Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

অ্যালকেমিস্ট

অ্যালকেমিস্ট

8 mins
929


(পর্ব -১)


একেবারে গন্ডগ্রামও নয় আবার পুরোদস্তুর শহরও নয় এমনি এক অখ্যাত অনামী ছোট মফস্বলের বাসিন্দা কৃষ্ণা, জন্মসূত্রে। এই আপাতনিরীহ নিস্তরঙ্গ উচ্ছ্বাসবিহীন ছোটোখাটো জনবসতিটিই কৃষ্ণার ভারী প্রিয়। কৃষ্ণার আজন্মলালিত সমস্ত স্মৃতিমেদুরতা এই ছোট্ট মফস্বলের চাকচিক্যহীন অথচ প্রাণবন্ত সুধারসে পরিপূর্ণতাকে সর্বাঙ্গে মাখামাখি করে।


কৃষ্ণা এবার স্কুলের গন্ডী টপকে কলেজের সিঁড়িতে পা রেখেছে। ওদের মফস্বল শহরের একমাত্র কলেজটি কো-এডুকেশন। কৃষ্ণা যা রেজাল্ট করেছিলো উচ্চ মাধ্যমিকে তাতে করে খুব সহজেই ও বড় শহর বা কলকাতা শহরের ভালো কলেজেই ভর্তি হতে পারতো, কিন্তু দুটি কারণে কৃষ্ণা নিজের এই ছোট্ট শহরের বাইরে যেতে চায় নি। এক....ও নিজে কয়েকটি বাচ্চাকে ট্যুইশন দেয়, তাতে ছেদ পড়বে এবং দুই.... যাতায়াতে বিরাট সময় ব্যয় হয়ে যাবে, কারণ দূর শহরে থেকে পড়ার খরচের চাপ ও বাবার উপর চাপাতে চায় না। সুতরাং এই বিষয়ে কোনো আলোচনার অবতারণাই কৃষ্ণার ঘোর অপছন্দ।



সময়ের গতিতে পা মিলিয়ে কৃষ্ণা ফার্স্ট ইয়ার শেষ করেছে ফার্স্ট হয়ে। অত্যন্ত সাদামাটা আটপৌরে চেহারার কৃষ্ণা যেন সকলের নজরে এলো কলেজে ক্লাস টপার হবার পর। এই সময়ে কৃষ্ণার বেশ কয়েকটি চাটুকার বন্ধুও জুটে গেলো। তবে সুখের বিষয় মাটির মেয়ে কৃষ্ণা, চাটুকারের চাটুকারিতায় ভেসে যাবার মেয়ে ও নয়। দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে সেকেন্ড ইয়ারের শেষ ভাগে কলেজ ইলেকশনের আগে ফাইনাল ইয়ারের ছেলেমেয়েরা কেমিস্ট্রি অনার্স ডিপার্টমেন্টের সেকেন্ড ইয়ারের কৃষ্ণাকে ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে তুলে ধরতে চাইলো। উদ্দেশ্য ভালো ছাত্রী হিসেবে কৃষ্ণার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা। কৃষ্ণা প্রথমে কিছুটা দোনোমোনো করে গররাজী থাকলেও, কি মনে করে শেষমেষ কৃষ্ণা রাজী হয়ে গেলো, ওর নিজের ক্লাসের রিপ্রেজেন্টেটিভের দায়িত্বভার নিতে। 



কৃষ্ণার নিজের প্রতি অগাধ আস্থা এবং কর্মক্ষমতায় সবদিক কৃষ্ণা সুন্দর ব্যালান্স করে চলছিলো। তবে একটু বেশী চাপ পড়ে যায় কৃষ্ণার ওপর যখন ক্লাসের শেষে স্টুডেন্ট'স ইউনিয়নের কোনো মিটিং থাকে। এছাড়া কৃষ্ণা সাংঘাতিক বিরক্ত বোধ করে যখন দেখে স্টুডেন্ট'স কাউন্সিলের আলোচনায় বা কর্মসূচী পালনের সময় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অতিসক্রিয়তা মাত্রা ছাড়াচ্ছে। কলেজের জিএস শুভজিৎকে কৃষ্ণা নিজের অপছন্দের একথা আকারে ইঙ্গিতে জানিয়েওছে।



ফাইনাল পরীক্ষা কড়া নাড়ছে, এমন সময়ে একদিন কৃষ্ণা আর তার চার সহপাঠী বাড়ীর পথে। নির্ধারিত সময়ের থেকে পরীক্ষা কিছুদিন পিছিয়েছে। কৃষ্ণারা এই বাড়তি সময়টুকুতে কলেজে ল্যাবরেটরিতে প্র্যাকটিক্যালের কিছু বাড়তি ক্লাসের জন্য প্রিন্সিপাল স্যারের বিশেষ অনুমতি আদায় করেছে। সেদিনই স্পেশাল ক্লাসেরও শেষ দিন ছিলো। এরমাঝেই একদিন ওরা ফর্ম ফিলাপ করেছে। কলেজে আসবে এরপর একদম এডমিটকার্ড নেওয়ার দিনে। তাই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা আদান-প্রদান সেরে নিচ্ছে। বাকী বন্ধুদের বাড়ী যে পাড়ায়, কৃষ্ণাদের বাড়ী সে পাড়ায় না, পাশের পাড়ায় কৃষ্ণার বাড়ী। বন্ধুরা নিজেদের পাড়ায় ঢুকে গেলো। কৃষ্ণাকে একটা গলি একা পেরোতে হবে নিজের পাড়ায় পৌঁছতে। কৃষ্ণার চকিতে মনে হোলো ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ইশারায় কেউ যেন ওকে লক্ষ্য করছে, কিন্তু যতদূর চোখ গেলো আশপাশ ফাঁকাই দেখলো।


---------------------------------------


(পর্ব - ২)


কৃষ্ণারা এডমিটকার্ড নিয়ে ফিরছে। ইউনিভার্সিটি থেকে এডমিটকার্ড কলেজে এসে পৌঁছতে নির্ধারিত সময়ের থেকে অনেকটা দেরী হয়েছে। এদিকে ঠিক পরীক্ষার আগেই আরেকদিন আবার কিছুটা পড়ার সময় নষ্ট করতে চায় না, তাই ওরা সেদিনই অপেক্ষা করে এডমিটকার্ড নিয়েই ফিরছিলো। বিকেল শেষ কিন্তু সন্ধ্যা পুরো নামে নি, পাড়ার পথে তেমন ব্যস্ততা এসময় থাকে না। পাড়ার মাঠের খেলুড়েরা এখন যে যার ঘরে অথবা গৃহশিক্ষকের টোলে পুঁথিপোড়ো। পাড়ায় গুরুজন স্থানীয়েরা এখনো অফিসফেরতা ব্যাগ হাতে অমিল। এবাড়ী সেবাড়ীতে টিভি চলার বিবিধ ঝমঝমে আওয়াজ। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তায় কৃষ্ণা দ্রুত পা চালালো। আর একদিন ও বাচ্চাদের পড়াবে নিজের পরীক্ষার আগে, তারপর একদম পরীক্ষার পরে পড়াবে। নিজের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিকি বাকী রইলো, বন্ধুদের কারুর কাছে ওর নিজের কোনো বইখাতা-নোটস রয়ে গেলো কিনা, ইত্যাদি নানান আগডুম বাগডুম চিন্তা মাথায় নিয়ে কৃষ্ণা পথ পেরোচ্ছে। এমন সময় ওর ডানপাশে একটা মোটর সাইকেল পুরোপুরি না থেমে একেবারে স্লো হয়ে গেলো।



ভয়ঙ্কর জ্বালা যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তেই কৃষ্ণা চিনতে পেরেছিলো অ্যাসিডের গন্ধটা, কেমিস্ট্রির ছাত্রী তো। তারপরের সময়টাতে ঠিক কী কী হয়েছে, কেমন ভাবে হয়েছে, তার কোনো হিসেবনিকেশ কৃষ্ণার জানা নেই। অবশ্য জানা থাকার কথাও নয়। কৃষ্ণার জীবনটাকে ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেলো একদিন হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী এক ঘটনা।



প্রায় বছর ঘুরতে চললো। কৃষ্ণা রাজ্যের রাজধানীর হাসপাতালে বিছানাবন্দী। কৃষ্ণার চিন্তাসূত্র ওলটপালট হয়ে দুর্ভেদ্য গিঁট পড়ে গেছে। কৃষ্ণা চোয়াল শক্ত করে রাগ পুঞ্জীভূত করার ক্ষমতাটুকু এখনো ফিরে পায় নি। ফিরে পায় নি সে গিঁট খুলে আবার জীবনস্রোতে ফেরার দিশা। দুবার হাসপাতাল বদলও হয়েছে, চিকিৎসার জটিলতায় এবং একাধিক অপারেশনের কারণে। কৃষ্ণা অনুমান করে, বাবা হয়তো সর্বস্বান্ত, দাদার উচ্চশিক্ষা বোধহয় মুখ থুবড়ে পড়েছে, মায়ের গয়নার ছিটেফোঁটাও হয়তো অবশিষ্ট নেই। আর তার নিজের ভবিষ্যৎই বা কি? ভাবতে পারে না কৃষ্ণা। তার চোখের জলও তার অ্যাসিডে পুড়ে গলে যাওয়া গর্তাকৃতির ডানচোখটাকে দেখে ভয় পায়। শরীরের ডানদিকের যতটুকু অংশ কৃষ্ণা বাঁচোখ দিয়ে দেখতে পায় তাতে সে এটুকু বোঝে মা কেন একদিনও ওর সামনে দু-এক মিনিটের বেশী থাকে না। তবে কৃষ্ণা এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই ঘটনাক্রম একত্রিত করার চেষ্টা করে চলেছে, প্রাণপণ সাজাচ্ছে ঘটনাপ্রবাহকে। পিছনে ছুটছে কৃষ্ণার মন মিসাইল গতির দ্রুততায়.... অতীতে।


--------------------------------------------------


(পর্ব -৩)


কলেজের ইলেকশনের দিন চারেক আগে একটা স্টুডেন্ট'স ইউনিয়নের মিটিং ছিলো, ঐ মিটিঙে হাজির ছিলো শহরের কিছু খুচরো নেতাও। যদিও তারা তেমন ধর্তব্যে ছিলো না। গোলমাল পাকালো কৃষ্ণাদের পাশের ওয়ার্ড, অর্থাৎ জিএস শুভজিৎদের ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের ভাইয়ের গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পাঁচালীর সুরে বক্তৃতাটা। সেদিনের মিটিঙে বক্তৃতা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে অসহ্য ঠেকায় কৃষ্ণা জিএসের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বাড়ী চলে যাচ্ছে জানিয়ে শুভজিতের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ইউনিয়ন রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। আর কৃষ্ণার এই চলে যাওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো।



পরেরদিনই বিকেলে কলেজ থেকে ফেরার সময়, কাউন্সিলরের চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী ভাই দুলাল চাঁদ এনফিল্ড মোটর সাইকেলের বিকট ভটভট আওয়াজে শব্দদূষণ ঘটিয়ে, পিছনে বশংবদ এক শাগরেদকে চাপিয়ে, কৃষ্ণার পাশে এসে থামলো। কৃষ্ণা ওদের আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিলো। কিন্তু কিছু বলার আগেই দুলাল চাঁদ তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁত বার করে কান এঁটো করা হাসি হেসে বলে ফেললো, "কোন্নো অস্সুবিধা হোল্লে আমাকে জানাবে, স্সব আমি স্সামলে দোবো, কোন্নো চিন্তার কিচ্চু নেই।" এবার শাগরেদটির গলা, "দাদ্দা স্সব হেল্প করে দেব্বে।" কৃষ্ণা অতিকষ্টে রাগ সম্বরণ করে কেটে কেটে বললো, "আমার কোনো অসুবিধা নেই।" কৃষ্ণা পাশ কাটিয়ে বাড়ীর পথ ধরলো। এরপর ফাইনাল পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ হওয়া পর্যন্ত রোজই দুলাল চাঁদ কৃষ্ণার পথে আবির্ভূত হতে থাকলো, ঠিক বন্ধুদের পাড়া পার হয়ে নিজের পাড়ায় ঢোকার মধ্যবর্তী সময়টাতে। সেই একই ভাবে দন্তব্যাদন করে, উগ্রগন্ধী ডিও আর ঘামের মিশ্রগন্ধ ছড়িয়ে, কোনো না কোনো অছিলা ঠিক দুলাল চাঁদ খুঁজে বের করে নিয়ে কৃষ্ণার মুখোমুখি হয়ে যায়।




ফর্ম ফিলাপের দিনে বাড়ী ফেরার পথে ঘটলো এক সাংঘাতিক অপ্রীতিকর ঘটনা, কৃষ্ণা পা চালিয়ে ফিরছে অন্যান্যদিনের থেকে বেশ খানিকটা আগেই। রাস্তা শুনশান ফাঁকা, কৃষ্ণা ছাতা খুলেছে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে, পরীক্ষার আগে ভিজে শরীর খারাপ হবার ভয়ে। কৃষ্ণার ছাতায় পেছন দিক থেকে একটা টান, কৃষ্ণা ঘাড় ঘোরাতেই দুলাল চাঁদকে দেখে ওর মনটা একদম তিতকুটে হয়ে গেলো। কিন্তু রোজকার মতোই কৃষ্ণা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চেষ্টা করতেই দুলাল চাঁদ খপ করে কৃষ্ণার হাতটা ধরে অবলীলাক্রমে বলে ফেললো, "আম্মি তোমাকে ভালবাস্সি জ্জানু, তোমাকে ব্বিয়ে কত্তে চ্চাই।" কৃষ্ণার কানে যেন গরম সীসা ঢেলে দিলো কেউ। কৃষ্ণার মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কয়েক মুহূর্তের ভগ্নাংশমাত্র সময় নিয়ে কৃষ্ণা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে, দুলাল চাঁদের গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে, ছাতার মায়া ত্যাগ করে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো বাড়ীর দিকে। 



স্বভাবচাপা কৃষ্ণা এতোবড় ঘটনা বেমালুম নিজের মধ্যেই চেপে রেখে দিলো, কাউকে ঘূর্ণাক্ষরেও কিছু জানালো না। এই ঘটনার পর আরও কয়েকটা দিন কৃষ্ণারা কলেজে গেছে এবং দুলাল চাঁদ আর কোনো উৎপাত না করায় ঘটনাটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করলো কৃষ্ণা। আর তাই বোধহয় ওর সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদও খানিকটা ফিকে হয়ে গেলো। এরকম মোক্ষম সুযোগেই ঘটে গেলো সুনামির বেগে বীভৎস এই দুর্ঘটনা। কলেজফেরতা কৃষ্ণা অ্যাসিড আক্রান্ত হোলো।


------------------------------------------


(পর্ব - ৪)


হাসপাতাল থেকে এবার ছাড়া পাবে কৃষ্ণা, ডাক্তার- বাবু ও নার্স সেরকমই জানিয়েছেন। তবে এই ছুটির খবরে কৃষ্ণা খুশী হতে পারে নি, পারে নি সঞ্চয় করতে এখনো বাস্তব পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাইক্লোন বিধ্বস্ত জীবনটা মোকাবেলা করার মানসিক দৃঢ়তা। কৃষ্ণা যেন নিজেরই ধ্বংসস্তুপের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভূত-ভবিষ্যৎ যে দিকভ্রষ্ট হয়ে বর্তমানের ব্ল্যাকহোলের ভেতরে কোথায় হারিয়ে গেছে তার হদিশ কৃষ্ণার কাছে আপাতত এই মুহূর্তে নেই। 



বাবা আর দাদা হাসপাতাল থেকে ছুটির কাগজ পত্রের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের তদারকিতে ব্যস্ত। কৃষ্ণা ফিমেল ওয়ার্ডের বাথরুমের দেওয়ালে লাগানো জলের ছিটে খেয়ে খেয়ে ঝাপসা আয়নাটাতে সাহস করে একবার তাকালো। কৃষ্ণার সর্বাঙ্গ হিস্টিরিয়া রুগীর মতো এলোপাথাড়ি থরথরিয়ে কাঁপছে। এক আয়ামাসীর নজরে পড়ে যাওয়ায় কৃষ্ণা পড়ে যায় নি মেঝের শানে। কৃষ্ণার নতুন করে গজাতে শুরু করা নরম স্পর্শকাতর চামড়ায় টান ধরেছে, বাষ্পীভূত অশ্রুতে চোখ ঝাপসা। প্রথমবারের জন্য কৃষ্ণার মনে হোলো সে মরে গেলো না কেন?



কী লম্বা এক পথ পরিক্রমণে বেরোতে বাধ্য হোলো কৃষ্ণা! এ কী এক যন্ত্রণাময় অসহায়ের জীবন যাপন করে চলেছে কৃষ্ণা। কী দীর্ঘ যে সে আইনি লড়াই, কী দুর্বিষহ করুণাভিক্ষার জীবন, কী অমানবিক সামাজিক অবস্থান! আর ততোধিক তার হার না মানার জেদ। বিপুল খরচবহুল চিকিৎসা কুশ্রী কুরূপকে ঢাকতে। দয়া-দাক্ষিণ্য মৌখিক স্তর পেরিয়ে বাস্তবায়নে পৌঁছতে না পারায় কৃষ্ণা এবার অন্যরকমভাবে ভাবতে শুরু করলো। কৃষ্ণা হয়ে উঠলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, মুখ লুকিয়ে সে চলবে কেন? অন্যায় তো সে করে নি, আবার এক অন্য লড়াই শুরু হোলো, মূলস্রোতে ফেরার। তবে ফিরবো বললেই তো আর ফেরা যায় না! সমাজ আর তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককগুলি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করলো। এগোবার পথ দুর্গম পিচ্ছিল, উপদেষ্টা অগণিত, সহানুভূতি বিলোনোর ব্যক্তি প্রচুর, হতোদ্যম করার ব্যক্তি প্রচুর, কিন্তু প্রকৃত সহযোগী একেবারেই মুষ্টিমেয়! তবে কৃষ্ণা কিন্তু স্থিরসিদ্ধান্ত। কর্দমাক্ত পথে চলার কায়দাটা যে ততক্ষণে কৃষ্ণা রপ্ত করতে শুরু করে দিয়েছে।



এতদিনের চেনাশোনা ছকের বাইরে বেরিয়ে জানাচেনা গন্ডী থেকে দূরে সরে গিয়ে কৃষ্ণার লড়াই শুরু হোলো। এ এক নতুন লড়াই। ইতিহাসে এ লড়াইয়ের পদাঙ্ক নেই। তবু কৃষ্ণাকে এগোতেই হবে নিজের চলার রাস্তা নিজেকেই তৈরী করতে হবে আর সেই পথে সামিল করতে হবে, একত্রিত করতে হবে তার মতোই যারা অ্যাসিড আক্রান্ত তাদের। কৃষ্ণা প্রথমে বিএসসি ফাইনালটা দিয়ে ডিগ্রি হাতে নিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ অনুমতি ও সহায়তায়। এরপর কৃষ্ণা পারতো নিজের জন্য একটা কোনো চাকরি বাকরি জোগাড় করে নিজের মতো নিজে থাকতে, কিন্তু কৃষ্ণা তা করে নি স্বার্থপরের মতো।



কৃষ্ণা একটি ব্যতিক্রমী মুখ হয়ে উঠলো। চেহারার আক্ষরিক বীভৎসতাই যার সৌন্দর্য্য, অবর্ণনীয় মনোবল যার ঐশ্বর্য্য। আর তাইই তাকে জিতিয়েছে দীর্ঘ আইনি লড়াই। ফলশ্রুতিতে আদালতের রায়ে বন্ধ হয়েছে খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি। সংগঠিত হতে পেরেছে অ্যাসিড আক্রান্তরা। তৈরী হয়েছে অ্যাসিড অ্যাটাক সা‌রভাইভারদের সামান্য হলেও পুনর্বাসনের সুযোগ। সর্বোপরি রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় তৈরী হয়েছে অ্যাসিড অ্যাটাক সারভাইভারদের ও তাদের পরিবারের। কিছুজন বিধ্বংসী মানসিক আঘাত সামলে ফিরে পেয়েছে ভারসাম্য, মিশে যেতে পেরেছে সমাজের মূল স্রোতে। আর বৃদ্ধি করতে পেরেছে রাষ্ট্রের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় ক্ষীণকায় হলেও প্রয়োজনীয় সামান্য জনসচেতনতা।



কৃষ্ণা নিজের স্বামী সন্তানকে জড়িয়ে ভাবে, এ জীবনের প্রাপ্য তো অর্জন সে করতে পেরেছে, তবে আত্মতৃপ্ত হতে পারে নি। সহমর্মিতার সমবেদনায় সে আছে আজও টর্ণেডোর কৃষ্ণগহ্বরে পাক খেতে থাকা দিকভ্রান্ত সব অ্যাসিড সারভাইভারদের সাথে-পাশে-মনে সর্বান্তঃকরণে। গড়ে তুলেছে সাংগঠনিক প্রতিবাদ। প্রতিবাদের প্রতিমূর্তি কৃষ্ণা হয়ে উঠেছে সদর্থক যাজ্ঞসেনী। তীব্রগন্ধী অ্যাসিডের ধোঁয়ায় - জ্বলনে - দহনে তার জন্ম। অ্যাসিডে ঝলসানো দগদগে ক্ষত কৃষ্ণাকে "খাঁটি সোনার মূর্তি যাজ্ঞসেনী"তে রূপান্তরিত করে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছে। জীবনযুদ্ধের সৈনিকেরা আজ আর শুধুমাত্র অ্যাসিডযুদ্ধের মৃত সেনানী নয়, এক অ্যালকেমিস্টের স্পর্শে সেই সর্বহারারা অমর-অজর-অক্ষয়-অনির্বাণ-অনির্বচনীয় মানবীসব। আর তাদের স্বর্ণময় হৃদমাঝারে ভাস্বর হয়ে সেই অমর্ত্যলোকের অ্যালকেমিস্ট... রক্তমাংসের "যাজ্ঞসেনী কৃষ্ণা!"


-----------------------------------------------------------

তথ্যসূত্র: মর্মান্তিক এই কাহিনীর সত্যতা সমগ্র দেশের সংবাদ মাধ্যম এবং গুগল সার্চ সম্মত......স্থান কাল পাত্র এবং বিন্যাস পরিবর্তিত কাহিনীর স্বার্থে।

-----------------------------------------------------------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational