Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Mausumi Pramanik

Tragedy

1  

Mausumi Pramanik

Tragedy

ছোট্ট একটা ভালবাসা

ছোট্ট একটা ভালবাসা

7 mins
965


১৯৮২-৮৩ সালের গল্প। তখন ফেসবুক বা হোয়াটস্ অ্যাপের রমরমা ছিল না, ছিল না মোবাইল ফোন। কোয়েড স্কুল কলেজের সংখ্যাও ছিল কম। বন্ধুত্ব, ভালবাসা ইত্যাদি সম্পর্ক এত সহজে হত না আর হলেও ভেঙে যেত না চট করে। এরকমই এক মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এগারো-বারো বছরের দুই বন্ধুর মধ্যে। অপু ও রিঙ্কু। জেন্ডার দিয়ে ভাগ যদি করতে হয়, তাহলে অপু ক্লাশ সিক্সের ছাত্রী আর রিঙ্কু ক্লাশ সেভেনের ছাত্র।

         উত্তর কলকাতায় পাশাপাশি বড় গরাদ-ওয়ালা জানালায় বসে এদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। “এমা! রিঙ্কু আবার ছেলেদের নাম হয় নাকি?”

“অপুও তো ছেলের নাম...”

“কে বলেছে?”

“সত্যজিত রায়, পথের পাঁচালীতে...”

“সে ছিল অপূর্ব আর আমি তো অপর্না...”

“আর আমিও তো বরুনাভ...”

“ইশ! বিচ্ছিরি নাম...না মানে আনকমন তো...তাই বললাম।”

“তুমি খুব মিষ্টি...”

“তুমিও খুব ভা অপুদের দ্বিতীয় বেডরুম আর রিঙ্কুদের বিশালাকার রান্নাঘরের জানালার মধ্যে দূরত্ব মাত্র চার ফুট। ঐ বাড়িতে তিন ছেলে আর এই বাড়িতে তিন মেয়ে। দুই বাড়ির মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেছিল এই বাড়ির ছোট মেয়ে ফুলটুসি। দুই বছরের ফুলটুসি আদো আদো ভাষায় ও বাড়ির গিন্নীকে বলত, “জ্যাম্মা...কি আন্না করচো...গন্নো আসছে...” কিংবা “টেবিলে নাল নাল কি?প্যায়ায়া..” অমনি ঐ বাড়ি থেকে ঝুলঝাড়ু করে চলে আসত পেয়ারা কিংবা আপেল। রিঙ্কুই এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। অপু যখন হাত বাড়িয়ে ঠোঙাটা নিত, দেখত সেখানে ফল ছাড়াও আছে চকলেট। রিঙ্কু ইশারায় বুঝিয়ে দিত, ‘ওটা তোমার জন্যে...’

         অপুর স্কুল ছুটি হত চারটেয় আর রিঙ্কুর তিনটেয়। রাস্তার দু’দিকে দুটি স্কুল। একটি নামী আর একটি অনামী। কড়া পাহারায় স্কুল থেকে ফিরত অপু, তাই কোনদিন রিঙ্কু ওর জন্যে অপেক্ষা করেছিল কিনা, জানতে পারে নি। আবার অপুও ওপাশের স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজলেই নিজের ক্লাশের জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করত রিঙ্কুকে, সেটা সেও জানত না।

         তবে দুজনের যত গল্প হত সবুজ খড়কড়ি দেওয়া জানালার লোহার গরাদের পাশের স্ল্যাবে বসে; পাঁচটা থেকে ছ’টা। অপু রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকত আর রিঙ্কু সেই ছবির মার্কিং করত। রিঙ্কু কবিতা লিখত আর অপুকে শুনে বলতে হত কেমন হয়েছে।

“কি দারুন আঁকো তুমি, অপু?”

“তুমিও তো ভাল কবিতা লেখ...”

 রিঙ্কুর বন্ধুপ্রেম বা ভালবাসা এতটাই বেশী ছিল যে ওর বড়দা ওকে টেনে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হত। “চল... পড়তে বসবি চল, খালি আড্ডা দিলে হবে...?” গেলেও মুহুর্তের মধ্যেই আবার রিঙ্কু ফিরে আসত। অপু এসব দেখে মজা পেত খুব। আবার সপ্তাহে তিনদিন দিদিমনি আসত পড়াতে ঠিক ছ’টার সময়।

“আসছি আমি...দিদিমনি এসেছেন...”

“না, তুমি মিথ্যে বলছো...কোথায়?”

রীতিমত দিদিমণিকে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হত অপুকে যে সে সত্যি বলছে। দিদিমণিও মুখ টিপে হাসতেন দুই নাবা অপু লেখাপড়ায় ভাল কিন্তু রিঙ্কু খুবই সাধারণ আর এইসব করতে গিয়ে সে সেইবছর ফেল করল। শুনে অপুর খুব কষ্ট হল। “কেন তুমি মন দিয়ে পড়াশুনা করো না রিঙ্কু?”

“ভাল তো...এখন তুমি আর আমি একই ক্লাশে...সমান সমান...”

অপু ভ্রু কুঁচকায়। ‘তাহলে কি রিঙ্কু ইচ্ছে করেই...!’ অপু প্রেম, ভালবাসা কি বুঝত না, যেমন বুঝত না যে কেন ওর স্তনে ব্যাথা হয়, আর কেন প্রতিমাসে ঐ জিনিসটা হয়? কিন্তু রিঙ্কু যে ওকে ভালবাসে সেটা বোঝানোতে কোন ত্রুটি রাখে নি। যেমন রাখির দিন ফুলটুসির কাছ থেকে রাখি পরত, কিন্তু অপু পরাতে গেলেই হাত সরিয়ে নিত। কিংবা দোলের দিন কাকু কাকিমার পায়ে আবির দেওয়ার নাম করে এসে অপুর মাথায় লাল আবির মাখিয়ে দিত রিঙ্কু। তবুও অপু বুঝত না, যদিও মজা পেত খুব।

         গরম বা শীতের ছুটিতে টিভি দেখার অনুমতি ছিল অপুর। রিঙ্কুদের বাড়িতে টিভি ছিল না। ভাল সিনেমা বা ফুটবল খেলা হলে সে চলে আসত অপুদের বাড়িতে। টিভি দেখতে দেখতেই আনন্দ করত, গল্প করত অনেক। রিঙ্কু ছুতোনাতায় অপুকে রাগিয়ে দিয়ে বেশ মজা পেত। আর অপুও তার টানা টানা, গভীর চোখের ভাষায় তার উত্তর দিতে এতটুকু দেরী করত না। এইরকমই একটি নাবালক-নাবালিকার প্রেমের কাহিনী নিয়ে হিট হিন্দী ছবি “গীত গাতা চল” দেখতে এসেছিল রিঙ্কু। শুরুর আগে বলেছিল, “ভাল করে দেখ, আজ তোমায় কিছু বলব, খুব ইম্পর্টেন্ট...” সেইজন্যেই কিনা জানা নেই, খুব মন দিয়ে সিনেমাটা দেখেছিল অপু এবং শেষ হলে অপেক্ষা করছিল, রিঙ্কু কি বলতে চায় সেটা শোনার জন্যে। দু’চারবার তাকে অনুরোধও করল, “বলো না প্লিজ কি বলবে?”

রিঙ্কু কোন উত্তর না দিয়ে ফুলটুসির সঙ্গে খেলা করতে থাকে। রাত তখন ন’টা। অপু আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না। এদিকে বড়দা রিঙ্কুকে ডাকছে জানালা দিয়ে। নীচে যাবার সিড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে অপুর হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে রিঙ্কু, “আমি তোমাকে ভালবাসি, অপু...আই লাভ ইয়ু...” বলেই গড়গড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়।

         ছোট্ট অপু একথা শুনে খুব খুশি হয়, কিন্তু তারপরেই ভাবে যে এটা কি এমন কথা? এটা বলার জন্যে এত ভনিতা। বলেই বা অমন করে পালানো কেন বাপু? এরকম হাজার প্রশ্নের ভিড় তার মনে ও ব্রেনে পাক খেতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে সে তার প্রিয় বান্ধবী টুকাইকে কথাটা বলে। ঘটনাচক্রে টুকাইদের বাড়িও রিঙ্কুদের বাড়ির পাশে আর টুকাই রিঙ্কুকে চেনে, যদিও দুজনের মধ্যে কোন বন্ধুত্ব নেই। টুকাই অপুকে বোঝায়, “রিঙ্কু একটি অত্যন্ত বদ ছেলে , তাই এসব কথা বলেছে। ওসব নোংরা কথা...তুই আর ওর সঙ্গে মিশিস না। তাছাড়া এখন লেখাপড়া করার বয়স। ওসব বদমাসী ফেলটুস মার্কা ছেলেমেয়েরা করে। ”

         সেই দিন থেকে অপু রিঙ্কুর সঙ্গে কথা বলা তো দূরে থাক, তার দিকে তাকায় না পর্য্যন্ত। রিঙ্কু যথেষ্ট ব্যাথা পায়। কখনো ইশারায় বা জানালায় এসে ওকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করে। অপু কোন উত্তর না দিয়ে চলে যায়। ইতিমধ্যে কোন এক অনুষ্ঠানে রিঙ্কুদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয় অপু’রা। সেদিন অপুকে কাছে পেয়ে রিঙ্কু সরাসরি প্রশ্ন করে, “তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো না, আমাকে এড়িয়ে চলছো, কেন?”

“টুকাই বলেছে, তুমি খারাপ ছেলে...তুমি ‘আই লাভ ইয়ু...’ কেন বলেছো...?”

“তুমি কি টুকাইকে সব বলে দিয়েছো?”

“হ্যাঁ। কেন?”

“হায় ভগবান!” রিঙ্কু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। সে বুঝলেও অপু কিছুতেই বুঝতে পারে না যে টুকাই যা বলেছে সবটাই ঠিক নয়। রিঙ্কু অনেক চেষ্টা করেও বোঝাতে পারলো না সে কথা। পরিশেষে ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে বললো, “তোমার বান্ধবী তোমায় হিংসে করে...আমার কথা মিলিয়ে নিও...” স্কুলে টুকাই ও অপু দুজনই দুজনের বেস্ট ফ্রেণ্ড, তাই বন্ধুর কথা পুরোটাই উড়িয়ে সে দিতে পারলো না। এমনকি রিঙ্কু অপুর মেজো বোন তপুকে ডেকেও অনুযোগ করেছিল, “তোমার দিদি আমার সাথে এমন করে কেন? যা করছে সেটা কি ঠিক?” রিঙ্কুকে অপুর বাড়ির সকলেই খুব স্নেহ করতো, এমনকি তপতীও। সেও তো যথেষ্ট ছোট, তবুও দিদিকে এসে বলল,

“রিঙ্কুদার সঙ্গে তোর ঝগড়া হয়েছে দিদিভাই?”

“কই না তো?”

“তবে তোরা আর কথা বলিস না কে তারপরে দুজনেই ব্যস্ত হয়ে যায়। উঁচু ক্লাশ; সামনেই মাধ্যমিক। তবুও দুজন দুজনকে জানালা দিয়ে লক্ষ্য যে করত না, তা বলা যাবে না। নতুন হেয়ার কাট করলে বা নতুন জামা পরলে অপু বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিত নিজেকে দেখানোর জন্যে। রিঙ্কু দেখত ঠিকই, কিন্তু এমন ভান করত যেন দেখে নি কিছুই। অপু রাগে বিছানাকে পা দিয়ে আঘাত করে ধড়াস করে জানালা বন্ধ করে দিত। এত রাগ, এত অভিমান যে প্রেম ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বুঝতেই পারলো না অপু। স্বভাবতই দুজনের মধ্যে দূরত্ব বা মাধ্যমিকের পর অপুর বাবা অন্যত্র বাড়ি করে চলে যান। কাকতালীয় ভাবে যে কলেজে অপু মর্ণিং-এ ভর্তি হয়, রিঙ্কুও সেই কলেজে ডে’তে ভর্তি হয়েছিল। মর্ণিং ক্লাশ শেষ হবার অনেক আগেই রিঙ্কু চলে আসত, তালামারা কোলাপসেবল গেটটা ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। দেখা হয়েছিল অনেকবার, চোখাচোখিও হয়েছিল। কিন্তু কেউ কারোর সঙ্গে কথাই বলতো না। অদ্ভূত! রিঙ্কু হয়তো চেয়েছিল যে অপুই এগিয়ে আসুক, ভালবাসার উত্তর দিক, ভালবাসা দিয়েই। কিন্তু অপু তো ভালবাসা কি সেটাই ভাল করে বোঝে না অথচ রিঙ্কুর বন্ধুত্ব হোক কিংবা ভালবাসা, তাকে কিন্তু বেশ মিস করতো, নতুন পাড়াতে, নতুন বাড়িতে গিয়েও। বান্ধবী অর্চনা অপুকে বোঝায়. “রিঙ্কুর সঙ্গে তুমি ঠিক করোনি...ওর কি দোষ? ভালই তো বেসেছে তোমায়। তুমিও তো ওকে খুবই পছন্দ কর। তোমাদের কতো গল্প বলেছো আমাকে! তুমি ওকে একটা সুযোগ দিতেই পারতে, কিন্তু...”

         উচ্চ-মাধ্যমিকের পরীক্ষার আগে নোটস্ আদান প্রদানের অছিলায় অপু অর্চনাকে সঙ্গে করে গিয়েছিল রিঙ্কুদের বাড়িতে। ততদিনে অপু দেখেছে যে কলেজে তার বান্ধবীদের প্রেমিকরা কলেজের গেটের বাইরে অপেক্ষা করে; কোন কোন বান্ধবীর বিয়ের খবরও পেয়েছে। পুরুষ সঙ্গীর অভাব বোধ করছিল সেও; তাই আর অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়েছিল সেদিন; কিন্তু কি কারণে যেন রিঙ্কু ভীষন গম্ভীর হয়ে ছিল। পরিস্থিতি হালকা করতে এবং সম্পর্কটাকে পুনরায় শুরু করার উদ্দেশ্য নিয়ে অপু রিঙ্কুকে হঠাৎ চোখ মেরে বসে। রিঙ্কু পরিষ্কার জানিয়ে দিল। “এসব কোরো না। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়েছি...”

“প্লিজ রাগ কোরো না...আমার কথাটা একবার শোন...” রিঙ্কুর হাত ধরে বলে অপু।

রিঙ্কু হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, “আমি খুব খারাপ স্টুডেন্ট...আমার নোটস নিয়ে কি করবে তুমি? তুমি তো অনেক ভাল স্টুডেন্ট...অনেক ভাল রেজাল্ট করেছো...”

অপু বুঝল যে বরফ গলবে না। অর্চনা বলল, “ইয়্যু মিসড্ দ্য বাস...ও আর তোমাকে চান্স দেবে না।”

         সত্যিই ওদের দুজনের মধ্যে আর কোন সম্পর্ক কোন দিন গড়ে ওঠে নি। তবে রিঙ্কু এসেছিল একবার, অপুর বিয়ের দিন। পুরো পরিবারই আমন্ত্রিত ছিল সেদিন, কিন্তু রিঙ্কু এসেছিল অন্য কারণে, অপুকে কনের সাজে একটিবার দেখতে বড়ো ইচ্ছে হয়েছিল যে! “একটা দানাও মুখে তোলে নি রিঙ্কুদা সেইদিন, জানিস দিদিভাই।” তপু বলেছিল,অষ্টমঙ্গলার দিন। শেষবারের মতো অপুর চোখে চোখ রেখেছিল একবার, বাসর ঘরে, তারপর ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়েছিল রিঙ্কু, অপু অনেক চেষ্টা করেও আর তাকে খুঁজে পায় নি।

 

ওরা এখন কে কোথায় আছে, তাও ওরা দুজনে কেউই জানে না। ফেসবুকেও দুজন দুজনকে খুঁজে পেয়েছে বলে তো মনে হয় না। দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার পাবারও চেষ্টা করেনি। এতদিনে তো দুজনের ফেস কাটিংও নিশ্চয় বদলে গেছে। ইনোসেন্ট মুখ দুটিতে নিশ্চয়ই চিন্তা আর ক্লান্তির বলি রেখা দেখা দিয়েছে। হয়তো দুজনেরই মনে পড়ে ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা। ছেলেমানুষী ভেবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টাও করেছে তারা; ভুলতে পেরেছে কি? তাহলেও চেহারাটা যে আবছা হয়ে গিয়েছে এতদিনে। ছেলেবেলার একটা ছোট্ট ভালবাসা, নিঃস্বার্থ একটা বন্ধুত্ব আবছা হতে হতে বিলীন হয়ে যাবে শূন্যে, কেউ আর তার খোঁজ পাবে না, কোনদিন, কোনখানে কারণ যে সময় চলে যায় তা আর ফেরৎ আসে না, তাই কোন কিছুর বিনিময়েও সেই পবিত্র প্রেমও আর ফিরে পাওয়া হবে না। এটাই যে নিয়ম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy