সুখের নীড়
সুখের নীড়
- হ্যালো, ঐন্দ্রিলা ম্যাডাম বলছেন?
- হ্যাঁ, বলছি। আপনি?
- আমি “হাত বাড়ালেই বন্ধু” থেকে আদৃতা বলছি। আমি আপনার সাথে পার্সোন্যালি দেখা করতে চাই। আপনাদের বাড়িতে নয়। অন্য কোথাও। আজ-কালের মধ্যে আপনার কি সময় হবে?
- সে হয়তো হবে। কিন্তু আমার সাথে আবার কি কথা? সেদিন যা বলার আমার স্বামী তো আপনাদের বলেই দিয়েছেন।
- এইমাত্র একটা অজানা নম্বর থেকে একজন ভদ্রমহিলা নিজের পরিচয় গোপন করে ফোন করেছিলেন। ওনার কথা শুনে মনে হল যে, আপনারা সেদিন সত্যিটা লুকিয়েছিলেন। কিছু একটা গোপন করে গেছেন আমাদের কাছে।
- যদি সেটা করেই থাকি, তা আপনাদেরকে কি বলতেই হবে? আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা আমাদেরকেই সামলাতে দিন না।
- সমস্যাটা আপনাদের একার নয়, এই জেনারেশনের। আজ এদের দিকে যে আঙ্গুলটা উঠেছে, তার কি সব দায়টাই এই জেনারেশনের? প্লিজ, দশ-পনের মিনিটের জন্য একটু সময় দিন না।
- ঠিক আছে, কোথায় আসতে হবে বলুন।
ওরা দুজনে সাক্ষাত করার আগে আমরা কিছুদিন পিছিয়ে যাই। ১৫ই আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা দিবস। দেশের প্রতিটি কোণে, কোণে এই দিনটির উদযাপন হয়। সুখের নীড়ও তার ব্যতিক্রম নয়। সকাল থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমের সদস্যরা দিনটির উদযাপনে মেতে ওঠেন। এবার সুখের নীড়ের সদস্যদের উৎসাহিত করার জন্যে তাদের সাথে ছিল “হাত বাড়ালেই বন্ধু” স্বেচ্ছা সেবক সংস্থার ছেলেমেয়েরা।
পতাকা উত্তোলন, দেশাত্মবোধক গান, মিষ্টি বিতরণ, প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সুখের নীড়ে এই স্বাধীনতা দিবস পালন হল। কয়েকজন বৃদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে বক্তব্য রাখলেন। “হাত বাড়ালেই বন্ধু” সংস্থাটি থেকে উপহার তুলে দেওয়া হল সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হাতে। বয়স্ক মানুষগুলোর সাথে গল্প-গুজব, খাওয়া-দাওয়া করে সারাটা দিন কাটিয়ে দিল ঐ স্বেচ্ছা সেবক সংস্থার ছেলেমেয়েরা। আর তখনই তারা লক্ষ্য করল প্রতিটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মনের ভেতরে যেন লুকনো রয়েছে একটা কষ্টের পাথর। মুখে কৃত্রিম হাসি আনার চেষ্টা করলেও, সেটা যে নকল হাসি, তা বয়স্ক মানুষগুলোর মুখ দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়।
“হাত বাড়ালেই বন্ধু” এন.জি.ও-টি মূলত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়েই কাজ করে। অসহায় স্বজনহীন মানুষগুলোর শেষ জীবনটা একটু সুন্দর ও বর্ণময় করে তোলার চেষ্টা করে। সুখের নীড় সহ আরও কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রমে ঘুরে তারা বুঝল যে, একটা দিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাথে থাকলে বা তাদের হাতে বিভিন্ন উপহার তুলে দিয়ে কোনও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। তাহলে রাস্তা কি?
সেই রাস্তা খোঁজার তাগিদে, বয়স্ক মানুষদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ বার করতে একটি ছুটির দিনে সংস্থাটির সভা গৃহে একটি আলোচনা সভা বসল। এই সভায় সদস্য ছাড়াও যোগদান করলেন বিভিন্ন পেশায় সফল, প্রতিষ্ঠিত, বিশিষ্ট মানুষরা। মূলত তাদের অনুদানেই এই সংস্থাটি চলে।
প্রকৃত ভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে হলে তাদের সমস্যার মুল কেন্দ্রে পৌঁছতে হবে। প্রত্যেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মনের কথা জানতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সন্তানদের সাথেও কথা বলতে হবে। জানতে হবে, যে বাবা-মা তাদের এত কষ্ট করে মানুষ করেছেন, কেন তারা সেই বাবা-মাকে নিজেদের কাছে না রেখে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখছে। নিজের মত পোষণ করলেন, একটি বেসরকারি কোম্পানির মালিক সত্য-সাধন কর।
শুধু সন্তানদের সাথেই নয়, তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথেও কথা বলতে হবে। অনেক ছেলে-মেয়েরা তো বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে বছরের পর বছর দেখা করতেই আসে না। সেক্ষেত্রে তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাহায্যের ভীষণ দরকার। বক্তব্য রাখলেন একজন জননেতা সার্বজনীন পাত্র।
সকলের মত অনুসারে ঠিক হল, এই এন.জি.ওর তরুণ-তরুণীরা প্রত্যেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাথে, তাদের ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলবে। প্রয়োজনে তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথেও কথা বলবে তারা। সেই কথোপকথন গোপনে যন্ত্র-বন্দিও করবে সদস্যরা। তারপর সেই সকল কথোপকথন শুনে পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করবে এই সংস্থা।
সুকোমল সেনগুপ্তর ছেলে স্বপ্ননীল নামকরা ডাক্তার। লন্ডনে বেশ ভালই পসার তার। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণের তাগিদে নিজের ভালোবাসার গীটারকে একসময় ছাড়তে হয়েছিল এই স্বপ্ননীলকে। এখন সব ভালবাসা ভুলে বিদেশে বসে কর্তব্য পালন করছে। সুকোমল বাবু ছেলেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে এখন একাকীত্বে ভুগছেন। স্ত্রী বিয়োগের পর নিজেই এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছেন। তবু তো কথা বলার দুটো মানুষ পাওয়া যাবে। স্বপ্ননীল বাবার সাথে দেখা করা তো দূরের কথা, নিয়মিত কথা বলতেই পারে না। এই গল্পটা সুকোমলের মতো আরও অনেকেরই।
চন্দ্রিমা মুখার্জীর স্বামী যখন মারা যান, তখন তাদের একমাত্র মেয়ে শ্রীতমা এম.এ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। মেয়ের বিয়েটা চন্দ্রিমাকে একাই দিতে হয়। তারপর একাকীত্ব কাটাতে উনি এই সুখের নীড়ের আশ্রয় নেন। মেয়ে জামাই অবশ্য তাদের সাথে থেকে যেতে বলেছিল। বলতে গেলে এক প্রকার জোরাজুরিই করে ছিল তারা। কিন্তু উনি মেয়ের সংসারে ঢুকতে চাননি। তবে মেয়ের বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। শ্রীতমাও মাঝে-মধ্যে সুখের নীড়ে এসে মাকে দেখে যেত। কিন্তু রিসেশনের বাজারে শ্রীতমার বরের চাকরিটা চলে গেলে, ও নতুন একটা চাকরি খুঁজে ব্যাঙ্গালোরে শিফট করতে বাধ্য হয়। বন্ধ হয়ে যায় মা-মেয়ের নিয়মিত সাক্ষাত। দুবছর হল শ্রীতমার একটি ছেলে হয়েছে। মেয়ের চেয়ে নাতির অদর্শনেই চন্দ্রিমা মুখার্জীর এখন বেশি কষ্ট হয়। এরকম ঘটনাও শুধু চন্দ্রিমা মুখার্জীর একার জীবনে নয়, অনেকের জীবনেই ঘটেছে।
ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা আর মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাতে বসত বাড়িটা বিক্রি করতে হয় জীবন মল্লিকের। ছেলের বদলির চাকরি। কন্সট্রাকশনের কাজ। সাইটে সাইটে ঘুরতে হয়। প্রথম প্রথম বাবা-মা ছেলের সাথে সাথে ঘুরলেও, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেটা আর পেরে উঠলেন না ওনারা। তাই ভাড়াবাড়ি থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমকেই বেছে নিলেন ওনারা। এ ঘটনারও মিল রয়েছে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জীবনের সাথে।
ছেলে বৌয়ের সংসারে খাপ খাওয়াতে না পেরে, বা তাদের জীবনে নাক গলাতে না চেয়ে স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমও বেছেছেন অনেকে। বহু সন্তানহারা বা নিঃসন্তান বাবা মা শেষ বয়েসে বৃদ্ধাশ্রমকে আশ্রয় করেছেন। নিজেদের স্বাধীন ভাবে জীবন যাপনের জন্য, বাবা বা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার ঘটনা যে পাওয়া গেল না, তা নয়। তবে তা সংখ্যায় খুবই অল্প।
তেমনি এক পরিবারের লোক-জনদের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল আদৃতা। সুখের নীড়ের আপাত বাসিন্দা প্রফুল্ল বিশ্বাসের ছেলের কথা বেশ অবাক করল আদৃতাকে।
- বাবার সাথে বনি-বনা হচ্ছিল না আমাদের। বোঝেনই তো জেনারেশন গ্যাপ। দোষটা হয়তো মুলতঃ আমাদেরই। তবে বাবাকে আমরা কোনও রকম কষ্টে রাখিনি। নিয়মিত টাকা পাঠাই। মাঝে মাঝে দেখা করেও আসি আমি। তাহলে সমস্যা কোথায়? আপনি বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন কেন? বাবা কিছু বলেছেন?
- না উনি কিছু বলেন নি। আমাদের এন.জি.ও থেকে একটা সার্ভে করা হচ্ছে। ওল্ড-এজ হোমে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কেন যাচ্ছেন, এই নিয়ে। সেইজন্যই এখানে আসা।
- ও। তা বললাম তো, জেনারেশন গ্যাপ। বাবার সাথে বনি-বনা হচ্ছিল না। আর কিছু জানার আছে?
- হ্যাঁ, বাড়িটা তো যতদূর শুনেছি আপনার বাবার নামেই এখনও আছে। নিজের বাড়ি ছেড়ে আপনাদের কথায় উনি বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলেন! ব্যাপারটা একটু অবাস্তব শোনাচ্ছে না?
- আমি বলেছিলাম, আমরা তোমার সাথে এক বাড়িতে থাকতে পারছি না। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাবো। শুনে বাবা বললেন, তোদের যাওয়ার দরকার নেই। আমিই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর কিছু জানতে চান?
- না, ঠিক আছে। আমি এখন আসছি।
মনে একটু দ্বিধা নিয়ে ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল আদৃতা। তার কয়েকদিন পরেই একটা অচেনা নম্বর থেকে একজন ভদ্রমহিলা ওকে ফোন করে।
- আদৃতা বলছেন?
- হ্যাঁ, বলছি।
- আপনাকে প্রফুল্ল বিশ্বাসের ছেলে ওনার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যাপারে যে ইনফরমেশন দিয়েছে, তা হয়তো সম্পূর্ণ সঠিক নয়। আপনি একটু ব্যাপারটা যাচাই করুন।
- আপনি কে বলছেন?
- সেটা আপনার জানার দরকার নেই।
- আপনি কি সত্যিটা জানেন? তাহলে আপনিই বলুন না।
- না, ওটা আপনি প্রফুল্ল বিশ্বাসের ছেলের বৌ ঐন্দ্রিলার থেকেই জেনে নিন। সঠিক তথ্য পাবেন। ওর ফোন নম্বর আছে? নইলে আমি দিতে পারি।
- ওনার ছেলের নম্বর আছে। ওনাকে ফোন করে নেব।
- না, না। আপনি ঐন্দ্রিলার সাথেই কথা বলুন। আমি ওর নম্বরটা হোয়াটস-অ্যাপ করছি।
ফোন কেটে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই হোয়াটস-অ্যাপে একটা ফোন নম্বর ভেসে এলো। নম্বরটা পেয়েই ঐন্দ্রিলা কে ফোন করল আদৃতা। প্রথমে রাজি না হলেও পরিশেষে আদৃতার অনুরোধে একটি ক্যাফে কফি ডেতে এক বিকেলে দেখা করতে রাজি হয় ঐন্দ্রিলা। যথা সময়েই আদৃতা সেখানে পৌঁছে যায়। ও পৌঁছনোর মিনিট দশেকের মধ্যে ঐন্দ্রিলাও এসে উপস্থিত হয় ওখানে।
- সরি, আমার আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। আপনি কতক্ষণ?
- বেশীক্ষণ নয়, মিনিট দশেক হবে।
- আপনারা হঠাৎ আমার শ্বশুর মশাইয়ের বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া নিয়ে এতো আগ্রহী হয়ে উঠলেন কেন?
- দেখুন বেশীর ভাগ মানুষের ধারণা যে এই সময়ের ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা-মাকে দ্যাখে না। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে নিজেদের দায়িত্ব সারে।
- এই ধারণাটা আরও বেড়েছে একজন জীবনমুখী গায়কের একটা বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গান থেকে।
- একদম ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমরা সার্ভে করে দেখেছি যে শতকরা আশি ভাগ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাই নিজেদের ইচ্ছেতে বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে ওল্ড-এজ হোমে যাচ্ছেন। আমার ধারনা এই আশি-ভাগের মধ্যে আপনার শ্বশুর-মশাইও পড়েন।
- আপনার ধারনা হয়তো ঠিক। আমি আপনাকে সত্যিটা বলতে পারি একটা শর্তে। যদি আপনি এই কথাগুলো রেকর্ডিং বা কোনোভাবে এর পাবলিসিটি না করেন। আমি আমার স্বামীকে কথা দিয়েছি যে আমি এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলব না।
- বেশ। কথা দিলাম পাবলিসিটি করব না। আপনার কথাগুলো আমার মধ্যেই থাকবে। আমি আমার মোবাইল সুইচ অফ করে আপনার সামনেই রেখে দিচ্ছি।
- আমার বিয়ের এক বছরের মধ্যেই আমার শাশুড়ি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে শ্বশুর মশাই বেশ ভেঙে পড়েন, আর ভীষণ একা হয়ে যান। দুপুরে খাওয়ার পরে উনি রোজই টিভি দেখতেন আমাদের ঘরে এসে। আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। উনি খাটের পাশে রাখা ইজি চেয়ারে আধা শোয়া ভাবে টিভি দেখতেন। দেখা হয়ে গেলে উনি কখন যে টিভি বন্ধ করে চলে যেতেন আমি টেরও পেতাম না। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর সেই টিভি দেখাটা বেড়ে গেল। ওনার ঘরে একটা পুরনো মডেলের টিভি থাকা সত্যেও উনি আমাদের ঘরের এল.ই.ডি টিভিটাই দেখতে বেশি পছন্দ করতেন। আমার স্বামীকে অফিসের কাজে চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুরু, পুনে প্রভৃতি জায়গা ট্যুরে যেতে হত। তখন উনি ডিনারের পরও আমাদের ঘরে বসে টিভি দেখতেন। আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে না ডেকে, নিজে টিভি বন্ধ করে, বেরিয়ে যেতেন। যাবার সময় আমার বেডরুমের দরজা টেনে বন্ধ করে দিতেন উনি। টিভি দেখা ছাড়াও নিঃশব্দে আমাদের ঘরে যখন তখন ঢুকে পড়তেন নানা প্রয়োজনে, কখনও বা নিছক গল্প করতে। শাশুড়ি মারা যাওয়ার বছর খানেক পর আমার মেয়ে হয়। তখনও উনি আগের মতই আমাদের ঘরে অবাধ বিচরণ করতেন। তখন আমার বেশ অস্বস্তি হত। আমি আমার স্বামীকে সে কথা বলাতে, ও আমার ওপর বেশ রেগে গেল। বলল, উনি তোমার বাবার মত। বাবারা যেকোনো সময় মেয়ের ঘরে ঢুকতেই পারে।একটা নিঃসঙ্গ মানুষ যদি তোমার সাথে দু-চারটে কথা বলে একাকীত্ব কাটায়, তাতে ক্ষতি কি? আমি এই ঘটনাটা আমার খুব কাছের কয়েকজন বন্ধুর সাথে আলোচনা করলাম। ওরা আমাকে একটু সতর্ক থাকতে বলল।
- তাহলে আপনার সেই কাছের বন্ধুদের মধ্যেই কেউ আমাকে ফোন করেছিল।
- হ্যাঁ, তাই হবে। কারণ ওরা ছাড়া এই ঘটনাটা আর বিশেষ কেউ জানে না।
- তারপর?
- তারপর একদিন আমার শ্বশুর-মশাই ওনার ঘরে বসে একমনে মোবাইল দেখছিলেন। কি একটা কথা বলতে আমি ওনার ঘরে ঢুকতেই উনি পড়িমরি করে ওনার মোবাইলটা লুকোলেন। আমি এক ঝলক মোবাইলটা দেখেছিলাম। মনে হল যে উনি আমার ফটোই দেখছেন। উনি মোবাইলটা লুকিয়ে ফেলায় আমার কৌতূহল ও সন্দেহ বেড়ে গেল। রাতে উনি ঘুমনোর পর আমি ওনার ঘরে ঢুকে বালিশের পাশ থেকে নিঃশব্দে ওনার মোবাইলটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। শ্বশুর-মশাইয়ের মোবাইলে কোনও পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন লক নেই। তাই সহজেই গ্যালারিতে গিয়ে ওনার ক্যামেরা বন্দী করা ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। দেখে আমার গা শিহরন দিয়ে উঠল। মোবাইল ভর্তি শুধু আমার ফটো। আমার ঘুমন্ত অবস্থায় অসতর্কতায় নাইটির ফাঁক দিয়ে ক্লিভেজ বেরোনো ফটো। আমার নাইটি হাঁটুর ওপরে উঠে যাওয়ার ফটো। আমার মেয়েকে ব্রেস্ট ফিড করাতে করাতে ঘুমিয়ে পড়ার ফটো। আরও কত ফটো।
- সাংঘাতিক! তখন কি করলেন আপনি?
- কিচ্ছু করলাম না। মোবাইলটা আবার জায়গা মতো রেখে এসে আবার নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। পরদিন আমার স্বামী অফিসে চলে গেল। আমি ওকে কিছুই বললাম না। ও অফিস থেকে ফিরলে আমি ওকে ওর বাবার ফোনটা কোনও অজুহাতে নিয়ে আসতে বললাম। ও প্রথমে রাজি না হলেও আমার অনুরোধে একটা কল করার কথা বলে ফোনটা নিয়ে এলো। আমি ওকে ছবিগুলো দেখালাম। বললাম, এখন বুঝেছ তো কেন উনি কারণে অকারণে আমাদের ঘরে ঢোকেন। কেন আমাদের ঘরে টিভি দেখতে ওনার এতো পছন্দ। কেন আমি ঘুমিয়ে পড়লেও উনি টিভি দেখার অছিলায় আমার ঘরে থাকেন। ছবিগুলো দেখে আমার স্বামীর মাথা গরম হয়ে গেল। ও সরাসরি ওর বাবাকে এই ছবিগুলো এই মোবাইলে কিভাবে এলো জানতে চাইল। শ্বশুর-মশাই নির্বাক। আমার স্বামী বলল, আমরা তোমার সাথে আর থাকবো না। ফ্ল্যাট ভাড়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। উনি বললেন, তোদের যাওয়ার দরকার নেই। আমিই বাড়ি ছেড়ে কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছি।
- তাহলে এই হল প্রফুল্ল বিশ্বাসের বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার প্রকৃত ঘটনা। আপনার স্বামী বাবার দোষ আড়াল করতে সব অপরাধ নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। তবে আপনার শ্বশুর-মশাইয়ের এই স্বভাবটা কিন্তু এক ধরনের মানসিক রোগ। আমার মনে হয় ভালো সাইকিয়াট্রিষ্ট দিয়ে চিকিৎসা করালে এ রোগ সারানো সম্ভব। ঠিক আছে এসব নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। আমরা দেখছি কি করা যায়। আর আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনার এই ঘটনা পাবলিক হবে না।
আদৃতা ওর সংস্থা থেকে প্রফুল্ল বিশ্বাসের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। একজন বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে ওনার চিকিৎসা চলল। চলল কাউন্সেলিং। কিছুদিনের মধ্যেই প্রফুল্ল বিশ্বাস হয়ে উঠলেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। উনি নিজের কর্মকাণ্ডে বেশ লজ্জিত ও অনুতপ্ত।
হাত বাড়ালেই বন্ধুর মধ্যস্থতায় নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন প্রফুল্ল বাবু। এই সংস্থা একজনকে হলেও তার বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।
শ্বশুরের পরিবর্তন ঐন্দ্রিলার নজর কাড়ল। প্রফুল্ল বাবু এখন বিশেষ প্রয়োজন না হলে ছেলে-বৌয়ের ঘরে যান না, গেলেও সারা-শব্দ করে যান। বাড়িতে থেকে টুকটাক নানা কাজ করে সংসারের সাহায্য করেন। প্রফুল্ল বাবুদের বাড়িটি এখন প্রকৃত সুখের নীড় হয়ে উঠেছে।