Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Banabithi Patra

Drama

3  

Banabithi Patra

Drama

করুণাধারায় এসো

করুণাধারায় এসো

5 mins
1.1K


এসব চল্ আস্তে আস্তে উঠে গেলেও কেউ কেউ এখনও মানে। গত পরশু সন্ধ্যেতে কেশব বাঁড়ুজ্জ্যের বাড়ি থেকে ঠাকুর নিতে এসে সিদে দিয়ে গিয়েছিল। সেই আনাজ কটাই কুটে একটা তরকারি বসায় করুণা। আনাজ-কটা না থাকলে আজ পিঁয়াজ-লঙ্কা কামড়ে ভাত খেতে হতো। স্টোভের পাশটাতে আবার জল জমে গেছে। ভাঙা বাটিটা করে জলটা ছেঁচে ফেলে করুণা। আকাশটা কবে যে ধরবে কে জানে! "শনির সাত, মঙ্গলের তিন। আর সব দিন দিন৷" পরশু রাত থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মনে মনে হিসাব করে করুণা। সেদিন মঙ্গলবার ছিল। তার মানে তো আজ হয়ে বৃষ্টিটা ধরে যাওয়ার কথা। শেষ ভাদ্রতে আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে একবারে। এর মধ্যে তো আর উনুন ধরানো যায়না! ঘরে যেটুকু কেরোসিন ছিল, তাই দিয়ে কোনরকমে স্টোভটা জ্বলছে। কখন যে ফুরবে কে জানে! আজকের ভাত কটা ফোটানো হলে হয়।


গেল বর্ষায় রান্নার টালির চালাটা ভেঙে পড়েছিল। আর সারানো হয়নি। পাশের বাড়ির টুবলুটাকে ডেকে একটা পুরনো প্লাস্টিক বাঁধিয়ে নিয়েছিল মাথার ওপর, সেই চলছে এখনও। অজস্র ফুটো হয়ে গেছে, জল পড়ছে যেখান সেখান দিয়ে। চালাটা সারানো না হোক, প্লাস্টিকটা অন্তত পাল্টাতে হবে। উঠোনের মাথার ওপরের ত্রিপলগুলোরও অবস্থা খারাপ। পুজোর মুখেই গরীব মানুষগুলোর ওপর দেবতা যে এমন নিষ্ঠুর হবেন ভাবতেও পারেনি করুণা।


ছুটে যায় উঠোনে। সারা উঠোনটাই ত্রিপল দিয়ে ঘেরা। একটা ষাট পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে টিমটিম করে। গতকাল সারাদিন লোডশেডিং ছিল। যাক! আজ সকালে কারেন্টটা এসেছে। আকাশে সুয্যি থাকলে ত্রিপলের ফুটোফাটা দিয়ে তবু একটু আলো আসে। এখন তো এক্কেরে অন্ধকার। ত্রিপলের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির জল ঢুকে সারা উঠোন জলে থৈ থৈ করছে। ভাগ্যিস ঠাকুরগুলো সব প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া আছে তাই রক্ষা, নাহলে সারাবছরের অন্ন সংস্থান গলে জল হয়ে যেত। রাস্তার সব ড্রেন তো জলে ভর্তি। এমনিতেই জল বেরোতে পারছে না। পাশের বাড়ির সুপারী গাছের একটা ডাল এসে পড়েছে বাড়ির সরু ড্রেনটাতে। নোংরা জল উপচে উঠে এসেছে। মনে মনে বৃষ্টির দেবতাকে গালি দিতে দিতে ত্রিপলের ফুটো দিয়ে পড়া জলগুলো ঝাঁট দিয়ে যতটা সম্ভব বের করার চেষ্টা করে করুণা।


তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে সারা পশ্চিমবঙ্গের জনজীবন বিপর্যস্ত। কলকাতার কিছু এলাকার মানুষ জল-বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তবে হাওয়া অফিস থেকে আশার খবর শুনিয়েছে, আগামী চব্বিশ ঘন্টার পর থেকে অবস্থার উন্নতি হবে। দুর্গাপুজোয় খাবারের স্টল করা জায়গা নিয়ে এক মনোমালিন্যকে কেন্দ্র করে উত্তর কলকাতা সরগরম। সেই সামান্য ঘটনা এখন হিন্দু-মুসলমানের জাতিগত দ্বন্দে রূপ নিয়েছে। গতকাল থেকে আজ অবধি পুলিশ প্রায় পনের জনকে গ্রেফতার করেছে। সামনেই শারদোৎসব। উৎসবের দিনগুলোতে শান্তিকর পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে তৎপর প্রশাসন। উফ্ এইসব অশান্তির খবর শুনতে আর ভালো লাগেনা। হিন্দু-মুসলমান সবাই তো মায়ের সন্তান। কিসের এতো ভেদাভেদ আর সে নিয়ে কিসের এতো হানাহানি বোঝে না! রেডিওখানা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বৃদ্ধ বাসুদেব। একসময় কলকাতার বাজারে কেন আশপাশের শহরতলিতেও নাম ছিল মৃৎশিল্পী বাসুদেব পালের। এখন সব নতুনধারার পুজো শুরু হয়ে। তবু বাসুদেব পালের একচালা প্রতিমার কদর এখনও কেউ কেউ করেন বলে সারাবছর দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়। নাহলে না খেয়ে পেটে গামছা বেঁধে থাকতে হতো। পেটের তাগিদে অনেকেই জাত ব্যবসা আর এই কুমোরটুলি ছেড়ে আজকাল অন্য পেশায় ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ছেড়ে কোথায় যাবে বাসুদেব! তার নিজের তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। বউ-ছেলেপিলের ঝক্কিও নেই। মায়ের মূর্তি গড়তে গড়তে এখন চোখ বুজতে পারলেই হলো। একমাত্র চিন্তা শুধু ঐ করুণাকে নিয়েই। বাসুদেব যখন থাকবে না তখন করুণার কি হবে! এই একটাই দুশ্চিন্তা এখন বাসুদেবকে প্রতি মুহূর্তে কুড়েকুড়ে খায়। মেয়েটার একটা বিয়েথা দিয়ে যেতে পারলে নিশ্চিন্তি।


----এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তা পানে তাকিয়ে কি দেখছিস রে মা?


করুণাকে উঠোনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গলির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জানতে চায় বাসুদেব।


----কিসের যেন গোলমালের আওয়াজ আসছে। এই জলবৃষ্টির মধ্যে কাদের আবার ঝগড়া লাগলো কে জানে! তুমি আবার এই জলের মধ্যে উঠোনে....


করুণার মুখের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই হুড়মুড় করে একদল ছোকরা ঢুকে আসে উঠোনে। 


---মুসলমান ছেলেটা ঢুকেছে এখানে?


বাসুদেবের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে জবাব দেয়,


----না।

----অ্যাই শালী, বুড়োর সাথে চোকাচোকি করে আমাদের জাবনা খাওয়াচ্ছিস?


কথাটা বলেই করুণার হাতটা পেঁচিয়ে ধরে। পকেট থেকে একটা চকচকে ধারালো চাকু বের করে করুণার চোখের সামনে ঘোরায়।


---- চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকো মামুণি। নইলে এটা সোজা পেটে ঢুকে যাবে। তোরা সব উল্টে-পাল্টে দেখবি। ছোঁড়াটাকে এদিকেই আসতে দেখেছি।


থরথর করে কাঁপছে বাসুদেব। দালানের বাঁশটা ধরে কোনরকমে নিজেকে সামলে রেখেছে। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে করুণা। ছেলেটা হাতটা এত জোরে মুচড়ে ধরে আছে যে ব্যথা করছে। তরকারির তলা-লাগা গন্ধ আসছে। জোরে শ্বাসটুকু নিতেও ভয় করছে করুণার।

সারা ঘর, রান্নাঘরের জিনিস এলোমেলো করে বেরিয়ে আসে ছেলেগুলো। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে কি বাক্সপ্যাঁটরার মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায় যে ঐভাবে সব হুলুস্থুল করলো ঘরদোরের, মনে মনে ভাবে করুণা।


----না গুরু, ভেতরে কেউ নেই।

করুণার হাতটা একটু আলগা করতে গিয়েও আবার চেপে ঘরে ছেলেটা।


---- ঐ প্লাস্টিকগুলো খুলে দেখ্, ওখানে আছে কিনা।


কোথাও কাউকে না পেয়ে যেন মেজাজ আরও চড়ে যায় ওদের।


----কোনো মুসলমানকে যদি ঘরে লুকিয়েছিস জানতে পারি, বাপ-বেটি দুজনের লাশ ফেলে দিয়ে যাব।


ছেলেগুলো বেরিয়ে যেতেই করুণা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বাসুদেবকে। 


আজ থেকে বছর পঁচিশ-ত্রিশ আগে। সারা দেশ জুড়ে চলছিল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। এমনি এক বৃষ্টিভেজা ভোরবেলা বাসুদেব উঠোনের এককোণে বাচ্চা কোলে এক মুসলমান বৌকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছিল। বাসুদেবকে দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল বৌটা। তারপর হয়তো বাসুদেবের মুখটা দেখে মনে হয়েছিল, তেমন ভয়ঙ্কর মানুষ বাসুদেব নয়। দাঙ্গায় তাদের ঘর পুড়েছে। আপন মানুষদের হারিয়ে পুলিশের তাড়া খেয়ে এসে লুকিয়েছে এখানে। বাসুদেব ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই কোলের বাচ্চাটাকে সবে একমাটি দেওয়া দুগ্গামায়ের পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে বলেছিল,

"আমার বেটিকে আপনার কাছে রেখে গেলাম।"


বৌটি মুহূর্তে হারিয়ে গিয়েছিল কুমোরপাড়ার গলিতে। বাসুদেবের তখন জোয়ান বয়স, কিছুটা ছুটে গিয়েও আর খুঁজে পায়নি তাকে। এখানকার গলিতে কেউ হারিয়ে যেতে চাইলে তাকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্যি। ফিরে এসেছিল বাসুদেব। বাচ্চাটা তখন ভিজে কাদামাটিতে শুয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে। কেমন একটা মমতায় বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিতে গিয়েই চমকে উঠেছিল বাসুদেব। গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে ছুটেছিল ডাক্তারের কাছে। দিন পনের ডাক্তার-ওষুধ-ইঞ্জেকশন করে শেষ অবধি দুগ্গামায়ের করুণায় সুস্থ হয়েছিল মেয়েটা। তাই তো ওর নাম রেখেছিল করুণা। তখন থেকেই বোনের মেয়ের পরিচয়ে করুণা বাসুদেবের কাছেই বড়ো হচ্ছে। 

বাসুদেবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এখনও যেন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা।

মায়ের মূর্তিগুলোয় ঢাকা দেওয়া প্লাস্টিক ছিঁড়েখুঁড়ে এলোমেলো করে দিয়ে গেছে ওরা। ফুটো ত্রিপল দিয়ে জল গড়িয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে মায়ের গায়ে। মা যেন কাঁদছে।

বাসুদেব কাঁদছে। কাঁদছে করুণা। করুণার মাথাটাকে গভীর স্নেহে নিজের বুকের কাছে টেনে নেয় বাসুদেব।

"আমি আছি, তোর ভয় কিসের!"

স্নেহের কোন জাত হয়না....

(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama