Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

সতীলক্ষ্মী

সতীলক্ষ্মী

10 mins
967


মহানবমীর মাতৃপূজা সমাপ্ত। চৌধুরীবাড়ীর বিশাল ঠাকুরদালান থেকে ভোগের বড়ো বড়ো গামলা, পরাত, মালসা সব চলেছে ঠাকুরদালানের একপাশে দরদালানে। সেখানেই ভোগ খেতে আসবে মানুষ, শহরের একাংশ প্রায়। আয়োজনে কোনো ত্রুটি থাকা চলবে না। বড়ো কর্তামশাই আর গিন্নী মায়ের কড়া হুকুম। আজ কিছুদিন যাবৎ চৌধুরীবাড়ীর গিন্নীমা, অর্থাৎ এবাড়ীর গৃহলক্ষ্মী গিরিবালাদেবী শয্যাশায়ী। কিন্তু তাতে কী? রোগশয্যায় শুয়েই তিনি যাবতীয় তদারকি করে চলেছেন। কোথাও কোনো ভুলচুক না থেকে যায়। কোথাও যেন না কোনো অব্যবস্থাপনা হয়। কোনোভাবেই যেন কোনো লোক নিন্দা বা আত্মীয় কুটুম্বের কাছে চৌধুরীবংশের মাথা হেঁট হবার মতো পরিস্থিতি তৈরী না হয়। যথাসর্বস্ব খুঁটিনাটি বিষয়ে গিন্নীমায়ের কড়া নজরদারি, সে যতই তিনি অসুস্থ থাকুন।


বর্ধমানের অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়ে গিরিবালা। লোক মুখে মেয়ের বাপ কলকাতায় থেকে শুনতে পেলেন বাগবাজারের ডাকসাইটে চৌধুরী পরিবারের বড়ো তরফের বড়ো ছেলে উপেন্দ্রনাথের জন্য সুন্দরী সুলক্ষ্মণা মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। যেমন খবর কানে শোনা তেমন কাজ। পাইকপাড়ায় মহারাজের নায়়েবি তহশিলদারিখানার কাজে ছুটি নিয়ে তড়বড়িয়ে দেশে ছুটলেন ভাইকে নিয়ে। মেয়ে আছে উপযুক্ত। সম্বন্ধ হোলো গিরিবালার। আর বিয়েও হয়ে গেলো একদম তড়িঘড়ি, ঐ সেই কথায় আছে না? "ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে"... ঠিক অমনি ভাবে।



অবিশ্যি তেমন ভাবে তড়িঘড়ি বাল্যবিবাহের চল সেকালের বাংলাদেশের গাঁ-শহর জুড়ে সবখানেই চালু ছিলো। চৌধুরীদের আবার চিরদিনের রীতি ছিলো প্রথমে মেয়ে দেখতে নায়েবমশাই যাবেন, সঙ্গে যাবে খাসদাসী, তত্ত্ব তালাশ নিয়ে। আর গৃহদেবতার প্রসাদী ফুল নিয়ে যাবেন কুলপুরোহিত মশাই। মেয়ে দেখে যদি তাঁদের মেয়েকে উপযুক্ত মনে হয়, এবং নায়েবমশাইয়ের তাদের ঘর-পরিবার দেখে পছন্দ হয়, তবেই আনানো হবে মেয়ের জন্মপত্রিকা। ছেলের সাথে যোটকবিচারে মেয়ের ঠিকুজি কোষ্ঠি মিললে তবে এগোবে বাকী কথা। যদি প্রয়োজন মনে করে তবেই সুযোগসুবিধে মতো যাবে বাড়ীর মেয়েরা। তাঁরা ফিরে এসে মেয়ে পছন্দ বলে ঘাড় হেলালে, বিয়ে পর্যন্ত কথা এগোতে পারবে। এবং সমান ঘর-পরিবার হলে বাড়ীর কর্তা স্থানীয় পুরুষেরা যেতে পারেন তারও পরে। লাখ কথা ছাড়া একখানা বিয়ে কী হতে পারে?




গিরিবালার বাপের বোধহয় ভয় ছিলো এমন সুপাত্র হাতছাড়া হয়ে না যায়। তাই তিনি ভাইকে নিয়ে ছুটলেন সোজা বর্ধমানে। মেয়ের বাপের সাথে কাকা বর্ধমানের বাড়ীতে পৌঁছলেন। পৌঁছে কাকা দেখলেন বৌদি ঘরে নেই। বাড়ীতে ঢুকেই দেখেছিলেন ভাইঝি দাওয়ায় বসে একলাই রান্নাবাটি খেলছে, তখন আর কালবিলম্ব না করে টেনে তুললেন ভাইঝিকে খেলা থামিয়ে দিয়ে। আর মেয়ের বাপ কাকা দু'জনে মিলে তারপর নিজের মা'কে সংক্ষেপে সব বললেন। তারপর ঠাকুমা আর বাপের নির্দেশে কাকা ভাইঝিকে কোনোরকমে একটা পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে তত্‍ক্ষণাত্‍ নিয়ে চললেন সোজা কলকাতায়।



ছ'বছরের ছোট্ট গিরিবালার মা তখন গেরস্থালির কোনো কাজে গাঁয়ের অন্য কোনো বাড়ীতে একটু গিয়েছিলেন। মাত্র ছ'বছর বয়সী শিশুকন্যা গিরিবালা কেঁদেকেটে বললেন, "মায়ের কাছে যাবো, বাবা, মা না এলে আমি কোত্থাও যাবো না।" কিন্তু তার বাবা সেকথা শুনলে তো! বাবা মেয়েকে সুপাত্রস্থ করতে, ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকা মেয়েকে নিয়েই চললেন কলকাতায়। ভাইঝিকে ভুলোনোর চেষ্টায় কাকা। বাপে কাকায় তখন কোনো প্রভেদ ছিলো না সংসারে। দুজনেই তখন অভিভাবক। শুভাকাঙ্খী। এমনকি মায়ের সঙ্গে মেয়ের শেষ দেখাটাও হোলো না। কলকাতায় পিসিঠাকুমার বাড়ীতে রেখে কথাবার্তা কয়ে, ধরাকরা করে ছ'বছরের গিরিবালার বিয়ে হয়ে গেলো বছর সতেরোর উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে। পরে গিরিবালা লোকমুখে শুনেছিলেন, তার মা ফিরে এসে মেয়েকে দেখতে না পেয়ে, বড়ো কান্নাকাটি করেছিলেন। তারপর একটিমাত্র মেয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতেই অসুস্থ হয়ে, শেষ পর্যন্ত মারা গেছেন।




বিয়ের পরে গিরিবালা ধীরেধীরে চৌধুরীবাড়ীর চালচলন, রীতিনীতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকলেন। তবে তাঁর স্বামী উপেন্দ্রনাথ সাহেবী চিন্তাধারার অনুকরণেই বিশ্বাসী। দেবদ্বিজে তাঁর তেমন ভক্তি শ্রদ্ধা নেই। আর পুজো আচ্চার মানে হোলো তাঁর কাছে কেবলমাত্র জমিদারির ঠাঁটবাট দেখানো, নিমন্ত্রিত কলকাতার বাবুসমাজকে। কলকাতার বাবুসমাজের বাবুয়ানি তখন উৎসব উপলক্ষ্যে বাঈজীনাচ, পায়রা ওড়ানো, আর নয়তো পোষা বেড়ালের বা খেলার পুতুলের বিয়ে দিয়ে নিত্যনতুন উৎসবের আয়োজন করা। এইসব উৎসবের খরচায়, রোশনাইতেই তখনকার কলকাতার বাবুদের রহিসি যাচাই হোতো। কে কতো টাকা বাস্তবিকই ওড়াতে পারে গড়গড়ার তামাকের ধোঁয়ায় এবং মদের ফোয়ারায়। আর চৌধুরীবাড়ীর বড়োকর্তা উপেন্দ্রনাথ চৌধুরী ততদিনে এইসব মানমর্যাদার লড়াইতে বড্ড জেদী একরোখা।



বড়োকর্তা উপেন্দ্রনাথের এই মাত্রাছাড়া বাবুয়ানির রেষারেষির ফলে, অচিরেই বেধে গেলো প্রবল পারিবারিক গোলযোগ। আয় ব্যয়ের সঙ্গতি রক্ষায় অভাব দেখা দেওয়ায়, এতোদিনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাপত্র সব ভাগের দাবী উঠলো। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভাগ হতে না হতেই উপেন্দ্রর খুড়তুতো ভাই নৃপেন্দ্রনাথ আলাদা হয়ে গেলেন। আগে যেটা ছিলো ঠাকুর্দা যোগেন্দ্রনাথের সন্তান সন্ততিদের জন্য নির্মিত একান্নবর্তী বসতবাড়ি, সেখানেই মাঝ বরাবর দেওয়াল উঠলো। ৭এর ১ আর ৭এর ২, এই ভাবে ভাগ হয়ে বাড়ি আলাদা হয়ে গেলো। বাগান ভাগ হোলো, পুকুরের ঘাট আলাদা হোলো।



তবে ঠাকুর পুজোর পালা ভাগ হতে দেন নি উপেন্দ্রনাথ। কারণ তাহলে তাঁর বাবুসমাজে নাককাটা যাবে যে। তবে গিরিবালাদেবী ভারী দুঃখ পেয়েছিলেন। আন্তরিক শত চেষ্টাতেও এই ভাঙন আটকাতে পারেননি বলে তিনি বিষম মর্মাহতও ছিলেন। বিশেষ করে এই উৎসবের দিনে তাঁর দেওর, ছোট জা আর তাদের ছেলেপুলের জন্য তিনি স্বামীকে লুকিয়ে ওবাড়ীতে সব ভোগের পরাত পাঠিয়ে দিতেন।

সত্যিই দেওর জায়ের চলে যাওয়ার দুঃখ ভুলতে পারেন নি গিরিবালাদেবী। গোপনে ওবাড়ীতে শুধু ভোগই নয়, তাদের জন্য লোকলৌকিকতার যাবতীয় উপহার সামগ্রীও পাঠাতেন। আবার স্বামীর বাবুয়ানির যাবতীয় আয়োজনেও যোগ দিতেন। বছরভর যেমনতেমন, দুর্গাপূজার সময় চৌধুরীবাড়ী সারা শহরের সঙ্গে যখন উত্‍সবে মেতে উঠতো, গিরিবালা দেবী একলাটি ঘরের মধ্যে বসে থাকতেন। আত্মীয়-স্বজনরা চেষ্টা করেও তাঁকে সান্ধ্য উত্‍সবে নিয়ে যেতে পারতো না। ঘরের মধ্যে থেকেই তিনি যাবতীয় নির্দেশ দিতেন, পরিচালনা করতেন। কিন্তু নিজেকে শাড়ী গয়নায় মুড়ে কিছুতেই তিনি দোতলার টানা বারান্দার চিকের আড়ালে বসে, ঐ বাবুয়ানির রোশনাইয়ে নিজেকে সামিল করতে পারতেন না। কখনো মুখে প্রকাশ না করতে পারলে কী হবে? বাঈজীনাচে আর তামুক মদে পয়সা ওড়ানোর মানে তিনি তেমন খুঁজে পেতেন না।



ছ'বছর বয়সে ছেড়ে আসা বর্ধমানের সেই গ্রামের বাড়ী, উঠোনের এককোণে মাটির তুলসীমঞ্চের সামনে গলায় কাপড় দিয়ে গড় করে মায়ের সন্ধ্যাবাতি দেখানোর কথাই ঘুরেফিরে মনে আসতো গিরিবালা দেবীর। এতো আলো, এতো রোশনাইয়েও সন্ধ্যার আঁধারে নিজের ঘরের নিভৃত কোণটুকুতেই নিজের মতো করে থাকতে ভালোবাসতেন চৌধুরীবাড়ীর বড়োগিন্নীমা, সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী গিরিবালাদেবী।



জীবনে একবারই মাত্র তিনি তাঁর মনের দুঃখের ও সাধের কথা স্বামীকে বলেছিলেন। উপেন্দ্রনাথ সেবার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তীর্থে যাবেন স্থির করলেন। বিশেষ ধরনের একটি নৌকাও ভাড়া করা হোলো সে কারণে। গিরিবালাদেবী হরনাথ, উমানাথ, লক্ষ্মীনাথ... তিন ছেলে এবং গৌরী, শ্যামা, অন্নপূর্ণা তিন মেয়েকে নিয়ে নৌকায় চড়ে বসলেন। তীর্থযাত্রা তেমনভাবে সম্পূর্ণই হতে পারে নি। নৌকাযাত্রায় প্রতিকূল আবহাওয়া এবং সন্তানদের শারীরিক গোলযোগের ফলে পথিমধ্যেই নানা বিপদের মধ্যে পড়তে হয়েছিলো। অবশেষে গিরিবালাদেবীই ভীষণ ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন কলকাতায় বাড়ীতে ফিরতে। পরে আরেকবার প্রস্তুতি নেওয়া হলেও, পরে সে যাত্রায়ও অব্যাহতি দিয়েছিলেন গিরিবালাদেবী নিজেই। এভাবেই শেষ হয়েছিলো শেষাবধি সংসার যাত্রাপথে তীর্থযাত্রার ইচ্ছাটুকুও। তাঁর সংসারই তাঁর শ্রেষ্ঠ তীর্থ ছিলো।




গিরিবালাদেবী লেখাপড়া শেখার কোনো সুযোগ পান নি বটে, তবে কিন্তু তিনি একেবারে নিরক্ষর ছিলেন না। চাণক্যের শ্লোক, শুভঙ্করীর আঁক, পাঁচালী পাঠের বই তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিলো। বিবাহের পরে তাঁর শিক্ষাগুরু হয়েছিলেন তাঁর দেওর নৃপেন্দ্রনাথ। পরে অবশ্য এসব ছাড়াও ছেলেদের ডেকে ডেকে গিরিবালাদেবী প্রায়শই রামায়ণ ও মহাভারত বা গীতাপাঠ করাও শুনতেন।




গিরিবালাদেবী সর্বমোট চোদ্দোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। আটটি ছেলে ও ছয়টি মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন গিরিবালাদেবী। তাঁদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন মাত্র এগারোজন। সাত ছেলে ও চার মেয়ে। এতোগুলি ছেলেমেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিলো বাড়ীর দাসী ও চাকরদের হাতে। সেকালের ধনীঘরের নিয়ম ছিলো জন্ম থেকেই শিশুরা ধাইয়ের স্তন্যদুগ্ধে লালিত হোতো। প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি স্তন্যদাত্রী ধাই ও একজন পালিকা দাসী নিযুক্ত হোতো, জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে শিশুসন্তানদের খুব বিশেষ সম্পর্ক থাকতো না বড়ো ঘরে। গিরিবালাদেবীর ছেলেমেয়েরাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাঁর সন্তানেরাও ভৃত্যদের কাছেই অথবা একান্নবর্তী পরিবারে অন্যদের কাছেই মানুষ হয়েছিলো।




গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন গিরিবালাদেবী, শ্রাবণ মাসের গোড়ায়। পালকি সমেত ডুব দিয়ে ওঠার সময় বাঁহাতের আঙুলগুলি বেকায়দায় পালকির দরজায় চেপ্টে থেঁতলে গেলো। বাড়ীতে আনা হলে হাতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে শয্যাশায়ী হলেন গৃহলক্ষ্মী গিরিবালাদেবী। প্রথমে টোটকা ও কবিরাজি দিয়ে সারানোর চেষ্টা ব্যর্থ হোলো। তারপর কলকাতা শহরের বড়ো বড়ো পাশ দেওয়া সাহেব ডাক্তার এনেও চিকিত্‍সা করানো হোলো, তাঁরাও সারাতে পারলেন না। পরপর অনেক ডাক্তার এলেন গেলেন। আঙুলের ভেতরে লোহার কুচি ঢুকে বিষিয়ে গেছে। একবার আঙুলে অস্ত্রোপচার করে লোহাকুচি বার করার পরেও ব্যথা কমলো না।



দু'মাস পার হয়ে গেলো। কিন্তু তার মধ্যেও গিরিবালাদেবীর ক্ষতজনিত রোগ পুরো সারলো না, খানিকটা উপশম হোলো মাত্র। এদিকে দুর্গাপুজোও এসে গেছে। পারিবারিক বাৎসরিক পুজো। তাতো আর বন্ধ করা যায় না। তাই দুর্গোৎসব নিয়ম মেনেই পালিত হোলো। দীপাবলিও পালিত হোলো প্রত্যেক বারের মতোই ধূমধাম জাঁকজমক করে। এইসব আয়োজনে কোনো ত্রুটিও হোলো না। শয্যাশায়ী থেকেও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবই পরিচালনা করে গেলেন চৌধুরী বাড়ীর গৃহলক্ষ্মী গিরিবালাদেবী।



শীতের শুরুতে হাতের ব্যথা বাড়লে হাওয়া বদলের জন্য গঙ্গায় নৌকা ভাড়া করে স্ত্রীকে সেখানেই রাখলেন উপেন্দ্রনাথ। বাড়ীর বন্ধ চার দেওয়ালের ঘেরাটোপের মধ্যে এতোকাল বাস করে এখন এই নৌকায় যেন মুক্তির আনন্দ পেলেন গিরিবালাদেবী। এই নৌকাটি যেন তাঁর একান্ত নিজের বলে মনে হোলো। বিয়ে হয়ে ইস্তক তিনি কেবলই চৌধুরীবাড়ীর গৃহিণী। এইপ্রথম বারের মতো, এখানেই তিনি তাঁর নিজের মনের মতো করে চলবার এক উপায় খুঁজে পেলেন যেন। নৌকায় তাঁর থাকার ঘরটির এককোণে তিনি ইতুঘট স্থাপন করলেন। তাঁর বর্ধমানের বাপের বাড়ীর এই মেয়েলি ব্রতপুজোটি তাঁর বড়ো প্রিয় ছিলো। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী মানদাদাসী রোজ টাটকা ফুল, বেলপাতা এনে দিতো পুজোর জন্য। তিনি স্নান করে গঙ্গাজলসহ ওই ফুল বেলপাতা নৈবেদ্য ঘটে নিবেদন করতেন রোজ।



বাড়ীর ডাক্তার গোপীনাথ রোজ নৌকায় এসে তাঁকে একবার করে পরীক্ষা করে যেতেন নিয়মমাফিক। মেয়েরা, বউমারাও রোজই দেখা করতে আসতো। তারা সঙ্গে করে গিরিবালাদেবীর পছন্দের সামগ্রী আনতো। কেউ কেউ সঙ্গে থেকেও যেতো রাতে কখনো কখনো। সবাইকে দেখলে ভারী আনন্দ পেতেন গিরিবালাদেবী। তবে বড়োছেলে হরনাথকে দেখার জন্য গিরিবালা দেবী বড়ো উতলা। সে যে তখনো বিলেতে, অনেক বড়ো পোড়ো সে, পাশ দিয়েছে ঢের। এবার তার ফেরার দরকার, ভাবেন মা গিরিবালাদেবী। তাকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে, মায়ের অসুস্থতার শুরুতেই, সব খবর জানিয়ে। বিলেত তো আর কাছে নয়। সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করে জাহাজে করে সাগরপার করে ফিরতে সময় তো লাগবে। এদিকে মায়ের মন তোলপাড়।




শীতের শুরুর মাসখানেকের মধ্যেই হরনাথ কলকাতা ফিরে এলেন। হরনাথ ফিরে এলে গিরিবালাদেবীও নৌকা থেকে ঘরে ফিরলেন। এতোদিন পরে বড়ো ছেলেকে দেখে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন গিরিবালাদেবী, "আর দেরী করে ফিরলে তোমার দেখা পেতাম না যে, বাবা। আর বোধহয় বাঁচবো না আমি।" মায়ের মাথাটা পরমস্নেহে নিজের বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয় ছেলে, "কে বলেছে বাঁচবে না? তোমার তো এখনও পঞ্চাশও হয় নি মা! এখনই কোথায় যাবে? আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চিকিত্‍সা করাবো তোমার। দেখি তো তোমার অসুখ কেমন না সারে? আমি এসে গেছি তো, তোমার আর কোনো চিন্তা করার দরকার নেই, মা!" 




সত্যিই যেন মনে প্রাণে নতুন জোরের জোয়ার এলো গিরিবালাদেবীর। আগের তুলনায় তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ। ব্যাথা আছে বটে, কিন্তু তাঁর সেই ব্যথা সহ্য করার শক্তিটাও যেন অনেকগুণ বেড়েছে। মাঝে মাঝেই সকালের রান্নার জোগাড়ের তদারকির সময় বা মেয়ে বৌদের বিকালের চুল বাঁধার আসরেও বসতে শুরু করলেন আবার। বছর ঘুরে গেলো। গিরিবালার শরীর কিছুটা ভালো থাকায় উপেন্দ্রনাথও নিশ্চিন্ত হয়ে অঘ্রাণের গোড়ায় সদলবলে নৌকাভ্রমণে নদীয়ায় কিছু জমিদারির কাজ দেখতে গেলেন। কাজও হবে, আবার ভ্রমণে মনও খানিক হালকা হবে। স্ত্রীর রোগ ও তার দীর্ঘদিনের অসুস্থতার ফলে উপেন্দ্রনাথ মানসিক বড়ো বিপর্যস্ত ছিলেন। বড়ো ছেলে বিলেত থেকে ফেরার পরে স্ত্রী গিরিবালাদেবী আরোগ্যের পথে, এইটে তাঁর মনে শান্তি ফিরিয়েছে খানিক। 




স্বামী নৌকা ভ্রমণে বের হবার পরেই, গিরিবালাদেবীর শারীরিক অবস্থারও দ্রুত অবনতি শুরু হোলো। উপেন্দ্রনাথকে খবর পাঠানো হলে, তাঁর নির্দেশেই গিরিবালাকে ঘরবন্দি না রেখে গঙ্গাবক্ষের মনোরম বাতাসে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হোলো। কিন্তু স্বামীর অনুপস্থিতিতে আবার তাঁর শরীর অতিদ্রুত খারাপ হতে শুরু করলো। ডাক্তার বদ্যি ছেড়ে এবার শুরু হোলো‌ তুকতাক, গিরিবালাদেবীর মতেই। এক হাতুড়ে ওঝার পরামর্শে জড়িবুটি বেটে ক্ষতের চারপাশে লাগানোয় ক্ষত বিষাক্ত হয়ে পেকে উঠলো। এবার বোধহয় আর বাঁচবেন না। গিরিবালা শেষ ক'টাদিন বাড়ীতে নিজের ঘরে কাটানোই উচিত বলে মনে করলেন।ছোট ছেলে মেয়েদের আবদারে বাড়িতে কয়েকদিন তাদের ঘরের একপাশেই বিছানা করে থাকছিলেন গিরিবালা। অসুখ বেড়ে যেতে তাঁকে তাঁর দোতলার পুব-দক্ষিণ খোলা নিজের শোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হোলো। ক্রমশঃ বিছানা থেকে ওঠার শক্তিও হারালেন গিরিবালাদেবী।




খবর পেয়ে বড়ো বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন উপেন্দ্রনাথ। এতোকালের সঙ্গী গিরিবালাকে কি আর তবে সত্যিই ধরে রাখা যাবে না? উদাস, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রইলেন। বাড়ীতে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। সবাই ভাবছেন কর্তামশায় নদীয়া থেকে ফিরে এসে দেখতে পাবেন তো গিন্নীমাকে? গিরিবালা কিন্তু নাড়ি ছেড়ে যায় যায় এমন অবস্থাতেও বললেন, "তোরা এতো ভাবিস নে রে, বড়োকত্তার পায়ের ধুলো না নিয়ে আমি যে মরতেও পারবো নে রে।"




ঠিক তাইই হোলো। উপেন্দ্রনাথ নদীয়ার জমিদারি থেকে ফিরে এলেন কলকাতায়। বাগবাজারে পৌঁছেই তড়িঘড়ি সোজা চলে এলেন স্ত্রীর দোতলার শোবার ঘরে। গিরিবালা অতি কষ্টে হাত বাড়িয়ে কর্তার পা ছুঁয়ে বললেন, "ছেলেপুলেরা সব রইলো, দেখেশুনে রেখো। আমি তবে চললুম। আর জন্মে ঠিক আবার দেখা হবে আমাদের।"

ঘরভরা ছেলে-মেয়ে, বউ-জামাই, নাতি-নাতনি, দাসদাসীর সামনে স্বামীর আশীর্বাদ নিয়ে চোখ বুজলেন গিরিবালাদেবী। চুপচাপ কিছুক্ষণ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ছাদে চলে গেলেন উপেন্দ্রনাথ। বড়ো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বড়োকর্তা একলা থাকতে চেয়েছিলেন তখন।



শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময়, ছেলেদের ডাকে আবার নেমে এলেন। এয়োস্ত্রী অর্ধাঙ্গিনীর দেহে নিজের হাতে ফুল চন্দন আলতা সিঁদুর ছিটিয়ে দিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, "সেই ছ'বছর বয়সে এসেছিলে এবাড়ীতে। আর আজ এই ভরা সংসার ফেলে রেখে একলাই আগেভাগে চললে বড়োবৌ? এ কেমনধারা কথা হোলো তো বড়োবৌ?" শ্মশানযাত্রার ঠিক আগেই হঠাৎ চৌধুরী বাড়ীর অন্দরমহলে ভারী শোরগোল। হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি। কী হয়েছে? সবাই উদ্বিগ্ন। মানদাদাসী এসে খবর দিলো, হরনাথের স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠেছে। প্রথম পোয়াতি, বড়ো কাহিল হয়ে পড়েছে। পুরনো দাঈ বলছে, সাহেব ডাক্তার ডাক দিতে, গতিক মোটে সুবিধের নয়। 




কী আতান্তর! গিরিবালাদেবীর শ্মশান যাত্রা স্থগিত। তাঁর অতি স্নেহের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ নতুন বংশধর আনার লড়াই লড়ছে। সাহেব ডাক্তার ও তাঁর সাথে এক মেম মিডওয়াইফ এসেছে। ঘন্টা দুয়েক পরে সুসংবাদ, কন্যাসন্তান হয়েছে, ঠিক যেন সোনার লক্ষ্মীপ্রতিমা। সবাই হরনাথের সদ্যোজাত কন্যাকে দেখে হতবাক। এতো স্বয়ং গিন্নীমা, সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখ, সেই কাঁচা সোনার মতো রং, হরনাথের শিশুকন্যা রূপে।




চৌধুরীবাড়ীর বড়োকর্তাও কৌতূহলী হয়ে নাতনির মুখ দেখতে চাইলেন। দাঈয়ের হাতে ধবধবে সাদা মসলিন কাপড়ের ওপরে শুয়ে হরনাথের প্রথম সন্তান, কন্যা সন্তান। সত্যিই তো! এযে সত্যিই গিরিবালারই প্রতিরূপ। গিনিখানা সদ্যোজাতের কপালে ছুঁইয়ে উপেন্দ্রনাথ বললেন, "শঙ্খ বাজাও, উলুধ্বনি দাও। সতীলক্ষ্মী গিরিবালা আবার নিজের সংসারে ফিরে এসেছে গিরিজা হয়ে।" জ্যেষ্ঠ পুত্র হরনাথের কন্যার নামকরণ করলেন বড়োকর্তামশাই উপেন্দ্রনাথ.... গিরিজাসুন্দরী।

গিরিবালার শ্মশানযাত্রার পূর্বেই তাঁর সংসারে নতুন প্রাণের আগমন! শোকে না ভাসিয়ে সংসারতরণীকে তিনি আনন্দসাগরে ভাসিয়ে গেলেন। সংসার অন্ত রমণী গিরিবালাদেবী, থেকে গিরিজাসুন্দরী, সবাইই সংসারে সুখদায়িনীর প্রতিমূর্তি। স্বয়ং সম্পূর্ণা, লক্ষ্মী স্বরূপা!


(বিষয়: আস্তিক না নাস্তিক?)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics