Become a PUBLISHED AUTHOR at just 1999/- INR!! Limited Period Offer
Become a PUBLISHED AUTHOR at just 1999/- INR!! Limited Period Offer

Debdutta Banerjee

Inspirational

1.3  

Debdutta Banerjee

Inspirational

কন‍্যাদান

কন‍্যাদান

5 mins
1.4K


সানাইয়ের সুরটা আজ বড্ড করুণ। এলিডি লাইটের আলোয় সেজে ওঠা বাড়িটার দোতলার শেষ ঘরটার বারান্দায় এসে দাঁড়ান সুলেখা দেবী । ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীর ভেঙ্গে পড়তে চায়, কিন্তু এখনো বাকি আছে শেষ কাজ। ঋতজাকে সাজাচ্ছে ওর দুই বান্ধবী। বিদায় হবে আর কিছুক্ষণ পর। সুলেখা দেবী ঠাকুর ঘরে এসে দাঁড়ান, ইঁদুরের মাটি আর মুষ্টি চাল গুছিয়ে রাখা আছে। বিদায়ের শেষ লগ্নে মেয়েটা এই দিয়েই ঋণ শোধ করবে ওঁঁদের। দু চোখ ভিজে ওঠে অজান্তে। 


কাল রাতে কন‍্যাদান করার সময় বুকের বা দিকটায় যে চিনচিনে ব‍্যাথাটা হচ্ছিল সেটাই ফিরে আসে ধীরে ধীরে। ননদ চঞ্চলা বার বার বারণ করেছিল এ বিয়ে দিতে। বুঝিয়েছিল ঋতজাই হবে ওঁঁর শেষ বয়সের লাঠি। কিন্তু সুলেখা দেবী পারেননি, স্বামী গত হতেই পেপারে অ্যাড দিয়েছিলেন ঋতজার জন‍্য। নিজের স্বার্থে একটা বাচ্চা মেয়েকে দাসী বাঁদি বানিয়ে রাখতে মন চায়নি। 


নিচের হল ঘরে এসে দাঁড়ান সুলেখা দেবী। স্বামীর ফটোতে টাটকা রজনীগন্ধার মালা, ধূপের গন্ধ। বিমল বাবু যেন হাসছেন। ভেজা চোখে সুলেখা দেবী বলে ওঠেন,

''আমি পেরেছি, তোমায় দেওয়া কথা রাখতে পেরেছি গো। মেয়ে আমাদের শ্বশুর বাড়ি যাবে আজ। ''


মালাটা ঝুপ করে খসে পড়ে সুলেখা দেবীর গায়ে। বিমলবাবু যেন পুরস্কার তুলে দিলেন নিজের বৌয়ের হাতে।

''ও পিসিমা, তুমি এখানে!! ওদিকে মণ্ডপে দেখো কি কাণ্ড?''

ভাইপো পিকলুর ডাকে সুলেখা দেবী চমকে ওঠেন।

এক অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে অন্তর। তাড়াতাড়ি বিবাহ মণ্ডপে ছুটে যান। ঐ তো কমলা বেনারসীতে লক্ষ্মী প্রতিমার মত লাগছে ঋতজাকে। নৈঋতকে ভীষণ মানিয়েছে ওর পাশে। সম্বন্ধটা পেপার দেখে হলেও নৈঋত এ কদিনে বাড়ির ছেলে হয়ে উঠেছে। কিন্তু মাথা নেড়ে ঋতজা কি বলছে ওদের? এগিয়ে যান উনি। 

ঋতজা ওঁকে টেনে নিয়ে যায় ওধারে। হাতে একটা ছোট্ট পুটুলি, জোর করে সুলেখা দেবীর হাতে পুটুলি তুলে দিয়ে বলে,

''এসব তুমি রাখো মা, আমি এসব নেবো না। ''

সুলেখা দেবী পুটুলি হাতে নিয়ে হতভাগ। ওঁর নিজের শাশুড়ির দেওয়া সীতাহার, রতনচুর আর নবরত্নের কান, এই বংশের ঐতিহ‍্য, যা একমাত্র বৌ হিসাবে উনি পেয়েছিলেন একদিন।


''এসব তো তোর, আমায় দিচ্ছিস মানে?'' অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন উনি।

''না, আমার নয়। তোমার স্ত্রীধন। তোমার শেষ বয়সের সম্বল।''

''ওসব আমি তোকে দিয়ে দিয়েছি। আমার আর কি প্রয়োজন।''

''না মা, এসব তোমার।''

নৈঋত এসে তাড়া দেয়। ঋতজা মণ্ডপে গিয়ে বসে। একে একে আশীর্বাদ শুরু হয়। 

কিন্তু সুলেখা দেবীর পা কেউ গেঁথে দিয়েছে মাটিতে। উনি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন। মনে হয় একটা কুয়াশার চাদর সরে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। 


 সানাইয়ের মিষ্টি আওয়াজ আর আলোর রোশনাই সারা বাড়ি জুরে। বরণডালা নিয়ে অপেক্ষারত মহিলার দল। নতুন বৌ এসে দুধে-আলতায় পা চুবিয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁখে কলস, এয়োর দল হাতে দিয়েছে জ‍্যান্ত মাছ। কিন্তু এ কি অলুক্ষুণে মেয়ে রে বাবা! শাশুড়ির মুখ ভার। মাছটা দিয়েছে ছেড়ে!! কলসির জল ছলকে পড়ে, আর পাথরের থালার থেকে পা তুলে বৌ লাফিয়ে ওঠে!!


কাহনের পছন্দের উপর ভরসা ওর মায়ের কখনোই ছিল না। একে তো বাপ মা মরা মেয়ে, দিদি কোনো রকমে বিয়ে দিয়েছে। কিছুই পায়নি কাহন। তাতে বৌয়ের ঐ চাল। সারাক্ষণ বকবক করছে, ধুপধাপ দৌড়াচ্ছে। মাথায় কাপড় নেই। এই চলল দুজনে ঘুরতে, লাজলজ্জা বড্ড কম। নিজের ঘরে বসে কপাল চাপড়ান কাহনের মা। পেপার পড়তে পড়তে ওর বাবা বলেন শুধু,

''গড়ে পিটে নাও নিজের মতো। ''

বিয়ের দু বছরেও নাতির মুখ দেখতে না পেয়ে আরো ক্ষেপে উঠেছিলেন ঐ মহিলা। বৌয়ের সব কাজেই দোষ ধরতেন। ঘটিবাটিতে ঠোকাঠুকি রোজ, কাহন দেরি করে ফিরত ভয়ে। বৌটি মুখরা না হলেও উচিত বক্তা। বাবা তার নির্বিরোধী আম্পেয়ার। 


কিন্তু হঠাৎ করে ছবিটা কেমন বদলে গেছিল। মাকে দিদার বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল কাহন। গাড়িটাকে সামনে থেকে ধাক্কা মারে একটা ট্রাক। ক্ষণিকের মধ‍্যে সব স্বপ্ন চুরমার। সর্বক্ষণ বকবক করত যে বৌ সে কেমন পাথর হয়ে গেছিল এরপর! শাশুড়িও বিছানা নিয়েছিলেন, বদলে গেছিলেন রাতারাতি। বৌ আস্তে আস্তে ছেলের টাকাকড়ি চাকরী সব পেয়েছিল ধীরে ধীরে। ননদরা বলেছিল এবার ও আবার বিয়ে করে সব নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। সেবা যত্নে শাশুড়িকে সারিয়েও তুলেছিল ঐ বৌ।

তবুও আত্মীয়রা এসব বলত সুযোগ পেলেই।এর কয়েক মাস পরেই ধরা পড়েছিল কাহনের বাবার হার্টের প্রবলেম। দিন রাত এক করে হাসপাতাল ডাক্তার বাড়ি অফিস সামলেছিল নতুন বৌ একাই। ওর সেবার জোরেই ফিরে এসেছিলেন বিমলবাবু। সুলেখাদেবীও বুঝতে পারেননি বৌ থেকে ঋতজা কখন ধীরে ধীরে মেয়ে হয়ে গেছিল! ওঁর চোখের অপারেশন, বিমলবাবুর চেকআপ সব সময়ে ঠিকঠাক করে চলেছিল ঋতজা। ওঁদের নিয়ে পুরীও ঘুরে এসেছিল দুবার। ওর বয়সী মেয়েরা যখন স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে ঘরকন্না করছে ও এই বুড়োবুড়ির সংসার সামলে রেখেছিল। 

বিমলবাবুই প্রথম বলেছিলেন কথাটা, সুলেখাদেবী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। বলেছিলেন,

''এসব কি অলুক্ষুণে কথা !! কাহন নেই তাই বলে এমন অনাচার !!''

সেদিন রাতেও এই নিয়েই ঝগড়া হতে হতেই আবার হার্ট আ্যটাক বিমলবাবুর। 


হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে ঋতজা বলেছিল,

''মা, এখনো আমায় বিশ্বাস নেই!! আমি কোথাও যাবো না, প্লিজ এ নিয়ে বাবাকে আর কিছু বলো না। ''


পনেরো দিন যমে মানুষে টানাটানি, মেয়েটা রক্ত দিয়েছিল। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। 

 ভোর রাতে সুলেখাদেবী স্বপ্ন দেখেছিলেন বিমল বাবু এসে দাঁড়িয়েছেন ওঁর সামনে, চেহারায় নেই রোগ ভোগের কোনো কষ্ট, এক উজ্জ্বল আলো সারা শরীর জুড়ে।

 বিমল বাবু বলেছিলেন,

''কন‍্যাদান হল শ্রেষ্ঠ দান। আমি পারলাম না। তুমি কিন্তু ওর জীবনটা সাজিয়ে দিও। পাপের ভাগি হয়ও না আর।''

ঘুমটা ভেঙ্গে গেলেও ঘরে একটা চেনা গন্ধ পেয়েছিলেন উনি সেদিন, স্নানের পর বিমলবাবু যে অডিকোলনটা মাখতেন তার গন্ধ। তখনি বেজে উঠেছিল বাড়ির ফোনটা। হাসপাতালের ফোন। ঘুম চোখেই ছুটেছিল ঋতজা ওঁকে নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ!


''না, ঐ ইঁদুরের মাটি আর চাল দিয়ে ঋণ শোধ হয় না। আমি এসব মানি না।''

আচমকা ঋতজার গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরে পান সুলেখাদেবী। 

''এই যে বৌমনি, ও তো কনকাঞ্জলী দেবে না বলছে। এবার তবে.....'' ননদের বিষ মেশানো কথা শেলের মত এসে বেঁধে সুলেখাদেবীর গায়ে। ওদের কথার কথার মাঝেই উনি বলে ওঠেন,

''ও তো ঠিকই বলেছে! ঋণ কি ওভাবে শোধ হয়? পেটের মেয়ে না হয়েও ও আমাদের জন‍্য যা করেছে সেই ঋণ কি আমরা কখনো শুধতে পারবো? আমি যখন দুর্ঘটনার পর বেডসোরে ভুগছি ও সব দুঃখ ভুলে আমার সেবা করছে নিস্বার্থ ভাবে। ওর বাবাকে প্রথমবার ঐ বাঁচিয়ে এনেছিল ভুলে যেও না। আজ ঋণ শুধবো আমি।''


নৈঋতের হাতটা টেনে ঋতজার হাতটা ওর হাতে দিয়ে গহনার পুটলিটা ওদের হাতে রেখে সুলেখা দেবী বলেন,

''আজ আমি আমার মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকেও ফিরে পেলাম। কে বলে আমার ছেলে হারিয়ে গেছে! আজ আমি নতুন করে পরিবারকে ফিরে পেলাম। আর এই গহনাটা রইল আমার নাতি নাতনির জন‍্য। আমি জানি কাহন আবার ফিরে আসবে অন‍্য রূপে, নতুন করে। সেই আশায় পথ চেয়ে থাকবে এক মা।''

নৈঋত আর ঋতজা জড়িয়ে ধরে এক মা কে। সানাইয়ের সুরে তখন বিদায়ের তান। 


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational