Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

ক্লোরমিন্ট

ক্লোরমিন্ট

6 mins
2.0K


পেটের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হতে দোকানটা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। দিশান এখনও একটা শোপিস নিয়ে দরাদরি করতে ব্যস্ত। ছেলেটাও হয়েছে বাবার ন্যাওটা, কুটুস দিশানের জামাটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওর কোল ঘেঁষে। বাবা-ছেলের হুঁশই নেই যে আমি কখন বেরিয়ে চলে এসেছি। পেটের মধ্যে অস্বস্তিটা বাড়ছে চরমে, এখানে আসার আগে মাসিমণি বারবার করে হিল ডায়েরিয়া নিয়ে সাবধান করে দিয়েছিল, তখন পাত্তা দিইনি কিন্তু এখন টের পাচ্ছি কি মারাত্মক ভুলটাই না করেছি। মনটাকে অন্যমনষ্ক করতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সন্ধ্যে নেমেছে খানিক আগেই; গুটিকতক দোকান ছাড়া আর কিছুই খোলা নেই, রাস্তাঘাটও প্রায় ফাঁকা। ভীষন ইচ্ছে করছে ওই কালো সাপের মত এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাই গন্তব্যহীনভাবে… কোথায় গিয়ে থামবো সে ভাবনা না ভেবেই। পাহাড় আমাকে বরাবর টানে, মনে হয় যেন এই পাহাড়ের প্রতিটা বাঁকে কোনো নতুন রহস্য লুকিয়ে আছে; কখনও আবার মনে হয় এই প্রতিটা বাঁকই যেন ভীষন চেনা, আগেও এদের ডাক শুনেছি আমি। একটা বাঁক থেকে অন্য বাঁকে গেলেই হয়তো দেখা মিলবে কোনো সুদূর অতীতের কিংবা কোনো বাঁকে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে এক নতুন ভবিষ্যৎ, যে ভবিষ্যতের কাছে আমিই হয়তো এখন অতীত...

খেয়ালই নেই কখন যেন হেঁটে হেঁটে বেশ খানিকটা রাস্তা চলে এসেছি এগিয়ে, এই জায়গাটা আরও বেশি নির্জন। ভাবলাম অনেক হল পাহাড়ের ভাঁজে রহস্যের সন্ধান, এবার ফিরে যাওয়াই ভালো। বাবা ছেলেও হয়তো এতক্ষণে খোঁজ শুরু করে দিয়েছে আমার। ফেরার পথ ধরতে গিয়েই একবার চারিদিকটায় ইতিউতি তাকালাম। আর তখনই হঠাৎ রাস্তার পাশের একটা দোকানে দেখতে পেলাম লোকটাকে। রোগা লিকলিকে চেহারা, ফর্সা গায়ের রং, গালে হালকা দাড়ি, চেহারার তুলনায় পুরুষ্ট একটা গোঁফ, খানিকটা পাঞ্জাবীদের কায়দায় দুপাশে বাঁকানো। আমি জানি ওই হালকা দাড়ির ভাঁজেই বাম দিকের গালে লুকিয়ে আছে একটা কালো আঁচিল, যে কালো আঁচিলটায় একসময় নিয়মিত লাগতো আমার ঠোঁটের রং।

পা দুটো শিথিল হয়ে আসছে আমার, নড়তে পারছি না ওখান থেকে, নয়তো ছুটে পালতাম নিশ্চয়। সত্যিই তবে এই পাহাড়ের বাঁকে আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল আমার অতীত! যে অতীতকে আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে ছেড়ে রেখে এসেছিলাম আমার ছেলেবেলার সেই ছোট্ট শহরটায়…

লোকটা হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে নেমে এলো রাস্তায়, আর তখনই তার নজর পড়ল আমার ওপর। হিসেব মেনেই চমকে উঠলো সেও, তবে আমি জানি এবার সে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে, অন্তত তার প্রকৃতি তো তাই বলে। কিন্তু… মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তনশীল। সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে আমার, চোখের পলকও পড়ছেনা বোধহয়। নিস্তব্ধ অন্ধকার রাস্তায় এই মুহূর্তে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধু সে আর আমি।

“বিনি তুই?”

“হ্যাঁ আমি।” কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলাম আমি।

“বেড়াতে এসেছিস?”

খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করছে সে, যেন এ দেখা হওয়া অতি স্বাভাবিক ব্যাপার, এই দেখা হওয়া তার মনে কোনো আলোড়নই তোলে না।

“হুঁ।”

“কতদিন পর দেখা, কেমন আছিস বল।”

“ভালো, খুব ভালো আছি আমি।”

“বাহ্, হাজব্যান্ডের সাথে এসেছিস?”

“হুঁ তা নয়তো কার সাথে আসবো! আমারা তো এখন আমেরিকা তে সেটেলড, দেশে ফিরেছিলাম কয়েকদিনের জন্য তাই…” গলাটা বুঝে আসছে কেন আমার! আজ থেকে সাত বছর আগে যে মেয়েটা ফোন করে এই লোকটার কাছে মিনতি করেছিল একবার বাবার সাথে কথা বলতে, বাবা বিয়ের প্রায় ঠিক করে ফেলেছে তার… বলেছিল, “প্লিজ আমাকে নিয়ে চল এখান থেকে, প্লিজ। তোকে ছাড়া কেমন করে কাটাবো জীবনটা!” …. সেই মেয়েটা মারা গেছে অনেকদিন, তার পুনর্জন্ম সম্ভব নয় আর। এই কাপুরুষটার প্রত্যাখ্যানে গুমরে মরে গিয়েছিল সেই মেয়েটা। আমি এখন মিসেস সেনগুপ্ত, ডলারে রোজগার করে আমার স্বামী। আমার চেয়ে সুখী আর কেউ আছে নাকি পৃথিবীতে! আমার মা তো অন্তত তাই মনে করে, হয়তো বাকি সবারও তাই মত। আমিও কি তাই মনে করি! কে জানে! কিন্তু এই মূহুর্তে এই লোকটারও মনে হওয়া উচিৎ যে আমি পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ, আমার চেয়ে বেশি সুখে থাকতে পারেনা কেউ। কিন্তু লোকটার কি সত্যি কিছু যায় আসে? নাকি ওর জীবনে আমি ছিলাম একটা পেন্সিলের আঁচড় মাত্র, প্রয়োজন ফুরোতেই মুছে ফেলেছে। লোকটার নিশ্চয় কিছু যায় আসেনা, নয়তো এতো স্বাভাবিক গলায় কথা বলে কি করে!

“কিরে বিনি চুপ করে গেলি কেন? জানি তো তুই বিদেশে চলে গিয়েছিলি বিয়ের পর।”

“ওহ জানতিস তাহলে। তা তুই এখানে কেন?”

“আমার এখন পোস্টিং এখানে।”

“পোস্টিং! কিসে আছিস তুই?”

“আমি…”

লোকটা কোনো জবাব দেওয়ার আগেই দেখলাম দিশান আর কুটুস ছুটে আসছে আমার দিকে। কাছে পৌঁছেই ধমকে উঠলো দিশান,

“হ্যাভ ইউ গন ম্যাড! একা একা চলে এসেছো…” দিশানের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ওর নজর পড়লো লোকটার ওপর। আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম,

“দিশান এ হলো আমার কলেজের বন্ধু স্বপ্নময় আর স্বপ্নময় এ হলো আমার হাজব্যান্ড দিশান আর আমার ছেলে অর্কদীপ্ত।” লোকটা চমকে উঠলো, স্বপ্নময় বলে বোধহয় সেই প্রথম আলাপের পর এই দ্বিতীয়বার সম্বোধন করলাম ওকে। পরস্পর করমর্দন করতে করতে লোকটা দিশানকে বললো,

“আসুন না আমার বাড়ি, বেশি দূরে নয়।”

“হুম আপনার বান্ধবী চাইলে যাওয়া যেতেই পারে।”

আমি চাইনা ওর বাড়ি যেতে, আমি চাইনা ওর সুখের সংসারটা নিজের চোখে দেখতে। নিজেকে সুখী দেখিয়ে আজ ওকে ঈর্ষান্বিত করার চেষ্টা করছিলাম একটু আগেই, কিন্তু এখন ওর বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে আমার নিজের বুকের ভেতরে কেমন যেন উথালপাথাল শুরু হয়েছে। আমার জায়গায় আজ ওর সংসার সাজিয়েছে অন্য কেউ! না না কিছুতেই আমি নিজের চোখে দেখতে পারবোনা সেটা। কথার মোড় ঘোরাতে বললাম, “অনেক দেরি হয়ে গেছে, হোটেলে ফিরে চলো। শরীরটা ভালো লাগছেনা আমার।”

“সেকি! তোমার আবার কি হল!”

“বললাম তো খারাপ লাগছে শরীর।”

“আচ্ছা আচ্ছা চলো।

আসছি স্বপ্নময় বাবু।”

“কটা দিন নিশ্চয় আছেন এখন, এর মধ্যেই আসুন একদিন আমার ওখানে।”

“এবারে বোধহয় আর হবে না সেটা, কালই এখান থেকে ফিরে যাবো আমরা।”

“ওহ”, দিশানের কথা শুনে খানিক্ষণের জন্য হঠাৎ চুপ করে গেল স্বপ্নময়, তারপর মৃদু গলায় বলল,

“একটা মিনিট দাঁড়াবেন প্লিজ...প্লিজ দাঁড়ান।”

কথাটা বলেই সেই দোকানটার দিকে ছুটে গেল স্বপ্নময়, যে স্বপ্নময়কে নিয়ে একদিন আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম ঘর বাঁধার, যে স্বপ্নময়কে নিজের হৃদয়টা সমর্পণ করেছিলাম… সেই স্বপ্নময়...

***************************************************************

গাড়ির ভেতর একটা লাইট মিউজিক চলছে। ক্লোরোমিন্ট ভর্তি একটা কৌটো নিয়ে ছলছল চোখে বসে আছে কুটুস, তার বাবার নির্দেশ এই চকোলেটের একটাও সে খেতে পারবেনা।

“তোমার বন্ধুকেও বলিহারি বাচ্চাকে কেউ এক কৌটো ভর্তি চুইংগাম দেয়! অন্য চকোলেট ছিলোনা নাকি!”

নিজের খেয়ালের জগতে ডুবে গিয়েছিলাম, দিশানের কথায় সম্বিৎ ফিরল কিন্তু কোনো উত্তর দিলাম না। দিশানই আবার জিজ্ঞেস করলো, “ভদ্রলোক করেন কি এখানে?”

যাহ এটাই তো জানা হলোনা!

“জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু তোমরা এসে যাওয়াতে আর কথা এগোয়নি।” ক্ষীণ গলায় জবাব দিলাম আমি।

“ওহ, তোমার কি খুব শরীর খারাপ করছে?” দিশানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। আর তখনই সামনে ভেসে উঠলো আজ থেকে বছর আটেক আগেকার একটা টুকরো ছবি; একটা মেয়ে একটা ছেলের বুকে মাথা দিয়ে বলছে, “আচ্ছা তুই যদি স্টেট ব্যাংকের জবটা পেয়ে যাস তাহলে কি কিনে দিবি আমায়?”

“তুই কি চাস বল...।”

“উমম এক কৌটো ভর্তি ক্লোরোমিন্ট।”

“ক্লোরোমিন্ট! আচ্ছা তাই দেবো।”

মেয়েটার মুখটা মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল খুশিতে।

কিন্তু সে খুশি স্থায়ী হতে পারেনি বেশিদিন । ছেলেটার চাকরি হওয়ার আগেই সুপাত্র পেয়ে একপ্রকার জোর করে মেয়েটার বিয়ের ঠিক করে ফেলে তার পরিবার। মেয়েটার কাতর মিনতির সামনে ফোনের ওপ্রান্ত থেকে শুধু নীরবে কেঁদেছিল ছেলেটা, আর বলেছিল, “আমি পারলাম না রে তোকে আটকে রাখতে… পারলাম না আমি...”

কুটুসের হাত থেকে আস্তে করে কৌটোটা নিয়ে একটা ক্লোরোমিন্ট মুখে দিলাম আমি, ক্লোরমিন্টের ঝাঁঝালো স্বাদটা যেন মিষ্টি হয়ে মিশে গেল আমার মধ্যে। তারপর জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে মুখ বাড়ালাম, আমি চাইনা ওরা আমার মুখটা দেখুক এই মুহূর্তে। কুলকুল করে একটা ঠান্ডা বাতাস এসে ধাক্কা মারছে আমার মুখে, আমার চোখ বেয়ে ছড়িয়ে পড়া নোনা জলটার সাথে সেটা মিশে কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমার শিরা উপশিরা; আর আমি এই পাহাড়ি বাতাসের নিঃশ্বাসে টের পাচ্ছি একটা ভীষন চেনা শরীরের গন্ধ, যে গন্ধটা একসময় আমার নিজের ছিল, যে গন্ধটা বহু বছর আগে পেছনে ফেলে এসেছিলাম, যে গন্ধটা আজ ফিরে পেয়েও আবার ফেলে রেখে যাচ্ছি এই পাহাড়ের ভাঁজে...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama