Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debdutta Banerjee

Tragedy

2.1  

Debdutta Banerjee

Tragedy

সমুদ্রের কান্না

সমুদ্রের কান্না

5 mins
16.4K


ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে বালিয়ারীটা পার করে ঢালু পথটা নেমে গেছে শান বাঁধানো রাস্তায়। মণি সেখানেই এসে দাঁড়ায়। বড় চওড়া রেলিং পার করে কংক্রিটের বাঁধানো চাতাল নেমে গেছে সমুদ্রে। তাতে বসার জন‍্য চৌকো উঁচু করে বাঁধানো বেঞ্চ মত। দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি এসে আছড়ে পড়ছে ঐ চাতালে।

এখন জোয়ার। সমুদ্র এগিয়ে এসেছে তাই। বৃহস্পতিবার বলে ভিড়টা কম। দীঘায় শুক্র, শনি, রবি ভিড় বারে। গত কয়েক বছরে সরকার নতুন করে সাজিয়ে তুলেছে সৈকত নগরীকে। সমুদ্রের পার বরাবর বাগান, পার্ক, লন আর সবুজায়ন।

মণি নিউ দীঘার সি-বিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুধারে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখে। কয়েক বছর আগেও সার সার ডাব ওয়ালা, আর ঝিনুকের জিনিসের দোকান দেখা যেত লাইন দিয়ে। আর ছিল চায়ের গুমটি। উন্নয়নের নামে সব উঠে গেছে। এত এত লোকের দোকান ভাঙ্গা পড়ল, রোজগার বন্ধ হল - অথচ কেউ কিছু বলল না! অবশ‍্য ঐ নতুন মার্কেটে ঘর পেয়েছে কিছু লোক। যাদের টাকার জোর ছিল অন‍্য ব‍্যবসায় গেছে। মার খেয়েছে মণিদের মত পরিবার গুলো।

অথচ কয়েক বছর আগেও ওদের গ্ৰামের পরিবারগুলো কত সুখী ছিল। মণির বাবা সমুদ্রের ধারে ডাব বিক্রি করত। ও খুব ভাল মালিশের কাজ জানত। শনি, রবি-ও নিশ্বাস নিতে সময় পেত না। মা আর বৌ মিলে সি-বিচে চা আর ডিম টোস্ট বিক্রি করত। ছেলে দুটো স্কুলে যেত। বোনটার ভাল বিয়ে দিয়েছিল টাউনে। ঘরটা পাকা করেছিল। ইচ্ছা ছিল পরের বার ছাদ দেবার। কিন্তু উন্নয়নের নামে ওদের মত দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার গুলোর উপর নেমে এসেছিল কোপটা।

সি-বিচে ব‍্যবসা বন্ধ করে দিলো সরকার থেকে। প্রথম কদিন বাবা সাইকেলে করে অল্প ডাব এনে বেঁচত। কিন্তু পুলিশকে টাকা দিয়ে হাতে কিছুই থাকত না। মালিশ তো বন্ধ হয়েই গেছিল বিচের ধারে। দু একটা হোটেলে কথা বলেছিল মণি। কিন্তু হোটেল কমিশন কেটে যেটা দিচ্ছিল তাতে সংসার চলে না। সময়ও নষ্ট হয় বেশি। চা এর দোকানটা ভাঙ্গা পড়েছিল দেড় মাসের মাথায়। মা কয়দিন বাবার সাথে সাইকেলে টিন ঝুলিয়ে চা নিয়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু বাবাটা তখনি অসুস্থ হয়ে পড়ল। আসলে মনটাই ভেঙ্গে গেছিল। জন্ম এই নোনা হাওয়ার দেশে। ছোট থেকে সমুদ্রের পারে ব‍্যবসা করে সংসার টাকে টেনে নিয়ে এসেছিল একাই । সেই মানুষটা এই সব পরিবর্তন দেখে ভেঙ্গে গেছিল ভেতর থেকে।

ফাঁকা বালিয়ারীর বুকে একটা দুটো হোটেল যখন মাথা তুলছে তখন থেকে ওদের এ সব ব‍্যবসা। আজ বালিয়ারী আর ঝাউবন কেটে হাজার হাজার হোটেল, অথচ উন্নয়নের বাঁধা বলে কোপ নেমে এল এই গরিব মানুষ গুলোর ওপর।

বাবাকে নিয়ে এক মাস সদরের হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল মণিকে। ফেরাতে পারেনি মানুষটাকে। জমানো টাকা শেষ করেও পারেনি বুড়ো লোকটার স্বপ্ন গুলো ফিরিয়ে দিতে। সমুদ্র ছিল বাবার প্রাণ। ভোর রাতে উঠে বেলাভুমিতে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে ডাবের দোকান খুলত। একাই সাইকেল নিয়ে দূরের গ্ৰাম গুলোয় চলে যেত মিষ্টি ডাবের খোঁজে। ডাব দেখে বলে দিতে পারত জল বেশি না কম। পাতলা লেওয়া, নাকি নারকেল হয়ে গেছে। সারাদিন নোনা জলে দাঁড়িয়ে ডাব বিক্রি করত। মানুষ বিশ্বাস করে চটি, জুতো, ঘড়ি, ক‍্যামেরা, টাকার ব‍্যাগ রেখে যেত বাবার জিম্মায়।

মণি সদর থেকে একাই ফিরেছিল। আর দেখেছিল তার বত্রিশ বছরের চেনা সৈকত শহরটা কেমন বদলে গেছে। এই যে ডাব ওয়ালা নেই, ছাউনি নেই, মালিশ-ওয়ালা নেই, চা-ওয়ালা নেই, নেই ঝুটা মুক্তোর আর ঝিনুকের দোকান - তাতে টুরিস্টদের অসুবিধা নেই। সবাই কেমন মানিয়ে নিয়েছে। কয়েকজন সাইকেলে করে ফেরি করে কিছু জিনিস। তাও পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে। ছোট ছোট চায়ের গুমটির বদলে এখন ওয়াও মোমো, কফি শপ, আরো নাম করা সব সাজানো দোকান ঘর।

বিশু দার কথা খুব মনে পড়ছিল মণির। সমুদ্রের জলে নেমে সবার ফটো তুলতো বিশুদা। কয়েক বছর আগে যখন স্মার্ট ফোন আর ডিজিটাল ক‍্যামেরার রমরমা বেড়েছিল আর ফটোগ্ৰাফারদের ব‍্যবসা মার খাচ্ছিল বিশুদা তখনি বলত খুব কঠিন দিন আসছে। যেই বিশুদা ফটো তুলে গোটা সংসারটাকে একাই টেনে নিয়ে যেত সে সারাদিন নোনা জলে ভিজে কোনো দিন পাঁচটা, কখনো দশটা ছবি তুলছিল।অর্ধেক দিন ক‍্যামেরার সাটার খুলতেই হত না। অনেকেই সরে যাচ্ছিল ব‍্যবসা থেকে। ইউনিয়ান তৈরি হচ্ছিল ওদের। কিন্তু বিশুদা সরে গেছিল। জীবন থেকে। পারেনি ধাক্কাটা নিতে। ওর বৌ এখন অঙ্গনওয়ারীর রান্না করে। বাচ্চা ছেলেটা একটা হোটেলের থাকা খাওয়ার কাজে ঢুকেছে। একটা ভদ্র পরিবার চোখের ওপর বদলে গেলো কি ভাবে!!

নিজের ছেলেদুটোর কথা ভেবে শিউরে ওঠে মণি। কাজের খোঁজে কত জনকে ধরেছে ও। সব হোটেলেই মালিশের লোক আছে। কেউ তেমন কাজ দেয় না। সি হর্সের অলকদা বলেছিল বেয়ারার কাজ করতে। কিন্তু ঐ কটা টাকায় সংসার চলবে না যে। মা এদিকে বাবার শোকে বিছানা নিয়েছে। বৌটা কি করে সংসারটা চালাচ্ছে মণি জানে না। ছেলে দুটোও হঠাৎ করে বড্ড শান্ত হয়ে গেছে। কোনো বায়না করে না।

সাইকেলটা নিয়ে সি-বিচের ধারে এসে দাঁড়ায় মণি। সমুদ্র একরকম ভাবে বয়ে চলেছে। জোয়ার ভাটা খেলছে নিয়ম করে। পর্যটকের ঢল নেমেছে শহর জুড়ে। কোনো কিছু বদলায়নি। অথচ তাদের মত লোকগুলো বেকার। যে দোকানঘর গুলো তৈরি হল সব বাইরের লোক পেয়ে গেলো টাকার বদলে। যাদের দোকান ভাঙা গেল তারা সবাই বেকার।

পলাশকে নতুন বাইক থেকে নামতে দেখে চমকে তাকিয়েছিল মণি। ওর কাছেই মালিশের কাজ শিখেছিল পলাশ। ভালো কাজ না জানলেও পেট চালিয়ে নিত ঠিকঠাক। এই ডামাডোলে ওর খবর নেওয়া হয়নি। মণিকে না দেখার ভান করে নতুন বড় হোটেলটায় ঢুকে গেছিল পলাশ। মণি ঢুকতে যেতেই সিক‍্যুরিটি আটকালো। পলাশ নাকি এখানে মালিশের কাজ করে। ও নাকি কলকাতা থেকে কোর্স করে এসেছে হোটেল থেকে বলেছিল। অবাক হয়েছিল মণি।

বৌ মিতা রাতে বলেছিল সে একটা হোটেলে রান্নার হেল্পারের কাজে ঢুকতে চায়। পাশের বাড়ীর মায়া হোটেলের চাদর বালিস পাল্টানোর কাজ নিয়েছে। বুকের ভেতরটা মুচরে ওঠে মণির। এভাবে এই সব কাজ করে সংসার চালাতে হবে কখনো ভাবেনি।

পরদিন সন্ধ‍্যায় গেছিল নিউ দীঘায় নতুন যে রিসর্টটা হয়েছে তার ম‍্যানেজার বিনুদার কাছে। আগে অন‍্য হোটেলে ছিল বিনুদা। মালিশের চাহিদা কম বিনুদা বলল। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে যা বলল শুনে মণির কান মাথা গরম হয়ে গেছিল। রেগে গিয়ে কিছু একটা বলেই ফেলছিল। জানালা দিয়ে মায়াকে দেখে থমকালো। একটা লোকের সাথে ওধারের ঘরে হাসতে হাসতে ঢুকে গেছিল মায়া। বিনুদার কথা গুলো গরম সিসার মত কানে লাগছিল। বিনুদা বলে চলেছে - "তোর বৌ নয়, তোর কথা বলছি রে। মেয়েছেলের থেকেও ব‍্যাটা ছেলেদের ডিমান্ড বেশি এ লাইনে আজকাল। তুই তো মালিশ করতেও জানিস। দেখতেও ঠিকঠাক। সপ্তাহে তিনদিন বাঁধাধরা কাস্টমার পাবি। বাকি দিন গুলো খুচখাচ খেপ মারবি। আমাদের মন্দারমনি, ওল্ড দীঘা আর নিউ দীঘা ছাড়া তাজপুরেও নতুন রিসর্ট হচ্ছে। তুই লেগে পর। যা কামাবি ফ‍্যামেলির হেসে খেলে চলে যাবে। পলাশ, বরুণ ওরা তো এই করেই খাচ্ছে রে। "

আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে মণি। এসব সিনেমায় হয় শুনেছিল। এখন এখানেও....

পলাশের বাইকটা রিসোর্টের বাইরে চোখে পড়ে। মণি সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে। মিতা বলেছিল চাল নিয়ে ফিরতে। পকেটে একটা পাঁচ টাকার কয়েন পড়ে রয়েছে। জোয়ার আসছে। পায়ের কাছে শীতল জলের স্পর্শ। আলোয় ঝলমল করছে সৈকত নগরী। সবার মুখে হাসি। হঠাৎ মণির মনে হয় সমুদ্র কাঁদছে। করুণ স্বরে কাঁদছে। পরিস্কার মণি শুনতে পায় একটা মেয়ের গলা, সে বলছে - "আমাকেও সাজিয়ে গুজিয়ে প্রতিনিয়ত বিক্রি করে দিচ্ছে। আমায় নিয়ে ব‍্যাবসা হচ্ছে রোজ। আমার কষ্ট কেউ দেখতে পায় না।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy