আমার চোখে বিদায়ী বছর, ২০১৯
আমার চোখে বিদায়ী বছর, ২০১৯
২০১৯… আর মাত্র দুদিন, তারপরেই প্রাক্তনের তালিকায় নাম লেখাবে বছরটা। আজকে এই বিদায়ী বছরের স্মৃতিচারণ করতে বসে আর প্রথম পুরুষের সাহায্য নেব না, অর্থাৎ এই গল্প তাতাই লিখবে (লিখবো) নিজের কথায়, উত্তম পুরুষে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস ছিল হয়তো আমার জীবনের ভয়ঙ্করতম একটা সময়। ১১ই ডিসেম্বর, মঙ্গলবার দাদুর মৃত্যু। তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় এক্সিডেন্টে আচমকাই এক মেসোকে হারালাম। তার আবার পাঁচ দিনের মাথায় এক দিদা চলে গেলেন। মেনে নেওয়া যায়না পরপর এতগুলো মৃত্যু। কেঁপে উঠেছিলাম ভয়ে। বাড়িটা মোবাইলটা বাজলেই কিংবা সন্ধ্যা নামার পর গেটের আওয়াজ হলেই কেঁপে উঠত বুকটা। রাতে ঘুম আসতো না এক অজানা আতঙ্কে, মনে হত ভোর হলেই আবার কোনো দুঃসংবাদ শুনবো না তো! এইরকমই এক আতঙ্কঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমার জীবনে এসেছিল ২০১৯। গোটা বিশ্ব যখন নতুন বর্ষপূর্তির আনন্দে মাতোয়ারা তখন আমি বা আমার পরিবার মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছি, "এই বছরটা যেন আর এতো ভয়াবহ না হয়।" এবারে আর নতুন বছরের উদ্দীপনা ছিল না আমার মধ্যে। পরপর আঘাতে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম ভেতরে ভেতরে। শুনেছি আমার নামের অর্থ নাকি "সন্ধ্যা প্রদীপ", অন্ধকারকে দূর করে যে। কিন্তু এখন এই প্রদীপের সলতে ফুরিয়েছিল। লেখালেখি যা এই আলো জ্বলার অক্সিজেন ছিল সেই অক্সিজেনটাও যেন কমে গিয়েছিল বাতাসে।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। সপ্তাহ শেষ হলেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস। StoryMirror এর মঞ্চে ঘোষণা করা হল একটি বিশেষ প্রতিযোগিতার, শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য--- "Women Write Now"। স্টোরিমিররে সেই কিছুদিন শুরু করেছি লেখা। কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিইনি এর আগে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতার বিষয়টা কোথাও না কোথাও ছুঁয়ে গেল মনকে। মেয়েদের জন্য প্রতিযোগিতা! আমি কি পারিনা আবার লেখা শুরু করতে? কিন্তু আজকাল মাথায় তো প্লট আসেনা, তাহলে লিখবো কিভাবে? কিছুদিন আগেই পেপারে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। নেপালের কিছু কিছু এলাকায় কিভাবে মেয়েদের মাসিকের সময় বাড়ির থেকে অনেক দূরে ঝুপড়িতে রেখে আসা হয়; এমনকি ভারতেরও বেশ কিছু রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে নাকি এই প্রথা বর্তমান। আমি সাধারণ বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ছোটর থেকে শেখানো হয়েছে মাসিক একটা লুকোছাপা করে রাখার বিষয়, মাসিক নিয়ে খোলাখুলি কথা বলাতে "taboo" রয়েছে। তাই একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম এই বিষয় নিয়ে লিখবো কিনা। কিন্তু এই নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে হাতে উঠে এলো মারাত্মক সব তথ্য, ভেবে শিউরে উঠলাম ওই সব এলাকাতে আজও মেয়েদের কিরকম ভাবে রাখা হয়! তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যদি লেখক হয়ে থাকি তাহলে এটা তো আমার দায়িত্ব যে কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হওয়া। আর তাছাড়া আমাদের মা ঠাকুমারা তো পুরোনো দিনের মানুষ, তাঁরা তাদের গুরুজনদের কাছে যা শিখেছেন তাই শেখাচ্ছেন আমাদের। কিন্তু আমাদের শেখা তো শুধু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বাবা মা আমাদের উচ্চ শিক্ষা দিচ্ছেন, বৃহত্তর জগতের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন তাই আমাদের উচিৎ সেই শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানো। আমি জানি মাসিক কোনো "taboo" নয়, আমাদের মল মূত্র ত্যাগের মতোই একটি সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, তাই এতে লুকোচুরি কিছু নেই। সুতরাং, আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে দূরে রেখে আমি কলম ধরলাম, লিখলাম "গাঁওকোর"। মেয়েদের মাসিকের সমস্যাকে কেন্দ্র করে লেখা একটি গল্প। আমি জানি আমার এই গল্প সেই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছাবে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল আমি যদি সাহসী হয়ে এই বিষয় নিয়ে লিখতে পারি তাহলে হয়তো বা আরও কেউ আমাকে দেখে সাহস পাবে এই নিয়ে কলম ধরার। তাকে দেখে হয়তো আরও অন্য কেউ সাহস পাবে। এইভাবে যদি একটা সাহসিকতার তরঙ্গ প্রবাহিত করতে পারি তাহলে হয়তো একদিন না একদিন ওই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ গুলোর কাছেও এই তরঙ্গের ঢেউ গিয়ে পৌঁছাবে। আমি স্টোরিমিররের প্রতিযোগিতায় প্রথম হলাম ওই গল্পটার জন্য। আর তার চেয়েও বড় কথা আমার ওই গল্পটি পড়ে আমারই এক ফেসবুকতুতো বোন যে কিনা এই বিষয় নিয়ে অন্য একটি প্লটে গল্প লেখার কথা ভাবছিল কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না, সে এবার সাহস করে লিখেই ফেলল তার গল্পখানি। তার থেকে মেসেজ পেয়ে সত্যি বলতে ভীষণ গর্ব হল আমার, যে একটা চিন্তা তরঙ্গের সূচনা অবশেষে করতে পারলাম। আর এই দিক দিয়ে ২০১৯ আমার কাছে সেরা। এই মার্চ মাসেই storymirror এর "Author Of the Week" এর শিরোপা পেয়েছিলাম। এছাড়াও স্টোরি মিরর থেকে একের পর এক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি এই বছর।
একটা অনলাইন গল্প লেখার প্লাটফর্ম আছে। প্লাটফর্মটা মূলত মেয়েদের জন্য বা বলা ভালো মায়েদের জন্য। এক ফেসবুকতুতো লেখিকা দিদি ওই প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত গল্প লেখেন এবং অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। সেই দিদি আমাকে প্রায়ই বলতেন ওখানে লিখতে। আমার মনটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আমার তো এখনও বিয়েই হয়নি,মায়েদের প্লাটফর্মে কি লিখবো! তার ওপর আমি তো সামাজিক গল্প লিখিনা বললেই চলে, কি করে লিখবো ওখানে! ওই প্লাটফর্মের ফেসবুক পেজ আমার ফলো করা ছিল। একদিন দেখলাম ওরা শত শব্দের গল্পের একটি কনটেস্টের আয়োজন করেছে। বিষয়টি দেখা মাত্রই অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকা ছোটবেলার একটা ঘটনা জেগে উঠে চলে এলো সচেতনে। লিখে ফেললাম একশো শব্দের একটি পরমাণু গল্প। তিনদিন পরে বিজয়ী তালিকায় নিজের নাম দেখতে পেয়ে কি যে আনন্দ হল বলার নয়। এর আবার কয়েক সপ্তাহ পর দেখলাম ওদের সাপ্তাহিকী লেখার চ্যালেঞ্জে একটি খুব পরিচিত পারিবারিক বিষয় দিয়েছে। বিষয়টি দেখা মাত্রই এক পরিচিতার কথা মনে এলো। তাঁকে নিয়ে গল্প লিখবো ভেবেছি অনেকবার কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠেনি। এবার এই সুযোগে লিখে ফেললাম গল্পখানি। সত্যি বলতে কোনো প্রত্যাশা রেখে লিখতে বসিনি। এমনিই লিখবো বলে লিখেছিলাম। কিন্তু পরের সপ্তাহে শুক্রবার দেখলাম আমার গল্পই সপ্তাহের সেরা নির্বাচিত হয়েছে। সেই মাসেই ওই প্লাটফর্মে আমার আরেকটি ব্লগ মাসের সেরা নির্বাচিত হল। উৎসাহ উদ্দীপনায় কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন। এতো আনন্দ শেষ কবে হয়েছিল মনে নেই। এখানের পুরস্কারের অর্থ থেকে জীবনে প্রথম মা বাবার জন্য উপহার কিনেছিলাম। মা বাবার চোখে সেদিন দেখেছিলাম এক প্রচ্ছন্ন গর্ব। বাবা যখন গর্ব করে সবাইকে উপহারটা দেখাচ্ছিলেন সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। সেই প্রথম মনে হয়েছিল "হ্যাঁ আমিও পারি।"
২০১৯ এ আরও বেশ অনেকগুলি পুরস্কার পেয়েছি লেখার জন্য। '১৮ - '১৯ থেকে আমি যেসব পত্রিকায় নিয়মিত লিখি, আলাদা করে নাম করছিনা কারুর, সেই সব পত্রিকার থেকে যে পরিমাণে সম্মান আর ভালোবাসা পেয়েছি তা জীবনে কোনোদিনও প্রত্যাশা করিনি। বিভিন্ন পত্রিকা, অনলাইন প্লাটফর্ম আর আমার নিজস্ব পেজে প্রতিদিন এতো সংখ্যক মানুষ আমার লেখা পড়েছেন, সমালোচনা করেছেন, প্রশংসা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন…. আমার মত এক সামান্য মানুষের ভাগ্যে এতো প্রাপ্তি লেখা ছিল ভাবলেও অবাক লাগছে। এই বছরই প্রথম পত্রিকা ছেড়ে বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে আমার লেখা। তারও সৌজন্যে StoryMirror। Book of Love এ জায়গা পেয়েছে আমার একটি গল্প। এছাড়াও অন্য দুটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিতব্য গল্প সংকলনে আমার গল্প জায়গা পেয়েছে। এই বছরই আমার মাস্টার ডিগ্রি শেষ হয়েছে। বাবার পছন্দের VTT College এ বি.এড পড়ার সুযোগ পেয়েছি।
তো সব মিলিয়ে ২০১৯ নিঃসন্দেহে আমার কাছে একটা প্রাপ্তির বছর। ব্যর্থতা কি তাহলে আসেনি এবছর? এমনটা কি হয়! সাফল্য আর ব্যর্থতা পরস্পরের পরিপূরক। ব্যর্থতা, মন খারাপ এই সবকিছুই এসেছে সমানভাবে। প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া, পত্রিকা থেকে প্রত্যাখ্যান, বই প্রকাশের কথাবার্তা এগিয়েও কোনো কারণে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া সবরকম আঘাত এসেছে। কিন্তু না পাওয়ার শলাকা বিদ্ধ করে আজ আমার প্রাপ্তিগুলোকে আঘাত করতে চাইনা। ২০১৯ আমার কাছে প্রাপ্তির বছর, অপ্রাপ্তির বছর। '১৯ আমাকে সাফল্য দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে। '১৯ আমাকে শিখিয়েছে আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা, '১৯ আমাকে শিখিয়েছে মিথ্যা খ্যাতির লোভে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন না দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, '১৯ আমাকে শিখিয়েছে নিজের মত সগর্বে প্রকাশ করতে। তাই ২০১৯ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরদিন। আর এই বছর থেকে যা যা শিখেছি সেই সব কিছু মনে রেখে এগিয়ে যেতে চাই আগামী বছরও, '১৯ এর ভুলত্রুটি শুধরে নিতে চাই পরের বছর। নিজের মত করে বাঁচতে চাই আগামীতে।