Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

arijit bhattacharya

Drama Romance

5.0  

arijit bhattacharya

Drama Romance

শোণিতপুরের সেই অমর প্রেমগাথা

শোণিতপুরের সেই অমর প্রেমগাথা

9 mins
1.3K


সুদৃশ্য অসম হিমালয়ের বুকে সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা প্রকৃতির কোলে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত মন মাতানো সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা 'অনন্ত প্রেমের নগরী' শোণিতপুর বা তেজপুর। গুয়াহাটি শহর থেকে মোটামুটি 175 কিলোমিটার দূরত্বে। দূর দিগন্তে ঢেউ খেলানো সবুজ অসম হিমালয়, মন মাতানো সুন্দর চা বাগিচা,শহরের মধ্যে পরম পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছে মহাভৈরব আর ভৈরবীর মন্দির, সুদৃশ্য নামেরী জাতীয় উদ্যান। সারা শহর যেন এক অনুপম সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা। চারদিকে বিরাজ করছে শুধুই সুন্দরতা! তবে এই তেজপুর যেমন 'অনন্ত প্রেমের শহর'(city of eternal love) , এখানে আকাশ বাতাসে বিরাজ করছে শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ এবং শিবভক্ত দৈত্যসম্রাট বাণাসুরের কন্যা উষার অনুপম প্রেমকাহিনী,তেমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এক মহাযুদ্ধের কলঙ্কিত ইতিহাস। এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকা। নররক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এখানকার ধরণী। তাই তো এর আরেকনাম শোণিতপুর! 


হাজার হাজার বছর আগের কথা। এখানে রাজত্ব করতেন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু। তাঁর পরাক্রম,অমরাবতীবাসী দেবতাদের ওপর তাণ্ডব,বিষ্ণুদ্বেষ আর কঠিন তপস্যার কথা তো সর্বজনবিদিত। ফলাফলস্বরূপ শ্রীবিষ্ণুর অবতার নরসিংহের হাতেই মৃত্যুবরণ করতে হয় তাঁকে। সকলে জানল এটাই, কিন্তু চাপা পড়ে গেল অন্য এক কাহিনী। অনেকেই জানে না,হিরণ্যকশিপু আসলে হলেন বৈকুন্ঠে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর দ্বাররক্ষী বিজয়। চার কুমারের অভিশাপে, তাকে মাতা দিতির গর্ভে জন্মাতে হয়েছিল দৈত্যকুলে। বিজয় যখন শাপগ্রস্ত হয়ে বিষ্ণুর কাছে যান ,তখন ভগবান বিষ্ণু তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে,তিনি স্বয়ং তাঁকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেবেন। নরসিংহের হিরণ্যকশিপুকে বধ আসলে এক বিপথগামী ভক্তকে ভগবানের উদ্ধার করারই কাহিনী।যাই হোক,এই হিরণ্যকশিপু ও তাঁর পুত্র পরম বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদেরই বংশের একজন বাণাসুর,যিনি এই রূপকথার কাহিনীর অন্যতম চরিত্র।


হিরণ্যকশিপুর মৃত্যুর পর হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। ত্রেতাযুগ শেষ হয়ে দ্বাপরযুগও শেষ হব হব করছে। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ সবে সমাপ্ত হয়েছে।মহাকালের কালচক্রে বলি হয়েছেন গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম,অঙ্গরাজ কর্ণ,মদ্ররাজ শল্য,পরশুরাম শিষ্য গুরু দ্রোণাচার্য্য।বীর যোদ্ধাদের শোণিতে লাল হয়ে গিয়েছে সারা ভারতভূমের মাটি। ঘোষিত হয়েছে পাণ্ডবদের জয়ধ্বনি,শাশ্বত প্রমাণিত হয়েছে ধর্মের বিজয়। তা সত্ত্বেও শস্যশ্যামলা ধনধান্যে পুষ্পে ভরা কামরূপের এই অঞ্চলটাতে মহা যুদ্ধের ধ্বংসলীলার খুব একটা আঁচ পড়ে নি।

বসন্তের এক সুন্দর সকাল। রাজপ্রাসাদের পুষ্পোদ্যান। সুন্দর এক রৌদ্র ঝরা সকালে স্নানসিক্ত কেশে শরীরে জুঁইফুলের সুবাস নিয়ে একঝাঁক সখীর কলতানের মধ্যে মহাভৈরব মন্দির থেকে পূজা সেরে পূজার থালি নিয়ে বেরিয়ে এলেন এক উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী। কেউ যদি পূর্ণিমার জ্যোৎস্নারাতে স্নিগ্ধ চাঁদের জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করে থাকে,তাহলে সে তখনি অনুভব করত যে এই তরুণীর মুখমণ্ডল আর পূর্ণিমারাতে চাঁদের জ্যোৎস্নার মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ নেই। বর্ষাঋতুতে যেমন কোনো নদী পূর্ণসলিলা হয়ে ওঠে,তেমনই শরীরে নারীত্বের পূর্ণবিকাশে এই তরুণীও পূর্ণযৌবনা। তরুণীর চালচলনে স্বভাবসুলভ স্থিরতা ও গাম্ভীর্য বিদ্যমান। প্রথম দর্শনেই প্রতীত হবে,এই সুললিতা হরিণীনয়নী সুস্তনী তরুণী কোনো অভিজাত পরিবারের কন্যা। টানা টানা আঁখির গভীরতায় জগতের সব সুন্দরতা প্রতিফলিত। তবুও আজ কেন মনে হয়, অন্যদিনের মতো আজ সেই স্থির ব্যক্তিত্বপূর্ণ গজেন্দ্রগমন নেই। তার পরিবর্তে কিছুটা আছে অস্থিরতা,কিছুটা আছে ভীরুতা,কিছুটা আছে চাঞ্চল্য,কিছুটা আছে দ্বন্দ্ব। আর এইসব অনুভূতি মিশ্রিত হয়ে তরুণীর চন্দ্রমাকিরণ সুলভ স্বভাবকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে। সৌন্দর্যের প্রতিমার রূপের আভায় কোথাও ছাপ ফেলেছে কালিমা!হৃদয়ে সেই স্থিতধী গাম্ভীর্য নেই,তার পরিবর্তে আছে প্রথমবারের জন্য প্রেমপরিপূর্ণ হৃদয়ের আবেগমথিত হৃদস্পন্দনের তীব্রতা। সখীরাও হয়তো জানে,তাদের রাজকুমারী কারোর হৃদয়হারিণী হয়েছে। ভালোবাসার শর বিদ্ধ করেছে রাজকুমারী উষার কোমল হৃদয়কে। কিন্তু তারা কেউ জানে না,কে সেই আগন্তুক যে প্রবল পরাক্রমী দৈত্যরাজ বাণাসুরের কন্যার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে। কেউ জানে না,সত্য টা কি! একমাত্র রাজকুমারীর অন্তরে প্রোথিত আছে সেই গভীর গোপন সত্যটা।

বিকেলে পশ্চিম আকাশে একরাশ আবির ঢেলে সূর্য যখন অস্ত যায়,তখন রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন গোলাপের বাগিচায় সখীদের থেকে দূরে কিছুটা নিঃসঙ্গ ভাবেই বিচরণ করেন রাজকুমারী। উড়ে আসে পায়রা দূর নীল গগন থেকে। পায়রার মুখ থেকে রাজকুমারী তুলে নেন তার বহুল প্রতীক্ষিত চিরকূট। না,আজো পূর্ণ হয় নি আশা তাঁর । বিরহীর অশ্রুতে ভরে ওঠে তাঁর চোখ।


দেবভূমি ভারতভূমের পূর্বপ্রান্তে কামরূপে অবস্থিত এই শোণিতপুর। এখন আমাদের যেতে হবে এই শোণিতপুর থেকে অনেক হাজার হাজার মাইল দূরে। ভারতের পশ্চিমে সুদৃশ্য সুন্দর রাজ্য দ্বারকা, যে রাজ্যের অধিপতি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং।বাসুদেব মানুষ হয়েও তাঁর মধ্যে দৈবসত্ত্বা বিরাজমান। বাসুদেবের শাসনে পুণ্যভূমি দ্বারকার সমৃদ্ধি তখন শীর্ষে। সারা ভারতের রাজগণ বাসুদেবের দৈবশক্তিকে স্বীকার করেন,তাঁকে মানেন- ব্যতিক্রম শুধু কামরূপের এক দুরাচারী , যার নাম বাণাসুর। যাই হোক,এই দ্বারকার একপ্রান্তে সমুদ্রতীরে অবস্থিত এক সুদৃশ্য স্থানের নাম প্রভাস । এটি তীর্থও বটে। উষার ব্রাহ্মমুহূর্ত। সেই ধবল সমুদ্রসৈকতে চিন্তিত মনে  বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন এক বিংশতিবর্ষীয় যুবক। যুবকের দৃষ্টি সামনের অসীম নীলিমায় নিবদ্ধ। তা সত্ত্বেও তিনি উদাস। তাঁর মনে চলছে অন্য চিন্তা। কে সেই পীবরোন্নতবক্ষা অষ্টাদশী,যে তাঁর স্বপ্নে বারবার আসে! তাঁর শরীর আর মনকে শিহরিত করে,যার প্রেম পাবার জন্য বারবার উন্মুখ হয়ে ওঠে তাঁর হৃদয়! কে সেই উদ্ভিন্নযৌবনা রমণী। তাঁর পিতামহ তো সর্বজ্ঞ,জগতের কোনো কিছুই তাঁর অবিদিত নয় । তা সত্ত্বেও প্রথম প্রেমে পড়ার লজ্জা আর ভয়ে তিনি পিতামহের কাছে উত্থাপন করতে পারেন না,এই নারীর কথা। একবার হস্তিনাপুরে তিনি মহর্ষি ব্যাসকে সঙ্গোপনে পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন স্বপ্নে দেখা সেই তরুণীর সম্পর্কে, যাকে স্বপ্নে একবার দেখামাত্রই কামদেবের শর বিদ্ধ করেছে প্রবল প্রতাপশালী বাসুদেবের পৌত্র অনিরুদ্ধকে। হয়তো ত্রিকালদর্শী বাসুদেবের কাছে তাঁর পৌত্রের স্বপ্নে দেখা এই রাজকন্যার কথা অবিদিত নয়,কিন্তু তা সত্ত্বেও পিতামহ বাসুদেবকে তিনি ভয় যথেষ্ট পান। মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসও তো ত্রিকালজ্ঞ, তিনিও ত্রিকালদর্শী। আর মহর্ষি তাকে যথেষ্ট স্নেহও করেন।


বসন্তের এক সোনালী বিকাল। নানা রঙের পুষ্পে সেজে উঠেছে প্রকৃতিরাণী। ফুরফুর করে বইছে দখিনা বাতাস। দূরে দিগচক্রবালে অস্তাচলে চলেছেন দিবাকর। কুরুক্ষেত্রের অদূরেই দ্বৈপায়ন হ্রদ। হ্রদের সলিল স্বচ্ছ,স্ফটিকের মতো। ঢেউশূন্য,স্থির। হ্রদে বিভিন্ন পরিযায়ী পক্ষীদের আনাগোনা। তাদের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারদিক। সেই শান্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে,হ্রদসংলগ্ন এক পর্ণকুটিরে শান্ত সমাহিত ধ্যানমগ্ন মহর্ষি ব্যাস। কুটিরের দরজা ধীরে ধীরে প্রবেশ করল। সেই কুটিরে প্রবেশ করলেন সৌম্যকান্তি সুদর্শন রাজকুমার অনিরুদ্ধ । আজ তিনি কিছুটা উদ্বিগ্নও বটে! নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য মহর্ষির ধ্যানভঙ্গ করা কি ঠিক হবে! অথচ নিজের মনে আবেগ এবং উদ্বেগের মধ্যে তো বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে। প্রয়োজনের কথা তো না বললেই নয়! কি করা উচিত আর কিই বা অনুচিত,ভেবে দিশাহারা হয়ে পড়েন অনিরুদ্ধ। তবে তাঁর উদ্বেগ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ধীরে ধীরে নিজেই নয়ন উন্মীলিত করেন মহর্ষি। অনিরুদ্ধকে স্নিগ্ধ হাসিতে ভরে যায়,তাঁর তপস্যাক্লিষ্ট মুখ। মহর্ষিকে শুধান অনিরুদ্ধ তাঁর স্বপ্নে আসা সেই অপরূপা মোহময়ী সুস্তনী রাজকুমারী সম্পর্কে। সব শুনে স্মিত হাসেন ব্যাস। সত্যিই,এই পূর্বরাগ কতো অদ্ভূত জিনিস! স্থান ,কাল,পাত্র কোনো কিছুকেই মানে না । নাহলে,দ্বারকাধীশ বাসুদেবের পৌত্র কেনই বা প্রেমে পড়বেন কামরূপাধিপতি প্রবল বাসুদেববিরোধী বাণাসুরের কন্যার! সত্যিই,প্রেম দ্বেষকে ভুলিয়ে দেয়,মনের গরলকে অমৃতে রূপান্তরিত করে। কিন্তু,পূরণ হবে কি এই সুন্দর যুবকের মনস্কামনা। স্থান,কাল ,পাত্র সবই তো এই প্রেমের প্রতিকূল। নিজের অনুমানকে বিবেচনা করলেন মহাজ্ঞানী ব্যাস,না এই প্রেমের সাফল্য সত্যিই কঠিন,কারণ দ্বারকা নগরীতে যাঁর অঙ্গুলিহেলনে সব কিছু সম্পন্ন হয় সেই মহাশক্তিমান বাসুদেবের জন্য এই প্রেমকে মেনে নেওয়া সত্যিই খুব কঠিন। না,বাসুদেব রাজি হবেন না এই সম্পর্কে। কিন্তু ,সারা ভারতকে যদি একসূত্রে গাঁথতে হয়,সারা ভারতকে বাসুদেব যদি নিজের ছত্রছায়ায় আনতে চান,সুদূর পশ্চিমের দ্বারকার সঙ্গে সুদূর পূর্বের সুদৃশ্য কামরূপের শোণিতপুরের মিত্রতা গড়ে তুলতে চান যেটা ভারতবর্ষের ঐক্যের পক্ষে অপরিহার্যও বটে,তাহলে এই পূর্বরাগ যার অনুরাগে পরিণত হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা,তার গুরুত্ব অপরিহার্য।

হ্যাঁ,তিনি মহাজ্ঞানী,তিনি দৈবশক্তির অধিকারী। তাঁকে প্রয়াস করতেই হবে,যে দৈববলে অনিরুদ্ধের স্বপ্নে শোণিতপুরের রাজকুমারী উষার চিত্র ফুটে উঠে অনিরুদ্ধের মনে ক্ষণস্থায়ী পূর্বরাগ জন্ম নিয়েছে,সেই ক্ষণস্থায়ী পূর্বরাগ যেন দীর্ঘস্থায়ী অনুরাগে পরিণত হয়। আজ সারা ভারত কামনা করে শ্রীকৃষ্ণ ও শিবভক্ত বাণাসুরের মিত্রতা। আর এক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে ভালো কি হতে পারে। সম্ভব হলে তিনি অবশ্যই বাসুদেবের সাথে কথা বলবেন,বাসুদেবকে এই প্রেমের পরিণতি ও ভবিষ্যৎ একটু ভেবে দেখতে বলবেন। তিনি তাঁর যথাসাধ্য করবেন।

মহর্ষি ব্যাসের দৈববলে কামরূপের রাজকুমারী উষার স্বপ্নেও ভেসে ওঠে অনিরুদ্ধের সুন্দর মুখমণ্ডলের চিত্রপট। প্রেমের জোয়ারে ভেসে যায় জম্বুদ্বীপের দুই প্রান্তে থাকা এক সদ্যযুবক ও এক সদ্যযুবতী। স্বপ্নে যুবকের কাঁধ অবধি ঘনকৃষ্ণ কেশ, পেশীবহুল দেহ ,চোখের চঞ্চল দৃষ্টি ,অদ্ভূত পরাক্রম যুবতীর মধ্যে সৃষ্টি করে প্রথম প্রেমোদ্দীপনা,চিত্তচাঞ্চল্য, মনে উত্তেজনা। রাজকুমার অনিরুদ্ধও শিহরিত হয়ে ওঠেন যুবতীর দেহবল্লরীর সৌন্দর্যের প্রথম সন্দর্শনে। ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে পূর্বরাগ। শরীর মনের কামনায় ভেসে যায় দুই সত্ত্বা। 


কোনো এক নিদাঘের রাত্রি। বাতায়ন থেকে আসছে মৃদুমন্দ বাতাস। মহামূল্যবান পালঙ্কে শুয়ে অঘোরে নিদ্রা যাচ্ছেন অনিরুদ্ধ। আজ তার স্বপ্নে ভেসে ওঠে এক অজানা দেশ। এই দেশের প্রকৃতির সাথে তাঁর রাজ্য দ্বারকার কোনো মিল নেই। সবুজ হিমালয়ের কোলে অবস্থিত পুষ্পপত্রে সজ্জিত বনানীতে পরিপূর্ণ এক অপরূপ রাজ্য। কি সুন্দর এখানের নিসর্গপ্রকৃতি! দিগচক্রবালে পাহাড়,আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ধূসর মেঘপুঞ্জ। বনে আছে হরিণ,একশৃঙ্গ গণ্ডার। বেশ বোঝা যায়,বর্ষাঋতু সমাগত। সেখানে আছে সুন্দর সুদৃশ্য কামাখ্যাদেবীর মন্দির। মা সদাই জ্যোতির্ময়ী,ব্যাঘ্রবাহিনী,দানবদলনী। এখানকার নারীরাও হরিণীচক্ষু,মুক্তকেশা,পুরুষের মনোহরণকারিণী। ভারতবর্ষে কোথায় আছে এত মনোহর রাজ্য! আর বয়ে যাওয়া ঐ শ্বেতাম্বুদ ঊর্মিমালায় পরিপূর্ণা তরঙ্গিনীই বা কোনটি, ভারতের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছেন পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা। কিন্তু,গঙ্গার ওপর এরকম ভূখণ্ড তো বিদ্যমান নেই। কিন্তু,এখানে এই পরিপূর্ণ নদীর ওপর যে বিশাল ভূখণ্ড বা চরভূমি বিদ্যমান। না, এই তরঙ্গিনী গঙ্গা নয়, অন্য কিছু। আর সেই রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে সম্পূর্ণ রক্তবর্ণ প্রস্তর দিয়ে তৈরি এক রাজভবন। সেই রাজভবনের বাইরে সুদৃশ্য উদ্যান, নানা বর্ণ ও গন্ধের মনোমুগ্ধকর আকর্ষণীয় পুষ্পে পরিপূর্ণ। ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে ভ্রমর। আর সেই সৌন্দর্যের প্রাচুর্যের মধ্যে,সুন্দরতাপূর্ণ পরিবেশে , যখন চারিদিক প্রভাতের শান্তিসঙ্গীত এবং সোনালী সূর্যকিরণে ঝলমল করছে, সেই সুন্দরতার মধ্যে নিজেদের সখীদের সাথে জলক্রীড়ায় রত স্বপ্নে দেখা সেই সৌন্দর্যময়ী নারী। প্রথম যৌবনের আনন্দে যুবতীর হৃদয় উদ্বেলিত, জলও নৃত্যরত। যুবতীর পরশে জলের মধ্যেও আজ ছন্দের আবেশ ঘটেছে। যুবতীর বক্ষের আন্দোলন ধীরে ধীরে জলের মধ্যে সেই আন্দোলনের সঞ্চার করেছে। জলই জীবন,সেই জলের মধ্যে আজ প্রাণসঞ্চার ঘটেছে। সিক্তবসনের মধ্যে দিয়ে যুবতীর দেহবল্লরী পরিষ্ফুট,যৌবনের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য দৃশ্যমান। স্বপ্নের মধ্যে প্রেমপৃষ্ট হন অনিরুদ্ধ। না এই অচিনপুরের রাজকুমারীকে নিজের জীবনসঙ্গিনী বানাবেনই,সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

ছদ্মবেশ ধরে নিজের প্রিয় অশ্বের পিঠে চড়ে পাড়ি দেন সুদূর কামরূপ নগরীর উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে তিনি চিনতে পারেন উষাকে। উষাও আপন করে নেন অনিরুদ্ধকে। এরপর প্রেমের আলিঙ্গনে ধরা দেন দুজন। তীব্র যৌবনের কামনায় মেতে ওঠে দুই শরীর।অনিরুদ্ধ আর উষার প্রেম প্রস্ফুটিত হয় পুষ্পোদ্যানে, সুবিশাল স্থিরযৌবন ব্রহ্মপুত্রের শুভ্র সৈকতভূমে।


সেদিন আকাশ ছিল ঘন কালো মেঘে ঢাকা। বাদলা হাওয়া ফিসফিসিয়ে শোনাচ্ছিল প্রেমের কথা। দিগন্তে সবুজ হিমালয়,চারদিক কিছুটা ধোঁয়াটে। উষার হাত ধরে অনিরুদ্ধ বলল,"প্রিয়া, তুমি আমার জীবন। তোমাকেই চেয়েছি, আর তোমাকেই চাই। তোমাকে ছাড়া বাঁচা আমার পক্ষে অসম্ভব। বানাতে চাই আমি তোমায় জীবনসঙ্গিনী।"

ভয়ার্ত স্বরে উত্তর দিলেন উষা,"তুমি তো জানই বাবা বাসুদেবকে সহ্য করতেই পারেন না। আমাদের এই সম্পর্ক যদি বাবার কাছে বিদিত হয়,তাহলে উনি তোমাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিতও করতে পারেন। উনি নিজের মেয়ের এই স্পর্ধা সহ্য করবেন না। উনি আমাকেও শাস্তি দেবেন।" চিন্তার এক কালিমা খেলে গেল অনিরুদ্ধের উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে। দুশ্চিন্তার সাথেই ফুটে উঠল দৃঢ়তা। অনিরুদ্ধের কন্ঠ থেকে মন্দ্রিত হয়ে উঠল প্রেমের শাশ্বত বার্তা। " না, আমরা একে অপরকে ভালোবেসেছি। ভালোবাসার বন্ধন এতো দুর্বল নয় যে, তা তরবারির ঝংকারে ভেঙে পড়বে। ভালোবাসার চেয়ে বড়ো শক্তি জগতে আর কিছুই নেই। আমার মনে হয় না যে,ভয় পাবার কোনো প্রকৃত কারণ আছে। আমার পিতামহ দ্বারকাধীশ বলেন,ভালোবাসার অমর শক্তির কাছে বাহুবল তুচ্ছ।"

উষাও বলে উঠলেন,"তুমি ঠিকই বলেছ প্রিয়তম,ভালোবাসা গরলকে অমৃতে পরিণত করে, ভালোবাসা পারে দ্বেষকে বন্ধুত্বে পরিণত করতে। ভালোবাসার মধ্যে সেই শক্তি আছে, যা পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। যুগ যুগান্তর ধরে বেঁচে থাকে ভালোবাসা। " অনিরুদ্ধ বলে উঠলেন,"তাহলে আর দেরি কিসের,চলো তোমাকে নিয়ে চলি দ্বারকা। সেখানে অসীম নীলিমার শুভ্র সৈকতভূমে পূর্ণতা পাবে আমাদের অমর ভালোবাসা।" "না প্রিয়তম,এটার মধ্যে কিছুটা চৌর্যবৃত্তি নিহিত রয়েছে। আমাদের ভালোবাসা যুগ যুগান্তর ধরে বেঁচে থেকে শোণিতপুরের আকাশ বাতাসে ধ্বনিত হবে ঠিকই,যখন পাবে তা পূর্ণতা। এবং সেই পূর্ণতা তখনই সম্ভব যখন দুই রাজপরিবারের বৈরিতা মিত্রতায় পরিণত হবে।" শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন উষা। "তাই হবে প্রিয়া,আর এভাবেই আমাদের এই প্রেম জীবনজ্যোতি হয়ে কামরূপের আকাশে জ্বলজ্বল করবে। আমাদের প্রেমের বন্ধনে একসূত্রে বাঁধা পড়বে শোণিতপুর আর দ্বারকা।"আশ্বাস দিলেন অনিরুদ্ধ।

বইছিল ফুরফুরে হাওয়া। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে অস্তমিত সূর্য পশ্চিম আকাশে রঙ বেরঙের এক অপরূপ প্রভা সৃষ্টি করেছেন। সেই সৌন্দর্য আর মদিরতার মধ্যে প্রেমিকযুগলের ঘনিষ্ঠ চুম্বনের দৃশ্য প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে আরোও মদির করে তুলছে। দূরে সবুজ হিমালয়ও মোহিত হয়ে প্রেমের লীলা দেখছে। 


আর এরপর! হয়তো হাজার হাজার বছর আগের কোনো এক রূপকথার কাহিনী হতে পারে,কিন্তু পরিণতিটা সেই একই। ভালোবাসার পরশে বৈরিতার অন্ত! অনিরুদ্ধ আর উষার প্রেমের কথা জানতে পারলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ। সায়ও দিলেন এই সম্পর্কে। কিন্তু শিবভক্ত বাণ এই প্রেমের বিরোধিতা করলেন। কামরূপের ভূমে ঘটল শ্রীকৃষ্ণের যাদববাহিনী এবং বাণাসুরের অসুরবাহিনীর মধ্যে সংঘাত। আর সেই যুদ্ধে পরাজয় ঘটল হিংসার,জয় ঘটল প্রেমের। শিবের কৃপায় শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটল বাণাসুরের,যুদ্ধের জন্য ক্ষমা চেয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে তিনি উত্থাপিত করলেন মিত্রতার প্রার্থনা। মিত্রতা আর প্রেমের এক অপূর্ব বন্ধনে বাঁধা পড়ল ভারতের পূর্ব আর পশ্চিম। প্রেম পূর্ণতা পেল অনিরুদ্ধ আর উষার।


তারপর হাজার বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজও শোণিতপুর তেজপুরে অনিরুদ্ধ আর উষার প্রেমগাথা গীত হয়। হতে পারে হাজার বছর আগের পৌরাণিক যুগের এক গাথা,কিন্তু গল্পটা সেই একই। ভালোবাসা কোনো ভয়,কোনো বাধা মানে না। ভালোবাসা সত্যিই চিরন্তন!Love is immortal.


সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama