অতীতের মুখোমুখি ভবিষ্যৎ
অতীতের মুখোমুখি ভবিষ্যৎ
"সারা পৃথিবী জুড়ে মানব জাতির ইতিহাস মূলত পুরাপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু হয়। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক লিখিত দলিল হতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও তার পূর্বেও আদিম মানুষ ছিল। তবে তারা চাষাবাদ করতে জানত না। পশু পাখি শিকার করে খেত। সেরকমভাবে নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না তাদের। পোষাক মূলত গাছের ছাল ছিল।"
"তাহলে তখন ওদের ঘরবাড়ি কিছুই ছিল না স্যার?" সৌনক ওরফে ক্যাপ্টেন মাইলোর ছোট্ট অনিয়ন্ত্রিত প্রশ্ন জেগে উঠল গৃহশিক্ষক সুদেব রায়ের পড়ানোর মধ্যে।
"নারে, ঘড়বাড়ি তো ওরা তখন বানাতেই জানত না।"
"এবাবা, কত বোকা ছিল ওরা। আর এখন দেখো, মানুষ কত চালাক। অন্য গ্রহে এডভেঞ্চার করে আসার কথা ভাবছে।"
"তুই কিকরে জানলি এসব?" সুদেবের বিষ্ময়কর প্রশ্ন।
"আমরা গেল বছর হায়দ্রাবাদে রামোজিতে গিয়েছিলাম না, ওখানে বিকেলের দিকে একটা স্পেস শো হয়েছিল। উফফ, কি মজা যে লাগছিল শোটাতে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব শব্দের জাল ভেদ করে আমাদের মহাকাশযানটা দ্রুতবেগে পৌঁছে যাচ্ছিল মহাকাশের একটা স্যাটেলাইটের মধ্যে। বসার চেয়ারটাতে এমন একটা কম্পন হচ্ছিল, যেন মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি আমরা মহাকাশযানের মধ্যেই বসে আছি। দারুণ একটা এডভেঞ্চার হয়েছিল পুরো শোটাতে। তখনই হোটেল ফেরার পথে বাবার এক বন্ধু প্রীতম আঙ্কেল গল্প করে বলছিলেন আমায়, বর্তমান বিজ্ঞানের অগ্রগতি এখন কোথায় পৌঁছে গেছে। বলছিলেন মঙ্গলগ্রহে পাঠানো কিউরিওসিটি স্পেসস্ক্রাফটের কথা।" ক্যাপ্টেন মাইলোর খুশিতে জ্বলজ্বল করা চোখের দিকে দৃষ্টি পড়লো সুদেবের। ও বুঝতে পারল, সৌনকের শিশুমন কৃত্তিম আয়োজনে অনেক বড় স্বপ্নপূরণের আস্বাদ পেয়েছে। এমনিতেই সৌনকের স্বপ্ন বিশাল বড় এস্ট্রো সাইন্টিস্ট হবে। টাইম মেশিনে চড়বে। তারপর এগিয়ে বা পিছিয়ে যাবে বর্তমান পৃথিবীর সময় সূচি থেকে। সেসময়কার পৃথিবীকে দেখবে, জানবে। সৌনক ওর এই স্বপ্নের কথা ওর গৃহ শিক্ষক সুদেব স্যারকে বলেছিল একদিন।
সুদেব সেসব কথা মনে করে সৌনককে দেখে বুঝতে পারে, ওর কল্পনা পাড়ি দিয়েছে সুদূরে। তখন ওকে মজা করে প্রশ্ন করে "তুই যদি টাইম মেশিনে করে আজকের সময় থেকে অনেকটা পিছিয়ে যাস, আর তোর সাথে আদিম মানুষের দেখা হয়, তখন কি তুই ওদের থেকে ইতিহাসের সব অচেনা কাহিনি জেনে খুশি হবি? নাকি আজকের সময় থেকে এগিয়ে গিয়ে এস্ট্রোনট হয়ে মঙ্গলে পিকনিক করতে গিয়ে জানতে চাইবি বিজ্ঞানের এতো উন্নতির রহস্য কি? কোনটা তোকে টানবে বেশি?"
সুদেবের প্রশ্নে থমকে থাকে ৯ বছরের ক্যাপ্টেন মাইলো। সে নিজেকে খুব সাহসী ও এডভেঞ্চারাস মনে করে। তবু তার মনে হয়, আদিম মানুষগুলো কেমন যেন গবেট মাথার পশুর মতো ছিল। এই যুগের জামাকাপড় পরা সৌনককে দেখে যদি তারা আক্রমণ করে? যদি ও আর ঘরে ফিরতে না পারে ?
আবার এস্ট্রোনট হয়ে মঙ্গলে চলে গিয়ে যদি ভিনগ্রহ থেকে বাড়ি ফেরার পথ বা ফেরার স্পেসক্রাফটাই শক্তি হারিয়ে ফেলে, তবে আর মা বাবার কাছে যে ফেরা যাবেনা। এ তো আর দক্ষিণ কলকাতার মামাবাড়ি থেকে এবাড়িতে ফেরা নয়, যে মেট্রো বা বাস না পেলে, ওলা উবের কিছু একটা করে নেবে। বড় সমস্যা! স্যারকে কি যে উত্তর দেবে ক্যাপ্টেন মাইলো? ভেবে ভেবে আপনমনে চুপ করে থাকে।
সুদেব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হেসে বলে "অনেক হয়েছে। আর ভেবে কাজ নেই তোর। ধীরেসুস্থে চিন্তা করে রাখ। পরশু এলে উত্তর দিস আমায়। এখন বইখাতা সব তুলে রাখ।"
স্যার চলে গেলেও সৌনকের মাথা থেকে কিছুতেই নামতে চাইছে না প্রশ্নটা। ও যদি সত্যি সত্যি বড় হয়ে কোনোদিন টাইম মেশিন তৈরি করে ফেলতে পারে, তখন পিছিয়ে যাবে না এগিয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতে ওর স্টাডি রুমে গিয়ে বসে। এমন সময় কানে আসে বড়ো দাদু, দাদু আর বাবার মধ্যে কথা কাটাকাটির কোলাহল। এরকম আজকাল মাঝেমধ্যেই হয়। ওর বড় দাদু মানে সৌনকের বাবার দাদু এখনকার জীবনের অনেক আদবকায়দাই মেনে নিতে পারেন না। আজও উনি ভোরবেলা উঠে লাঠি নিয়ে হাঁটতে বেরোন। নিয়ম মেনে চলেন, তাই প্রায় পঁচানব্বুই ছুঁই ছুঁই বুড়ো হলেও যথেষ্ট ফিট। অপরদিকে সৌনকের বাবার এই সাইত্রিশেই ব্যাক পেইন, মাথা ব্যাথা, অ্যাসিডিটি। তাই বাইরের খাবার অর্ডার করলেই বড় দাদু রেগে গিয়ে নাতিকে বেশ ভালোমতো রগড়ে দেন। সৌনকের যুক্তি, 'কম দামে বড় রেস্টুরেন্টের খাবার পাচ্ছি অফারে। তার উপর ঘরে বয়ে দিয়ে যাচ্ছে।'
সেকথা শুনে বড় দাদু রেগে বলতে থাকেন, 'আরো খা এসব বিষ। দুনিয়ার মশলাপাতি খেয়ে ঢেক তোল। ঘরে কি মুড়ি টুরি কিছু নেই নাকি?'
সৌনকের দাদু তখন সমতা রাখতে মধ্যিখানে এসে বলেন, 'আহ বাবা, এখনকার ছেলেমেয়েরা কি আমাদের মতো মুড়ি চিবোবে?'
সব মিলিয়ে জেনারেশন গ্যাপের চিন্তাগত লড়াই চলতে থাকে। এসব শুনে হঠাৎ সৌনকের মনে হয়, দু একটা জেনারেশনের গ্যাপের মধ্যেই যদি এতো লড়াই হয় ও মেনে না নেওয়ার প্রবণতা জন্মায়। তবে ও টাইম মেশিনে করে আগিয়ে বা পিছিয়ে গেলে, ওকে কিকরে অতীত বা ভবিষ্যৎ মানুষ মেনে নেবে?
এসব চিন্তার মধ্যেই হঠাৎ সৌনকের চোখ পড়ে টেবিলের উপর রাখা খেলনা রোবটটার দিকে। ওটা নিয়ে ও আনমনে নাড়াচাড়া করতে থাকে। রোবটটা অনেকটা এস্ট্রনটের মতো ধাতব পোষাক পড়া। সৌনকের বন্ধুরা প্রথম ওর মামার গিফট করা এই রোবট দেখে ওকে বলেছিল 'এতো পুরো ডিসকভারি চ্যানেলে দেখানো রোবটের মতো।'
সৌনক তখন বুক ফুলিয়ে ওদের বলতো "হবে না কেন? আমার মামু যে অ্যামেরিকা থাকে, তাইতো এমন জীবন্ত যন্ত্র নিয়ে আসতে পারে।
ভাবতেই সৌনকের মনে হল যেন, সত্যি যন্ত্রটা মানে রোবটটা হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আর দুহাত দিয়ে ওর চোখদুটোকে ঢেকে দিয়ে ওকে কেমন অবশ করে দিচ্ছে। তারপর সেই স্পেস শোয়ের কম্পন শুরু হয়ে গেল সৌনকের সারা শরীরে। যেন একটা স্পেসক্রাফটে চেপে বসেছে ও। আরো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোবটটা ভারী যান্ত্রিক ভাষায় বলতে শুরু করল " আর ইউ রেডি ক্যাপ্টেন মাইলো? সুন উই উইল রিচ ইন এনাদার প্লানেট।"
সৌনক মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় রোবটকে। আর মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যায় এক অচেনা জায়গায়। তারপর চোখ খুলে দেখে, চারদিকে বরফের রূপালি রঙের মুকুট পড়া পাহাড়ের সারি। আর মধ্যখানে এক টুকরো সমতলভূমি রয়েছে। বেশ একটা নৈসর্গিক পরিবেশ যেন জায়গাটাকে অন্যরূপে সাজিয়ে রেখেছে। এমন সময় খেয়াল হল কিছু কোলাহলের শব্দ। তাকে অনুসরণ করতেই দেখল, অনতিদূরে একজন মহাকাশচারী কিছু আদিম মানুষের সাথে তর্কবিতর্ক জুড়েছে। কেউ থামবার পাত্র নয়। মহাকাশচারীর পড়নে ওর রোবটটার মতো ধাতব পোষাক। সৌনকের ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন, ওর জেনারেল নলেজ বইয়ের পাতার নীল আমস্ট্রং জীবন্ত হয়ে উঠেছে এখানে। আদিম মানুষগুলোর পড়নে গাছের ছাল, হাতে বল্লম জাতীয় অস্ত্র। তারস্বরে চিৎকার করে বলছে, 'অতীতকে জানো, সেখানেই সব রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই ইতিহাসই শ্রেয়।'
আবার মহাকাশচারী বলছে 'বিজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ। সে তার শক্তিতে পৃথিবীর আদি অন্তের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে।'
সেই বাকবিতণ্ডা বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। এদিকে সৌনকের তখন খেয়াল হয়েছে, ওর সাথে ওর পরিচিত রোবটটা নেই। ওই তো ওকে এখানে নিয়ে এসেছিল। তাহলে এখন গেল কোথায় রোবটটা?
সৌনকের এসব ভাবনার মধ্যেই ওর বাহাত ধরে টান মারে একজন। চমকে উঠে সৌনক দেখে এক আদিম মানুষ। সে হাবেভাবে ওকে নিজের পক্ষে কথা বলাতে চাইছে। তখনই সৌনকের ডান হাতে টান পড়ায় দেখে সেই নীল আমস্ট্রং এর মতো মহাকাশচারীটা। সেও সৌনককে দিয়ে বলাতে চায় যে, বিজ্ঞান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সৌনকের অসহায় দৃষ্টি উভয়কে অনুরোধ করেও কোনো ফল হয় না। সামনে চেয়ে দেখে ওর রোবটটা যান্ত্রিক ভাষায় বলছে 'বিচার করো। এখন অতীতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান। তুমি মধ্যমণি।'
সৌনক বিপদে পড়ে একবার এদিক একবার ওদিকে চায়। তারপর একটা সময় এমন হয় যে টানাটানির লড়াইয়ে সৌনকের দুটো হাত অবশ হয়ে আসতে থাকে। কোনো উপায় না পেয়ে ও হাতদুটোকে মুক্ত করতে সজোরে ঝাপটা মারে। আর গড়িয়ে পড়ে যায় চেয়ার থেকে।
দুচোখের পাতা সজোরে কচলে চারদিকে তাকিয়ে বোঝে সৌনক, যে ও পড়ার টেবিলে বসে রোবটটার দিকে চেয়ে সুদেব স্যারের প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতেই এসব স্বপ্ন দেখেছে। মা তখন রাতের খাবার খেতে ডাকছেন। স্কুলের জন্য বইয়ের ব্যাগ গুছিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই সৌনকের খেয়াল হল ওর দুহাতে কব্জিতে কেমন যেন লালচে দাগ, ঠিক যেমনটা স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হলে হয়। পড়ার টেবিলের উপর দাঁড় করানো রোবটটার দিকে চেয়ে নীরবে ভাবল ক্যাপ্টেন মাইলো, তবে কি স্বপ্ন ছিল সবটা? নাকি সত্যি সত্যি অতীত আর ভবিষ্যৎ লড়ছিল নিজেদের গুরুত্ব স্থাপনে?
(সমাপ্ত)