Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debdutta Banerjee

Others

3  

Debdutta Banerjee

Others

ভরা থাক, স্মৃতি সুধায়

ভরা থাক, স্মৃতি সুধায়

6 mins
2.1K


পিটসবার্গ থেকে রওনা দিয়ে এতো গুলো টাইমজোন পার করে আটলান্টিকের উপর দিয়ে উড়ে দুবাই ,মুম্বাই, কলকাতার মাটি ছুঁয়ে যখন বাগডোগরা পৌঁছলাম সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর দেশের মাটিতে পা দিয়ে এক অন্য রকম অনুভূতি মনকে নাড়া দিলো। অবশ্য পনেরো বছর আগে বাবা মারা গেছিলো যখন দিল্লীতে, মেজো জেঠুর বাড়িতে, আমি ওখানেই এসেছিলাম। শেষ কাজ করে ফিরে গেছিলাম, বাড়ি আসিনি আর। কিন্তু টান ছিল বরাবর বাড়ির প্রতি।


ছোট্ট এয়ার পোর্টের বাইরে আমার ছোটকাকার ছেলে পুপান দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে পনেরো বছরের দেখেছিলাম শেষবার। অবশ্য ফেসবুকের কল্যাণে চিনতে অসুবিধা হল না তেমন। ওর বোনের বিয়ে উপলক্ষেই সবাই আবার বহুদিন পর এক জায়গায় হচ্ছি। বড় জেঠু সবাইকে বারবার করে আসতে বলেছিল। পরিবারের সবার সাথে দেখা হবে।


সেবকের পাহাড়ি পথে পুপানের নতুন কেনা আইটেন গ্ৰ‍্যন্ড মসৃণ ভাবে ছুটে চলেছে। কুড়ি বছর দীর্ঘ সময়। পথ ঘাটে অনেক বদল চোখে পড়ল। রাস্তাঘাট চওড়া হয়েছে। সেবকেশ্বরী কালীবাড়ি আরও জাগ্ৰত হয়েছে গাড়ির ভিড় দেখে মনে হল। চা বাগানগুলোয় শেড-ট্রির সংখ্যা কমেছে। বাগানগুলোর যত্নর অভাব চোখে পড়ল।ছোট ছোট জনপদ গুলো বড় হয়েছে।প্রচুর হোটেল আর রিসর্ট দেখলাম চারদিকে। দোকানগুলোতেও আধুনিকতার ছোঁওয়া চোখে পড়ল। চা বাগান আর পাহাড়ি নদী ঘেরা আমার জন্মস্থান মালবাজারে গাড়ি ঢুকতেই এক এক করে বহু পুরানো স্মৃতি উঁকি দিচ্ছিল মনের কোনে। চেনা জায়গাটাও কেমন অচেনা লাগছিল। পুরানো বাসস্ট‍্যান্ডের কাছে এক বিশাল ক্লক টাওয়ার, থানার পাশের মিউজিক্যাল ফাউন্টেন আর দীর্ঘ কয়েক যুগ বন্ধ থাকার পর সদ্য প্রাণ ফিরে পাওয়া ওল্ড মাল স্টেশন যার নতুন নাম হয়েছে মালবাজার, সব ছাড়িয়ে পুপানের গাড়ি তখন বাড়ির পথ ধরেছে।


বিয়ে হবে ভবনে, তবুও বাড়ির সামনে গেট আর আলোয় সারা বাড়ি সাজানো হয়েছে। আমায় দেখে ভাই বোনেরা বেরিয়ে এলো। সবাই খুব খুশি। ছুটকি এসে জড়িয়ে ধরল।আমাদের একশো বছরের পুরানো কাঠের দোতলা বাড়ির উপর নিচ মিলিয়ে ছটা বড় বড় ঘর, এক পাশে রান্নাঘর আর খাবার ঘর, আজো একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে ভগ্ন প্রায়, বহুদিন রঙ হয় না, আলোর মালায় সেজে উঠলেও দীনতা ঢাকা পড়েনি।আমায় ভীষণ টানছিল ভগ্নপ্রায় বাড়িটা।


সব কাকা জেঠুরা আশেপাশে পাকা ভালো আধুনিক বাড়ি করে নিয়েছে। এই বাড়িতে কেউ থাকেই না। পাশেই বড় জেঠুর দোতলা বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা। ভেতরে ছোটকাকার বাড়ি। ওধারে ফুলকাকা আর রাঙ্গা কাকা এক সাথে ঘর তুলেছে। আমি ভাঙ্গা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম দোতলার বারান্দায়। আজ আমি নিজের বাড়িতেই অতিথি। মন এক ছুটে পারি দিলো ছোটবেলায়। সেই বারান্দা, আমার ছোটবেলার কত স্মৃতি!!


কুড়ি বছর আগে পাঁচ বছরের ছুটকিকে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াতে দেখতাম। কাল তার বিয়ে। আমার বাবারা আটভাই দু বোন, বর্তমানে ছয় ভাই একবোন জীবিত। ছোটপিসি আসতে পারেনি। বাকি ছয় জন এখানে আছেন।


নকাকা আর বাবা পরপর চলে গেছিল মারণ রোগে।


আমার জীবনের একুশটা বছর কেটেছিল এই বাড়িতে। তারপর চাকরী নিয়ে চার বছর দিল্লীতে। তখনো বছরে দু বার বাড়ি আসতাম। মা কে মনেই পড়ে না। জেঠি কাকিদের কোলেই মানুষ আমি। বড় আর সেজো জেঠির আদরেই বড় হয়েছিলাম।


আমাদের এত বড় বাড়ি আর পেছনে বিশাল বাগান, ক্ষেত, ধানী জমি, পুকুর, বাঁশঝাড়। আঠারো জন ভাই বোন একসাথে হেসে খেলে বড় হয়েছি। বিশাল পরিবার।রান্না ঘরের টানা ঢাকা বারান্দায় রোজ সকাল সন্ধ্যায় প্রায় তিরিশটা পাত পড়ত। অনুষ্ঠান বাড়ির মতো করে কাকিমারা পরিবেশন করত। জেঠিরা হেঁসেল সামলাত। প্রচুর ফলের গাছ ছিল বাগান জুড়ে। ঠাম্মা রোজ দুপুরে খাওয়া মিটলে এক ঝুড়ি ফল কাটতে বসতো। আর আমরাও ঠাম্মাকে ঘিরে বসতাম।


শীতকালে ভোরের কুয়াশা গায়ে মেখে হরি কাকা খেজুর রসের হাড়ি নামাত। ছোটকা লাইন করে আমাদের এক ভাঁড় করে রস খাওয়াত। হলুদ কুচি আর আঁখি গুড় খেয়ে সব বই নিয়ে পড়তে বসতাম রাঙ্গা কাকার কাছে। ফুলকাকা আমাদের ইংরেজি পড়াতো। বড় জেঠুর ছোট মেয়ে কেয়াদিভাই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। জেলায় প্রথম হয়েছিল। সবসময় ওর গল্প শুনেই আমরা পড়াশোনা করতাম।


ভালভাবেই ছুটকির বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ে মিটে যাওয়ার পরদিন সকালে বাবান, আমার ফুলকাকার ছেলের সাথে গেলাম নিজেদের বাগান ঘুরতে। বড় জেঠু লোক ডেকেছে। সবাইকে এবার নিজের ভাগ বুঝিয়ে দেবে। চার-বিঘা জমিতে ছিল ফল আর সুপুরি বাগান। এখন অবশ্য আয়তনে কমেছে। যত্নের অভাবে আগাছা জন্মেছে। বড় জেঠু বিছানায়। মেজো জেঠু দিল্লীতেই থাকেন। কাকাদেরও বয়স হয়েছে। বাগান দেখাশোনা করত হরিকাকা। সেও আজ শত্তুরে বুড়ো। আজকাল নাকি সরকারের কৃপায় কাজের লোক পাওয়া যায় না।


সুপুরি গাছের গায়ে পেঁচিয়ে উঠেছে গোলমরিচ গাছ। ফলের ভারে ঝুঁকে রয়েছে। আনারস বাগানে সব গাছেই কমলা হলুদ রঙের ছোপ ধরেছে। বড় চালতা গাছটা মরে গেছে, জোড়া বারো মেসে কাঁঠাল গাছ দুটোও আর নেই। সব চেয়ে কষ্ট হল পুকুর পারে শিউলি-গাছটা নেই দেখে। এই শিউলি ফুল কুড়াতে আসতো মৌ। মনে পড়তেই সারা গায়ে একটা অদ্ভুত শিরশিরানি টের পেলাম।


ঐ বাঁশ ঝাড়ের পিছনে মৌকে প্রথম ছুঁয়েছিলাম। কিশোর বয়সের প্রথম ভালোবাসা। না, কোনও পাপ ছিল না মনে। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। তারপর আমি আর মৌ এই বাঁশঝারে লুকিয়ে কত দুপুর কাটিয়েছি। একসাথে কত বৃষ্টিতে ভিজেছি। বাল্যপ্রেমে নাকি অভিশাপ থাকে।


মৌ তিনদিনের জ্বরে চলে গেছিল সব ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। তারপরেও এই বাঁশঝারে আমি ওর গন্ধ পেতাম। কত সন্ধ্যায় আবছা মৌকে আমি এই বাগানে দেখে ছুটে এসেছি। কখনো ভয় পাইনি। আজো বাঁশ গাছের সরসর শব্দে মৌয়ের দীর্ঘশ্বাস মিশে রয়েছে।


বাতাবি গাছটার নিচে এসে মনে পড়ল এখান থেকে পড়ে পা ভেঙ্গেছিলাম মাধ্যমিকের আগে। তাতে অবশ্য লাভই হয়েছিল। ফুটবল নিয়ে মাঠে ছোটা বন্ধ হয়ে গেছিল।মৌ চুন হলুদ গরম করে লাগিয়ে দিয়েছিল পায়ে। ওর তাড়নায় বাধ্য হয়ে পড়ার বইতে বেশি সময় দেওয়ার ফল পেয়েছিলাম রেজাল্টে।


বিকেলে হরিকাকা বাগানে যে পরিত্যক্ত হাবিজাবি জিনিস রাখার বেড়ার ঘর সেটা খুলেছিল। আমার ছোটবেলার কাঠের চেয়ারটা চোখে পড়ল। এটায় ছিল আমার একছত্র রাজত্ব। কাঠের ঘোড়াটা ছিল পুপানের। একটা কান ভাঙা।


পরদিন সকালে জমি মাপা-মাপি শুরু হল। বড় জেঠু সবাইকে যার যার ভাগ বুঝিয়ে দেবে আগেই বলেছিল। মোট দশ ভাগ হবে পেছনের জমি আর ক্ষেত। সামনের দু বিঘা বাস্তুভিটা নিয়ে কথা কাটাকাটি চলছিল। আসলে ন'কাকার আর মেজো জেঠার ছেলেরা বাইরে থাকে। ওদের অংশ বিক্রি করে দিতে চাইছে। আমাকেও ওরা দলে টানতে চায়। ছোটকা আর ফুলকাকা কাঠের দোতলা ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে। কারণ ওদের ঘরগুলো ভেতরে পড়ে গেছে। সবাই চায় সামনে আসতে। এসব নিয়ে তপ্ত বাক্য বিনিময়।


আমার এসব ভালো লাগছিল না। এই বাড়ির সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি গুলোকে কে যেন অদৃশ্য ছুরি দিয়ে কেটে ফালা ফালা করছিল। আসলে মা হারা ছোটবেলাটা এক অদৃশ্য মায়ার বন্ধনে এ বাড়ির আনাচে কানাচেতে এখনো লুকিয়ে রয়েছে। পরিবারের সকলের মিষ্টি ভালোবাসার স্মৃতি মনের গভীরে। এক অদ্ভুত টান এ বাড়ির প্রতি।


মোটা মোটা কাঠের খুঁটি গুলো মাটি ফুড়ে দোতলার টিনের চালকে আজও ধরে রেখেছে শক্ত করে। কাঠের দেওয়াল, মেঝে একশো বছরের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঠাম্মার কাছে লন্ঠনের আলোয় কত গল্প শুনেছি। কত বর্ষার রাতে ঐ টিনের চালে বৃষ্টির কনসার্ট শুনে ঘুমিয়েছি। মৌয়ের সাথে কত লুকোচুরি খেলেছি। কত সন্ধ্যায় ঐ বারান্দায় বসে গল্প করেছি ওর সাথে। গরমের সময় বাইরের বারান্দায় আম গাছের হাওয়ায় দাদুর সাথে শুয়ে কত দুষ্টুমি করেছি।


প্রতিবছর দীপাবলিতে এত বড় বাড়িকে ছোটকার সাথে আমরা সব ভাইবোনরা মিলে আলোয় আলোয় সাজিয়ে তুলতাম। বহুদূর থেকে দেখা যেত সেই আলোর মেলা। ওদিকে আলোচনার পারদ এখন ঝগড়ার রূপ নিয়েছে। সব কাকাতো ভাইবোনের গলায় নতুন নতুন বিশেষণ শুনতে পাচ্ছি। মনটা খারাপ লাগছিল। কালকেই ফুলকাকা বলেছে এই কাঠের আদি বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হবে। আমায় নো অবজেকশন লেটারে সাইন করতে বলেছে। বাস্তু জমির ভাগাভাগি চলছে এখন। বারান্দার নড়বড়ে রেলিং এ হাত রেখে নিজেকে শক্ত করলাম। পরান উকিল গেটের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সব ক্লাসে দুবছর করে পড়তো ও। ওর বাবা কানাই ছিল দাদুর উকিল। পরান আমায় আগেই বলেছিল একজন ওয়ারিশ ও যদি সই না করে এই আদি বাড়িতে হাত দেওয়াই যাবে না।


শেষবারের মত দেওয়াল গুলোয় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এলাম। সুটকেস আর কয়েকটা জামাকাপড় থাক এখানেই। ছোট্ট পিঠের ব্যাগ আর ল্যাপটপটা নিয়ে এগিয়ে গেলাম।পাসপোর্টটা সাথেই আছে। দূরে ট্রেনের হুইসল শোনা যাচ্ছে। সারা দিনে একটাই ডিএমইউ ট্রেন চলে। আসার তেমন নির্দিষ্ট সময় নেই। প্লাটফর্মে উঠতেই ট্রেনের ইঞ্জিনটা দেখতে পেলাম। আর হয়তো আসা হবে না। একবার চারপাশটা ভালো করে দেখলাম। পিছনে তাকালে দোতলার একটা অংশ চোখে পড়ে। ট্রেনে উঠে বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। ঝাপসা হয়ে আসছে চেনা দৃশ্যগুলো।অতিথি হয়ে এসেছিলাম নিজের বাড়িতে, অতিথির মত ফিরে যাচ্ছি। ছোটবেলার মিষ্টি স্মৃতি গুলো আমার একার হয়েই থাকুক নাহয় মনের মণিকোঠায়।



Rate this content
Log in