চেতনার অন্তরালে
চেতনার অন্তরালে
হাতে ম্যাগাজিনটা ধরেও চোখ দুটো বুজে প্রীতমের কাঁধে মাথা রেখে শুয়েছিল নিঝুম। সাড়ে পাঁচটাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলেও এখনও চেম্বারে বসেননি ডাক্তারবাবু। আরও কয়েকজন পেশেন্ট এসে বসে আছেন। কিন্তু কি ভীষণ নিস্তব্ধতা সারা ঘরে। দেওয়ালে আটকানো "keep silence" বোর্ডের এমন সুন্দর মান্যতা আগে কোথায় দেখেছে বলে মনে করতে পারেনা প্রীতম। ওয়েটিং রুমের দেওয়াল ঘড়িটার টিকটিক আওয়াজ প্রতিটা মুহূর্তের জানান দিচ্ছে। ডাক্তারবাবুর আসতেই দেরি হচ্ছে, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। অপেক্ষা করতেই হবে। একটু বাইরে যেতে ইচ্ছা করছিল প্রতীমের। অথচ নিঝুম এমনভাবে হাতটা জড়িয়ে ধরে আছে, ছাড়িয়ে উঠে যেতে মায়া হচ্ছে। গত দশ-বারোদিনে মেয়েটার চেহারার কি হাল হয়েছে!
আইটি সেক্টরে কর্মরতা, স্মার্ট, সুন্দরী মেয়েটা কয়েকদিনে যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। আরও কয়েকদিন আগে এই ডাক্তারবাবুর কাছে এলেই বোধহয় ভালো হতো। এই মুহূর্তে বেবী নিঝুম চাইলেও প্রতীক চায়নি। ডেলিভারীর আগে পরে মিলিয়ে কমপক্ষে একটা বছরের মামলা। নিঝুমকে প্রতীক বুঝিয়েছিল, এই মুহূর্তে একটা বছর নষ্ট করলে ওর ক্যারিয়ারের কতটা ক্ষতি হয়ে যাবে। নিঝুমকে রাজি করিয়ে অ্যাবরেশনের সিদ্ধান্তটা নিতে কয়েকটা সপ্তাহ দেরেই হয়েছিল। তবু ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, মোটামুটি তিনটে দিন রেস্ট নিলেই নর্মাল লাইফে ফিরতে পারবে। কিন্তু এমনটা হবে কেউ ভাবতে পারেনি। নিঝুমও কি পেরেছিল!
ডাক্তারবাবু তিনদিন বললেও হোলির দুদিন ছুটির সাথে অ্যাডজাস্ট করে পুরো সাতটা দিনেরই ছুটি ম্যানেজ করেছিল নিঝুম। প্রতীকের মনে মনে প্ল্যান ছিল, নিঝুম যদি সুস্থ হয়ে যায় শেষ দুদিনে মন্দারমণিতে ছোট্ট করে একটা সারপ্রাইজ ট্রিপ দেবে নিঝুমকে। এবার শীতে একটা সানডেতে চিড়িয়াখানা ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি।
অ্যাবরেশনের দুদিন পর থেকেই বেটার ফিল করছিল নিঝুম। মন্দারমণি যেতে আর তাহলে কোন অসুবিধা নেই। অনলাইনে হোটেল বুকিংও কমপ্লিট। কিন্তু তৃতীয়দিন রাত থেকেই সমস্যাটা দেখা দিল।
ডিনারের পরে প্রতিদিনের মতোই বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিল প্রতীক। ড্রেসচেঞ্জ করে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে রুটিন মাফিক ত্বকচর্চা করছিল নিঝুম। সারাদিনের হাজার ব্যস্ততার পরের রাতে শোয়ার আগের এই আধঘণ্টা নিঝুমের একদম নিজের জন্য বরাদ্দ।
সেদিন হঠাৎ ভয় পেয়ে প্রতীককে এসে আঁকড়ে ধরে নিঝুম। প্রতীক ভেবেছিল, নির্ঘাত আরশোলা। মাঝরাতেও অফিস থেকে একা ফিরতে ভয় করে না নিঝুমের, কিন্তু একটা আরশোলা দেখলেই কুপোকাত।
প্রতীক জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় আরশোলা?
নিঝুম তখনও ভয়ে মুখ গুঁজে আছে প্রতীকের বুকে। মুখ না তুলেই বলেছিল,
-আরশোলা নয় গরিলা।
নিঝুমের কথা শুনে হেসে উঠেছিল প্রতীক।
-কোথায় গরিলা?
মুখ না তুলেই আয়নার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল নিঝুম।
সেই শুরু....
আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছবির বদলে গরিলা দেখছে।
প্রতীক কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, পুরোটাই মনের ভুল। এমনটা কখনও হতেই পারেনা। কিন্তু বোঝাতে পারলে তো!
নিঝুমের বাবা-মা এসেছেন মেয়ের এমন অদ্ভুত অসুস্থতার কথা শুনে। তাঁরাও অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। যে মেয়ে একদিনও অফিস কামাই করে না, সে আজ প্রায় দু সপ্তাহ বাড়িতে। হাউস ফিজিসিয়ান ডাঃ ধর প্রাথমিক ভাবে সমস্যাটা কাটানোর চেষ্টা কিছু করতে পারেননি। উনিই এই ডাক্তারবাবুর কথা বলেছেন, মানুষের মনের সমস্যাগুলো ইনি ভীষণ ভালো বোঝেন।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর নিঝুমের নাম ডাকেন অ্যাটেনডেন্স। চেম্বারে ঢোকার আগে প্রতীকের হাতটা শক্ত করে ধরে নিঝুম।
-এই ডাক্তারবাবুও যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন, কি হবে! আমি মিথ্যা বলছি না। কেন এমন হচ্ছে প্রতীক?
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদেই ফেলে নিঝুম।
নিঝুমের কাঁধে আলতো হাত রাখে প্রতীক।
-ডাক্তারবাবু ঠিক তোমার কথা বুঝবেন। তুমি কোন কথা গোপন করবে না ওনার কাছে।
বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ে নিঝুম।
বয়স্ক ডাক্তার। ডাক্তারবাবুকে দেখেই কেমন যেন ভরসা করতে ইচ্ছা করে। নিঝুমের সমস্যাটা মন দিয়ে শোনেন। প্রতীক কিছু বলতে গেলে ওকে ইশারায় থামতে বলেন ডাক্তারবাবু। নিঝুমের মুখ থেকেই পুরোটা শোনেন উনি। এমনকি যে কথা ওর মা-বাবাকেও বলেনি সেটাও বলে ডাক্তারবাবুকে। গত সতেরদিন আগের অ্যাবরেশনের কথাটাও।
-আপনি এই গরিলাটাকে আগে কোনদিন দেখেছেন?
ডাক্তারবাবুর কথায় ঘাড় নেড়ে না বলে নিঝুম।
-ভালো করে মনে করার চেষ্টা করুন একটু।
মনে করতে পারছে না নিঝুম। প্রতীকও মনে করার চেষ্টা করে। চিড়িয়াখানায় তো গরিলা দেখেনি ওরা।
অনেকক্ষণ ভাবার পর নিঝুমের মুখে একটুকরো খুশির ঝিলিক দেখা দিয়েই যেন মিলিয়ে যায়। মুখ নামিয়ে নেয় নিঝুম।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করেন,
-কি হলো ম্যাডাম, মনে পড়ল কিছু?
নিঝুম যেন কিছুটা উদাস।
-কিছুদিন আগে একটা ইংলিশ মুভিতে গরিলাটাকে দেখেছিলাম। ভীষণ হিংস্র আর নিষ্ঠুর গরিলাটা। নিজের সন্তানকে অবধি মেরে ফেলেছিল।
কথাটা বলে কিছুক্ষণ থামে নিঝুম। তারপরেই দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে,
-আমিও ঐ গরিলাটার মতোই নিষ্ঠুর....
নিঝুম কাঁদছে। নিঝুমকে থামাতে যায় প্রতীক। ডাক্তারবাবু বারণ করেন।
-ওনাকে কাঁদতে দিন মিঃ সেন। অ্যাবরেশনটা ওনার মনে ভীষণভাবে এফেক্ট করেছে। ওনার অচেতন মনে নিজেকে ঐ গরিলাটার মতো নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে উনিও ওনার সন্তানকে হত্যা করেছেন। তাই এমনটা মনে হচ্ছে ওনার।
-নিঝুম কি করে সুস্থ হবে ডাক্তারবাবু?
জানতে চায় প্রতীক।
-আমি সামান্য কিছু ওষুধ দিচ্ছি। তবে উনি যত তাড়াতাড়ি মা হতে পারবেন, ততই ওনার মন আর শরীরের জন্য ভালো।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসছিল ওরা। ডাক্তারবাবুর ডাকে থমকে দাঁড়ালো। কিছু বলতে ভুলে গেছেন উনি, হয়তো সেটাই বলবেন।
ডাক্তারবাবু হাসিমুখে শুধু বললেন,
-বেস্ট অফ লাক।