Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sheli Bhattacherjee

Drama Tragedy

3  

Sheli Bhattacherjee

Drama Tragedy

ধ্রুবতারা

ধ্রুবতারা

5 mins
1.6K


"মা:, মাগো, মা ..."

"কিরে মামন, কি হয়েছে? স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?" আমাকে ঝাঁকিয়ে বলে উঠলেন মা। আমি প্রায় ঘেমে নেয়ে উঠে মায়ের কোলখানি নিরুত্তর আঁকড়ে ধরলাম শুধু। মায়ের কাছে বোধ হয় সেটাই ছিল উত্তর। তাই আর জিজ্ঞেস করেননি। 


পরেরদিন দুপুরে খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। দেখলাম মা রেডি হয়ে গিয়ে আমাদের রাতের খাবারগুলো ঠিক করে রাখছেন টেবিলের উপর ঢাকা দিয়ে। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কিকরে সম্ভব একজন রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে নিজের ব্যাপারে এতো উদাসীন থাকা, এতোটা নির্লিপ্ত থাকা। তারপর ভেজা গলায় মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বললাম "আমাদের জন্য এতো ভাবনার মধ্যের যদি সিকিভাগটুকু নিজের জন্য ভাবতে, তাহলে আজ এইদিন আসতো না। আচ্ছা, সত্যি কি তোমার ভয় হচ্ছে না একটুও? চিন্তা হচ্ছে না কোনো?"

মা চিরকালীন সহাস্যমুখে উত্তর দিলেন 

"ভয় কিরে বোকা? সব যে তার চরণে সমর্পণ করে রেখেছি। আর আগেও তো এই শরীরটা নিয়ে কতো কাঁটাছিড়ে হয়েছে। এসবতো নতুনকিছু নয়। এই হাসপাতাল বেড, স্যালাইন, ছুড়িকাচির অপারেশন থিয়েটার ... সবাই আমার পূর্ব পরিচিত। তাই ভয় নেই আর নতুন করে। তবে চিন্তা আছে। তোর জন্য।"

কথাগুলো শোনার পরে আর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। তবু চোখের জল আটকে রাগ দেখিয়ে বললাম 

"আমার কথা ভেবেও তো একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখতে পারতে। জানোইতো তুমি আমার পৃথিবী। তোমার কিছু ..." অর্ধসমাপ্ত কথাটাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে দ্রুত সরে গেলাম মায়ের পাশ থেকে।


বিকেলে মাকে বেসরকারি একটা হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে পূর্ব বার্তালাপ অনুসারে ভর্তি করা হল। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে বাসে বসে অতীতের গুহায় মনটা অবচেতনেই প্রবেশ করে গেল। আর হাতড়াতে লাগলো আঁধারিয়া সব স্মৃতিগুলোকে। আমি যে বছর ক্লাস ফাইভ, সেই বছরই মায়ের ওটি সিরিজে হাতেখড়ি হয়েছিল। এপেন্ডিসাইটিসের হাত ধরে। অপারেশন করার আগে যেদিন পেটে ব্যাথা হয়েছিল, ঘরে কেউ ছিল না। দশ বছরের অবুঝ আমি ভয়ে কখনো মায়ের মাথার কাছে বসে কাঁদছিলাম, কখনো তেলজল মালিশ করে দিচ্ছিলাম তার পেটে। বাবা তখন বন্ধুবান্ধব সঙ্গে বাহিরমুখী। অনেক রাতে ফিরতো।


তারপর অপারেশনের পর ভেতরের স্তরে পেটের শেলাই খুলে গিয়ে মায়ের একাধিকবার হার্নিয়া ভোগান্তির শুরু হল। দায়ী ছিল ঘরের অশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে নিজের প্রতি শান্ত অবহেলা। সবকিছুর মাঝে মা শুধু যক্ষের ধনের মতো আমার পড়াশুনোটাকেই আগলে রাখতেন। অতঃপর দুর্নীতিতে অংশীদারি হব না বলে সরকারি সুযোগ প্রত্যাখ্যান করলাম। বেসরকারি চাকরিতে বেশিদিন জীবনপথ সুগম হল না আমার। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়েও সুখেদুখের সঙ্গী পাবার আশা ম্রিয়মাণা হল ভাগ্যের পরিহাসে। তবে পঁচিশ বছর আগের দেখা অন্যায়গুলোর ছিটেফোঁটাকেও দ্বিতীয়বার আমার জীবনে প্রশ্রয় দিই নি আমি। আমি যে মায়ের কাছেই একদিন শিখেছিলাম ভাব সম্প্রসারণটি। 'অন্যায় যে করে ও অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে'। মা শুধু আমায় শিখিয়েছিলেন, নিজের জীবনে ছিটেফোঁটাও হাতেকলমে প্রয়োগ করতে পারেননি। আর সেই না পারার কারণ হয়তো আমিই ছিলাম সেদিন। কিন্তু বাল্যকালে দৃশ্য অবিচারগুলো আমাকে চাবুকের মতো গড়ে তুলেছিল। চোখের সামনে ঘরের লোকগুলোকে বিবেক মেরুমন্ডতে প্রতিবন্ধী স্বরূপ দেখে, ইস্পাত হয়ে উঠেছিল আমার ভেতরের প্রতিবাদগুলো। 

আজকের বাবাকে দেখলে অবাক লাগে, মনে হয় এ এক অন্য মানুষ। পরের সন্তানের ক্ষেত্রে না হলেও, নিজের সন্তানের জীবনের এলোমেলো দিনগুলো বোধ হয় তার ভেতর গৃহে কড়া নেড়েছিল। কিন্তু মা সেসব প্রসঙ্গ উঠলে, নির্বিকারে বলেন 'ছাড়, অতীতের কথা। অতীত খুঁড়ে ক্ষতিই বাড়বে। এক জীবনে সব সম্পর্ক মনের মতো হয় না কারো। তুই তো অন্তত আমার মনের ছাঁচের হয়েছিস। আজীবন মনে রাখবি স্বামীজির কথাটা ... জন্মেছিস, তো দাগ রেখে যা। সে দাগ অর্থ উপার্জনগত প্রতিষ্ঠার দাগ নয়, আপন মনুষ্যত্ববোধের দাগ। সেই দাগের ছাপ ফেলতে ফেলতে উঠতে থাকবি তুই উন্নত মনুষ্যালয়ে প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে। সেদিন আমার অতীতবেত্তাগুলো এক একটা সোপান হয়ে গর্বিত হবে সেই চৈতন্যালয়ে, মাতৃসুখে।'


পরেরদিন ভোরে রওনা হয়ে গেলাম আমরা। সকালের ফার্স্ট ওটি মায়ের। মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম, সূচ সমন্বিত গহনা পরে ওটির ড্রেসে সে দিব্যি বসে আছে আমার দিকে চেয়ে। এক আয়ার মুখে ডাক্তারের কিছুটা দেরি হবে শুনে চমকে আমায় জিজ্ঞেস করলেন "খেয়ে এসেছিস কিছু? আমিতো জানি তুই আমার চিন্তায় কিছুই খাস নি। এখন ডাক্তারের দেরি হলে, আমার ওটি হয়ে বেরোতে যে আরো দেরি হবে। পেটে পিত্তি পরে যাবে তোর। একটু বেড়িয়ে কিছু খেয়ে নে।"

আমি রাগ দেখাতে গিয়েও গম্ভীর হয়ে বললাম "এই মূহূর্তেও তুমি আমার খাওয়ার কথা ভাবছো?"

একজন নার্স আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন "খেয়ে এসো। মায়ের চিন্তা কম হবে।"


ঝাপসা চোখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দুটো বিস্কুট খেলাম কষ্ট করে। শুধু মায়ের কথা রাখতে। তারপর ওটি হল। মাকে বেডে দিল। মায়ের কাতরানো অবস্থাটা পঞ্চমবারের জন্য আমার চোখের সামনে এলো। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল অজ্ঞানকৃত মানুষটার দুচোখের কোন দিয়ে বেয়ে আসা অশ্রুরেখা দেখে। মায়ের মাথায় হাত বোলাতে গিয়ে দেখলাম, বালিশের পাশে গোঁজা আছে মায়ের কোলে আমার ছোটোবেলার ছবি। তা দেখে, আমার সমস্ত সন্তানসত্ত্বা দিয়ে আরেকবারের জন্য অনুভব করলাম মায়ের মাতৃত্বের অসীম পরিধিকে। আমার দুচোখে তখন প্রলয়সম প্লাবন। নিজেকে সামলাতে সে ঘর হতে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসলাম। বাবা বাইরেই চুপচাপ বসেছিলেন। হয়তো নিজের মনে পুরানো ভুলগুলোকে ভুলতে চেষ্টা করছিলেন। 


বিকেলে যখন দেখা করতে গেলাম, তখন মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। আমাকে অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলেন "তোর রেজাল্টটা বেরিয়েছে?"

কাল বেরোবে জানালাম। এতোকিছুর মধ্যেও মায়ের আমার কলম জগতের হিসেব রয়েছে নির্ভুলভাবে। ছোটো হতে আজ অবধি আমার পাঠ্যক্রম ও তার বাইরের বাংলা ভাষা সাহিত্য জ্ঞানের গুরু যে আমার জননীই। তাই নিজের জীবনের উথালপাতাল ঢেউয়ে সব ভেসে গেলেও বহু যন্ত্রণা দিয়ে আঁকড়ে রেখেছি এই কলমকে। মায়ের রংতুলি, গিটার থেমে গিয়েছিল সংসারস্রোতে, কিন্তু আমি তা হতে দিনি। এই কলমেই যে সুপ্ত আছে দুই প্রজন্মের দিবারাত্রের নোনা জলের স্বপ্ন।


পরেরদিন বিকালে মাকে সানন্দে জানালাম, আমার কৃতী হওয়ার সংবাদ। মাঝ সমুদ্রের স্থির তরঙ্গমালাসম তৃপ্তিতে মা আমাকে কাছে ডাকলেন। তারপর আমার লেখা তার প্রিয় কবিতাটির কটা লাইন শোনাতে বললেন। আমি শুরু করলাম ...


"জন্ম হতে জীবনস্রোতে, দুর্বার সব মোহের আশ,

অসীম প্রেমে লিপ্ত হয়ে পিষিয়ে চল সে নাগপাশ।

দ্বিধাদ্বন্দ্ব মানের গন্ধ তাসের ঘরের মিথ্যা ছাদ,

চিত্ত হতে মিটিয়ে দিয়ে মৃত্যুভূমি কর আবাদ। 

বাইরে যতই আঁধার নামুক, অন্তরালোকে নিত্য জাগ,

পুড়িয়ে খাঁটি মনখানি তোর, তাঁর চরণেই গুছিয়ে রাখ।"


মা আমার পরিতৃপ্তিতে বলে উঠলেন "সেই আমার সব যন্ত্রণার বিশল্যকরণী যোগাবেন, এ ভরসা ছিল আমার। আজ তোর কলম পরিচয়ের মধ্য দিয়ে আমি পেলাম তা। জানিস, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মা কি বলেছিলেন ... সন্তানই যে মায়ের শ্রেষ্ঠ অলংকার।" অত:পর মায়ের কণ্ঠে ধীর দুর্বল স্বরে গান উঠলো "তোমারেই করিয়াছি জীবনেরও ধ্রুবতারা, এ সমুদ্রে ধরা মাঝে হবো নাকো দিশাহারা।" আর আমি চেয়ে রইলাম আমার জীবন্ত ধ্রুবতারার দিকে, নিষ্পলক।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama