিরতার কানে কানে স্মরণ করাইয়া দিবার উদ্দেশ্যটা যে কী তাহা সুচরিতা ঠিক ঠাওরাইয়াছিল। এমন-সকল গভীর মনের অভিপ্রায় সংসারে যে এত সহজে ধরা পড়িয়া যায়, বেচারা সতীশের তাহা জানা ছিল না।

চারি দিন পরে একখানি চিঠি হাতে করিয়া হারানবাবু বরদাসুন্দরীর কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আজকাল পরেশবাবুর আশা তিনি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়াছেন।

হারানবাবু চিঠিখানি বরদাসুন্দরীর হাতে দিয়া কহিলেন, “আমি প্রথম হতেই আপনাদের সাবধান করে দিতে অনেক চেষ্টা করেছি। সেজন্যে আপনাদের অপ্রিয়ও হয়েছি। এখন এই চিঠি থেকেই বুঝতে পারবেন ভিতরে ভিতরে ব্যাপারটা কতদূর এগিয়ে পড়েছে।”

শৈলবালাকে ললিতা যে চিঠি লিখিয়াছিল সেই চিঠিখানি বরদাসুন্দরী পাঠ করিলেন। কহিলেন, “কেমন করে জানব বলুন। কখনো যা মনেও করতে পারি নি তাই ঘটছে। এর জন্যে কিন্তু আমাকে দোষ দেবেন না তা আমি বলে রাখছি। সুচরিতাকে যে আপনারা সকলে মিলে বড্ডো ভালো ভালো করে একেবারে তার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছেন– ব্রাহ্মসমাজে অমন মেয়ে আর হয় না– এখন আপনাদের ঐ আদর্শ ব্রাহ্ম মেয়েটির কীর্তি সামলান। বিনয়-গৌরকে তো উনিই এ বাড়িতে এনেছেন। আমি তবু বিনয়কে অনেকটা আমাদের পথেই টেনে আনছিলুম, তার পরে কোথা থেকে উনি ওঁর এক মাসিকে এনে আমাদেরই ঘরে ঠাকুর-পুজো শুরু করে দিলেন। বিনয়কেও এমনি বিগড়ে দিলেন যে, সে এখন আমাকে দেখলেই পালায়। এখন এ-সব যা-কিছু ঘটছে আপনাদের ঐ সুচরিতাই এর গোড়ায়। ও মেয়ে যে কেমন মেয়ে সে আমি বরাবরই জানতুম– কিন্তু কখনো কোনো কথাটি কই নি, বরাবর ওকে এমন করেই মানুষ করে এসেছি যে কেউ টের পায় নি ও আমার আপন মেয়ে নয়– আজ তার বেশ ফল পাওয়া গেল। এখন আপনাকে এ চিঠি মিথ্যা দেখাচ্ছেন– আপনরা যা হয় করুন।”

হারানবাবু যে এক সময় বরদাসুন্দরীকে ভুল বুঝিয়াছিলেন সে কথা আজ স্পষ্ট স্বীকার করিয়া অত্যন্ত উদারভাবে অনুতাপ প্রকাশ করিলেন। অবশেষে পরেশবাবুকে ডাকিয়া আনা হইল।

“এই দেখো” বলিয়া বরদাসুন্দরী চিঠিখানা তাঁহার সম্মুখে টেবিলের উপর ফেলিয়া দিলেন। পরেশবাবু দু-তিন বার চিঠিখানা পড়িয়া কহিলেন, “তা, কী হয়েছে?”

বরদাসুন্দরী উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, “কী হয়েছে! আর কী হওয়া চাই! আর বাকি রইলই বা কী! ঠাকুর-পুজো, জাত মেনে চলা, সবই হল, এখন কেবল হিন্দুর ঘরে তোমার মেয়ের বিয়ে হলেই হয়। তার পরে তুমি প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দুসমাজে ঢুকবে– আমি কিন্তু বলে রাখছি–”

পরেশ ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। অন্তত এখনো বলবার সময় হয় নি। কথা হচ্ছে এই যে, তোমরা কেন ঠিক করে বসে আছ হিন্দুর ঘরেই ললিতার বিবাহ স্থির হয়ে গেছে। এ চিঠিতে তো সেরকম কিছুই দেখছি নে।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “কী হলে যে তুমি দেখতে পাও সে তো আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলুম না। সময়মত যদি দেখতে পেতে তা হলে আজ এত কাণ্ড ঘটত না। চিঠিতে মানুষ এর চেয়ে আর কত খুলে লিখবে বলো তো।”

হারানবাবু কহিলেন, “আমার বোধ হয় ললিতাকে এই চিঠিখানি দেখিয়ে তার অভিপ্রায় কী তাকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত। আপনারা যদি অনুমতি করেন তা হলে আমিই তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি।”

এমন সময় ললিতা ঝড়ের মতো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিল, “বাবা, এই দেখো, ব্রাহ্মসমাজ থেকে আজকাল এইরকম অজানা চিঠি আসছে।”

পরেশ চিঠি পড়িয়া দেখিলেন। বিনয়ের সঙ্গে ললিতার বিবাহ যে গোপনে স্থির হইয়া গিয়াছে পত্রলেখক তাহা নিশ্চিত ধরিয়া লইয়া নানাপ্রকার ভর্ৎসনা ও উপদেশ-দ্বারা চিঠি পূর্ণ করিয়াছে। সেইসঙ্গে, বিনয়ের মতলব যে ভালো নয়, সে যে দুইদিন পরেই তাহার ব্রাহ্ম স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় হিন্দুঘরে বিবাহ করিবে, এ-সমস্ত আলোচনাও ছিল।

পরেশের পড়া হইলে পর হারান চিঠিখানি লইয়া পড়িলেন; কহিলেন, “ললিতা, এই চিঠি পড়ে তোমার রাগ হচ্ছে? কিন্তু এইরকম চিঠি লেখবার হেতু কি তুমিই ঘটাও নি? তুমি নিজের হাতে এই চিঠি কেমন করে লিখলে বল দেখি।”

ললিতা মুহূর্তকাল স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, “শৈলর সঙ্গে আপনার বুঝি এই সম্বন্ধে চিঠিপত্র চলছে?”

হারান তাহার স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিলেন, “ব্রাহ্মসমাজের প্রতি কর্তব্য স্মরণ করে শৈল তোমার এই চিঠি পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।”

ললিতা শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “এখন ব্রাহ্মসমাজ কী বলতে চান বলুন।”

হারান কহিলেন, “বিনয়বাবু ও তোমার সম্বন্ধে সমাজে এই-যে জনরব রাষ্ট্র হয়েছে এ আমি কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারি নে, কিন্তু তবু তোমার মুখ থেকে আমি এর স্পষ্ট প্রতিবাদ শুনতে চাই।”

ললিতার দুই চক্ষু আগুনের মতো জ্বলিতে লাগিল– সে একটা চৌকির পিঠ কম্পিত হস্তে চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “কেন, কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারেন না?”

পরেশ ললিতার পিঠে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “ললিতা, এখন তোমার মন স্থির নেই, এ কথা পরে আমার সঙ্গে হবে– এখন থাক্‌!”

হারান কহিলেন, “পরেশবাবু, আপনি কথাটাকে চাপা দেবার চেষ্টা করবেন না।”

ললিতা পুনর্বার জ্বলিয়া উঠিয়া কহিল, “চাপা দেবার চেষ্টা বাবা করবেন! আপনাদের মতো বাবা সত্যকে ভয় করেন না– সত্যকে বাবা ব্রাহ্মসমাজের চেয়েও বড়ো বলে জানেন। আমি আপনাকে বলছি বিনয়বাবুর সঙ্গে বিবাহকে আমি কিছুমাত্র অসম্ভব বা অন্যায় বলে মনে করি নে।”

হারান বলিয়া উঠিলেন, “কিন্তু তিনি কি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করবেন স্থির হয়েছে?”

ললিতা কহিল, “কিছুই স্থির হয় নি– আর দীক্ষা গ্রহণ করতেই হবে এমনই বা কী কথা আছে!”

বরদাসুন্দরী এতক্ষণ কোনো কথা বলেন নাই– তাঁর মনে মনে ইচ্ছা ছিল আজ যেন হারানবাবুর জিত হয় এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়া পরেশবাবুকে অনুতাপ করিতে হয়। তিনি আর থাকিতে পারিলেন না; বলিয়া উঠিলেন, “ললিতা, তুই পাগল হয়েছিস না কি! বলছিস কী!”

ললিতা কহিল, “না মা, পাগলের কথা নয়– যা বলছি বিবেচনা করেই বলছি। আমাকে যে এমন করে চার দিক থেকে বাঁধতে আসবে, সে আমি সহ্য করতে পারব না– আমি হারানবাবুদের এই সমাজের থেকে মুক্ত হব।”

হারান কহিলেন, “উচ্ছৃঙ্খলতাকে তুমি মুক্তি বল!”

ললিতা কহিল, “না, নীচতার আক্রমণ থেকে, অসত্যের দাসত্ব থেকে মুক্তিকেই আমি মুক্তি বলি। যেখানে আমি কোনো অন্যায়, কোনো অধর্ম দেখছি নে সেখানে ব্রাহ্মসমাজ আমাকে কেন স্পর্শ করবে, কেন বাধা দেবে?”

হারান স্পর্ধা প্রকাশপূর্বক কহিলেন, “পরেশবাবু, এই দেখুন। আমি জানতুম শেষকালে এইরকম একটি কাণ্ড ঘটবে। আমি যতটা পেরেছি আপনাদের সাবধান করবার চেষ্টা করেছি– কোনো ফল হয় নি।”

ললিতা কহিল, “দেখুন পানুবাবু, আপনাকেও সাবধান করে দেবার একটা বিষয় আছে– আপনার চেয়ে যাঁরা সকল বিষয়েই বড়ো তাঁদের সাবধান করে দেবার অহংকার আপনি মনে রাখবেন না।”

এই কথা বলিয়াই ললিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “এ-সব কী কাণ্ড হচ্ছে! এখন কী করতে হবে, পরামর্শ করো।”

পরেশবাবু কহিলেন, “যা কর্তব্য তাই পালন করতে হবে, কিন্তু এরকম করে গোলমাল করে পরামর্শ করে কর্তব্য স্থির হয় না। আমাকে একটু মাপ করতে হবে। এ সম্বন্ধে আমাকে এখন কিছু বোলো না। আমি একটু একলা থাকতে চাই।”

সুচরিতা ভাবিতে লাগিল ললিতা এ কী কাণ্ড বাধাইয়া বসিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ললিতার গলা ধরিয়া কহিল, “আমার কিন্তু ভাই ভয় হচ্ছে।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কিসের ভয়?”

সুচরিতা কহিল, “ব্রাহ্মসমাজে তো চারি দিকে হুলস্থূল পড়ে গেছে– কিন্তু শেষকালে বিনয়বাবু যদি রাজি না হন?”

ললিতা মুখ নিচু করিয়া দৃঢ়স্বরে কহিল, “তিনি রাজি হবেনই।”

সুচরিতা কহিল, “তুই তো জানিস, পানুবাবু মাকে ঐ আশ্বাস দিয়ে গেছেন যে বিনয় কখনোই তাদের সমাজ পরিত্যাগ করে এই বিয়ে করতে রাজি হবে না। ললিতা, কেন তুই সব দিক না ভেবে পানুবাবুর কাছে কথাটা অমন করে বলে ফেললি।”

ললিতা কহিল, “বলেছি ব’লে আমার এখনো অনুতাপ হচ্ছে না। পানুবাবু মনে করেছিলেন তিনি এবং তাঁর সমাজ আমাকে শিকারের জন্তুর মতো তাড়া করে একেবারে অতল সমুদ্রের ধার পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, এইখানে আমাকে ধরা দিতেই হবে– তিনি জানেন না এই সমুদ্রে লাফিয়ে পড়তে আমি ভয় করি নে– তাঁর শিকারী কুকুরের তাড়ায় তাঁর পিঞ্জরের মধ্যে ঢুকতেই আমার ভয়।”

সুচরিতা কহিল, “একবার বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি।”

ললিতা কহিল, “বাবা কখনো শিকারের দলে যোগ দেবেন না এ আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি। তিনি তো কোনোদিন আমাদের শিকলে বাঁধতে চান নি। তাঁর মতের সঙ্গে যখন কোনোদিন আমাদের কিছু অনৈক্য ঘটেছে তিনি কি কখনো একটুও রাগ প্রকাশ করেছেন, ব্রাহ্মসমাজের নামে তাড়া দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করেছেন? এই নিয়ে মা কতদিন বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু বাবার কেবল একটিমাত্র এই ভয় ছিল পাছে আমরা নিজে চিন্তা করবার সাহস হারাই। এমন করে যখন তিনি আমাদের মানুষ করে তুলেছেন তখন শেষকালে কি তিনি পানুবাবুর মতো সমাজের জেল-দারোগার হাতে আমাকে সমর্পণ করে দেবেন?”

সুচরিতা কহিল, “আচ্ছা বেশ, বাবা যেন কোনো বাধা দিলেন না, তার পরে কী করা যাবে বল্‌?”

ললিতা কহিল, “তোমরা যদি কিছু না কর তা হলে আমি নিজে–”

সুচরিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “না না, তোকে কিছু করতে হবে না ভাই! আমি একটা উপায় করছি।”

সুচরিতা পরেশবাবুর কাছে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল, এমন সময় পরেশবাবু স্বয়ং সন্ধ্যাকালে তাহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই সময়ে পরেশবাবু প্রতিদিন তাঁহার বাড়ির বাগানে একলা মাথা নিচু করিয়া আপন মনে ভাবিতে ভাবিতে পায়চারি করিয়া থাকেন– সন্ধ্যার পবিত্র অন্ধকারটিকে ধীরে ধীরে মনের উপর বুলাইয়া কর্মের দিনের সমস্ত দাগগুলিকে যেন মুছিয়া ফেলেন এবং অন্তরের মধ্যে নির্মল শান্তি সঞ্চয় করিয়া রাত্রির বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত হইতে থাকেন– আজ পরেশবাবু সেই তাঁহার সন্ধ্যার নিভৃত ধ্যানের শান্তিসম্ভোগ পরিত্যাগ করিয়া যখন চিন্তিতমুখে সুচরিতার ঘরে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তখন যে শিশুর খেলা করা উচিত ছিল সেই শিশু পীড়িত হইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিলে মার মনে যেমন ব্যথা বাজে সুচরিতার স্নেহপূর্ণ চিত্ত তেমনি ব্যথিত হইয়া উঠিল।

পরেশবাবু মৃদুস্বরে কহিলেন, “রাধে, সব শুনেছ তো?”

সুচরিতা কহিল, “হাঁ বাবা, সব শুনেছি, কিন্তু তুমি অত ভাবছ কেন?”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমি তো আর কিছু ভাবি নে, আমার ভাবনা এই যে, ললিতা যে ঝড়টা জাগিয়ে তুলেছে তার সমস্ত আঘাত সইতে পারবে তো? উত্তেজনার মুখে অনেক সময় আমাদের মনে অন্ধ স্পর্ধা আসে, কিন্তু একে একে যখন তার ফল ফলতে আরম্ভ হয় তখন তার ভার বহন করবার শক্তি চলে যায়। ললিতা কি সমস্ত ফলাফলের কথা বেশ ভালো করে চিন্তা করে যেটা তার পক্ষে শ্রেয় সেইটেই স্থির করেছে?”

সুচরিতা কহিল, “সমাজের তরফ থেকে কোনো উৎপীড়নে ললিতাকে কোনোদিন পরাস্ত করতে পারবে না, এ আমি তোমাকে জোর করে বলতে পারি।”

পরেশ কহিলেন, “আমি এই কথাটা খুব নিশ্চয় করে জানতে চাই যে, ললিতা কেবল রাগের মাথায় বিদ্রোহ করে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছে না।”

সুচরিতা মুখ নিচু করিয়া কহিল, “না বাবা, তা যদি হত তা হলে আমি তার কথায় একেবারে কানই দিতুম না। ওর মনের মধ্যে যে কথাটা গভীর ভাবে ছিল সেইটেই হঠাৎ ঘা খেয়ে একেবারে বেরিয়ে এসেছে। এখন একে কোনোরকমে চাপাচুপি দিতে গেলে ললিতার মতো মেয়ের পক্ষে ভালো হবে না। বাবা, বিনয়বাবু লোক তো খুব ভালো।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা, বিনয় কি ব্রাহ্মসমাজে আসতে রাজি হবে?”

সুচরিতা কহিল, “তা ঠিক বলতে পারি নে। আচ্ছা বাবা, একবার গৌরবাবুর মার কাছে যাব?”

পরেশবাবু কহিলেন, “আমিও ভাবছিলুম, তুমি গেলে ভালো হয়।”

আনন্দময়ীর বাড়ি হইতে রোজ সকালবেলায় বিনয় একবার বাসায় আসিত। আজ সকালে আসিয়া সে একখানা চিঠি পাইল। চিঠিতে কাহারো নাম নাই। ললিতাকে বিবাহ করিলে বিনয়ের পক্ষে কোনোমতেই তাহা সুখের হইতে পারে না এবং ললিতার পক্ষে তাহা অমঙ্গলের কারণ হইবে এই কথা লইয়া চিঠিতে দীর্ঘ উপদেশ আছে এবং সকলের শেষে আছে যে, এ সত্ত্বেও যদি বিনয় ললিতাকে বিবাহ করিতে নিবৃত্ত না হয় তবে একটা কথা সে যেন চিন্তা করিয়া দেখে, ললিতার ফুস্‌ফুস্‌ দুর্বল, ডাক্তারেরা যক্ষ্ণার সম্ভাবনা আশঙ্কা করেন।

বিনয় এরূপ চিঠি পাইয়া হতবুদ্ধি হইয়া গেল। এমনতরো কথার যে মিথ্যা করিয়াও সৃষ্টি হইতে পারে বিনয় কখনো তাহা মনে করে নাই। কারণ, সমাজের বাধায় ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ যে কোনোক্রমে সম্ভব হইতে পারে না ইহা তো কাহারো কাছে অগোচর নাই। এইজন্যই তো ললিতার প্রতি তাহার হৃদয়ের অনুরাগকে এতদিন সে অপরাধ বলিয়াই গণ্য করিয়া আসিতেছিল। কিন্তু এমনতরো চিঠি যখন তাহার হাতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তখন সমাজের মধ্যে এ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ বিস্তর আলোচনা হইয়া গিয়াছে। ইহাতে সমাজের লোকের কাছে ললিতা যে কিরূপ অপমানিত হইতেছে তাহা চিন্তা করিয়া তাহার মন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। তাহার নামের সঙ্গে ললিতার নাম জড়িত হইয়া প্রকাশ্যভাবে লোকের মুখে সঞ্চরণ করিতেছে ইহাতে সে অত্যন্ত লজ্জিত ও সংকুচিত হইয়া উঠিল। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল তাহার সঙ্গে পরিচয়কে ললিতা অভিশাপ ও ধিক্কার দিতেছে। মনে হইতে লাগিল, তাহার দৃষ্টিমাত্রও ললিতা আর কোনোদিন সহ্য করিতে পারিবে না।

হায় রে, মানবহৃদয়! এই অত্যন্ত ধিক্কারের মধ্যেও বিনয়ের চিত্তের মধ্যে একটি নিবিড় গভীর সূক্ষ্ণ ও তীব্র আনন্দ এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্তে সঞ্চরণ করিতেছিল, তাহাকে থামাইয়া রাখা যাইতেছিল না– সমস্ত লজ্জা সমস্ত অপমানকে সে অস্বীকার করিতেছিল। সেইটেকেই কোনোমতে কিছুমাত্র প্রশ্রয় না দিবার জন্য তাহার বারান্দায় সে দ্রুতবেগে পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল– কিন্তু সকালবেলার আলোকের ভিতর দিয়া একটা মদিরতা তাহার মনে সঞ্চারিত হইল– রাস্তা দিয়া ফেরিওয়ালা হাঁকিয়া যাইতেছিল, তাহার সেই হাঁকের সুরও তাহার হৃদয়ের মধ্যে একটা গভীর চাঞ্চল্য জাগাইল। বাহিরের লোকনিন্দাই যেন ললিতাকে বন্যার মতো ভাসাইয়া বিনয়ের হৃদয়ের ডাঙার উপর তুলিয়া দিয়া গেল– ললিতার এই সমাজ হইতে ভাসিয়া আসার মূর্তিটিকে সে আর ঠেকাইয়া রাখিতে পারিল না। তাহার মন কেবলই বলিতে লাগিল, “ললিতা আমার, একলাই আমার!’ অন্য কোনোদিন তাহার মন দুর্দাম হইয়া এত জোরে এ কথা বলিতে সাহস করে নাই; আজ বাহিরে যখন এই ধ্বনিটা এমন করিয়া হঠাৎ উঠিল তখন বিনয় কোনোমতেই নিজের মনকে আর “চুপ চুপ’ বলিয়া থামাইয়া রাখিতে পারিল না।

বিনয় এমনি চঞ্চল হইয়া যখন বারান্দায় বেড়াইতেছে এমন সময় দেখিল হারানবাবু রাস্তা দিয়া আসিতেছেন। তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারিল তিনি তাহারই কাছে আসিতেছেন এবং অনামা চিঠিটার পশ্চাতে যে একটা বৃহৎ আলোড়ন আছে তাহাও নিশ্চয় জানিল।

অন্য দিনের মতো বিনয় তাহার স্বভাবসিদ্ধ প্রগল্‌ভতা প্রকাশ করিল না; সে হারানবাবুকে চৌকিতে বসাইয়া নীরবে তাঁহার কথার প্রতীক্ষা করিয়া রহিল।

হারানবাবু কহিলেন, “বিনয়বাবু, আপনি তো হিন্দু?”

বিনয় কহিল, “হাঁ, হিন্দু বৈকি।”

হারানবাবু কহিলেন, “আমার এ প্রশ্নে রাগ করবেন না। অনেক সময় আমরা চারি দিকের অবস্থা বিবেচনা না করে অন্ধ হয়ে চলি– তাতে সংসারে দুঃখের সৃষ্টি করে। এমন স্থলে, আমরা কী, আমাদের সীমা কোথায়, আমাদের আচরণের ফল কতদূর পর্যন্ত পৌঁছয়, এ-সমস্ত প্রশ্ন যদি কেউ উত্থাপন করে, তবে তা অপ্রিয় হলেও, তাকে বন্ধু বলে মনে জানবেন।”

বিনয় হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “বৃথা আপনি এতটা ভূমিকা করছেন। অপ্রিয় প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আমি যে কোনোপ্রকার অত্যাচার করব আমার সেরকম স্বভাব নয়। আপনি নিরাপদে আমাকে সকলপ্রকার প্রশ্ন করতে পারেন।”

হারানবাবু কহিলেন, “আমি আপনার প্রতি ইচ্ছাকৃত কোনো অপরাধের দোষারোপ করতে চাই নে। কিন্তু বিবেচনার ত্রুটির ফলও বিষময় হয়ে উঠতে পারে এ কথা আপনাকে বলা বাহুল্য।”

বিনয় মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “যা বাহুল্য তা নাই বললেন, আসল কথাটা বলুন।”

হারানবাবু কহিলেন, “আপনি যখন হিন্দুসমাজে আছেন এবং সমাজ ছাড়াও যখন আপনার পক্ষে অসম্ভব, তখন পরেশবাবুর পরিবারে কি আপনার এমনভাবে গতিবিধি করা উচিত যাতে সমাজে তাঁর মেয়েদের সম্বন্ধে কোনো কথা উঠতে পারে?”

বিনয় গম্ভীর হইয়া কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিল, “দেখুন, পানুবাবু, সমাজের লোক কিসের থেকে কোন্‌ কথার সৃষ্টি করবে সেটা অনেকটা তাঁদের স্বভাবের উপর নির্ভর করে, তার সমস্ত দায়িত্ব আমি নিতে পারি নে। পরেশবাবুর মেয়েদের সম্বন্ধেও যদি আপনাদের সমাজে কোনোপ্রকার আলোচনা ওঠা সম্ভব হয়, তবে তাঁদের তাতে লজ্জার বিষয় তেমন নেই যেমন আপনাদের সমাজের।”

হারানবাবু কহিলেন, “কোনো কুমারীকে তার মায়ের সঙ্গ পরিত্যাগ করে যদি বাইরের পুরুষের সঙ্গে একলা এক জাহাজে ভ্রমণ করতে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তবে সে সম্বন্ধে কোন্‌ সমাজের আলোচনা করবার অধিকার নেই জিজ্ঞাসা করি।”

বিনয় কহিল, “বাইরের ঘটনাকে ভিতরের অপরাধের সঙ্গে আপনারাও যদি এক আসন দান করেন তবে হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে আপনাদের ব্রাহ্মসমাজে আসবার কী দরকার ছিল? যাই হোক পানুবাবু, এ-সমস্ত কথা নিয়ে তর্ক করবার কোনো দরকার দেখি নে। আমার পক্ষে কর্তব্য কী সে আমি চিন্তা করে স্থির করব, আপনি এ সম্বন্ধে আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।”

হারানবাবু কহিলেন, “আমি আপনাকে বেশি কিছু বলতে চাই নে, আমার কেবল শেষ বলবার কথাটি এই, আপনাকে এখন দূরে থাকতে হবে। নইলে অত্যন্ত অন্যায় হবে। আপনারা পরেশবাবুর পরিবারের মধ্যে প্রবেশ করে কেবল একটা অশান্তির সৃষ্টি করে তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে কী অনিষ্ট বিস্তার করেছেন তা আপনারা জানেন না।”

হারানবাবু চলিয়া গেলে বিনয়ের মনের মধ্যে একটা বেদনা শূলের মতো বিঁধিতে লাগিল। সরলহৃদয় উদারচিত্ত পরেশবাবু কত সমাদরের সহিত তাহাদের দুইজনকে তাঁহার ঘরের মধ্যে ডাকিয়া লইয়াছিলেন– বিনয় হয়তো না বুঝিয়া এই ব্রাহ্ম-পরিবারের মধ্যে আপন অধিকারের সীমা পদে পদে লঙ্ঘন করিতেছিল, তবু তাঁহার স্নেহ ও শ্রদ্ধা হইতে সে একদিনও বঞ্চিত হয় নাই; এই পরিবারের মধ্যে বিনয়ের প্রকৃতি এমন একটি গভীরতর আশ্রয় লাভ করিয়াছে যেমনটি সে আর-কোথাও পায় নাই। উঁহাদের সঙ্গে পরিচয়ের পর বিনয় যেন নিজের একটি বিশেষ সত্তাকে উপলব্ধি করিয়াছে। এই-যে এত আদর, এত আনন্দ, এমন আশ্রয় যেখানে পাইয়াছে সেই পরিবারে বিনয়ের স্মৃতি চিরদিন কাঁটার মতো বিঁধিয়া থাকিবে! পরেশবাবুর মেয়েদের উপর সে একটা অপমানের কালিমা আনিয়া দিল! ললিতার সমস্ত ভবিষ্যৎ জীবনের উপরে সে এত বড়ো একটা লাঞ্ছনা আঁকিয়া দিল! ইহার কী প্রতীকার হইতে পারে! হায় রে হায়, সমাজ বলিয়া জিনিসটা সত্যের মধ্যে কত বড়ো একটা বিরোধ জাগাইয়া তুলিয়াছে! ললিতার সঙ্গে বিনয়ের মিলনের কোনো সত্য বাধা নাই; ললিতার সুখ ও মঙ্গলের জন্য বিনয় নিজের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়া দিতে কিরূপ প্রস্তুত আছে তাহা সেই দেবতাই জানেন যিনি উভয়ের অন্তর্যামী– তিনিই তো বিনয়কে প্রেমের আকর্ষণে ললিতার এত নিকটে আনিয়া দিয়াছেন– তাঁহার শাশ্বত ধর্মবিধিতে তো কোথাও বাধে নাই। তবে ব্রাহ্মসমাজের যে দেবতাকে পানুবাবুর মতো লোকে পূজা করেন তিনি কি আর-এক জন কেহ? তিনি কি মানবচিত্তের অন্তরতর বিধাতা নন? ললিতার সঙ্গে তাহার মিলনের মাঝখানে যদি কোনো নিষেধ করাল দন্ত মেলিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, যদি সে কেবল সমাজকেই মানে আর সর্বমানবের প্রভুর দোহাই না মানে, তবে তাহাই কি পাপ নিষেধ নহে? কিন্তু হায়, এ নিষেধ হয়তো ললিতার কাছেও বলবান। তা ছাড়া ললিতা হয়তো বিনয়কে– কত সংশয় আছে। কোথায় ইহার মীমাংসা পাইবে?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics