Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Drama

2.6  

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Drama

নষ্ট মেয়ের কষ্ট কথা

নষ্ট মেয়ের কষ্ট কথা

11 mins
6.8K


ঋদ্ধিমা দত্ত ভালবেসে বিয়ে করেছিলো পাইলট রাজদীপ ঘোষকে। কত আশা ছিলো, কত স্বপ্ন ছিলো। ছেলেমেয়ে হলে কী নাম রাখবে, তাও দু'জনে মিলে সোহাগকালে বসে ঠিক করেছিলো।ছেলে হলে ঋদ্ধিরাজ আর মেয়ে হলে ঋদ্ধিদীপা নাম হবে। রাজদীপ জানতে চেয়েছিলো, "ওসব নামের মানে কি?" ঋদ্ধিমা বলেছিলো, "আমার ইচ্ছে তাই, ব্যাস্!" রাজদীপ আরও ঘন করে বুকে মিশিয়ে ধরেছিলো ঋদ্ধিমাকে। কিন্তু সয় নি এতো সুখ, টেকে নি সে সম্পর্ক একবছরের বেশী। ঝগড়াঝাঁটি, হাতাহাতি, মারামারি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সের মামলা এবং সে মামলায় ঋদ্ধিমার হার। অনেক নোংরামি, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। তবে আসলে মূল অভিযোগ হোলো, দু'জনেরই নাকি একাধিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। প্রথমে একাধিক প্রেমের অভিযোগে গণ্ডগোল শুরু, তারপর অসহ্য হয়ে ওঠে, আর এক সময় বাধ্য হয়েই ঋদ্ধিমা ছেড়ে যায় রাজদীপকে।

রাজদীপকে ছেড়ে গিয়ে ঋদ্ধিমা প্রথমে নিজের বাপেরবাড়ীতেই যায়, কিন্তু সেখানে ঠাঁই মেলে নি।

ঠাঁই না মিললেও সেখান থেকে চূড়ান্ত অপমান মিলেছিলো। থাকার কোনো জায়গা নেই, আবার এতো অশান্তির পরে রাজদীপের বাড়ীতেও ফেরা যায় না। অহংকার এসে বাধা দিলো ঋদ্ধিমাকে।


ঋদ্ধিমা একরকম বাধ্য হয়েই এসে উঠলো ওর কলেজবেলার বন্ধু অংশুর বাড়ীতে, ভবানীপুরে। একা মানুষ, একলা একটা ভাঙাচোরা পৈতৃক আমলের বাড়ীতে থাকে। গানবাজনা ওর পেশা। নিজস্ব একটা ব্যাণ্ড আছে। এককালে ঋদ্ধিমাও গাইতো ঐ ব্যাণ্ডে, লিড ভোকালিস্ট।

আর ঠিক এই কারণেই, মানে ঋদ্ধিমার এই অংশুর বাড়ীতে থাকার ইস্যুতেই ঋদ্ধিমা ডিভোর্সের মামলা

হেরে গেলো। সুতরাং, একটা টাকাও এলিমনি পেলো না, খোরপোষের জন্য এক কানাকড়ির আশাও রইলো না। এবার? ঋদ্ধিমা কী করবে?

অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছে বলে ওর বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন সবাই ঋদ্ধিমাকে তুমুল তিরষ্কার করেছে, বোকা বলেছে, আড়ালে নষ্টা বলেছে। বলেছে ঋদ্ধিমা নাকি নিজের দোষ ঢাকতেই রাজদীপের নামে নারীঘটিত দোষ আরোপ করছে। কেউ বুঝতেই চায় নি যে রাজদীপের ঐ অসংযত জীবনযাপন এবং ঋদ্ধিমার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চাপটা আর ঋদ্ধিমা সহ্য করতে পারে নি বলেই বেরিয়ে এসেছিলো।


রাজদীপ যেদিন প্রকাশ্যেই ঋদ্ধিমাকে নষ্ট মেয়েছেলে বলে, রাজদীপের বন্ধু আর বন্ধুর বৌয়ের সামনেই, তার ঠিক পরদিনই ঋদ্ধিমা ঘর ছেড়েছিলো, রাজদীপের ঘর। তারপর বেলেঘাটায় বাপের বাড়ীতে জায়গা না জোটায় অগত্যা ভবানীপুরে অংশুর বাড়ীতে উঠেছিলো। আর তাকে কেন্দ্র করেই রাজদীপের দুঁদে উকিলের পক্ষে ঋদ্ধিমাকে দুশ্চরিত্রা নষ্ট মেয়ে প্রমাণ করতে খুব বিশেষ বেগ পেতে হোলো না। স্রেফ জেরার জালে ফেঁসে গেলো ঋদ্ধিমা আর সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলেজবেলার বন্ধুর জন্য অপমানিত হয়ে পর্যুদস্ত হোলো অংশু।

এর পরে ঋদ্ধিমা আর অংশুর বাড়ীতে থাকে নি।

অংশুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলো ঋদ্ধিমা। ঋদ্ধিমা গিয়ে একটা লেডিস হোস্টেলে উঠেছিলো।

পেট তো চালাতে হবে। যেমন তেমন কাজ চাই একটা। লেখাপড়ায় তেমন মাথা ছিলো না। টেনেটুনে বিএ পাস, ঐ যোগ্যতায় আজকালকার বাজারে এমন কোনো চাকরি জোটে না, যাতে নিজের সব খরচাপাতি উঠে যাবে। থাকার মধ্যে আছে মারকাটারি আলগা যৌবনের চটক আর গানের গলা। ফেসবুকে ঋদ্ধিমার পরিচয় হয়েছিলো রাজদীপের সাথে। আর এই যৌবনের চটকেই হবে, রাজদীপ ঋদ্ধিমার প্রেমে পাগল।

অনেকদিন অনলাইন প্রেম করে তবে দেখাসাক্ষাৎ, তারও বছর চারেক পরে বিয়ে। ছেলে ভালো চাকরি করে, নিজেরা পছন্দ করেছে। অতএব, বিয়েতে দেওয়াথোওয়ার হ্যাপা থেকে মুক্তি পেতে ঋদ্ধিমার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কোনো আপত্তি আসে নি। দু'বাড়ীর সবাই দাঁড়িয়ে থেকে বিয়েটা দিয়ে দিয়েই তারা তাদের দায়িত্ব খালাশ করেছে। আর রাজদীপ আর ঋদ্ধিমাও খুশীতে ডগমগ হয়ে নিজেদের আলাদা ফ্ল্যাটে সংসার শুরু করেছে।

অংশুর বাড়ী ছেড়ে আসার পর হন্যে হয়ে এধার ওধার ঘুরে বেড়াচ্ছে ঋদ্ধিমা। একটা কাজ চাই, খুব তাড়াতাড়ি। আবার একদিন অংশুর সাথে দেখা হয়ে গেলো হঠাৎ, বাগুইআটির কাছে, ঋদ্ধিমার লেডিস হোস্টেলের কাছাকাছিই, বাসস্ট্যান্ডে। অংশু সত্যিই বড়ো ভালো ছেলে। লজ্জায় ঋদ্ধিমা অংশুর সাথে সহজ ভাবে কথা বলতে পারে না, ঐ কোর্টের তিক্ত ঘটনার পর থেকে। অংশু সেটা বোঝে, তাই বললো, "আরে, তুই কেন লজ্জা পাচ্ছিস? আমার সাথে তো তোর কোনো গোলমাল হয় নি। সে তুই আমার বাড়ীতে থাকতে না চাস, সেটা অন্য কথা। তাই বলে একসাথে কাজ করে পেটের ভাত জোটাতে আপত্তি কোথায়?" একটু থেমে অংশু আবার বললো, "আরে শোন শোন, কোনো নষ্টামি না করেই তো নষ্ট মেয়ের স্ট্যাম্প পড়ে গেছে তোর কপালে, একলা একলাই চলছিস। কেউ কী তোর তোয়াক্কা করছে, না পাশে দাঁড়িয়েছে? তবে তোর কিসের দায় রে, এসব ফালতু লোকের কথায় পাত্তা দেওয়ার? দেমাক নিয়ে তুই এক্কেবারে নিজের মতো নিজে থাকবি।"


অংশুর কথায় সাহস পেয়েছিলো ঋদ্ধিমা, সব আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে শুরু করলো নতুন জীবন।

বাইপাসের ধারে নাইট ক্লাবে গান গাওয়ার কাজ, অংশুর ব্যাণ্ডের সাথে। নতুন নাম হোলো ঋতু।

ব্যাণ্ডের লিড সিঙ্গার ঋতু। শুধু হোস্টেলটা পাল্টাতে হয়েছিলো। নাইটক্লাবে গান গেয়ে ফিরতে ফিরতে রাতবিরেত। এটা হোস্টেলের নিয়মবিরুদ্ধ। ঋদ্ধিমা এক বুড়ি অ্যাঙ্গলো ইণ্ডিয়ান ভদ্রমহিলার বাড়ীতে উঠে এলো, বো ব্যারাকে। অংশুই জোগাড় করে দিয়েছিলো। বেশ চললো ক'বছর এভাবেই, বেশ নিরুপদ্রবে। কিন্তু বিধি বাম, ঋদ্ধিমার কপালটাই আসলে বোধহয় গড়বড়ে।

ঋদ্ধিমার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের চার বছর পরে

রাজদীপ মারা যায়। অতিরিক্ত মদ্যপান ও মাদক সেবনকে তার অকাল মৃত্যুর জন্যে দায়ী করা হয়। এই মাদকদ্রব্য সেবনের জন্যই রাজদীপ পাইলটের চাকরিটাও খুইয়েছিলো। ঋদ্ধিমার সাথে ডিভোর্সের ঠিক বছর দুয়েকের মাথায়। এতো সব কিছু ঋদ্ধিমা জানতো না। জানলো আবার সেই অংশুর মুখে। রাজদীপের ভাই খোঁজ করে করে অংশুকে ঠিক খুঁজে বার করেছিলো, ঋদ্ধিমাকে খবর দেবার জন্য। মারা যাবার আগে রাজদীপ অংশুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে চেয়েছিলো, আর বেহালার ফ্ল্যাটটা ঋদ্ধিমার নামে করে দিয়ে গেছে। যদিও এই দ্বিতীয় ব্যবস্থাটা আবার রাজদীপের ভাইদের মোটেই পছন্দ হয় নি। ওরকম একটা নষ্ট মেয়ে, যার জন্য তাদের ভাইয়ের জীবনটা এভাবে নষ্ট হোলো, তার নামেই আবার ঐ নিজের রোজগারে কেনা ফ্ল্যাটটা। রাজদীপ বেহালার ঐ ফ্ল্যাটটা কিনেছিলো ঋদ্ধিমাকে বিয়ে করার ঠিক আগে। ঐ ফ্ল্যাটেই তাদের একবছরের সংসার করা, রাজদীপ আর ঋদ্ধিমার সংসার।

রাজদীপের মৃত্যুর পরে ওর ভাইয়েরা খুব অসন্তুষ্ট ছিলো রাজদীপের এরকম বোকার মতো সিদ্ধান্তে।

তবে মৃত ভাইয়ের শেষ ইচ্ছেটা জানাতেও বাধ্য হয়েছিলো অংশুর মাধ্যমে ঋদ্ধিমাকে। এর অবশ্যই অন্য একটা কারণও আছে, রাজদীপের শেষশয্যায়

আরও একটি খবর সামনে আসে, রাজদীপের জবানিতেই। ঋদ্ধিমার প্রতিটি অভিযোগ সঠিক ছিলো আর রাজদীপ মিথ্যে অভিযোগে ঋদ্ধিমার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছিলো। নিশা নামের মেয়েটা, যার জন্য রাজদীপ এই সমস্ত ঘটিয়েছিলো, তার পাল্লাতে পড়েই এই মারাত্মকভাবে নেশায় ডুবতে থাকে রাজদীপ। আর ওর টনক নড়ে যখন চাকরিটা চলে যায়। তারপরই ঘটে আসল কাণ্ড, রাজদীপের সাথে সেই নিশা নামের মেয়েটার যে জয়েন্ট একাউন্ট ছিলো সেখান থেকে সম্পূর্ণ টাকা তুলে নেয়, একাউন্ট ফাঁকা করে, রাজদীপকে লুকিয়ে।

ঋদ্ধিমা বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার পরে যখন ঐ নিশা মেয়েটার সাথে একসাথে বেহালার ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে রাজদীপ, তখনই আস্তে আস্তে করে রাজদীপের চোখে সব ধরা পড়েছিলো। নিশার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, বাড়ীতে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে এনে নেশার আর জুয়ার আড্ডা বসানো। কথায় কথায় রাজদীপকে গালিগালাজ, মারধোর করে

অশান্তি করা, আর তারপর ক্রমাগত চাপ দিতে থাকা বেহালার ফ্ল্যাটটা নিশার নিজের নামে লিখিয়ে নিতে। এতেই রাজদীপ বুঝতে পারে নিজের ভুল, কিন্তু কোথায় খুঁজে পাবে ঋদ্ধিমাকে? আর যদি বা খুঁজে পায়ও, তবে কীই বা বলবে রাজদীপ, তার প্রাক্তনকে, ভালোবেসে বিয়ে করা আর তারপর তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলা স্ত্রী, ঋদ্ধিমাকে?

নিশার সাথে অশান্তি চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছতে একদিন বেহালার ফ্ল্যাট ছেড়ে রাজদীপ পুরনো পৈতৃক বাড়ীতে, বাগবাজারে চলে আসে। চুরচুর নেশাগ্রস্ত অবস্থায়, গায়ে ধূম জ্বর নিয়ে, রাত প্রায় বারোটা নাগাদ। ভাইয়েরাই ভর্তি করে দিলো সরকারি হাসপাতালে। আসার সময় রাজদীপ তিনটে জিনিস সঙ্গে করে এনেছিলো, বেহালার ফ্ল্যাটের চাবি, ঋদ্ধিমার সাথে তোলা রাজদীপের বিয়ের পরে প্রথমদিন ডিউটিতে যাওয়ার আগে নিজের ইউনিফর্ম পরে তোলা একটা ছবি, বাঁধানো, আর বেহালার ফ্ল্যাটের দলিলটা। নিশার অনুপস্থিত থাকার সুযোগে ফ্ল্যাট লক করে বেরিয়ে এসেছে রাজদীপ।


রাজদীপের এই বহির্মুখী জীবনধারার জন্যই ভাইদের সাথেও খুব মধুর সম্পর্ক ছিলো না। নেহাত অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রীর অনুরোধ ঠেলতে পারে নি, বিশেষতঃ রাজদীপের বড়দা। ওনার উদ্যোগেই রাজদীপের ছোটভাই খোঁজ শুরু করে অংশুর, ঠিকানাটা রাজদীপই জানিয়েছে। তবে রাজদীপের নিজের মধ্যেই বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা পুরোপুরিই মরে গিয়েছিলো। দগ্ধ হচ্ছিলো তীব্র অনুশোচনায়। কত তাড়াতাড়ি সব ঘটে গেলো। নিশা পুলিশ নিয়ে ফ্ল্যাটের চাবি উদ্ধার করতে এসেছিলো, বাগবাজারের বাড়ীতে। গুরুতর অভিযোগ রাজদীপের বিরুদ্ধে। বিয়ের করার প্রতিশ্রুতি এবং বেহালার ফ্ল্যাট নিশার নামে লিখিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করে, নিশার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, রাজদীপ জোর করে নিশাকে সহবাসে বাধ্য করে। এবং যখন বিয়ের কথা ওঠে তখন সম্পর্ক অস্বীকার করে রাজদীপ। কিন্তু যার বিরুদ্ধে এতোকিছু অভিযোগ, সে তখন সব অভিযোগের ঊর্দ্ধে, এই জাগতিক ভালো মন্দের সব বন্ধন কাটিয়ে রাজদীপ তখন সেই না ফেরার দেশে।

এরপর অংশুর খোঁজ পাওয়া, ঋদ্ধিমার সন্ধান, সবই হোলো, কিন্তু সামনাসামনি রাজদীপের আর ক্ষমা চাওয়া হোলো না। খবরটা শোনার পর সেদিন আর ঋদ্ধিমা, মানে নাইটক্লাবের লিড সিঙ্গার ঋতু আর বাড়ী থেকে বেরোতে পারলো না। কোথায় ছিলো এতো চোখের জল? ভারী অবাধ্যতা করছে, ঋদ্ধিমার মানা শুনছে না। দু'চোখ থেকে সমানে ঝরছে, আর ভাসিয়ে দিচ্ছে সব রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, অভিমান। চোখের সামনে দিয়ে সিনেমার মতো বিয়ের আগের মেলামেশার চার বছর আর বিয়ের পরের একবছর, এই সময়ের প্রতিটি মূহুর্ত ঋদ্ধিমার মনে তোলপাড় করে চলে যাচ্ছে।

রাজদীপের চলে যাওয়ার পরে মাস চারেক পার, ঋদ্ধিমা এখন বেহালার ফ্ল্যাটেই থাকে। দু'টো মেয়ে ওর সাথে থাকে, পেয়িং গেস্ট, শুধু থাকা। এখন আর নাইটক্লাবে গান গাইতে যায় না, অংশুর ব্যাণ্ডে নতুন জয়েন করা নতুনদের গান তুলিয়ে দেয়। অংশু একদম খালি হাতে কাজ নেয় না ঋদ্ধিমার কাছ থেকে, সামান্য কিছু গুঁজে দেয় ‌ঋদ্ধিমার হাতে, জোর করে। এসব মিলিয়েই ঋদ্ধিমার একার জীবন কোনোরকমে চলে যায়।

একটা দু'টো করে দিন পেরিয়ে বছর ঘুরতে চলেছে।


একা হাতে সব করতে গিয়ে ঋদ্ধিমার আর সময় হয় না, যে সব ঘর বারান্দা ঝকঝকে তকতকে করে পরিষ্কার করবে। সেদিন পেয়িং গেস্ট মেয়ে দু'টো নিজেদের বাড়ীতে গেছে। রবিবার, অংশুর ব্যাণ্ডেও ছুটি। ফাঁকা ফ্ল্যাট, সকাল থেকে ঋদ্ধিমা শুরু করেছে পরিষ্কার অভিযান। হয়ে গেছে ঘর দু'টো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অনেকটা বেলা হয়েছে, রান্না করতে আর ইচ্ছে করলো না। ফ্রিজে পাঁউরুটি, মিষ্টি আর কলা ছিলো, তাই দিয়েই দুপুরের খাওয়া সারলো, রাতে দু'টো সেদ্ধ ভাত ফুটিয়ে নেবে। অবশ্য বেশীরভাগ দিনই এভাবেই চলে ঋদ্ধিমার খাওয়া দাওয়া।

দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে ঋদ্ধিমা শুরু করলো আলমারি গোছাতে। ওয়ার্ডরোবের প্রতি তাকে তাকে, খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে কত স্মৃতি। বিয়ের আগে, বিয়ের পরেও প্রথম প্রথম রাজদীপ যে যে শহরে যেতো, সেই শহর থেকেই কত রকমের গিফট আনতো ঋদ্ধিমার জন্য। বিশেষ করে শাড়ি, ড্রেস মেটেরিয়াল, ফ্যান্সি জুয়েলারি.... কতকিছু! শহরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে শপিং করার সময় না পেলেও, ডিউটির ফাঁকে ঠিক এয়ারপোর্টের শপিং আর্কেড থেকেও অন্ততঃ কিছু না কিছু কিনতোই, ঋদ্ধিমার জন্য। পরে আস্তে আস্তে কমতে থাকলো। দু'টো নাম তখন রাজদীপের সঙ্গে জড়িয়ে হাওয়ায় উড়ছিলো, এক নম্বর নাম এয়ারহোস্টেস রুক্মিণী। আর দুই হোলো বড়োলোক বাড়ীর বিগড়োনো মেয়ে নিশা। ঋদ্ধিমা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলো। সর্বক্ষণ ক্ষিপ্ত হয়ে থাকতো, অশান্তির চূড়ান্ত। নাহ্, ঋদ্ধিমা আর এসব ভেবে মন খারাপ করবে না।

যতই মন খারাপ করবে না মনে করে, ততই আরো বেশী করে ঘুরে ঘুরে মনে চলে আসছে স্মৃতির পাহাড়। বড্ড একলা হয়ে গেছে ঋদ্ধিমা। যেদিন ঋদ্ধিমা এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, তার ঠিক আগের দিনটা মনে পড়লো। রাজদীপের এক কলিগের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারীর পার্টিতে রুক্মিণী তো ছিলোই, আরো অচেনা কেউ কেউও ছিলো। পার্টি না ছাই, যত ঢলাঢলি লাফড়াবাজির আখড়া একদম। ঋদ্ধিমা চুপ করে বসেই ছিলো। পান ভোজনে উন্মত্ত তখন রাজদীপ। তারপর নেশা বাড়তে বাড়তে শুরু হোলো নানান ধাষ্টামো, আর তার মধ্যেই নিশার ফোন। রাজদীপ তখন পুরো ঘেঁটে আছে। নিজের ওপর বিন্দুমাত্র কন্ট্রোল নেই আর। পার্টিতে বন্ধুদের আর তাদের বৌদের সামনেই ঋদ্ধিমাকে বলে বসলো, "নষ্ট মেয়েছেলে একটা, ঘাড়ে বসে একেবারে রক্ত চুষে খাচ্ছে!" ঋদ্ধিমা রাগে, দুঃখে, অপমানে সবার চোখ এড়িয়ে গিয়ে গাড়িতেই বসেছিলো। ড্রাইভার লক্ষ্য করেছিলো, ঋদ্ধিমাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে আবার গাড়ি নিয়ে ফিরে গিয়েছিলো পার্টি ভেন্যুতে, রাজদীপকে আনতে। পরের দিন সকালেই ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলো ঋদ্ধিমা, সামান্য কিছু জামাকাপড় আর দু-একটা হালকা গয়না, বাপেরবাড়ীর দেওয়া, ওটুকু নিয়েই। তারপর কতকিছু হয়ে গেলো।


চাকরি যাবার পর রাজদীপ গাড়ি বেচেছে, ঋদ্ধিমার গয়নাগাঁটি তো বোধহয় সবটাই নিশা হাতিয়েছে। কী হবে আর এসব কথা ভেবে? ভাবতে ভাবতেই রাজদীপের স্টিলসেফটা খুলেছে ঋদ্ধিমা। খুব অগোছালো, কাগজপত্রে ভর্তি, এলবাম পুরনো ছবি ভর্তি, রাজদীপের শখের টুকিটাকি জিনিসপত্র। সবকিছু নামিয়ে, ঝেড়ে পুঁছে গুছিয়ে রাখলো। কিছু জামাকাপড় রয়েছে রাজদীপের, পুজোর সময় দিয়ে দেবে ওগুলো অভাবী মানুষদের। একটা তাকে সব পাট করে গুছিয়ে গাছিয়ে রেখে বন্ধ করার সময় দেখলো ঐ স্টিলসেফের ডানধারের ছোট ড্রয়ারটা তো গুছোনো হয় নি। খুলে ফেললো পাল্লাটা চাবি ঘুরিয়ে, টেনে। একটা বড়ো ফাইল, রাজদীপের চাকরি থেকে টার্মিনেশনের কাগজপত্র, ওদের ডিভোর্সের কাগজপত্র। ওসব দিয়ে আর কি হবে?

ফাইলটা ফেরত রাখতে গিয়ে দেখলো ড্রয়ারের তাকে পাতা হলদেটে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের তলা থেকে একটা ব্রাউন পেপারের চওড়া খাম উঁকি মারছে। ঋদ্ধিমা টেনে বার করলো খামটাকে। বেশ মোটা ভারী, বড়সড়। কী আছে এতে? মুখটা ফাঁকা করে খামের ভেতরে চোখ ফেললো। একটা মাঝারি মাপের কভার ফাইল মনে হচ্ছে না? টেনে বার করে ফেললো। হ্যাঁ, তাইতো! ফাইলটার ওপরের ফ্ল্যাপে চোখ আটকালো। ওওও! এতো সেই হসপিটালের ফাইলটা! বিয়ের চারমাস পরে ঋদ্ধিমার খুব শরীর খারাপ হয়েছিলো। অ্যাপেন্ডিক্স। অপারেশন করাতে হয়েছিলো, এই হসপিটালে, ঠিক হসপিটাল না, খুব দামী একটা নার্সিংহোম ছিলো। মনটা আবার খুব আর্দ্র হয়ে গেলো ঋদ্ধিমার। দেখো দেখি, কত পুরনো চিকিৎসার কাগজপত্র, কিন্তু কত যত্নেই না রেখেছিলো রাজদীপ ওগুলোকে। ঋদ্ধিমার হঠাৎ মনে হোলো, রাজদীপের সাথে ওভাবে গণ্ডগোলে না জড়িয়ে, ওকে হয়তো আরও একটু বোঝাতে পারতো। আরও একটু সুযোগ দিতে পারতো!

ঋদ্ধিমা খুব ধীরে ধীরে ফাইলটার গায়ে হাত বুলোতে লাগলো। ঐ ফাইলটার গায়ে যেন তখনও রাজদীপের ছোঁয়া লেগে আছে। ঝাপসা চোখ মুছে খুললো ফাইলটা, কতদিনকার কথা, তবু ঋদ্ধিমার মনে হচ্ছে যেন এই সেদিনের কথা। একদম ওপরেই রয়েছে ফিটনেস সার্টিফিকেট আর ডিসচার্জ সার্টিফিকেট। তার নীচে প্রেসক্রিপশনগুলো। তার তলায় হাসপাতালের একটা লেটারহেড, তার মধ্যে একটা খরচের এস্টিমেট। ভর্তি হবার ডেট আর টাইম। আরও কিছু লেখা.... বেশ জড়ানো হাতের লেখা। অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার করতে পারলো না, কী লেখা আছে? আর তাছাড়া এইসব দেখে আর জেনেই বা কী আর হবে। সেই কবেকার প্রায় ছ'বছর আগেই তো ঐ অপারেশন হয়েছে। এখনও পর্যন্ত তো কোনো অসুবিধা তো হয় নি। আবার কোনো সমস্যা হলে না হয় আবার এইসমস্ত কাগজপত্র নিয়েই আবার হসপিটালে যাবে। ভাবলো, থাক, যেখানে ছিলো রাখা সেখানেই রাখা থাক। হয়তো ভবিষ্যতে লাগতে পারে ভেবেই রাজদীপ এতো যত্ন করে রেখেছিলো।

ফাইলটা বন্ধ করে খামে আর রাখলো না, খামটা ভাঁজ করে ফাইল কভারের পেছন দিকের ফ্ল্যাপে ঢোকাতে গিয়ে দেখলো, ওখানে আরেকটা একটু ছোট সাদার ওপর হসপিটালের প্যাথলজির নাম প্রিন্ট করা খাম ভাঁজ করে রাখা। ওটা আবার কী?

বার করলো রিপোর্টটা, ঋদ্ধিমারই রিপোর্ট। নাম তো ওরই লেখা। রিপোর্টটা বিছানায় রেখে সোজা করে নিয়ে হসপিটালের অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে রাখতে গিয়ে প্রিন্টেড রিপোর্টটায় চোখ গেলো। এ কী লেখা দেখছে এতে? ঋদ্ধিমা দুই আর দুইয়ে ততক্ষণে চার করে ফেলেছে। সব পরিষ্কার হয়েছে দিনের আলোর মতো। ঘৃণায় মুখটা কুঁচকে উঠেছে ঋদ্ধিমার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সেই দুর্বোধ্য লেখাটাও আন্দাজ করে নিয়েছে ঋদ্ধিমা। ঐ ফাইল থেকে আবিষ্কার হয়েছে তিনটে কথা, তিনটে বিষাক্ত তীরের মতোই তিনটে কথা ঋদ্ধিমার সমস্ত অস্তিত্বকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো। ফাইলটা খোলা পড়ে, আর ঋদ্ধিমার দু'চোখ থেকে আগুন ঝরছে। একী লেখা দেখলো? ঋদ্ধিমা উঠে দাঁড়ালো, বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো ঋদ্ধিমা, দু'হাতে পেট ধরে....."ঋদ্ধিরাআআজ, ঋদ্ধিদীপাআআ"!!

ঋদ্ধিমার চিৎকার ওর ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে চতুর্গুণ হয়ে ফিরে এলো ওর কাছেই আবার।

ফ্যানের হাওয়ায় ফড়ফড় করে উড়ছে কাগজগুলো, কোনোটায় লেখা.... প্রেগন্যান্সি পজিটিভ, কোনোটায় লেখা.... অ্যাবরশন আর লাইগেশন অপারেশন করার খরচের এস্টিমেট, কোনোটায় লেখা....... অপারেশন শেষে টোটাল ফিটনেস আর ডিসচার্জড!

ঋদ্ধিমার জীবনটা নষ্ট.... সত্যিই নষ্ট আর ওর কষ্ট কথাগুলো একটা বড়সড় ব্যঙ্গ! সম্পর্ক আর বিশ্বাস এই শব্দ দু'টোকে ভেংচি কেটে!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy