শিশু ও কিংকর
শিশু ও কিংকর
রাত তখন প্রায় দশটা হবে পাড়ার মোড়ের একটা চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিল কিংকর। দুটোর পর তিনটে সিগারেট সবে ধরিয়েছে.... গাড়ির হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝুপ্ করে একটা আওয়াজ.... যেন বড়োসড়ো কিছু একটা পড়ল ওপাশে। দৌড়ে কাছে যেতে দেখলো একটা মোটা পুঁটলি, দেখে মনে হল খুব ভারী। আর একটু কাছে যেতেই নড়ে উঠল। কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল।
থমকে গেল কিংকর। যথেষ্ট সাহসী ডাকাবুকো ছেলে বলে পরিচিত। সে পর্যন্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতোন চেয়ে রইল কিছুক্ষণ.... খানিক পর সম্বিত ফিরে পেয়ে পুঁটলির মুখটা খুলে ফেললো। শিউরে উঠল ভিতরে সদ্যোজাত ফুলের পাপড়ির মতোন একটি দুধের শিশু দেখে.... কে এটা? কার বাচ্চা?? কেন গাড়িটা এখানে ফেলে রেখে গেল??? বুক কেঁপে ওঠে অতো সাহসী ছেলেটারও।
শিশুটির পানে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টিতে দেখতে আর ভাবতে লাগলো কি করবে। চায়ের দোকানদারের বোধহয় কিছু সন্দেহ হল....
'কিছু হয়েছে?? তোমার হাতে ওটা কি??
তাড়াতাড়ি নিজের কর্তব্য ঠিক করে ফেলে কিংকর....
'কই না.. কিছুনা তো।
বলেই জোরে জোরে পা চালিয়ে দেয় নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। অতো রাতে থানায় যাওয়ার কথাও মনে হয়না তার।
কিন্তু একটা কথা তার মাথায় বারংবার ঘুরপাক খেতে থাকে। বাড়ি তো যাচ্ছে.. বাচ্চাটাকে রাখবে কোথায়। মা আর বোনকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বাবার দুই বছর আগে চলে যাওয়া.. প্রচুর দেনা.. ঘরে অবিবাহিত বোন.. মা সবসময় চিন্তাতেই থাকেন। তার মধ্যে এইসব উটকো ঝামেলা একেবারেই বরদাস্ত করবেননা....
রাত তখন এগারোটা.. বাড়ি পৌঁছে বোন দরজা খুলতেই তাড়াতাড়ি কিংকর নিজের ঘরের দিকে রওনা দেয় কোনোরকমে। বোনকে কিছু বলার সুযোগই দেয়না....
বোন অবাক হয়ে যায় দাদার ব্যাবহারে। দাদা তো এইরকম কখনো করেনা। এসে আগে কতো গল্প করে তাদের সাথে.. মা বলেন "অল ইন্ডিয়া রেডিও"। একবার শুরু হলে থামতেই চায়না.... কিন্তু.. আজ কি হল তার????
কিংকর এদিকে ভাবে শিশুটিকে নিয়ে কি করা যায়..?? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসে.. দীপনকে বললে কেমন হয়?? দীপন তার ছোট্টবেলার বন্ধু। পাশের বিশাল তিনতলা বাড়িতে থাকে। কিন্তু এতো রাতে সে কি জেগে আছে....
বাইরের দিকে পা বাড়ায় কিংকর। দীপনের ঘরের ঠিক নিচে তার বাবার ঘর। এখানকার ডাকসাইটে উকিল। সেই ঘরের কাছে পৌঁছে হঠাৎ বাইরে থেকে অনেকগুলো মূর্তি দেখতে পায়। কৌতূহল হওয়ায় কিংকর জানালার কাছে আঁড়ি পাতে। উনি যেন কাউকে খুব বকা দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে কিংকর যা শোনে তাতে তার চোখ কপালে উঠে যায়.... পুলিশ কমিশনারের সদ্যোজাত নাতি কিডন্যাপ হয়েছে। তাকে কিডন্যাপ করে যেখানে নেওয়ার কথা সেখানে না পৌঁছে তারা পুলিশের তাড়া খেয়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে ফেলেছিল। একটু পরে এসেই তুলে নেবে ভেবেছিল.... কিন্তু পৌঁছে আর সেই পুঁটলি পায়নি। উনি তো তাদের এই মারেন কি সেই মারেন।
কিংকরের মাথা ঘুরতে লাগলো.. তাহলে এই কি সেই শিশু???? আর সে কিনা দীপনকেই এই কথা বলতে চলেছিল যদি কাকুর কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় ভেবে....
কি করবে বুঝতে পারেনা কিংকর। মনে মনে খুবই ভীত হয়ে পড়ে সে। বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। দরজার কাছে দেখে মা দাঁড়িয়ে.. তাকে ভিতরে ঘরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে। আর চেপে রাখা ঠিক হবেনা ভেবে কিংকর মাকে সব কথা খুলে বলে। চুপ করে শোনেন নিরুপমা দেবী। এমনিই স্থির স্বভাব স্বামীর মৃত্যু তাকে আরও শক্ত করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন....
'বাবা এক কাজ কর। এতো রাতে কিছু করতে যাসনা.. তুই কাল সকালে একবার অনুপমের সাথে গিয়ে দেখা কর। ও ঠিক একটা কিছু উপায় বাতলে দেবে....
ঠিক ভাবে কিংকর। সেই ভাল। অনুপমদা এখানকার নামকরা ডক্টর। অনেক বড়ো বড়ো লোকের সাথে ওঠাবসা.... মানুষ খুবই ভাল।।
শিশুটিকে মা বোনের হেফাজতে দিয়ে কিংকর যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। দেখলো তাকে বাটি থেকে অল্প অল্প করে ঝিনুকে করে দুধ খাওয়াচ্ছে তার বোন.... মা পাশে বসে আছেন।
পরেরদিন সাত সকালেই সে ছুটল অনুপমদার বাড়ি। উনি তখন চেম্বারের উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছেন। খুব অবাক হলেন তাকে দেখে....
'আরে কিংকর যে, কি ব্যাপার??
'অনেক কথা আছে তোমার সাথে অনুপমদা....
ভয়ার্ত কিংকর সব খুলে বলে ডক্টর অনুপম বিশ্বাসকে। আস্তে আস্তে করে গম্ভীর হয় তাঁর মুখ। সবশেষে বলেন....
'ঠিক আছে কিংকর.. দারুণ বুদ্ধি ও সাহসিকতা দেখিয়েছ তুমি!! এখানকার থানার ও. সি. প্রকাশ আমার সাথে কলেজে পড়ত। চলো আমরা সোজা তার কাছে যাই....
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। প্রকাশবাবু সব শুনে খুব অবাক হলেন....
'ওনার মতোন একজন মানুষ এমন কাজের সাথে যুক্ত এ তো কল্পনার বাইরে....!! ঠিক আছে আমরা দেখছি কি করা যায়।
এরপর কতোগুলো ফোনে অনেক্ষণ কথা বলেন প্রকাশবাবু.. তারপর দাঁড়িয়ে বলেন....
'চলো তো আগে তো শিশুটিকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিই.... তারপর বাকি সবকিছু খবর নিয়ে দেখা যাবে।
সকলে মিলে কিংকরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। নিরুপমা দেবী শিশুটিকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। কিংকর গিয়ে সব বুঝিয়ে বলতেই উনি তাড়াতাড়ি তাকে প্রকাশবাবুর হাতে তুলে দিলেন। উনি গাড়িতে ডক্টর অনুপমের সাথে রওনা দিলেন। কিংকরকে বলে গেলেন পরে সব জানাবেন।
কিংকর শান্তিমনে একটু ঘুমাতে গেল শিশুটির একটা সদগতি করতে পেরে। আগের রাতে সেভাবে ঘুমই হয়নি।
ঘুম থেকে উঠতেই মা বললেন....
'অনুপম এসেছিল। তুই ঘুমাচ্ছিস জেনে চলে গেল। বলেছে তুই যেন অবশ্যই একবার ওর সাথে গিয়ে দেখা করিস।
কিংকর যেতেই অনুপম বললেন....
'আয় আয়, দারুণ একটা কাজ করেছিস তুই। দীপনের বাবা প্রবীরবাবু ধরা পড়েছেন। ওনার ড্রাইভারকে জেরা করতে সব বলে দিয়েছে। একটি বিশাল শিশুপাচারকারী দলের মাথে ছিলেন উনি....
শিউরে ওঠে কিংকর। সেই কাকু যাঁকে ছোটবেলা থেকে চেনে.... তাকেও কি ভালোবাসতেন....
অনুপম বলেন....
'এইরকমই সাহসী প্রতিবাদী থাকিস চিরকাল। আশীর্বাদ করি, অনেক বড়ো হবি তুই।।