সিল্ক-রুট সরগরম ২
সিল্ক-রুট সরগরম ২
জিষ্ণু দিঠিকে বলে -" এমন প্রকৃতির কোলে চাঁদের আলোয় বসে আছি আজ তোর গল্পের দৌলতে। সারাদিনের সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যায় এই সুন্দর পরিবেশে।"
অয়ন হেসে ফেলে। বলে -" ধন্যবাদ তোমার প্রাপ্য, এই লোকেশন তুমি বার করেছো। দিঠি তো কল্পনায় গল্প লিখেছে শুধু।"
-" লোকেশন খুঁজে দিয়েছে ঐ মদন। সব ব্যবস্থা ওর। ওদের ট্রাভেলিং এর ব্যবসা। সেই সূত্রে ওর টালিগঞ্জে যাতায়াত আছে। লোকেশনের জন্য সবাই ওকে ধরে আজকাল। আমাদের গাড়ি, হোটেল থেকে লোকেশনের জন্য পারমিশন সব ওর সাহায্যে করা।" জিষ্ণু বলে।
ওর হাতের কাচের গ্লাসে নতুন করে ভরে নেয় সোনালী তরল। দিঠি আর অয়ন নিজেদেরটা শেষ করে উঠে পড়বে ভাবছে, হঠাৎ জঙ্গলের দিক থেকে একটা হাড় হিম করা চিৎকার ভেসে আসে।
রাতের নিস্তব্ধতা চিরে হাড় হিম করা সেই চিৎকারে সবাই চমকে উঠেছিল। কটেজের পিছন দিকের যে জঙ্গল ওখান থেকে ভেসে এসেছিল চিৎকারটা।
মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দিঠি, অয়ন, জিষ্ণু ইউনিটের আরো অনেকে ছুটে যায় ওদিকে। রিসর্টের লোকেরাও চার ব্যাটারির টর্চ নিয়ে ছুটে যায়। এতো লোকের চেঁচামেচি আর টর্চের আলোয় কয়েকটা পাখী ডানা ঝাপটে উড়ে যায়। কয়েকটা বাদুড় ককিয়ে ওঠে। পায়ে চলা পথটা ধরে একটু গেলেই দেখা যায় একটা মেয়ের পা। একটা পাথরের উপর পড়ে রয়েছে অজ্ঞান হয়ে। জিষ্ণু বলে -"এ তো মৌ, ইউনিটের ড্রেসার। ও এতো রাতে এখানে কি করছে একা?"
দিঠি চারপাশে তাকায়, তেমন কিছু চোখে পড়েনা। একটা কেমন খুব হাল্কা গন্ধ নাকে আসে শুধু। কিসের গন্ধ বুঝতে পারেনা। নানা রকম বুনো ফুল চারদিকে।
আপাতত মেয়েটিকে তুলে আনা হল ওর ঘরে। জলের ঝাপটায় জ্ঞান ফিরলেও ও এতোটাই ভয় পেয়েছিল যে জ্বর এসে গেছিল। গুছিয়ে কথাই বলতে পারছিল না। কাঁপছিল শুধু। ঐ ঠাণ্ডাতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বার বার চারদিকে তাকাচ্ছে। শুধু বলছে "ভুত, ভুত, ...".ওর সাথে ঐ ঘরে আরো দুটি মেয়ে ছিল। সবাই ইউনিটের অংশ। তারাও বলতে পারলনা ও কেন ওখানে গেছিল। এতো রাতে এখানে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না। ওকে বিশ্রাম করতে বলে বাইরে এলো সকলেই। এত-সুন্দর রাতটা কেমন বিস্বাদ হয়ে গেল। সকাল সকাল উঠতে হবে বলে সবাই শুতে চলে গেল।
পরদিন সকালে এই ঋষি নদীর ধারে শুটিং, সে এক হৈ হৈ ব্যাপার, ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ইউনিটের লোকের চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে গেছিল।
আজ প্রেমের দৃশ্য। নদীর ধারে ঘুরতে এসে নায়ক নায়িকার দেখা। দুজনেই পূর্ব পরিচিত। আসলে মিমি (নায়িকা) পিয়াস (নায়ক )কে ছোটবেলায় ভালবাসত। কিন্তু মিমিরা বদলি হয়ে চলে যায় কলকাতা। নায়ক থাকে শিলিগুড়িতে। এর বহু বছর পর মিমি একবার কলকাতায় পিয়াসকে একটা বৌ এর সাথে দেখে ভাবে ওরা স্বামী স্ত্রী। আর পিয়াস মিমির ফেসবুকে দেখে ও রিলেশনশিপে আছে। আসলে মিমি কল্পনায় পিয়াসকেই ভাল বাসত। তাই ফেবুতে ঐ রকম লিখেছিল।হঠাৎ ঘুরতে এসে দেখা হয় এখানে। মিমি পিয়াসের বৌ এর খবর জানতে চায় আর পিয়াস মিমির প্রেমিকের খবর। মিমি পিয়াসকে বানিয়ে বলে ওর বয় ফ্রেন্ড এখন আমেরিকায়। এ বার এলেই বিয়ে। আর পিয়াস ওকে বলে বৌ এর বাচ্চা হবে তাই বাপের বাড়ি গেছে। বেশ মজার মজার ডায়লগ।
দিঠির ভালোই লাগছিল বেশ। তবে এক দৃশ্য বার বার করে নেওয়া হচ্ছিল বলে একটু বোরিং।
অয়ন একটু পরে ফটো তুলতে চলে গেল জঙ্গলে, কতো পাখি এখানে। দিঠিও পায়ে পায়ে নদী পথে এগিয়ে চলল। নদীর কাঠের সাঁকোতে শুটিং চলছে, একটু দূরে আরেকটা বাঁশের সাঁকো আছে। তবে দিঠি পাথরে পা ফেলে ফেলেই এগিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছুটা আসার পর দেখল নদীর অনেকটা জায়গার পাথর সরিয়ে বেশ সুন্দর পরিষ্কার একটা ন্যাচারাল সুইমিংপুল বানিয়েছে কেউ। ও ধারে একটা বড় রিসর্ট চোখে পড়ল। নদীর জল ঢুকছে ঐ পুলে, আবার ওধার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন সাঁতার কাটছে।
পাথরের উপর একটা মেয়ে বসা, সুইমিং স্যুট পরা, পাশে এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক, বেশ ঘনিষ্ঠ। কিন্তু ওদের কাপল্ বলে মনে হলনা। মেয়েটার মুখটা বড্ড চেনা। ভুঁড়ি ওয়ালা টাক মাথা থলথলে লোকটার হাতে একটা খোলা বোতল। সকাল দশটাতেই পান শুরু হয়ে গেছে।
দিঠি এগিয়ে চলে। সামনে একটা ঝরণা এসে মিশেছে নদীতে। ও ওর মোবাইল ক্যামেরায় পটাপট ছবি তুলছিল ঘুরতে ঘুরতে। এবার একটা বড় পাথরে বসে জলে পা চুবায়। ঠাণ্ডা কনকনে জলে পা দিতে বেল ভালোই লাগছিল। এতোটা হেঁটে আসার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। দিনের বেলা ঠাণ্ডা তেমন নেই। বেশ আরাম দায়ক ওয়েদার। ঝিরঝিরে হাওয়ায় বেশ মিষ্টি গন্ধ। সামনে কয়েকটা লোকাল বাচ্চা ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। পাথরের খাঁজে খাঁজে জমা জলে বেশ ছোটছোট মাছ হয়েছে। হঠাৎ দিঠিকে অবাক করে ওর মুঠোফোন বেজে ওঠে। আসলে সকাল থেকেই টাওয়ার ছিল না। দিঠি দেখে অয়নের ফোন। ফোনটা ধরে, ওকে খুঁজছিল অয়ন। একটু পরেই অয়ন চলে আসে। ওরা আবার রিসর্টের দিকে ফেরে।
দুপুরের খাওয়া মিটতেই অয়ন বলল ও পাহাড়ের উপর একটা গ্ৰাম দেখতে যাবে। একটা লোকাল ছেলে নাম বিরা, ওকে নিয়ে যাবে বলেছে। একটা বহু পুরানো মন্দির রয়েছে ওখানে। দিঠিও ওর সঙ্গী হয়। পায়ে চলা পাকদণ্ডি পথ ধরে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে বেশ লাগছিল। অনেকক্ষণ চড়াই পথে হেঁটে দুজনেই হাঁফিয়ে গেছিল। একটা গাছের গুঁড়িতে বসতেই বিরা রে রে করে ছুটে এলো৷ ওর বক্তব্য নানারকম পোকামাকড় আছে এখানে। পিঁপড়ে আছে একধরনের যারা মাংসাশী। তাছাড়া জোঁক রয়েছে। ফট করে না দেখে কোথাও বসতেনা।
দিঠিরা বুনো ফুলের ছবি নিচ্ছিল। বিরা একটা নীল ফুল দেখিয়ে বলে ওটায় হাত দিতে না। বিষাক্ত ফুল। ওর শিকড় থেকে পাতা, ফুল সবেতেই বিষ। অয়ন দেখে বলে -"এটা হেমলক ফুল "
সামনের একটা বড় পাথর দেখিয়ে বিরা ওদের সেখানে বসতে বলল। বহু নিচে ঋষি নদী আর শুটিং এর জায়গা দেখা যাচ্ছে। এখনো জিষ্ণুর টিম লড়ে যাচ্ছে। বেশ লাগছিল এতো উঁচু থেকে দেখতে, অয়ন ফটো নিচ্ছিল। জুম করে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
আর একটু উঠতেই সেই প্রাচীন শিব মন্দির, আসলে একটা প্রাকৃতিক পাথরের খাঁজে গুহা মতো তৈরি হয়েছে। সেখানে একটা বেশ বড় গোল মসৃণ কালো পাথর তেল সিঁদুর মাখানো। ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে কয়েকটা। বুনো-ফুল আর ধুপের গন্ধে বোঝা গেল পূজা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। কয়েকটা ফলের টুকরো পড়ে রয়েছে।
দিঠির আরণ্যকের কথা মনে পড়ছিল। বিভূতিভূষণ বাবু এই পরিবেশের সঠিক বর্ণনা দিতে পারতেন। সামনের বাঁক ঘুরতেই একটা ঝরণার ধারে আট দশটা চালাঘর। এই হল বীরাদের গ্ৰাম , মোট পনেরোটা পরিবার থাকে এখানে। আগে আরো বেশি লোক ছিল। এখন নাকি সবাই শহরে কাজে চলে যায়, আর ফেরে না। কষ্ট করে ক্ষেতি করার জন্য কে থাকবে? শহরে টাকা ওড়ে। এই পরিবার গুলো ছাগল ভেড়া চরায় আর জুম চাষ করে। আরেকটু এগিয়ে দেখা যায় পাহাড়ে থাক থাক সিঁড়ির মতো করে ধাপে ধাপে ওরা কত কি চাষ করেছে। সবার বাড়িতেই সবজি লাগিয়েছে। একটা সমতল জায়গায় ভুট্টা ক্ষেত।
ভগ্ন প্রায় বাড়ি গুলো যেন সুকুমার রায়ের কবিতার বই থেকে উঠে এসেছে, চারদিকে জোড়াতালি। বিরা বলল এ গ্ৰামের ছেলে মেয়েরাও রাস্তায় লেবারের কাজে চলে যায়। কেউ কেউ রিসর্টে কাজ নেয়। ও যেমন রিসর্টে কাজ করে।
ওর বাড়িতে ওর মা আর বোন ছিল। বাবা শহরে গেছে, রোংলিতে। ওর বোন প্রথমে থুম্বা বলে একটা লোকাল পানীয় এনেছিল বাঁশ গাছের তৈরি বড় বড় পিপে বা গ্লাসে । কিন্তু দিঠিরা খায় নি বলে একটু দুঃখ পেয়েছিল।ওর মা ওদের আদা দিয়ে লাল চা খাওয়ালো। এই গ্ৰামটা নাকি পশ্চিমবঙ্গে পড়ে। অথচ ওরা সিকিমের লোক।কোনো এক সময় এটা সিকিম ছিল।
গ্ৰাম প্রধানের সাথে দেখা হল। বেশ বুড়ো। সিনেমার শুটিং হচ্ছে শুনে খুব বিরক্ত। ওদের ভাষায় যা বললেন তার অর্থ এ সব হলে এখানকার অল্প বয়স্ক দের ক্ষতি হয়। সবার মতিগতি বদলে যায়। দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো ওনার কথার সাথে।
সন্ধ্যার আগে পাখিদের কলতান শুনতে শুনতে ওরা ফিরে এলো নিজেদের ডেরায়। আজ নাকি জিষ্ণুর দারুণ কাজ এগিয়েছে। ওর নায়ক নায়িকা পাশেই একটা রিসর্টে উঠেছে, নদীর ওপারে। আজ ওখানেই রাতের পার্টি। দিঠিদের তৈরি হতে বলল।(চলবে)