তাতাই গেল ইস্কুল
তাতাই গেল ইস্কুল
---- যা যা পড়িয়েছি সব ঠিক করে বলবে কিন্তু।
---- হুঁ।
---- হুঁ কি?
---- মা আমাকে একটা পান্ডা টেডি বিয়ার কিনে দেবে?
---- উফফ ভগবান! তোমার মাথায় কি খেলা ছাড়া আর কিছু আসে না?
---- না তো।
---- উফফ কি বিচ্ছু মেয়ে রে বাবা!
হে ভগবান, একবার মেয়েটাকে এই স্কুলে এডমিশন পাইয়ে দাও। আমার কতদিনের শখ এরকম একটা নামী স্কুলে আমার মেয়ে পড়বে।
কথাগুলো বলতে বলতে ঠাকুরের উদ্দেশ্য জোড় হাত করে প্রণাম করলেন তাতাইয়ের মা।
দাদু টেবিলে বসে চা খাচ্ছিলেন আর এতক্ষণ ধরে চুপচাপ দেখছিলেন ওদের মা মেয়ের কান্ড। এবার মুখ খুললেন তিনি,
---- আহ বৌমা তোমাকে বলেছি না খামোকা এতো চিন্তা করবে না। দেখবে আমার দিদিভাইয়ের অনেক দূর লেখাপড়া হবে।
---- তোমার মুখের কথাই যেন সত্যি হয় বাবা। কিন্তু ওর মন এতো চঞ্চল, কি করে লেখাপড়া করবে কে জানে!
---- ঠিক হয়ে যাবে সব, তুমি এতো চিন্তা কোরো না।
★★★★★
বাবার সাথে প্রথমবার স্কুলের ক্যাম্পাসে ঢুকেই তো তাতাইয়ের চক্ষু চড়ক গাছ, এত্তো বড় মাঠ! এত্তো বড় স্কুল! কিন্তু বাবা ওকে টেনে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে…!
তাতাইকে টানতে টানতে বাবা নিয়ে এসে দাঁড়ালো একটা ছোট্ট বিল্ডিং এর সামনে। তাতাই তো কিছুতেই ঢুকবে না সেখানে,
---- না না আমি এইটুকুনি ইস্কুলে পড়ব না। আমি ঐ বড় সুন্দর ইস্কুলটায় পড়ব।
---- ওরে বোকা, এই ছোটো স্কুলে পড়লে তবেই না ওখানে পৌঁছাতে পারবি।
---- কে বলেছে? তুমি আমার হাতটা ছেড়েই দেখো না আমি কেমন এক ছুটে পৌঁছে যাই ওখানে।
---- ওরে গাধা আমি সেই পৌঁছানোর কথা বলছি না। ওটা হল হাইস্কুল। তুই আগে নার্সারি পাস কর, তারপর প্রাইমারি পাস কর, তারপর গিয়ে হাইস্কুলে পড়তে পারবি।
---- সেতো তাহলে অনেক দিন।
---- হ্যাঁ। এখনও অনেক দিন আছে ওখানে যেতে। তুই এখন চল দেখি, ইন্টারভিউ শুরু হয়ে যাবে।
★★★★★
ভেতরে ঢুকতেই তাতাই দেখলো একটা হল ঘরের মত জায়গায় ওর মত অনেক বাচ্চা আর তাদের বাবা মায়েরা গম্ভীর মুখে বসে আছে। হল ঘরের পাশেই একটা ছোট্ট ঘর, সেখানেই চলছে ইন্টারভিউ। হল ঘরের এক কোণে টুলের ওপর বসে আছে একটা লোক, লোকটার হাতে কাগজ আর কলম। সে এক এক করে নাম ডাকছে ইন্টারভিউয়ের জন্য।
একজন অভিভাবক উঠে এসে তাতাইয়ের বাবাকে বললেন,
---- একটু আগে হেড মিস্ট্রেস ঢুকলেন। শুনছি তো খুব কঠিন কঠিন প্রশ্ন করছেন নাকি!
---- তাই?
---- হুমম।
একটু পরেই তাতাইয়ের ডাক পড়ল। বাবা ফিসফিস করে বললেন,
"সব ঠিক করে বলবে কিন্তু।"
ঘাড় নাড়ল তাতাই। ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাবা অপেক্ষা করতে লাগলেন বাইরে। তাতাই ভেতরে ঢুকে দেখলো দুজন মিস বসে আছেন। তাদের মধ্যে একজন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মত দেখতে। মা ক'দিন আগেই ইন্দিরা গান্ধীর ছবি চিনিয়েছেন তাতাইকে। সেই মিসের মুখটাও কেমন গম্ভীর গম্ভীর। মিস একটা চেয়ার দেখিয়ে তাতাইকে বসতে বললেন। তাতাই চেয়ারে উঠে বসতে বসতেই বলে উঠল,
----যাহ একটা কথা তো বলতে ভুলে গেছি।
---- কি কথা?
---- মা বলেছিল ঢুকেই গুড মর্নিং বলতে।
---- ওহ আচ্ছা আচ্ছা। মর্নিং মর্নিং। তোমার নাম কি?
---- তৃষা দত্ত। সবাই ভালোবেসে আমাকে তাতাই বলে ডাকে।
---- বাহ্। আচ্ছা তৃষা আকাশের রং কি তুমি বলতে পারবে?
---- উম্ম সাদা।
---- সাদা! নাহ বেটা, ভালো করে আজ দেখবে ওটা সাদা নয় নীল।
---- নীল! কিন্তু… মিস মিস ওই জানলা দিয়ে দেখো না সাদাই তো দেখাচ্ছে।
গম্ভীর মিস একটু হেসে বললেন,
---- মেঘের রং সাদা বেটা। জানালা দিয়ে ওটা তো মেঘ দেখা যাচ্ছে। আকাশের রং নীল।
---- ওহ এই ব্যাপার!
---- হুমম। আচ্ছা তৃষা কালো গরু কি রংএর দুধ দেয়?
কালো গরু…! উমম… আমাদের দেশের বাড়িতে লালী বলে একটা গরু ছিল, তার গায়ের রং বাদামি। সে তো সাদা সাদা মিষ্টি মিষ্টি দুধ দিত। আর আমি তো সাদা রঙের দুধ ছাড়া আর কোনো রঙের দুধ খাইনি!....
বিড়বিড় করে কথাগুলো নিজের মনে আওড়াতে আওয়াতে তাতাই বলে উঠল,
---- সাদা দুধ।
---- ভেরি গুড। এবার বলতো কোন পাখি কথা বলতে পারে?
---- টিয়া পাখি।
---- হুমম। টিয়া পাখিকে নিয়ে তুমি কোনো ছড়া বলতে পারবে?
---- টিয়া পাখি! আচ্ছা মিস টিয়া পাখিই কি তোতা পাখি?
---- হ্যাঁ।
---- আচ্ছা, তাহলে বলি।
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ
হিরে দাদার মড়মড়ে থান
ঠাকুর দাদার বউ।
মিস মিস মড় মড়ে থান মানে কি?
---- মড়মড়ে থান! থান মানে এক ধরণের কাপড়।
---- মড়মড়ে কেন হয় সেটা?
---- মড়মড়ে…! বোধহয় মাড় দেওয়া আছে।
---- মাড় কি?
---- মাড় হল সাবুকে জলে ফুটিয়ে তৈরি এক ধরণের জিনিস। জামা কাপড় ভালো রাখতে ব্যবহার করা হয়।
---- ওহহ।
---- এই আমরা ওর ইন্টারভিউ নিচ্ছি না ও আমাদের ইন্টারভিউ নিচ্ছে!
পাশে বসা ম্যাডাম অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন।
গম্ভীর ম্যাম তাঁকে ইশারায় চুপ করতে বলে তাতাইকে জিজ্ঞেস করলেন,
---- আচ্ছা তৃষা তোমরা ক' ভাই বোন?
---- গুনে বলছি দাঁড়াও।
উম্ম… এক দুই তিন চার… এগারো জন।
---- এগারো!
---- হুঁ। ওই তো বাবু দাদা, সিজু দাদা, কেকা দিদি, কেয়া দিদি….
---- বুঝেছি বুঝেছি। এদের মধ্যে তোমার মাকে কে কে মা বলে?
---- মাকে তো শুধু আমিই মা বলি।
---- তাই বলো। তা তৃষা তোমার বন্ধু আছে?
----হুঁ।
----কটা বন্ধু? তাদের নাম কি?
---- অন্নেক বন্ধু। পান্ডি, পিচকু, বকু, কুকু, মিয়াও, মিম…
---- এরা কারা?
---- আমার বন্ধু।
---- এরা তোমার পাড়ায় থাকে?
---- না না, আমার বাড়িতেই তো থাকে।
---- ওহ বুঝেছি, এরা নিশ্চয় তোমার খেলনা পুতুল সব।
---- হুঁ।
---- আচ্ছা তৃষা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?
---- এমনিতে দাদু, তবে গল্প বলার সময় ঠাম্মি।
---- হাঃ হাঃ হাঃ
গম্ভীর মিস এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তারপর তিনি আরেকজন মিসকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
---- বুঝলে নয়না এতক্ষণে এই একটা বাচ্চাই পেলাম যে সত্যিকারের বাচ্চা, তোতা পাখি নয়।
---- এতোক্ষণ তোতা পাখিরা সব তোমার কাছে আসছিল? ওরাও ইস্কুলে পড়বে?
---- এই না না। ব্যাপারটা সেরকম না, বুঝলে? শোনো বাইরে গিয়ে তোমার বাড়ির থেকে যিনি এসেছেন তাকে বোলো পরের সোমবার থেকে সকালে স্কুলে আসতে হবে। আর এই কার্ডটা ওনাকে দিয়ে দিও তাহলেই উনি সব বুঝতে পারবেন।
---- আমি কি ভর্তি হয়ে গেলাম মিস।
---- হ্যাঁ বেটা।
---- সোমবার এলে তাহলে তোতা পাখিদের সঙ্গে দেখা হবে?
---- কি মুশকিলে পড়া গেল রে বাবা! (মনে মনে)
সোমবার স্কুলে এলেই দেখতে পাবে সব। এখন গিয়ে বাবাকে খবরটা দাও তিনি অপেক্ষা করছেন।
---- আচ্ছা। টাটা মিস।
----- টাটা।
---- সোমবার আমি আসবো কিন্তু।
---- হ্যাঁ, এসো।