উত্সব এবং তারপর...
উত্সব এবং তারপর...
"কি রে ওঠ,এবার তো নামতে হবে!"সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে গোপাল।বুঝে নিতে সময় লাগে কোথায় আছে ও।"বাপ চলে
এসেছি বাড়ি?"
"নারে এখন কোথায়?এই তো সবে জংশন, এরপর এখনো একটা গাড়ি বদলাবো,তারপর
আমাদের স্টেশনে, তারপর ভটভটি চেপে সোজা বাড়ি।যাবার সময় গেলুম মনে নেই?"-কথার মাঝেই স্টেশন চলে আসে।গোপালের বাবা গোপালের হাত ধরে স্টেশনে নামে।ওরা
ছাড়াও আরো দশজন ঢাকি নামে।এদের মধ্যে রামু জেঠু শুধু ওদের ট্রেনে
যাবে।বাকি সবাই অন্য ট্রেন ধরবে।ওরা সবাই আজ এক সপ্তাহ ঘর ছাড়া।মা দূর্গা
জলে পড়লে ওরা ঘরে ফিরছে।ওদের ঢাকের বোলে মেতে ওঠে পুজার উত্সব।এ বছরেই
প্রথম সাত বছরের ছোট্ট গোপাল বাবার সাথে শহরে গিয়েছিল।বাবা ঢাক বাজায় আর
ও কাঁসি।এই বয়সেই সুন্দর ঢাকের তালে কাঁসি বাজায় গোপাল।বাকি সব ঢাকিরা
গোপালকে আদর করে ট্রেনে উঠে পড়ে।আবার পরের বছর দেখা হবে।গোপালের পেটে
হাজার কথা গুড় গুড় করছে।উফ্ কখন যে বাড়ি যাব, ভাবে গোপাল।দশ মিনিট অন্তর
অন্তর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে আর কত দেরি বাবা?গোপালের বাবা হেসে
সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়।-আর বেশি দেরি নেই বাবা।
গোপাল মনে মনে চিন্তা করে মাকে কত কথা বলতে হবে।কত কিছু দেখেছি
শহরে।বাবুরা আবার একটা জামাও দিয়েছে।কত্ত বড় প্যান্ডেল, কত্ত লোক!কি
সুন্দর কি ফর্সা মেয়েগুলো ঠিক যেন মাদূগ্গার মত সুন্দর।আর হ্যাঁ দূগ্গা
পিসির মত দেখতে একটা মেয়েকে দেখেছে সেটাও তো বলতে হবে মাকে।
ইস কত দিন দূগ্গাপিসি আসে না।কত ভাল না বাসতো দূগ্গা পিসি।সব সময় কোলে
নিয়ে ঘুরতো।স্নান করিয়ে দিত।তারপর একদিন বিয়ে হয়ে চলে গেল আর এল না।শুধু
বাবা একদিন রামু জেঠুকে নিয়ে দূগ্গাপিসির শ্বশুরবাড়ি গেল।তারপর মা
কাঁদল,ঠাম্মা কাঁদল বাবা কাঁদল,সব্বাই বললো দূগ্গা পিসির নাকি পোড়াকপাল
তাই অমন বর জুটেছিল।মাকে কতবার জিজ্ঞাসা করে দূগ্গা পিসি কবে আসবে?মা কিছু
বলে না শুধু কাঁদে।মা দূগ্গা তো প্রতি বছর আসে তা হলে দূগ্গা পিসি কেন
আসে না?
দূর থেকেই গোপাল দেখতে পায় মা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে পথের দিকে চোখ
মেলে।এক,দুই,তিন ছুট।এক ছুট্টে গোপাল মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।মা জড়িয়ে
ধরে বুকের মধ্যে।এক সপ্তাহ পর সন্তান মায়ের বুকে ফিরে এল।এবার শুরু হবে
গোপালের বাড়িতে উত্সব।
মা, মা,মাদূগ্গা তো প্রতি বছর আসে তাহলে দূগ্গা পিসি আসে না কেন?অবোধ
বালকের প্রশ্নের কোনো উত্তর পায়না গোপালের মা।কি করে বোঝাবে তাকে আজও কত
দূর্গাকে পণের কারনে অকালেই পৃথিবী ছাড়তে হয়।গোপালের মা শুধু গোপালকে আর
একটু জোরে বুকে চেপে ধরে সন্তানসম ননদকে হারনোর কষ্ট ভুলে যেতে চায়।
[2]
মায়ের ফোন।ভ্রাইবেট হচ্ছে।রোশমি শিখার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে আসে কেবিন
থেকে।আজ এক সপ্তাহ হল শিখা এই হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।বড় ভালবেসে ফেলেছে
এর ই মধ্যে রোশমি শিখাকে।নিজের ছোট্ট বোনের মত মনে হয় ওর ওকে।কতদিন যে
বোনকে, মাকে দেখেনি রোশমি।বাবা মারা যাবার পর সংসার চালাতে সুদূর কেরল
থেকে এই পশ্চিমবঙ্গে নার্সের চাকরিটা নিতে হয় রোশমিকে।এখন পূজার সময়
বাঙালি নার্সেরা ছুটি পাবে।পূজার শেষে দশমীর পরে এক মাসের জন্য রোশমি
ছুটি পাবে।উফ কবে যে দিনটা আসবে!আর তো দুসপ্তাহ।দশমীর পরের দিন ই রওনা
দেব।টিফিনটা খেতে খেতেই এই সব ভাবনার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল রোশমির
মনটা।হঠাত্ ভীষণ চিত্কার আর ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখে হত চকিত হয়ে
পড়ে।বুঝতে সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড ব্যাপারটা।আগুনের লেলিহান শিখা ঘিরে
ধরেছে ওটি রুমকে।ওই ঘরেই তো শিখা রয়েছে?সবার বারণ আগাহ্য করে ছুটে যায়
রোশমি।
আজ দশমী, মা জলে পড়েছে।ঢাকের বাদ্যিও বিদায়ের সুরে আকাশ বাতাসকে ভরিয়ে
তুলেছে। চোখের জল মুছে আবার সবাই অপেক্ষা করে মা ফিরে আসবে আবার, তার
গৌরী রুপ ছেড়ে কালী রুপে বিরাজ করবে।
রোশমির মুখের ব্যান্ডেজ ধীরে ধীরে খোলেন ডঃ।শিখার বাবা -মা শিখার হাত ধরে,
তখন দূর্গার আর এক রুপ কালী দর্শন করে দুচোখ কৃতজ্ঞতার অশ্রুর প্লাবনে
ভরিয়ে তুলেছেন।
[3]
বার বার ঘড়ির দিকে চোখ যায় সায়নের।আর তো দুঘন্টা।ফোনে জানিয়ে দেয় নীলাকে
-"রেডি থাকবে ডিউটি শেষ করেই বাড়ি পৌঁছে জাস্ট ড্রেসটা চেঞ্জ করেই বেরিয়ে
পড়বো।বাবানকে আজ ঐ নীল ড্রেসটা পরাবে।"ফোনের ওপারে তখন বাবান লাফাচ্ছে।ইস
আর কত দেরি বাবার আসতে।কি যে মজা আজ ওর।সবাই তাদের বাবার সাথে রোজ রোজ
ঠাকুর দেখতে বেরোয় আর ওর বাবার ই খালি অফিস থাকে।নীলা ও আজ পরিপাটি সাজে
নিজেকে অপরূপা করে তোলে।বোঝে নীলা,কতটা নিরূপায় সায়ন।পুলিশ ইন্সপেক্টর এর
স্ত্রী দের অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়।নীলা খুব ভালো করে জানে কতটা ওভার
ডিউটির বিনিময়ে সায়ন আজ এই সন্ধ্যের ছুটিটা ম্যানেজ করেছে।তবুও মাঝে মাঝে
অভিমানে মনের কোনটা ভারী হয়ে ওঠে।নীলার মনে হয় আজ নবমীর রাতটা শুধুই যেন
ওদের তিন জনের।
ফোনটা আসার পর কয়েক মিনিট নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় লাগে সায়নের।আর দেরি
করা যাবে না।এক্ষুনি পৌঁছাতে হবে স্পটে।সায়ন ছুটে চলে নামী পূজা মন্ডপে।
কোনো এক অজানা কারণে হঠাত্ ঘটা বিশৃঙ্খলাকে নিয়ন্ত্রনে আনতে যাতে
প্রতিটা মানুষ তাদের উত্সবের দিনগুলো আনন্দে কাটাতে পারে কোনো রকম বিপদ
ছাড়াই।কেবলমাত্র ঘুমিয়ে পড়া বাবানের গালে তখনো শুকনো জলের দাগ।আর বাবানের
পাশে শুয়ে থাকা নির্ঘুম নীলার আর কর্তব্যে ব্যস্ত সায়নের মনে পরের বছরের
জন্য আবার নতুন করে স্বপ্ন বোনা চলতে থাকে।
[3]
ঘর ঘর ঘর....সেলাই মেশিনের শব্দ রাত্রির নিস্তবদ্ধতা খান খান করে
দিচ্ছে।নির্মলার এখন নাওয়া খাওয়ার সময় নেই।এবারের পূজোতে একটু বেশিই কাজ
নিয়েছে।কদিন আগেই নির্মলা যখন পাশের বাড়ির বৌদির শাড়িতে ফলস্ বসাচ্ছিল
তখন এই প্রথম তার একমাত্র মেয়ে নিতু আপন মনেই বলে ফেলেছিল "মা শাড়িটা কি সুন্দর না?" "তোর খুব ভাল লেগেছে?"
নিতু মাথা নিচু করে শুধু অস্ফুটে হুম্ বলেছিল।সে ভালোই জানে বাবা চলে
যাবার পর মা কত কষ্টে তাকে মানুষ করছে, তাই এত দামী শাড়ি চাওয়া
বিলাসিতা।তবু মায়ের মন বুঝে নিয়েছিল মেয়ের মনের চাওয়া।"কিছুই তো দিতে
পারি না একটু বেশি কাজ নিয়ে কি পারব না মেয়ের এটুকু চাওয়া পূরণ করতে"
ভাবে নির্মলা।
অষ্টমীর সকালে তখনো শাড়ি কেনার টাকা পাঁচশ কম।না এবারে আর হল না ,স্বপ্ন
টা আবার তোলা থাক পরের বছরের জন্য...