Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Mausumi Pramanik

Inspirational

5.0  

Mausumi Pramanik

Inspirational

শেষ ঈদের উপহার

শেষ ঈদের উপহার

12 mins
17.2K


পবিত্র রমজান মাস চলছে। গ্রামের আর পাঁচজনের মত রোজা রেখেছেন আমিনা বিবিও। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। একাই থাকেন। বার্ধক্যজনিত কারণে শরীরে নানা রোগের বাসা। হাসপাতালের ডাক্তার মানা করেছিলেন। ডাক্তারের কথা তিনি শুনলে তো! ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে সামান্য কিছু খাবার খেয়ে তিনি মাঠে চলে যান। সূর্যাস্ত অবধি খাবার তো দূরে থাক, জলও পান করেন না। সন্ধ্যের পর নামাজ পড়ে শশা, ছোলা, গুড় খেয়ে ইফতার সারেন। ফলে স্বভাবতই ওষুধ পত্র খাওয়ার অনিয়ম হয়। ছেলে শাহানুর মায়ের হাতে পায়ে ধরতে বাকী। “আম্মি এসবের কি প্রয়োজন? আমি তো রাখছি...তুমি রোজা না রাখলে কি হবে?”

মেয়ে জাহিরা বলে, “যদি রোজা রাখতেই হয়, তাহলে আমাদের ঘরে চলো না কেন আম্মি। আমি তোমার দেখাশোনা করব। ভাল করে খাওয়া দাওয়া না করলে যে তুমি ঈদের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়বে...”

“দ্যাখ তরা আমায় আমার মতো থাকতে দে দিনি...আমার কিসু হয় নাই...আমি ভালা আসি...ঈদের চাঁদ তো দ্যাখবোই...এমনকি দূর্গা পূজার অঞ্জলি না দিয়ে মরবো নে...”

নিজের শরীরের খোঁজ রাখার সময় কোথায়? গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরের কে কেমন আছে, সকলে ভাল আছে কিনা, কারোর বিপদ আপদ হল কিনা সেটা না জানলে তাঁর রাতের ভাতই হজম হবে না। অন্যের বিপদ তাঁর রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, যতক্ষন না তিনি সেই মানুষটিকে বা পরিবারটিকে বিপদ থেকে বাঁচাতে পারছেন। আমিনা যেন সকলের থেকে আলাদা; যেন আজকের জগতের মানুষই নন। তিনি গ্রামের প্রবীণ মানুষদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর জমির ধারেই টিনের চাল দেওয়া ছোট্ট ঘরে একাই থাকেন। নিজেই একা নিজের জমি চাষ করে, সেখানে সবজী ফলিয়ে, সেই সবজী বাজারে বিক্রী করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। মেয়ের ভাল করে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকেও সংসারী করেছেন। ছেলে স্থানীয় মাদ্রাসায় শিক্ষাকতা করেন।

 দাঙ্গা, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, অসহিষ্ণুতা,খুন, ধর্ষন, লুঠতরাজ ইত্যাদি ঘটনায় যে আজকের সমাজ ও সমাজবদ্ধ মানুষেরা জর্জরিত, অতিষ্ঠ তা প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা যে কোন নিউজ চ্যানেল খুললেই বোঝা যায়। পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতবর্ষের চিত্রটা অনেকাংশেই এক। সামাজিক পরিকাঠামোটাই যেন ভেঙে গিয়েছে। এইসব ঘটনা অনভিপ্রেত। যদিও খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে এর বিশেষ কোন কারণই থাকে না। হাসপাতালে রোগীমৃত্যু হয়েছে, জ্বালিয়ে দাও, গুড়িয়ে দাও। ট্রেন বা বাস অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তো হয় রেল অবরোধ নয়তো রাস্তা অবরোধ। ভাইয়ে ভাইয়ে কিংবা বন্ধুতে বন্ধুতে মারামারি লেগেছে, ঘর, ফসল ইত্যাদি জ্বালিয়ে প্রতিশোধ নাও। প্রতিরোধ, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। কারণ প্রতিবাদ করলেই খুন নয়তো ধর্ষনের হুমকি। মানুষ দিনে দিনে যেন আরো আরো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। আর যা কিছু ঘটছে তাতেই রাজনীতির রঙ লেগে যাচ্ছে। মানুষ যেন রাজনীতির আঙিনা থেকে বেরোতেই পারছে না।

 সন্দেশখালি থানার অন্তর্গত লেবুখালি গ্রামটিও তার বাইরে নয়। ছোট ছোট ঘটনা ঘটেই চলেছে। জমির আল নিয়ে ভাই-বন্ধুর লড়াইয়ে একজন খুন হয়ে গেল ক’দিন আগে। গেল বছর পূজোর আগে বহিরাগতরা এসে একটি নাবালিকা মেয়েকে ধর্ষন করে চলে গেল, আজ পর্যন্ত্য তার কিনারা হল না। আসলে মোহনার কাছাকাছি হওয়ায় বিভিন্ন নদী গ্রামটিকে জালের মত ঘিরে আছে, নদীপথে আততায়ী যদি একবার বর্ডার ক্রশ করে চলে যায় তো ধরাও মুশ্কিল। গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষই জেলে, মাছ ধরাই তাদের প্রধান জীবিকা। এছাড়া উঁচু এলাকায় সামান্য কিছু জমি আছে, তাতে সবজী,ফল,নিম্নমানের ধান চাষ হয়। এছাড়া সুন্দরবন অঞ্চল বলে কথা, তাই সুন্দরী গাছের জঙ্গল থেকে মধু আহরন করে তা শহরে বিক্রি করেও কিছু মানুষের সংসার চলে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাস এই গ্রামটিতে। এখনও যে বড় কোন অশান্তি হয় নি তার কারণ ঐ আমিনা বিবি।

 বলতে গেলে গ্রামটিকে তিনিই যেন বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। স্থানীয় লোকেরা তাকে লেবুখালির মাতঙ্গিনী বলেই চেনে। সব রাজনৈতিক দলের কাছেই তিনি পরিচিত মুখ, কিন্তু কোন দলের ঝান্ডা ধরতে তিনি রাজী নন। তার মত সাহসী মহিলা এ তল্লাটে দুটি নেই। একবার মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন ভোট চাইতে। আমিনা বিবি ভীড় ঠেলে পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া করে মঞ্চে উঠে যান। উঠেই বলতে শুরু করেন, “বলি অ মা...তুমি যে ভোটের আগে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দে যাচ্ছো...বিলোচ্ছো ইচ্ছামতো...তা তোমার সাকরেদরাতো ভুংভাং করে সব খরচ করি দিবে...পাকা রাস্তা হবে নে...গেরামে জল, আলো কিসুই আসবে নে...তুমি দেখে নিও...আসপাতাল হবে নে...ভোটের পর খবর নিয়া দেখো...”

মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “সব হবে... আম্মা...আমি ঠিক খোঁজ নেব...”

“তা সে মা’ই বলো আর আম্মা...কামকাজ না হলে কিন্তু তুমিও পার পাবি নে...এই বলে দে গেলুম...”

ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলে ওঠে... “ওরে কি আমার মাতঙ্গিনী হাজরা এলেন রে!...”

মাইকের সামনে চিৎকার করে বলেন আমিনা, “দ্যাখেন ভাই..আমি মুখ্য মেয়েমানুষ হতি পারি, কিন্তু মাতঙ্গিনী হাজরা’র দ্যাশের মাইয়া তো...তিনি স্বাধীনতা এনে দেছেন...আর তোমরা তার অপব্যবহার কইরবে...আমি তো তা হতি দেব নে...আমার পেরাণ থাকতে আমি আমার গেরামের কোন খেতি হতি দেব নে...”

মুখমন্ত্রী আমিনার ভাষন শুনে মুগ্ধ। স্থানীয় এম.এল.এ কে পরেরদিনই পাঠালেন যদি তাকে পরবর্তী পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু বুড়ি নারাজ। বলে, “রাজনীতি আমার কম্ম নয় বাপু...এই বেশ আছি... সারাদিন খাটি...সময় সুযোগ পেলে মান্’ষের সেবা করি...তা হ্যা বাপ মান্’ষের কাজকাম করনের লগে কি রাজনীতি করতেই হইবো...?”

 বিরোধী দলও তাকে দলে টানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এমনকি কিছু ধার্মিক সংগঠনও তার কাছে বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। তার সোজা সাপটা কথা, “আমি তোমাদের ধম্মো মানি নে...আমি বিকালে নামাজ পড়ি আবার ভোরের বেলা নদীতে সিনান সেরে শিবথানে মাথা ঠ্যাকাই...আমি রমজানও পালন করব...আবার দূর্গা পূজাতে অষ্টমীর অঞ্জলিও দেব...দেখি কোন বাপের ব্যাটা আমারে আটকায়...”

সত্যিই এমন বিচিত্র মানুষ এই আমিনা বিবি। কারোর কাছে তিনি প্রিয় চাচী, কারোর কাছে তিনি ঠাকমা, কারোর আছে তিনি আম্মা...আবার কারোর কাছে তিনি মা। বিপদের একটা গন্ধ পেলে হয়। আমিনা বিবি তার বাঁশ লাঠি নিয়ে ছুটবেন, সঙ্গে কাউকে পেলে ভাল, নাহলে একাই। কেউ খবর দিল যে কোথাও কোন নাবালিকাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমিনা বাইকের পিছনে বসে গেলেন থানায়, বড় বাবুকে ধমক চমক দিয়ে নিয়ে এসে বিয়ে বন্ধ করলেন; মেয়ের বাপ কে গালি দিয়ে তার বাপের শ্রাদ্ধ করে ছেড়ে দিলেন; তা সে যে সম্প্রদায়ের মেয়ের বাবা হোক না কেন।

বিষমদ খেয়ে কিছু লোক একবার আক্রান্ত হল। তিনি বাঁশ দিয়ে মেরে মেরে ভাটিখানাটাই ভেঙে দিলেন। গ্রামের যুবক যুবতীরা তাকে ঈশ্বরের মত শ্রদ্ধা করে। তাই আমিনা বিবি একবার হাঁক দিলে তারা না এসে পারে না।

 কোথাও ফসল বা মাছ ভাগাভাগি নিয়ে বচসা চলছে, সে বচসা প্রথমে হাতাহাতি, পরে খুনোখুনিতে রূপান্তরিত হল। ক্লাবের ছেলেরা ডাকতে আসে, “ চাচী শিগগির চলো...রহিম চাচা আর মধু মামায় ঝগড়া বেঁধেছে...মারামারি হল বলে...” শুঁটকী মাছের চচ্চড়ি দিয়ে পান্তা মেখে সবে এক গাল মুখে দিয়েছিলেন আমিনা... ভাত চাপা দিয়ে ছুটলেন সেখানে। “খবরদার রহিম...খবরদার মধু...এক পাও আগাবি নে...কয়ে দিচ্ছি...”

“তুমি সরো... চাচী...”

“ছাড়ান দাও...আমিনা বিবি...তুমি এর মধ্যে ঢুকবা না...”

“ক্যান...ক্যান ঢুকব না...কাঠারি হাত থেইকা ফ্যাল কইতাছি...”

“না..আজ ফয়সালা করেই ছাড়ুম...”

“হ্যাঁ। আজ ফয়সালা হয়েই যাক...” দুজনেই গজরাতে থাকে।

আমিনা দুজনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। গ্রামের লোকেরা ভয়ে তটস্থ। কিন্তু তার কোন ভয় ডর নেই।

“ঠিক আসে...থাইলে আগে আমারে মার...আমারে কাট মধু...আমার রক্ত দিয়ে সিনান কর..তারপর তোরা ফয়সালা করবি...”

মধু আর রহিম বাধ্য হয় হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিতে। শুধু তাই নয়। গ্রামের পাঁচজনকে ডেকে উনি ওদের ঝগড়ার মীমাংসাও করে দেন। আমিনা বড়ই বুদ্ধিমতী মহিলা, জানেন যে গ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে বসবাস করে। তাই এমন কোন ঘটনার ফল যে সুদূর প্রসারী হবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। গ্রাম খানি জ্বলে পুড়ে রাখ হয়ে যাবে। তাছাড়া গ্রামের পুরুষরা বেশির ভাগই বাড়ির বাইরে থাকেন রাতের পর রাত, কিংবা দিনের পর দিন। হয় তারা সমুদ্রে চলে যায় নৌকা নিয়ে, কিংবা শহরে চলে যায় বিক্রী বাট্টা করতে। তাই গ্রামের মেয়ে বৌরা, কচি কাচারা আমিনাবিবিকে দেখে বল-ভরসা পায়।

 নিজে বেশীদূর লেখাপড়া করতে পারেন নি তো কি হয়েছে, সন্ধ্যে হলেই গ্রামের কচি কাচাদের তার উঠানে পড়তে বসান। টাকার অভাবে হয়তো সকলের বাড়িতে বিদ্যুৎ আসেনি, কিন্তু আমিনাবিবি শুধুমাত্র ওদের জন্যেই তার উঠানে মোটা পাওয়ারের আলো ফিট করে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, নিজের বাগানের আমড়া, পেয়েরা কেটে বিটনুন আর লঙ্কা মাখিয়ে ওদের খেতে দেন। সেই লোভেই হয়তো তারা সন্ধ্যে হতে না হতেই স্লেট আর বই হাতে করে আমিনার উঠানে এসে হাজির হয়।

 নদীগুলি গ্রামের আনাচে কানাচে এমন ভাবে ঢুকে এসেছে ঠিক যেন সমুদ্রে যাবার রাস্তা খুঁজছে। গরমের দিনে নদীর পাড়ে বসে ঠাণ্ডা বাতাস খেতে ভালই লাগে, কিন্তু বর্ষাকালে তারা আবার জোট বাঁধে। মানে দুকূল ছাপিয়ে এমনভাবে গ্রামের ভিতর ঢুকে পড়ে যে তখন নদীগুলিকে আলাদা করে চেনে কার সাধ্য। সেই বিপদের দিনেও আমিনাই ভরসা। ওর জমি আর ঘরটা উঁচু সাইডে। ঐ ছোট্ট ঘরেও যে তিনি গৃহ হারা কতজনকে আশ্রয় দেন, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। একবার তো ঐ ঘরেই প্রসব বেদনা ওঠা মায়ের বাচ্চার জন্ম করালেন পাকা দাইয়ের মত। আয়লার পর সরকার থেকে বাঁধ নির্মানের জন্যে যত টাকা এসেছিল, কন্ট্রাক্টরেরা হরির লুঠের বাতাসার মতো হাপিস করে দিল। আমিনা ডি. এমের সঙ্গে দেখা করে তাদের নাম, ধাম জমা করে আসেন। তদন্তের পর তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। এইভাবেই কিন্তু তিনি তার শত্রুর সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়েই চলেছেন। তবু ভয় ডর কাকে বলে তিনি জানেন না। বলেন, “মরতে তো একদিন হইবোই ভাই...মরবোই যখন কিসু ভাল কামকাজ করে মরাই ভাল...”

 অথচ তেতাল্লিশ বছর আগে আমিনা বিবি এমনটা ছিলেন না, একজন সরল সাধাসিধে ঘোমটা টানা বিবি ছিল। তার মিঞা রসিদ মহম্মদের একটি ট্রলার ছিল। তিনি ও গ্রামের আরো কয়েক ঘরের পুরুষ সদস্য প্রায়ই সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত। দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে সুখেই কাটত তার দিনগুলো। রসিদ এমনিতে খুব ভাল কিন্তু রেগে গেলে কোনো জ্ঞান থাকে না। মোহনাতে অন্য গ্রাম থেকে আসা একদল জেলের সঙ্গে জাল ফেলা নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়। রসিদ রেগে গিয়ে একজনের গায়ে কাঠারির কোপ মারে। সেদিন তারা ঘরে ফিরে গেলেও এই পবিত্র রমজান মাসে যখন তারা মাছ ধরা থেকে বিরত ছিল, সুযোগ বুঝে তাদের ট্রলারে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরপর অনেকগুলো নৌকাতেও আগুন ধরে যায়। জালগুলিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গ্রামের বেশির ভাগ জেলেপরিবার ক্ষতগ্রস্ত হয়। খবর পেয়ে তারা ছুটে যায় মোহনার দিকে। প্রতিদিন ইফতারের পর তারা খোঁজ চালাতে থাকে কারা তাদের পেটে এমনভাবে লাথি মারল। আন্দাজ করেছিল, কিন্তু প্রমাণ ছিল না। একদিন ঐ গ্রামেরই এক জেলে মদ খেয়ে সব উগড়ে দেয়, বলা ভাল যে এরাই চালাকি করে তার পেট থেকে কথা বের করে নেয়। আমিনা চুপি চুপি সব জানতে পারে। সে তার মরদকে আটকায়।

“দ্যাখো ঘরে পোলাপান আসে। পবিত্র রমজান মাসে কিসু কইরো না তোমরা..আজ বাদে কাল খুশির ঈদ..এইসময় ঝগড়াঝাটি, অশান্তি ভালা লাগে নে...”

কিন্তু রসিদের চোখে তখন আগুন জ্বলছে। সে পারলে আমিনাকেই কুপিয়ে মেরে ফ্যালে। সেই সময় রেডিও তে ঘোষনা হয় যে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। আগামীকালই খুশির ঈদ। অমনি তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় উৎসবের। পরেরদিন সকালবেলা স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে নামাজ পড়ে। তারপরই সকলে সকলের সঙ্গে কোলাকুলি সেরে নিতে থাকে। শুভেচ্ছা বিনিময় হতে থাকে। ঘরে ঘরে দাওয়াৎ। সব সম্প্রদায়ের লোকেরাই আমন্ত্রিত। তাদের সবচাইতে বড় উৎসব বলে কথা। একমাস ধরে সংযম ও সাধনার পর উৎসব। কিন্তু সে খুশি ছিল ক্ষনস্থায়ী। সেইদিনই রাতে রসিদ ও তার দলবল বদলা নিল। আমিনা হাজার চেষ্টা করেও আটকাতে পারল না। দু তরফেই প্রচুর রক্তপাত হল। ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠল। আমিনার বুকটা যন্ত্রনায় ফেটে যেতে থাকল। “হায় আল্লা! তুমি এদের বিচার করবা! ঐ মাইয়াগুলার কি দষ কও, যাদের মরদগুলান বলি চড়সে! ঐ পোলাপানগুলার কি দূরগতি হইবো...হা ঈশ্বর! হিংসার কুনো স্যাষ নাই গো...কারে কই? কারে বোঝাই...কও...” কপাল চাপড়াতে থাকে আর কাঁদতে থাকে আমিনা। তার পরিবারেরও যে সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই, তা সে জানত। তাই গোলমাল থেমে যাওয়ার বেশ কয়েক মাস পরেও রসিদ যখন জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে খুন হয়, তখন আমিনা গ্রামে ফিরে মিথ্যে কথা প্রচার করে, বলে রসিদ মিঞাকে বাঘে ছুঁয়েছে। কারণ সে জানতো যে সে যদি সত্যি কথা বলে তাহলে আবার কিছু ঘর জ্বলবে, কিছু মানুষ মরবে কারণ প্রতিহিংসার কোন শেষ নেই। ছাই চাপা আগুন হয়ে জ্বলতেই থাকে। সেই থেকেই সে নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করে যে এই গ্রামে এবং পার্শ্ববর্তী কোন গ্রামে সে আর একটিও দাঙ্গা হতে দেবে না। কিছুতেই না।

 এই গ্রামের প্রতি তার দান বলে বলে শেষ হবার নয়। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করার পাত্রী তিনি নন। এবারে ঈদের দিন গণ্ডোগোল বাধতে পারে এমন একটি কথা তিনি কানাঘুষো শুনেছিলেন। তাই ইফতার শেষ করে চলে গেলেন পুরাতন মাদ্রাসায়। তিনি জানেন যে এইখানেই তিনি গ্রামের মাতব্বরদের পাবেন। সেখানে গিয়েই জানতে পারলেন যে একদল লোক দাঙ্গা বাধাবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রবীনেরা তাদের থামাবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাতে দাঙ্গাবাজের দল দমে যাবার পাত্র নয়।

“রথের দিন ইচ্ছা করে ওরা ধানের গোলায় আগুন দিসে...এইবার ওদের ছাড়ান নাই...”

শুনে চুপ থাকতে পারলেন না আমিনা।

“ পোড়ারমুখো মিনসের দল...বাজি ফাটাতে গিয়ে একখানা আগুন উড়ে গিয়ে পড়িছিল...তাই আগুন ধরি গিসল...তার ক্ষতিপূরণ তো ত্যানারা দিসে...এখন কি পায়ের উপর পা লাগিয়ে অশান্তি না বাধালেই হচ্ছি নে...”

“তুমি চুপ করো আমিনা চাচী...তুমি কিছু বুঝো না...”

“আমি বুঝি আর নাই বা বুঝি...তুই তো সব বুঝস... জানস না পবিত্র রমজান মাস চলসে...। এটা সংযমের মাস...”

“ওরা বড় বাড়বাড়সে আমিনা বিবি...ওদের শায়েস্তা করা দরকার...দু চারটে লাশ পড়লে বুঝবা কত ধানে কত চাল...আমাদের পিছনে লাগতে আসা অদের বেরিয়ে যাবা...”

“কিছুদিন আগে আমাদের কত লোক মারা গিসে তার হিসাব আসে নাকি তোমার কাছে...বড়ো বড়ো কথা কইয়ো না যাও দেহি...আমাদের মিটিং সারতে দাও...”

কিছুদিন আগেই অন্য একটি অঞ্চলে বড়সড় দাঙ্গা লেগেছিল। পুলিশ প্রশাসন গোষ্ঠী কোন্দোল বলে চাপা দিতে চাইলেও আত্মীয় স্বজনের মারফৎ আসল খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল। বাস, ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বহু মানুষের হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। আমিনা তাই অচিরেই বুঝতে পারলেন যে সেই আগুন এখনো নেভেনি। এদের মনে ধিকধিকি করে জ্বলছে। কিন্তু যেভাবেই হোক ওদের আঁটকাতেই হবে। তেতাল্লিশ বছর আগে যা তিনি করতে পারেন নি তা এখন তাঁকে করতেই হবে। তাই সত্তর বছরের আমিনা বিবি অসুস্থ শরীরেও ছুটে এসেছেন। কিন্তু হাজার বুঝিয়েও মানুষের প্রতিহিংসার আগুন তিনি নেভাতে পারলেন না।

“উদ্যাশ, সেদ্যাশ থেইক্যা লোগ ঢুকাইতাসে সন্ত্রাস করনের লাইগ্যা, টিবিতে দ্যাখোস না? রোজ রোজ জওয়ান মরতাসে; এহন তরাও যদি অবুঝ পানা করোস, বাপজান...সাধারন মানসে কুনদিকে যাইবা? যা খেতি হবার তো আমাগোর হইবো,ন্যাতাদের কিস্যু আসবো-যাবো না। ঠাণ্ডা হও বাপসকল...”

“আমাগোর রক্ত গরম হইয়া গ্যাসে গিয়া; জ্বলতাসে, মগজখান দাউ দাউ কইরা উঠতাসে; ছাড়ুম না! ওদের শ্যাষ না কইরলে শান্তি নাই গো চাচী; তুমি ঘর যাও দেহি। আমাগোর কামে যদি বাগড়া দিতে আসো, তয় তুমারো ছাড়ান নাই; ঘর যাও...”

আমিনা আরো সুর নরম করে বলেন,

“এমন পুণ্যময় মাসে কাম, ক্রোধ , লোভ , লালসা, হিংসা বিদ্বেষ, বিভেদ সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় বাবারা...রমজান মাস সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস...এমন কাম করতে নাই...কথা শোন...খুশীর ঈদ আসতাসে। চাঁদরাত ঘোষনা হল বলে...”

ঈদ-উল-ফিতর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে, গড়ে তোলে সবার মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ঐক্যের মেলবন্ধন সেটা বোঝাতে তিনি ব্যর্থ হলেন। 

 কিন্তু না। যেভাবেই হোক তাঁর গ্রামকে, অসহায় মানুষগুলোকে রক্ষা করতেই হবে। আমিনা বিবি সেই রাতেই ছুটে গেলেন ডি. এমের বাংলোয়। দেখা পেলেন না। তিনি নাকি ছুটিতে। ভোরের বেলা দুটি কোনমতে খেয়ে পথ হেঁটে, নৌকা পেরিয়ে, বাস ধরে, ট্রেনে করে তিনি কলকাতা পৌঁছালেন। তিমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে যে দেখা করা যায় না সেটা তাকে বোঝানো গেল না। অফিসের বাইরে তিনি চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কোন এক ডি গ্রুপের কর্মীর আমিনা বিবিকে দেখে মায়া হয়েছিল; সেই মুখ্যমন্ত্রীর কানে কথাটা পৌঁছে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তাকে ঘরে ডেকে নিলেন এবং চিনতেও“লেবুখালির মাতঙ্গিনী মা আজ আমার অফিসে, ঈদের নেমন্তন্ন করতে বুঝি?”

আমিনা তখন রীতিমত হাঁফাচ্ছেন। কথা বলার শক্তি তাঁর নেই। এতটা রাস্তা রোদে গরমে এসেছেন অথচ রোজা ভাঙবেন না বলে একফোটা জল মুখে দিলেন না। অল্পের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীকে সব কথা বুঝিয়ে বললেন।“আপনি ডি. এমের কাছে যান নি?”

“গেসিগো মা...তিনি নাকি ছুটিতে...”

“কে বলল? ঈদে আবার ওর কিসের ছুটি?” সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডি.এম কে ফোনে ধরলেন এবং অর্ডার দিলেন যেভাবেই হোক এই বিপদের হাত থেকে গ্রামকে রক্ষা করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর আদেশে পুলিশ প্রশাসন সব রকম পরিস্থিতির জন্যে তৈরী হয়ে গেল। লোকাল থানা থেকে শান্তি ও সম্প্রীতির বানী প্রচার করা হতে থাকল। ততক্ষনে ঐ অঞ্চলের এম.এল এ ছুটে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে আদেশ দিলেন, “আপনি ও দলের সমস্ত কর্মীরা আজ থেকেই নিজের নিজের এরিয়ায় থাকবেন। এলাকার শান্তি রক্ষা করবেন। এতবড় কন্সপিরেসি চলছে, তার কোন খোঁজই রাখেন নি দেখছি। দাঙ্গা বাধালে কিন্তু কেউ পার পাবে না...জানিয়ে দেবেন সকলকে আর হ্যাঁ। যাবার সময় আমিনা বিবিকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ওনাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। উনি যে আজ কতবড় কাজ করেছেন! আমি রাষ্ট্রপতির কাছে ওনার নামটা ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ডের জন্যে পাঠাবো।”

“আমার পুরস্কারের দরকার নাইরে মা...সাধারন মানুষগুলান পোলাপান লইয়া সুখে থাকলেই আমি খুশী...”আমিনা বিবি আর কথা বলতে পারছিলেন না। চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর কেবিনেই তিনি শুয়ে পড়লেন মেঝেতে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। যেতে যেতেও তিনি বলতে থাকলেন, “ভাই চাঁদ কি দেখা গিসে...”

সেই ডি গ্রুপের কর্মীটি সঙ্গে ছিল। সেই জানাল, “এখনও ঘোষনা হয় নি মাসী...”হঠাৎই আমিনা বিবির বুকের বাঁ দিকটা যন্ত্রনায় ফেটে যেতে থাকে। তাঁর হাত পা গুলো কেমন যেন কুঁকড়ে যেতে থাকল। আমিনা বিবি জোর করে তাকিয়ে থাকতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। বারবার চোখের সামনে শাহানুর আর জাহিরার মুখটা ভেসে উঠতে থাকল। দু চোখ বেয়ে জল নেমে এল। এই কি তবে তাঁর শেষ ঈদ?

অ্যাম্বুলেন্স থেকে যখন তাকে স্ট্রেচারে করে নার্সিংহোমের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। সেই কর্মীটি তাকে ডাকল, “মাসী...ও মাসী...আগামী কাল তোমাদের ঈদ গো...মসজিদ থেকে এইমাত্র ঘোষনা হল..আমিনা বিবি আলতো করে চোখ খুললেন, আকাশের দিকে চাইলেন, দেখলেন কালো আকাশের এক কোনে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। চাঁদ দেখার খুশি তার মুখেও ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর ঠোঁট ততক্ষনে বেঁকে গিয়েছে, তবুও হাসার চেষ্টা করলেন, মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ল, তাঁর মাথাটা একপাশে হেলে রইল। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন, “না! বেঁচে নেই...ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যাটাক...” 

এটাই ছিল আমিনা বিবির শেষ ঈদ। আর এইভাবেই তিনি তার গ্রামকে শেষ ঈদের উপহার দিয়ে গেলেন।

#অনুপ্রেরণা#

.”

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational