নদীর নাম মোহনা
নদীর নাম মোহনা
টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি বাইরে পড়েই চলেছে,শব্দটা যেন রিম্ ঝিম্ ঝিম্ কোনো গানের সুর মনে করিয়ে দেয়। নদীর জলে বৃষ্টির শব্দ অপরূপ সুরধ্বনি জাগিয়ে তোলে৷মনে পড়ে যায় সেই কতো ছোটবেলাকার কথা।
সেই কাগজের নৌকা বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দেওয়া,সকলে মিলে মজা করে মাছ ধরতে যাওয়া,তারপর মাছের টোপ্ তৈরী করে সেই ঘন্টার পর ঘন্টা ছিপ্ হাতে করে বসে থাকা,এমনি আরো কতো কি। রাতে চন্ডীমন্ডপে বসে মুড়ি ও গরম গরম বেগুনি সহযোগে জমিয়ে আড্ডা আর একটানা ব্যাঙেদের সঙ্গীতোল্লাস। উফ্ ফাটাফাটি ছিল সেই সব দিন৷ ভাবেন, কোলকাতার নামকরা আন্তর্জাতিক সংস্থার এম. ডি. সৌগত চৌধুরী।
মায়ের কাজ করতে এসে কেমন যেন হঠাৎ পুরোনো সব কথা মনে পড়ে যায় তার৷সেই সব দিনগুলো কি মধুরই না ছিল যার প্রত্যেকটা স্মৃতি এখনো চোখের সামনে ভাসে।
জানালার ধারে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে সব কথা মনে পড়ে যায় তার৷দুই বছর আগে বাবা চলে গেছেন। রেললাইনের ধারে ছোট্ট সুন্দর গ্রাম,পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। সৌগতবাবু কতোবার মাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন,কিন্তু উনি কখনো আসতে চাননি।কারণটা এইরকম দিনে বসে থাকতে থাকতে বুঝতে পারেন তিনি৷এমন জায়গা ছেড়ে, বদ্ধ পরিবেশে-অসম্ভব, নিজের মনেই ভাবেন। ছোট্টবেলার এই দিনগুলোই ছিল বেশ ভালো৷বাবা ছিলেন গ্রামীণ একটা স্কুলের হেডমাস্টার। কতো কষ্ট করে বড় করেছেন তাঁকে যা সার্থক হয়েছে আজ।
কিন্তু এখানে পড়ে থাকলে তো চলবেনা, ফিরতে হবে আবার তাঁকে কাজের জায়গায়। চিন্তা শুধু ছোট একটি মেয়েকে নিয়ে,মোহনা নাম তার। মায়ের কাছেই থাকতো। ওর বাবা-মা গেলবারের বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। বড়ো মায়া লাগে মেয়েটিকে দেখলে। ফুলের পাপড়ির মতোন মুখখানি,কি সুন্দর স্বভাব;সবসময় মুখে মিষ্টি হাসি। সৌগতবাবু ডাকেন কাছে,মাথায় হাত বুলিয়ে দেন৷
''তুই যাবি আমার সাথে?''
''কোথায়?''
''কেন কোলকাতা? যেখানে আমি থাকি।''
''ওখানে কি আছে?''
''অনেক কিছু৷গাড়ি কতো রকম,বড়ো বড়ো বাড়ি,কতো রকম লোকজন..''
''এরম সুন্দর নদী আছে?গাছপালা? ক্ষেত ,মাঠ এসব কিছু..''
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সৌগতবাবু। নাহ, এসব কিছুই সেখানে নেই। ছোট্ট মেয়েটিকে মিথ্যে কথা বলতে পারেননা তিনি। অথচ মা বারবার বলেছিলেন তাঁর কিছু হলে মেয়েটিকে যেন কাছে রাখেন,একটু দেখেন। কি যে করেন তিনি! ভাবার জন্য আর মাত্র দুইদিন,তারপরই আবার তাঁর জগতে ফিরতে হবে তাঁকে।
এই দুইদিন মোহনাকে বিশেষ একটা দেখতে পাওয়া গেলনা। কে জানে, তার মনে বোধহয় ভয় ঢুকে গিয়েছিল তিনি যদি তাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যান।
অবশেষে যাওয়ার দিন চলে আসে কাছে। একটু বাইরে বেরিয়েছিলেন,ফিরে এসে দেখেন তাঁর খাবার ঢাকা দেওয়া,ঘরদোর পরিষ্কার ঝাঁট দেওয়া,সবকিছু পরিপাটি সাজানো। বোঝেন এই মেয়ের হাতে ভিটে ভালোই থাকবে। স্টেশন পাশেই। শুধু মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন লোক এসেছে। ট্রেনের টাইমে এখনো দেরী আছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সৌগতবাবু যদি তাকে একটিবার দেখতে পান.. নাহ্ সে এলোনা।
বেরোতে যাবেন হঠাৎ দরজার কড়াটা নড়ে উঠল। মোহনা, নিজেই কাছে এসে দাঁড়ালো।
''তুমি সত্যি চলে যাচ্ছো?'' দুচোখে জল।
''হ্যাঁ মা, আমায় যে যেতে হবেই। তুমি..''
কথাটা শেষ করতে পারলেননা,তার আগেই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
''না আমি কোথাও যাবোনা। এখানে ঠাকুর্দা ঠাকুরমা থাকতো এখান থেকে আমি কোথাও যাবোনা..''
এরপর খানিক সব স্তব্ধ। সৌগতবাবু কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেননা।হঠাৎ মোহনা বলে উঠল,
''তুমি যাও নিশ্চিন্তে। আমি এখানে ভালোই থাকবো,এই বাড়িও আমি দেখবো।''মুখে স্নিগ্ধ হাসি..
সৌগতবাবু কিছু বলতে পারলেননা।সারা মন জুড়ে ছেয়ে গেল এক অপূর্ব আলো যা এই মেয়েটির মধ্যে আছে। এতোটুকুন মেয়ে কি বুদ্ধি!কি আলোর দীপ্তি!সত্যি এই সুন্দর মেয়েটিকে ওই কংক্রীটের জগতে নিয়ে গিয়ে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানেই হয়না,ভাবলেন সৌগতবাবু। তাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে মনে আনন্দ নিয়েই স্টেশনের পথে রওনা হলেন।
#positiveindia