Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sandip Das

Romance

4.2  

Sandip Das

Romance

চন্দননগরের মেয়েটা ( বই ১)

চন্দননগরের মেয়েটা ( বই ১)

31 mins
1.3K


ভূমিকা 


ভুলতে পারলাম কই ? 

এই তো কাল এসেছিলে , সারা রাত জুড়ে বেসেছিলে ভালো

চুলের নরম আঁচল জড়িয়ে বুকে 

ঘুরে বেরিয়েছিলাম কত অজানা সড়ক ।

তারপর আকাশের কপালের টিপটা মুছে যেতেই 

কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সব অধ্যায়গুলো 

খোলা চোখে যা ভুলে থাকা , 

বন্ধ চোখের পিছনেই সেই বরফগুলোই গলতে দেখলাম আবার ।


চন্দননগরের মেয়েটা আমার প্রেমিকাকে উৎসর্গ করলাম । বাস্তব পথে কল্পনা কখনো কখনো গল্প হয়ে যায় । 








চন্দননগরের মেয়েটা ( এক )


পূর্বকথন


মেয়েটি ছেলেটিকে দেখেছিলো নন্দনে ।

ছেলেটি প্রথমবার কথা বলেছিল মেয়েটাকে ভিক্টরিয়ার ভিড়ে

আমি তোমায় ভালোবাসি ।

মেয়েটি ইডেনের পাশে ছাতা ধরে জানিয়েছিল

সে আরো কিছুদিন সময় নেবে ।

এরপর একদিন গঙ্গার ঘাটে ছেলেটি বিরক্ত হয়ে বলেছিল

আর কত দিন সময় নেবে ?

মেয়েটি চিড়িয়াখানায় রোদে বসে হাসতে হাসতে বলেছিল

আর কিছুদিন সবর করো ।

আজ বিশ্ব প্রেম দিবস , ছেলেটি বলেছিল শেষবার

পারবে দেখা করতে , আমার সঙ্গে একবার

গঙ্গার ধারে ।

তারপর আর্মেনিয়া হেসে ওঠে সূর্যের ডুবে যাওয়া আলোতে

একটি গুন চিহ্ন উপহার রূপে আঁকা

মেয়েটি পেয়েছিল কুড়িয়ে সেখানে ।

শেষবার ....

বিদায়ের আগে .....



সময়টা ওই মে জুন মাস । কবিতার দুনিয়ায় সদ্য পরিচিত নাম তখন ঈশ্বর । এমনই এক সন্ধ্যায় একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করতে গিয়ে মিনিট দু এক থামলো সে । কি অপরূপ দেখতে তাকে !! বোধহয় একেই বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট । দেরি না করে সত্যবতীর প্রোফাইলটা একবার খুলে দেখল সে । ঠিক যেটা চেয়েছিল , সেটা যে খুঁজে পেয়েছে সেটা তার মুখ চোখ থেকে স্পষ্ট । সত্যবতী এখনো সিঙ্গেল আর ফেসবুক বলছে , তার বয়স ২২+ । কিন্তু সমস্যা একটাই , মেয়েটিকে কিকরে বোঝাবে সে যে ঈশ্বর ইস ইন লাভ উইথ হার । নিজের লাজুক স্বভাবের জন্য মেয়েদের সাথে খোলামেলা ভাবে সে মিশতেও পারে না । সুতরাং , সমস্যা , ভয় , যদি সত্যবতী অন্য কারুর হয়ে যায় ।

এমন এক পরিস্থিতিতে তার একমাত্র অস্ত্র হল কবিতা । এই জায়গাটা ঈশ্বরের খুব স্ট্রং । গোপনে কবিতার মধ্যে দিয়ে সে ঠিক করলো মেয়েটাকে মনের কথা বোঝাবে । তারপর ....

শুরু হল একের পর এক প্রেমের সিরিজ আর প্রেমের কবিতা । কিন্তু কোন কিছুই কাজ দিচ্ছে না তার । এদিকে পুজো কাছে এসে যাচ্ছে । কিছুই মাথায় আসছে না । সুতরাং , ভাগ্যই ভরসা । ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে ঈশ্বর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । এর মধ্যে একটি পুরোনো ঝামেলা ঈশ্বরের জীবনে উঁকি মারতে শুরু করলে সত্যবতীকে ঈশ্বর প্রায় এক প্রকার ভুলেই গেল । একপ্রকার দায়ে পড়ে ঈশ্বর কে বাবার একমাত্র রেখে যাওয়া বাড়িটি বিক্রি করতে হলো ।

চারদিকে কাশ ফুল ফুটে আছে আর মাঝখান দিয়ে বাইক নিয়ে ছুটে চলেছে ঈশ্বর ও তার বন্ধু শুভ । নবমীর এই রাতটি কোনদিন ভুলতে পারে নি ঈশ্বর । জীবনে শেষ বারের মত মদ খেয়েছিল তারা আর তারপর ...?

মনে জমে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে এসেছিল বুক ফেটে । নিউটাউনে কাটানো সেই রাত্রি , ওরা তিনজন --- শুভ , নব আর ঈশ্বর ছাড়াও সেই কষ্টের ভাগ নিয়েছিল কিছু গেলাস ও রঙিন জলের বোতল । নবমীর শেষে বিজয়ার সকালে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এলো তারা । ঈশ্বরের মন আর কলম সেদিন উবেরে বসে বসেই লিখে ফেলেছিল কয়েকটা লাইন ---

" আগামী বছর আমাদের হবে ,

রাতগুলো আমাদের নিয়ে জাগবে

ঈশ্বরের ঈশ্বর এসেছে ,

সত্যবতীও ঠিক দেখা দেবে সেই ফাঁকে ।"

আজ কোজাগরী লক্ষী পুজো । সবাই যখন দেবী আরাধনায় ব্যস্ত , ঈশ্বর তখন ফেসবুকের পাতায় তাকিয়ে । হঠাৎ একটি শব্দে হোস ফিরল তার । মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ এসেছে আর মেসেজ করেছে সত্যবতী -- লেখা হায় । সেও দেরি না করে উত্তর দিল হ্যালো । বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো তাদের মধ্যে । অধিকাংশটাই ভাট বকাবকি , শুধু যে তথ্যটা ঈশ্বরের কাছে উল্লেখযোগ্য ছিল সেটা হল সত্যবতী হল চন্দননগরের নায়িকা ; আর ফরাসি বন্দর তার জন্মশহর ।

এই টুকু তথ্য নিয়েই ঈশ্বর পরের দিন ফিরে যাবে তার কাজে । এর মানে হল ছুটি শেষ আর তাই দিল্লির টিকিট এর সিটটাও কনফার্ম হওয়ার মেসেজ চলে এসেছে মোবাইলে । বলে রাখি ঈশ্বর দিল্লিতে চাকরি করে , সি .এ.জি -র অধীনে ।

পরের দিন দুপুর এগারোটায় তার ট্রেন ।

দিল্লি চলে গেলেও ঈশ্বর তার হৃদয়ের একটা টুকরো ফেলে গেছিল ফরাসি নগরে । সে মেয়েটিকে প্রচণ্ড ভালোবাসত আর প্রতি মুহূর্তে সেটা বোঝাবে কি করে তাই ভেবে চলেছিল । এদিকে সেই রাত্রের পর থেকে ঈশ্বর আর সত্যবতীর মধ্যে প্রায়ই কথা হত ম্যাসেঞ্জারে । বলতে বাকি নেই এতে তাদের বন্ধুত্বটা গভীর থেকে গভীরতম হয়ে উঠছিল ধিরে ধিরে । ঈশ্বর সত্যবতী কে খুব বিশ্বাস করত আর তাই নানা মনের কথা বলে থাকতো । অন্যদিকে সত্যবতীও নিজের অতীত জীবনটা খুব বিশ্বাস করে একদিন ফোনে বলেছিল ঈশ্বরকে ।

দেখতে দেখতে কালি পুজো এসে গেল প্রায় । এই কদিন আগেই ছুটি কাটিয়ে দিল্লি ফিরেছে ঈশ্বর । তাই দিপাবলিতে বাড়ি যেতে পারবে না আর । কিন্তু বাড়ি না গেলে কি হবে ! মন তো তার ফরাসি নগরেই ফিক্স হয়ে আছে । এদিকে যেটা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে সেটা হলো , চ্যাটে অতীত খুলে রেখে দিলেও ঈশ্বর আজও মেয়েটিকে বলতে পারেনি যে সে তাকে কত ভালোবাসে । অবশেষে সে ঠিক করল মেয়েটিকে প্রেম পত্র লিখবে , তবে সরাসরি নয় কবিতার আকারে ।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ । ফেসবুক জুড়ে সৃষ্টি হতে লাগলো একের পর এক প্রেমপত্র । দু এক দিনে ঈশ্বরের ওয়াল ঢেকে ফেললো এক নয় , দুই নয় ; তিন তিনটে প্রেম পত্র তবে কবিতার ছদ্মবেশে ।

"প্রেম-পত্র ১

এমন কিছু মন আজও আছে এ পৃথিবীতে ,

সহজ , নম্র , সরলতায় ঠাসা 

অসংখ্য কথা মনে পুষে রেখেও বলে যায় 

না বলা অনেক কটা মনেরই ভাষা ।। 

আমি দেখেছি তাকে প্রতিদিন 

এই পথের ধারে , কাঁচের ওই দেওয়ালের ওপারে 

চিনেছি তাকে কাছে গিয়ে ; অপেক্ষায় বসে 

এক সুন্দর প্রভাতের আলোর ।।

চোখ দুটো তার : যেন অসীম স্বপ্ন বয়ে বেড়ায় 

প্রতিদিন , প্রতিবার -- কাব্যিক ছন্দে গড়ে ওঠা 

সে মনীষী আমার চোখে , অন্ধকারের পথে এক নতুন আলো : যেন ডাকছে আমায় ।।

সাহস হলনা ঠিক , যদি তাড়িয়ে দেয় ; 

বিস্বাস টুকু বেশ নেমে গেছে মাটিতে --

তাই ফিরে এলাম নিজের ঠিকানায় উদাস ভাবে ।।

তবে দেবী অপেক্ষা কর , একদিন ফিরে আসব ঠিক 

বলব সমস্ত গল্প তোমায় ; কিভাবে একটু একটু করে 

আবার প্রেমে পড়লাম তোমার ।।

প্রেম - পত্র ২

বয়ে যাওয়া একটা ঝড়ের মত 

আমার চোখে ধরা দিয়েছ তুমি , 

শূন্যতার এক অদ্ভুত খেলায় 

মেঘ হয়েই বর্ষে গেছ ভালবাসার চিঠিখানি ।।

তোমায় সামনাসামনি দেখি নি কোনদিন 

হয়ত সুযোগ হয় নি দেখা করবার --

তবু একটিবার তোমায় সামনাসামনি দেখতে চাই 

জানতে চাই এক অচেনা পাখি হয়েও 

কেন এত বিস্বাস করতে শুরু করেছি তোমায় ।।

কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলতে চাই 

ভালবাসি তোমায় , ভালবাসবে তুমি কি আমায় ??

তোমার ছবিটা প্রথম দেখি এই পাতাতেই 

ফুটে উঠেছিল আমার এই ঝাপসা চোখের সামনে ,

মনে হয়েছিল আবার একবার তোমার জন্য তো 

বাঁচাই যায় ।।

তারপর বহু বার পত্রের আদান প্রদান ঘটে গেছে 

তুমি আমায় চিনেছ খানিকটা আর অল্প আমি তোমায় 

ভাষার মধ্যে দিয়েই প্রথম দৃষ্টি পড়েছিল 

তোমার চাউনির দিকে , যেন রাম সিতার প্রাক স্বয়ম্বর মিলন ।।

নানা হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কি আর কবিতার প্রতি 

তোমার ভালবাসা আমাকে আরও কাছে ঠেলে দিয়েছে ।।

ডাক হরকরার মত ফেরি করে ফিরেছি এত দিন 

নানা সুখ দুঃখ প্রেম যন্ত্রণার কাহিনী ,

তবু অপেক্ষা রয়ে গেছে আজও যখন বসে আছি 

এই ভিনদেশে , তোমার থেকে অনেক দূরে ;

অপেক্ষা যেন বন্দিনী সিতার তার ভালবাসার থেকে 

একটা চিঠির অপেক্ষা : একটা বার্তার অপেক্ষা ।।

ভেবে দেখতে পার , হতে পারে তোমার মনের অনেক গভীরে 

আগ্নেগিরির হৃদয় থেকে ম্যাগমা একই ভাবে বেরিয়ে আসতে চায় : প্রচুর ধাক্কা খেয়ে 

আমারই মত সাহস হারিয়ে ফেলেছে ।।


প্রেম-পত্র ৩

একগুচ্ছ জনতার ভিড়ে আমি একলা 

অনেকের কথায় বোকা , তাই পারিনি আজও 

জীবনের পূর্ণগোলক এঁকে দিতে ।। হয়ত ওরা কিছুটা ঠিকই বলে ,

কিন্তু যেটুকু জানে সেটুকুই বলে , যেটা জানেনা সেটা হল 

রাজকন্যার সামনে দাঁড়িয়েও বলতে পারিনি আজও 

খাঁটি হৃদয়ের খাঁটি তিনটে কথা ।।

বাড়ির কাছেই বিশাল ঝিল আছে , জলের ধরে কত পাখি 

রোজ বসে আড্ডা দেয় , খেলা করে ।। সেদিন নজরে এল 

দুইজন দূরে একলা বসে ।। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে উপভোগ করছে 

ভালবাসার মুহূর্ত ।। 

এরকম কত তো রয়েছে , চোখ খুলে তাকালেই দেখা যায় 

গাছে গাছে , পাতায় পাতায় , জলের স্রোতে , হাওয়ায় হাওয়ায় -- 

সবাই পেরেছিল বলতে ।। শুধু আমি ছাড়া ।। 

সূর্যের অস্তগামী চেহারার পিছনে অন্ধকার নেমে আসছে ,

ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বাভাস -- ফিরতি পাখিদের দলে আমরা দুজন ; 

চলো না মনের কথা শেষবার বলে ফেলা যাক ।।

তোমার জানি অভাব নেই কোন , 

খুঁজলেই ভাল ছেলে পেয়ে যাবে অনায়াসে : 

সমস্যাটা আমার ; বলেই দেখি অন্তত যদি কোন পেত্নিও 

জুটে যায় শেষমেস ।। "

আশ্চর্য জিনিস হলো এতে । তিনটে প্রেমপত্র লিখতে না লিখতেই মেয়েটি ছেলেটির মনের কথা বুঝতে পারলো । একদিন মাঝ রাতে অনলাইনে সত্যবতী প্রপোস করলো ঈশ্বর কে ; তবে শর্ত একটাই ঈশ্বর কে চিরকালের মতো বেঙ্গল ফিরে আসতে হবে । ঈশ্বর বেশ জানতো যে ফিরে আসা এত সোজা নয় ; মিউচুয়াল ট্র্যান্সফার পাওয়া খুবই কঠিন । তবু এমন সুযোগ কি ছাড়া যায় ! সে মেয়েটির কথায় রাজি হয়ে গেল । সেই আনন্দের মুহূর্তটুকু ঈশ্বর মিস করতে চাইনি সেদিন । সে সত্যবতীর কাছে একবার ফোন করার আবদার করে বসলো । কিন্তু সত্যবতী সব কিছু একদিনে হোক এমন চাইনি । সে ঈশ্বরকে জানায় পরের দিন সকালে সে নিজে কল করবে । এই বলে সে ঈশ্বরের ফোন নম্বরটা চেয়ে নিল । আর ঈশ্বর ??

সত্যবতীকে বিশ্বাস করে ফোন নম্বর টি ম্যাসেঞ্জারে ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো এক বুক তৃপ্তি নিয়ে ।

পরেরদিন সকালকে আর কড়া নাড়তে হয়নি ঈশ্বরের দরজায় , সূর্যের অনেক আগেই সে ঘুম থেকে জেগে গেছে । ভালোবাসা বোধহয় এমনই , মানুষকে পুরোপুরি পাল্টে দেয় নিমেষের মধ্যে । ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে । এক একটা মিনিট ঈশ্বরের কাছে এক একটা মিনিট মনে হতে লাগল । উপায় না পেয়ে সে তার কবিতার খাতা খুলে কয়েক লাইন লিখে নিজের চাপ হালকা করতে চাইল ;

" আজ সূর্য আমার দরজায় আসেনি

আমি সূর্যের দরজায় বসে আছি

একটা মেঘ পিয়ন ফিরবে এই পথেই

তাকে বৃষ্টি করে নিয়ে যাবো বলে "।

লেখাটা তখনও শেষ হয়নি তার , হঠাৎ বেজে ওঠা মোবাইলের শব্দে ধ্যানভঙ্গ হল ঈশ্বরের । ঘড়িতে ঠিক নটা আর ফোনে একটি আননোন নম্বর , সম্ভবত জিওর । ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলা ভেসে এল " হ্যালো , ঈশ্বর । আমি সত্যবতী বলছি । " নামটা শোনামাত্রই সে কেমন যেন নিথর হয়ে গেল । ঈশ্বর ভাবতে পারছে না , যে মুহূর্তের জন্য এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা তার , সেই মুহূর্ত অবশেষে উপস্থিত তার কামরায় । কি কথা বলবে কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না সে , ওদিকে ওপাশ থেকে ভেসে আসছে সত্যবতীর উৎকণ্ঠা ভরা কণ্ঠস্বর , " হ্যালো । শুনতে পাচ্ছো আমায় । "। ছেলেটি দুবার জোরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবার জানান দিলো যে সে সত্যবতীর সঙ্গেই আছে । এরপর প্রায় ঘন্টাখানেক পার হল । কিছু প্রেম আদান প্রদান আর অনেকটা প্রথম পরিচয়ের আলাপ চারিতা চললো ওদের মধ্যে । তাদের চোখ , মুখের হাসি আর শরীরের ভঙ্গিমা দেখে একটা জিনিস অনায়াসেই বলা যেতে পারে , ইটস দা স্টার্টিং অভ আ লাভ স্টোরি ।

দিনটা ২০সে অক্টোবর । সেদিন ছিল সত্যবতীর জন্মদিন । আর তারই পাশাপাশি সত্যবতীর জীবনের পরীক্ষা । আসলে পরীক্ষা মানেই ভয় , এই টা বেশ কিছু মাস যাবৎ সত্যবতীর মাথায় গেঁথে গেছিল । সুদূর দিল্লি থেকে সকাল সাতটায় যখন মোবাইল টা চিৎকার করে উঠলো সত্যবতী তখন পরীক্ষার সাজুগুজু করতে ব্যস্ত । যাই হোক সবার নজর এড়িয়ে সেদিন সে ফোনটা তুলতে সফল হয়েছিল । রিসিভ বাটন টা টিপতেই ওপাশ থেকে সেই চেনা গলায় ভেসে এলো সেই ভালোবাসার লাইনটা , হ্যাপি বার্থডে টু ইউ । অবশ্য আরো একটি সারপ্রাইজ কাল রাতেই ছেড়ে গেছিল ঈশ্বর । তবে সেটা এখানে নয় ফেসবুকে । সারাদিন হলবন্দি সত্যবতী যখন মুক্তির আকাশ খুঁজে পেল , ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টে । তারপর সেখান থেকে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরার তাড়া । বাসে ট্রেনে ফরাসি নগর পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যে ৭টা হয়ে গেল । এর মধ্যে সত্যবতীর যে ঈশ্বরের কথা একবারের জন্য মনে পড়েনি ঠিক তেমনটি নয় , তবে মা সঙ্গে থাকায় কথা বলার বা ম্যাসেজ করার সুযোগ হয়নি তার । বাসে , ট্রেনে বসে বা দাঁড়িয়ে , রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে সত্যবতীর মনে হচ্ছিল আর কতদিন এভাবে মায়ের আঁচলের আড়ালে চলতে হবে তাকে । আফসোস করে নিজের মনকে বারবার বলছিল সে , " ইস ! আজ যদি ঈশ্বর সঙ্গে থাকতো তাহলে কত মজাই না হতো । বাড়ি পৌছেই আর সময় নষ্ট করে নি সে । মনের মানুষটিকে একটিবার কাছে পেতে সে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে ল্যাপ টা অন করলো । এর আগে পর্যন্ত সত্যবতীর মধ্যে এরকম ব্যাকুলতা , উদগ্রীব স্বভাব কোনদিন কারুর চোখে পড়ে নি । কিন্তু ওই যে কথায় আছে , প্রেমে পড়লে সব মানুষ ই বদলে যায় । সুতরাং , সত্যবতীর ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় কী করে ? ফেসবুকে অন হতেই সত্যবতী তো হতবাক !! একদম অন্যরকম এক প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে তার সামনে , সৌজন্যে সেই পাগল ছেলেটা , ঈশ্বর –

" আর তো কিছুক্ষন ।। সময়ের পাল্লায় সেই সময় এসে দাঁড়িয়েছে , 

একদিন ঈশ্বর যখন নিজের প্রিয় অংশটুকু

সযত্নে পাঠিয়ে ছিল পৃথিবীর কাছে ।।

সেদিন থেকে এইদিন ; সত্য ; ১৩২ খানা ঋতু পেরিয়ে এসেছ

বেড়েছে বয়স , বেড়েছে অভিজ্ঞতা , চিনেছ পৃথিবীটাকে

অনেকটা ।। আরও পথ চলতে বাকি ,

অনেক অধ্যায় জীবনে আসতে বাকি , আমি ধন্য

এ পথে তোমার সঙ্গী হতে পেরে ।।

ভবিষ্যৎ চিনি না ; কিস্সু জানি না

শুধু বুঝি এটুকুই , সত্য , কোনদিন পালিয়ে যাব না

তোমাকে ছেড়ে ।।

২২ এর দোরগোড়া আজ খোলা ।। স্বাগতম জানাতে হয় তোমায় ।। তবে আড়ম্বর দিয়ে নয় , 

এ জীবন্ত দেবীর আজ

অভিষেক হোক সামান্য টুকু রেখে দেওয়া ভালবাসায় ।।

মহাভারত থেকে ব্যোমকেশ ; সর্বত্রই তুমি ছিলে ,

কোথাও প্রেমিকা হয়ে তো কোথাও নায়িকা হয়ে ।।

সত্য , তোমায় ছাড়া ব্যোমকেশ যেমন অধরা ; ঠিক তেমনি

একটুকু সোহাগ ছাড়া এ বুদ্ধিমতি , সত্যবতী আমার --

তার ২২ এর এই মুহূর্ত টুকুও খুবই পাতলা ।।

ডাকহরকরা এসে গেছে , মেঘের চিঠি হাতে নিয়ে --

চোখ খোল এবার : ২২ এর আগের পর্বেও আবার

ব্যোমকেশের জীবনে সত্যবতী ; তোমাকেই যে দরকার ।। "

মেসেজটা পড়ে বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনের মধ্যেই আজ কেঁদেছে সত্যবতী । ভাল লাগছে না তার , তবু সমস্তটাই নিয়তি বলে মেনে নিয়ে সে পরের দিন আবার বেড়িয়ে পড়েছে পরীক্ষা দিতে ।

সকাল এগারোটা । আজ তো রবিবার , তাই নিজের ঘরের কাজে ব্যস্ত ঈশ্বর । আচমকা মোবাইলের শব্দ তাকে আকৃষ্ট করতে শুরু করলো । ফোন তুলে বুঝতে সময় লাগলো না যে সত্যবতী তাকে খুব মিস করছে । স্কুলের বাইরে মায়ের চোখের আড়ালে এসে লুকিয়ে কথা বলছে সে । পরীক্ষা শুরু হতে আর ঘন্টা খানেক বাকি । হয়তো এই কলটা সে করতো না , তবু করেছে , কারন তার কথায় " আমি তোমার মত একজনকে হলে ঢুকতে দেখলাম । সে এল , আমার মাথায় হাত ছুঁয়ে দিয়েই চলে গেল " । বুঝতে বিন্দুমাত্র বাকি নেই ঈশ্বরের , তার হৃদয়ে যে আঘাত লেগেছে সে আঘাতে আজ দুজনই সমান ভাবে আহত ।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন । হঠাৎ একদিন রাতে , প্রায় নটা হবে , সত্যবতী আবদার করলো ঈশ্বরকে , কাল তারা নিজেদের সম্পর্কের কথা নিজেদের বাড়িতে জানিয়ে দেবে । সে আরও বললো যে যদি তাদের দুজনেরই বাড়ি রাজি থাকে তবে তারা এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাবে , অন্যথা তারা এটা একটা স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে ।

ঈশ্বর , সত্যবতীর কথায় মোটেই রাজি ছিল না । বাংলা ফেরার জন্য সে যখন আমরণ চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিক তখনই যদি ফিরে আসার কারনটাই ফুরিয়ে যায় , তাহলে তার কাছে এর থেকে কষ্টের আর কিছু থাকবে না । সুতরাং সে সত্যবতীকে মানা করে দিয়েছিল এই সম্পর্কের ব্যাপারে বাড়িতে জানানোটা । কিন্তু সত্যবতীর সামনে ঈশ্বর বরাবরই দুর্বল । একটু জেদাজেদি করলে ঈশ্বরের কাছে সত্যবতীকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা থাকতো না কোনদিনই । আজও ঠিক তাই হল । সত্যবতী , ঈশ্বরকে স্পষ্ট জানালো , " তুমি যদি এই ব্যাপারটা বাড়িতে না জানাও তাহলে আমাকে চিরকালের মতো ভুলে যাও । বাড়ির পারমিশন ছাড়া আমাদের প্রেম একটি সম্পর্কের রূপ নেবে না । আর একটা কথা , আমাদের যে কারুর বাড়ির যদি এই সম্পর্কে আপত্তি থাকে তাহলে এই সম্পর্ক সেইখানেই শেষ হয়ে যাবে । " সত্যবতীকে ছেড়ে ঈশ্বর নিজেকে কল্পনা করতেই পারে না এখন । তার ওপর এমন সব নিয়মে সে রীতিমত দিশেহারা ।

রাত তখন একটা দশ । ঈশ্বরের চোখে আজ একটুও ঘুম নেই । কবিতাও আসছে না আজ তার কাছে । ভোর হব হব করছে ঠিক সেই সময়ে তন্দ্রা গ্রাস করলো ঈশ্বর কে । ঘুমের পৃথিবীতে চলে যাওয়ার আগে সে লিখে রেখে গেছে দুটো কথা ---

" কি করবো আর কি করবো না

আজ শুধু জীবন জানে আর ঘুম আমার " ।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে । যদিও সারা রাত ঈশ্বর সেভাবে ঘুমাতে পারে নি , দুশ্চিন্তা আর দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করে রেখেছে । প্রতিদিনের অভ্যাস মত আজও মর্নিং ওয়াকে বেড়োলো সে । কিছু চেনা আর অনেক কটা অচেনা মুখের সাথে দেখা হল , গুড মর্নিং বিনিময় হলো কিন্তু চিন্তা কম হলো না কোনভাবেই । কাল রাতে সত্যবতীর কথাটা শোনার পর থেকেই সে ভেবেছিল বাড়িতে সত্যবতীর সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্ক নিয়ে সব খুলে বলবে কিন্তু সাহস করতে পারে নি এই ভেবে যে মা যদি রাজি না হয় ! যদি রাগারাগি করে । যতই হোক এই সমাজ আজও প্রেম নামক অনুভূতিটিকে ভালো চোখে দেখতে শেখে নি । তার ওপর মা যদি কোন প্রকার আপত্তি জানায় তাহলে তো সব শেষ । সত্যবতী তো তেমন ই এক প্রকার ফরমান জারি করে রেখেছে । আবার না বললেও রেহাই নেই । সত্যবতীর আদেশ অমান্য করে এত দুঃসাহস অন্তত ঈশ্বরের নেই । কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না যখন , ঠিক তখনই মোবাইলের ঘন্টাটা বেজে উঠলো : এক নয় , দুই নয় , তিন তিনবার । সত্যবতী ওয়াস কলিং । 

গুড মর্নিং । সত্যবতীর গলার আজ ঈশ্বরকে ভাবিয়ে তুলছিল । শান্ত গলায় সেও গুড মর্নিং জানালো তার প্রিয়তমাকে । কেমন আছো , কি করছো এমন হাজার কথার মধ্যে সত্যবতী হঠাৎ বলে উঠলো , " জানোতো আজ মা কে সব বলে দিয়েছি আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে । মা কোন আপত্তি করে নি । বরং বাবার সাথে কথা বলবে বলেছে । তুমি বাড়িতে জানিয়েছিলে ? কি বললো আন্টি " ? ঈশ্বর কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না , আর তাই কোন কথা না বলে চুপ করে রইল । ওদিকে সত্যবতীর উৎকণ্ঠা যে আর ধরে না । মোবাইলের ওপাশ থেকে সে ক্রমাগত বলে চললো , " কি গো , বলো না । আন্টি কি বললো ? দেখো অর্ধেক ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেছে , বাকিটা শোনার জন্য তর সইছে না আমার আর " । ঈশ্বর তখনও চুপ । প্রায় মিনিট দুই এক পরে শান্ত গলায় সে বলল , " বলা হয়নি গো । সাহস করে উঠতে পারি নি । আর একটু সময় দাও "। সত্যবতী এই উত্তর মোটেও প্রত্যাশা করছিল না । " এত বড় ছেলে হয়ে মাকে এটুকু বলতে পারছো না যে তুমি একটা মেয়েকে পছন্দ করো আর তাকে বিয়ে করতে চাও । তুমি পুরুষ মানুষ না অন্য কিছু ! আজ রাতে ফোন করবো । জানাবে আন্টি কি বললো " । এইটুকু বলে ফোনটা কেটে দিল সত্যবতী । ঈশ্বর তখনও ভেবে পাচ্ছে না যে কী করবে । এদিকে বিকেলে কিছু একটা বলতেই হবে । এদিকে চিন্তায় ঈশ্বর যখন দিশেহারা তখন ঘড়ির শব্দ জানিয়ে দিল সকাল দশটা বাজে । অফিস যেতে হবে । 

"কিন্তু অফিসে গিয়ে কি করবো ! না গেলে এএও মুলানি স্যার আবার চ্যাচাবে ..... " । এমন নানা কথা ঈশ্বর নিজের সাথে বকে চলেছে : শুধু বাড়িতে নয় , রাস্তায় এমন কি অফিসে পোঁছেও আজ তার মনের অস্থিরতা কম হলো না । এই পরিবর্তন সে আজ চায় না অন্য কেউ টের পাক কারন তাতে হাজার প্রশ্ন উঠবে আর ঈশ্বর আজ কারুর কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নয় । তবে নিজেকে অনেক লুকিয়ে চুড়িয়ে রাখার চেষ্টা করলেও তার কলিগদের এড়িয়ে যাওয়াটা অতো সোজা ছিল না । সুতরাং যে ভয়টা সে পাচ্ছিল তাই হলো । 

" ক্যায়া বাত হ্যায় ভাই , আজ সুবাহ সে ক্যান্টিন কে কোনে মে ব্যাঠে হুয়ে হো । তাবিয়ত তো ঠিক হ্যায় না আপকা " । অজিতের প্রশ্নগুলো শুনেও ঈশ্বর চুপ থাকলো কারন সে চায় না তার সমস্যাটা লোকে জানুক আর কথা চালাচালি হোক । এরই মধ্যে রজত , রাজীব ও আরো কিছু বন্ধুদের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে ঈশ্বর একটু সোজা হয়ে বসলো নিজের জায়গায় । " সব এক সাথ আজ । বাত কেয়া হ্যায় " । অজিত এর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলো রজত । " পতা নেহি ভাই । ঈশ্বর ভাই আজ সুবাহ সে চিন্তিত লগ রহে হ্যায় । ওহি পতা কর রহা থা । মগর ইয়ে তো কুছ বোলতা হি নেহি " .... শান্ত গলায় অজিত উত্তর দিল । রজত ও বাকিরা এতক্ষনে চেয়ারে ঈশ্বরকে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়েছে । তারা পরবর্তী কিছু জিজ্ঞাসা করতো তার আগেই ঈশ্বরের গলায় ভেসে এলো একটা কবিতা , এক দৃষ্টি রেখে মনের গভীর থেকে যেন বেরিয়ে এলো শব্দ যুগল অনেককটা ,

" কয়সে বতাউ বতানে কে হর উও বাত 

দিল সে নিকলি উও সারি বাত 

বতানে হ্যায় বাতো বাতো মে 

মুহব্বত .... অপনে ঘর " ।

অবাক হয়ে শুনছিল সবাই । এরই মাঝে নিশার হাততালি শুনে হোস এলো সবার । তারা আর প্রশ্ন করলো না কেউ । মনে হল যেন তারা সব বুঝে গেছে । এক মিনিট আগেও যা বুঝতে পারছিল না কেউ , একটা কবিতা সব বুঝিয়ে দিলো তাদের । অবাক লাগলেও এটাই সাহিত্য । নিচে নামতে নামতে অজিত ঈশ্বরের পিঠে হাত রেখে বলে উঠলো হঠাৎ ,

" ডর মত দোস্ত , বোল দো 

হিম্মত করকে ঘরমে সব রাজ খোল দো

হম হ্যায় না তেরে সাথ "....

সকলে অজিতের সুরে সুর মিলিয়ে বলে উঠলো এবার একসাথে । " হা হম হ্যায় আপকে সাথ "।

অফিসের নানা কাজের মধ্যে আজ বোঝা যাই নি কখন কিভাবে ছটা বেজে গেছে । পেরিয়ে গেছে ছ ছটা ঘন্টা । ওদিকে ফরাসি বন্দরে র ধারে বসে থাকা নায়িকা অস্থির হয়ে উঠছে কোন খবর না পেয়ে । শেষ মেস আর থাকতে না পেরে কল করলো সে ঈশ্বরকে । ঈশ্বর তখন নিজের গ্ল্যামারে সবে মাত্র কিক করেছে , পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠলো এইবার ..... 

" বলো .... " , শুধু এটুকু বলে ঈশ্বর কিছু বলতে যাবে , তার আগেই মোবাইলের ওপাশ থেকে চোখ লাল করে গম্ভীর গলায় ভেসে এলো , " এতক্ষন কোথায় ছিলে তুমি । জানো কত দুশ্চিন্তা হয় আমার । তুমি কিচ্ছু বোঝো না । " , সত্যবতী এটুকু বলেই কেঁদে ফেললো এবার ...

নানা রকম চিন্তা করে ঈশ্বর বলে উঠলো , " আ..আ...আমি ফো... "

~ থামো । তুমি আর একটাও কথা বলবে না । তোমাদের সব ছেলেদের অজুহাতে ভরা । 

এটুকু বলেই ফোন কেটে দিল চন্দননগরেরসেই নায়ক । আর নায়ক ?? 

প্রায় ত্রিশ বার নম্বর ঠুকে গেল বৃথা । উত্তরে ভেসে এলো এক কন্ঠ ,

আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন সেটি এখন সুইচ অফ আছে ..... 

ভাঙা মনটাকে বুকে বয়ে নিজের ভাড়া করা চার দেওয়ালের কামরায় ফিরে এলো । ঘড়িতে প্রায় নটা আর বাইরে বৃষ্টি নেমেছে হালকা । মনে হচ্ছে ঠিক যেন একটা কবিতা যেখানে ঈশ্বরের মন আর বাইরের প্রকৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে । আরও দু তিনবার সত্যবতীর নম্বরে ঢোকার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় , ঈশ্বর তার কবিতার খাটাটাই খুলে বসলো এবার ---

"মাথা আজ ভার হয়ে আছে একটা প্রশ্নে , 

বাড়িতে জানিয়ে দেবো সব নাকি 

সত্যবতীর সাথে আবার পরিচয়ের অপেক্ষা হোক আমার ।

জানিনা এ দূরত্ব মিটবে কবে , কবে তুমি আমার হবে 

লাল সিঁদুর আর শাড়ির আঁচলে 

তোমায় নতুন করে জড়িয়ে নেবো আমার বুকে । "

সারা রাত অপেক্ষা করেছিল সে । কিন্তু কোন ডাক আসে নি প্রিয়তমার । হোয়াটস এপে বেশ কয়েকবার সত্যিটা বলে ম্যাসেজও করেছিল ঈশ্বর কিন্তু সত্যবতী তার ডাকে কোন সারা দিলো না । অপেক্ষার রাত গভীর হলো । ঘড়িতে তখন দুটো বাজে । আস্তে আস্তে ভিজে চোখের পাতা বন্ধ হল ঈশ্বরের । তারপর যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়ে গেছে । মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ঈশ্বর দেখলো সকাল দশটা বাজে । মোবাইলটা তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে দেখলো সে - ইনবক্স , ম্যাসেজবক্স , হোয়াটস এপ কোনটা দেখে নি , কিন্তু সত্যবতীর কোন চিঠি আসে নি কোথাও । মন খারাপ হলেও অফিস বেরোতে হবে । ওটা তো বাদ দেওয়া যায় না । তাই সে মোবাইলটাকে বিছানায় রেখে স্নান খাওয়া সেরে তৈরি হতে গেল অফিসের জন্য ।

সারা দিনের হাজার রকমের কাজ তাকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও পড়ন্ত বিকেল এর রোদ সত্যবতীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বারবার । মোবাইলটা হাতে নিয়ে সত্যবতীর নম্বরটা একটা ডায়াল করলো সে । মুহূর্তের মধ্যে ফোনটা বেজে উঠতে না উঠতেই ফোনটা কেউ রিসিভ করলো এবার । কিছু বলার উপায় নেই । ফোনের ওপরই হাজারো চুম্বনে ভরে উঠল কয়েক মিনিট । তারপর শান্ত গলায় ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই মধুর স্বর ; " বাবু , আই এম সরি " । ঈশ্বর এর বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যবতী তার সাথে কথা বলছে । আনন্দে পুরো শরীর তার পাথরের মত স্থির হয়ে গেছে । এমন সময় রাজীব এর আওয়াজ ভেসে এল পেছন থেকে । ঈশ্বরের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলো , " ভাবি হেয় ক্যায়া উধর " ? 

কৌন হেয় ? চমকে উঠে পিছনে ঘুরতে না ঘুরতেই বলে উঠলো ঈশ্বর । মনে হল যেন কত জন্মের ঘুম ভেঙে গেছে আজ তার । আর তার বলার ভঙ্গি শুনেই মোবাইলের ওপাশ থেকে হো হো করে হেসে উঠলো সত্যবতী । হ্যাঁ ! সত্যবতী । ওই নামেই তো ঈশ্বর আজকাল সত্যবতীকে ডেকে থাকে ভালোবেসে ।

তারপর ??

তারপর আর কি । ভালোবাসার কথায় কেটে গেল ঘন্টার পর ঘন্টা । রাজীব , অজিত , রাহুল , রজত , নিশা , রামমিলন সবাই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো যখন , তখন সি এ জি অফিসের বাইরে বাইকে বসে থাকা ঈশ্বর , আর ফোনের ওপাশে সত্য র মধ্যে ঘন্টা খানেক চললো অনর্গল ভালোবাসাবাসী , যে ভালোবাসায় শরীর এর ছোঁয়া নেই , শুধুই মনের না দেখা এক গুচ্ছ পরিকল্পনা । 

" এবার রাখি তাহলে " , বলতেই ঈশ্বরের গলায় ভেসে উঠলো সেই বিখ্যাত গান ---

" আভি না যাও ছোড়কর , কে দিল আভি ভরা নেহি " , 

সঙ্গে সঙ্গে সত্যবতীর গলা ফুটে বেরিয়ে এলো বাংলা গান ---

" আবার হবে তো দেখা , এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো " । সত্যি বলতে আজকের এই ঘন্টা খানেক তাদের মুখখানার মধ্যে এক অদ্ভুত তৃপ্তি ধরা পড়ছিল বারবার । ঈশ্বরের সাহস বাড়াতে সত্যবতী আজ অনেকটাই তৎপর । 

" একজন ছেলে হয়ে মা কে বলতে পারছো না যে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও ! " , বেশ আদর করে বললো সত্যবতী । ঈশ্বর তবু ভেঙে পড়ছে দেখে সত্যবতী তাকে সান্তনা দিয়ে আবার বলে উঠলো , " ভয় পেও না । হনুমানজি তো রয়েছে আমাদের সঙ্গে । " 

" ভয় পাই নি । শুধু ভাবছি মা কে ঠিক কি বলবো ! তবে একটা কাজ করেছি আমি । নিজের দিদির সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম । দিদিকে সব ঘটনা খুলে বলেছি । প্রথমে ভয় হচ্ছিল , বারবার একটা কথা মাথায় ঘুরছিল যে দিদিও যদি রাজি না থাকে তাহলে তো মাকে কিছু বলার সাহস টাও শেষ হয়ে যাবে " ।

" দিদি কি বললো গো ? " , বেশ কৌতূহল দেখিয়ে এবার জানতে চাইল সত্যবতী । 

ঈশ্বর জানালো , দিদি রাজি আছে । তোমার সাথে দেখা করবে বলেছে । 

" নিশ্চই করবো " , সত্যবতী উত্তর দিল । " কাল মা কে সাহস করে সব বলে দাও । দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে । " , সত্যবতী বলে চললো ।

ফোন রেখে বাড়ি ফিরতে ঈশ্বরের আজ দশটা বেজে গেল । রাস্তায় জ্যাম প্রচুর । তাই দেরি হওয়াটাই স্বাভাবিক । তবে এমন একটা সুন্দর বিকেলের জন্য যদি রোজ দেরি হয় , ঈশ্বর তাতে রাজি । যতই হল সত্য আজ মুখ তুলে চেয়েছে তার দিকে । রাতে খাবার কিনেই আনা হয় । খেতে খেতে ঈশ্বরের বারোটা বেজে যায় । তারপর সে তার কবিতার খাতা খুলে বসে । কিছু মাথায় এলে ভালো আর নাহলে সে তার নায়িকাকে গুড নাইট ম্যাসেজ করে ঘুমিয়ে পড়ে প্রতিদিন । আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি । শুধু আলাদা বলতে আজকের কবিতাখানা সে লিখেছে তার সত্যবতীর জন্য । যত্ন করে ইনবক্সে জমাও দিয়েছে । রাতে গুড নাইট লিখতে এসে সত্যবতী অবাক কবিতাটি পড়ে । সে ভাবতে পারেনা কেউ এত ভালোবাসতে পারে তাকে ---

" বাইরে ঘন শ্রাবণ ধারা ঝরে পড়ে ।। 

কাঁচের জানালায় ফোঁটা ফোঁটা , টপ টপ শব্দ করে ।। 

ঘরের মধ্যে তারই পাশে বসে সত্যবতী ।। দূরে দাঁড়িয়ে 

তার প্রিয় ব্যোমকেশ ।।

সত্য : বরষা আমার বড়ই প্রিয় সর্বদা ।। কি সুন্দর লাগে !! কি দারুন !! যেন কোন বার্তা ভালোবেসে নিয়ে এসেছে কেউ ; ওই মেঘেদের ওপার থেকে ।।

ব্যোমকেশ : তাই বুঝি !! তবে তো হিংসা করতে হয় ।। বৃষ্টির এই সতিনতা আমার জন্য মোটেও ভাল নয় ।।

সত্য : যা: !! কি যে বল ।। বৃষ্টি আমার গান আর তুমি আমার প্রাণ ।। বৃষ্টি জীবনে আনে অনেক খুশি আর 

তুমি মুঠো মুঠো আনন্দ ।।

ব্যোমকেশ : এইটি শুনতে চেয়েছিলাম ।। আমি জানি তুমি আমায় কত ভালবাস ...

সত্য : সে কি তুমি কম বাস আমায় ।।

ব্যোমকেশ এবার দুপা এগিয়ে যায় সত্যের দিকে ।।

ব্যোমকেশ : সাহিত্য , রহস্য এই নিয়েই তো ছিলাম ।। তারপর হঠাৎ তোমাকে দেখলাম ।। 

ঠিক যেন একটা হলুদ পাখি সবুজ গাছে বসে অপেক্ষায় মেঘের দিকে চেয়ে ।। নিচ থেকে অনেকেই 

মুগ্ধ ভাবে চেয়ে আছে ।। তোমায় একটি বার কাছে পাবে তাই ।।

সত্য : তাই বুঝি !! তাহলে তুমি কেন ডাক দাওনি সেদিন ।।

ব্যোমকেশ : দিয়েছিলাম তবে মনে মনে ।। তারপর একদিন সেই মনের কথাগুলোই চিঠি হয়ে ফুটে উঠলো জীবনে ।।

সত্য : তারপরেও তো মুরোদ ছিল না বলবার ।। ভালোবেসে আমাকে জোর করে কেড়ে নেওয়ার ।।

ভাগ্যিস , সব কিছু বুঝতে পেরেছিলাম আর তাই বলে দিলাম ।।

ব্যোমকেশ : সত্য , তুমি সত্য আমার ।। তোমাকে কাছে পেয়ে জীবন সত্যিই ধন্য আমার ।।

সত্য : একটা কথা বলবে ।। তুমি এত ভাল কেন গো ??

ব্যোমকেশ : হয়ত তুমি এত ভাল তাই ।।

এটুকু বলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল ।। দুজনের মুখে একটাই কথা তখন

আই লাভ ইউ টু " ।।

নীচে লেখা শুভ রাত্রি ।

সত্যবতী আজ শুভ রাত্রি লিখলো না আর , বরং প্রত্যুত্তরে সে লিখে পাঠালো 

কবিতার শেষ লাইনটা " আই লাভ ইউ টু " ।।

পরের দিন সূর্য ওঠার অনেক আগেই ঈশ্বরের ঘুম ভেঙে গেলো । আজ মা কে সব বলবেই সে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে । সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় অনেক দিন পর মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পড়ল সে । আজ কয়েক ঘন্টা বাকি । তারপর বাড়ি ফিরে মুখ হাত ধুয়ে নিয়েই মা কে ফোন করতে হবে এই ভাবনা নিয়ে পথ চলছে সে । এদিকে সত্যবতীও আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে । সকাল বেলা স্নান সেরে পুজোর আসনে হাত জোড় করা মেয়েটি আজ খুবই চিন্তিত । ঈশ্বরের মা যদি কোন কারনে এই সম্পর্কে রাজি না হয় .... আজ বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল নভেম্বর মাসটা । আফটারল এটাই ছিল ওদের প্রথম দেখা । 

ঈশ্বর পুজোর ছুটি সেরে সবে সবে ফিরেছে অফিসে । কাজের চাপের মধ্যে সে বুঝতেই পারিনি কবে দীপাবলির আলোতে একটা রঙিন উপহার সে পেয়েছিল পৃথিবীর কাছ থেকে । আর তাই চটপট কাউকে বুঝতে না দিয়েই অফিসে হপ্তা খানেক লম্বা ছুটি নিয়ে ঈশ্বর রওনা দিতে চেয়েছিল আবার একবার মেঘের দেশে । কিন্তু সত্যবতী অনেক করে বলায় সে যাত্রায় আর ফেরা হয় নি তার । আর তার পরেই সত্যবতীর আবদারটা ঈশ্বরের কাছে বেশ বেদনা দায়ক হয়ে উঠেছিল ।

সত্যবতী সেদিন খুব ভুল ছিল না । নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা ভরে অমাবস্যার সেই রাতে সে কবিতার মধ্যে দিয়ে কিছু কঠিন বাস্তব এঁকেছিল । সাধারণ কেউ হয়তো বোঝেনি ---

" অমাবস্যা কত সুন্দর ! যদি তুমি পাশে থাকো চিরকাল

ইতিহাস বলে চাঁদের কলংকের গল্পটা , তোমার কথা কেউ তো বলে না । " .....

তবু , সত্যবতী মনে মনে ঠিক করেছিল সেরাতেই , তার ভালোবাসার মানুষটিকে সে পাল্টে দেবে । জীবনের কান্নাগুলো মুছে ফেলবে সে । পারবে কি পারবে না জানতো না সে , তবু চন্দননগরের মেয়েটার মধ্যেও একটা নেশা আছে , আজ বুঝতে পারলো । রাতেই যে মোমবাতি জ্বলছিল সেই দিল্লির বুকে তার প্রত্যেকটির বুকে আজ সত্যবতীর নাম খোদাই হয়ে আছে I যতই হোক সবটাই তারই ইচ্ছাতে I

একটা সিগারেট মুখে ধরিয়ে মোবাইলটা চোখের সামনে খুলে ধরল । জ্বলজ্বল করছে শনিবারটা চোখের সামনে । অনেক হিসেব নিকেশ কষে , ইন্টারনেট চেক করে ফোন লাগালো সত্যবতীর নম্বরে । মনে মনে একটা অতৃপ্ত ইচ্ছা বেড়িয়ে আসতে চাইছে ঈশ্বরের হৃদয় ভেদ করে । প্রায় দু তিনবার রিং হতেই সেই চেনা আওয়াজ ভেসে এলো মোবাইলের ওপাশ থেকে । ' কি গো ! হঠাৎ ফোন করলে এই বিকেলে । ' , সত্যবতী প্রশ্ন করলো ।

' কেন করতে নেই বুঝি !' ---

' না । করতেই পারো । কিন্তু এই তো দুপুরে কথা হলো এত । '-----

' মিস করছিলাম ।' ----

' কিছু বলবে মনে হচ্ছে ! ' -----

' না মানে হ্যাঁ মানে মানে .... শনিবার ফ্লাইটে করে আমি আসবো । রবিবার আবার ফ্লাইটে ফিরে আসবো । পারমিশন .... ' ----

এক ঝটকায় সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে সত্যবতী বলে উঠলো , না ।

ঈশ্বরের আর কিছুই বলার ছিল না শুধু চুপচাপ ফোনটা কেটে দেওয়া ছাড়া । আজকের মত মন খারাপ ঈশ্বরের কোন দিন হয়নি । সারা রাত জেগে সে নিরবেই লিখলো তার কষ্টগুলো ম্যাসেঞ্জারে ---

" আমার এই পথ মসৃন ছিল 

আজ কে যেন তাতে গ্লিসারিন ঢেলে দিল 

এই সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়নি একফোঁটাও 

তবু এই মাটির হৃদয় গলে কাদা হয়ে গেছে 

তুমি বুঝলে না সেটুকুও । 

তুমি কি শুনেছ কোনদিন নীরবতা ? 

হয়তো নিরবতাও কিছু বলতে চায় 

সেও হাতড়ে বেড়ায় পুরোনো পথে 

দু চুমুক লিকার , কুয়াশার সকাল , 

দুটো প্রাণ , উচ্চস্বরে চিৎকার ( গান ) 

আর ধোঁয়া ধোঁয়া চারপাশ । " .....

আজকের নীরবতা সত্যবতীকে বেশ ভাবিয়েছে । ঈশ্বর জগদ্ধাত্রী পুজোর একটা রাত তার সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিল । কি দোষ করেছিল সে যদি সে তার নায়িকা -- চন্দননগরের নায়িকাকে নিজের জন্য পেতে চেয়েছিল ! তবে ঈশ্বরের বোঝাটাও উচিত , সব স্বপ্ন পূরণ হয় না সবসময় -- সব কিছুর অনুমতি সব পরিস্থিতিতে দেওয়া যায় না ।

প্রায় তিনদিন পর অভিমানের বরফ গললো । ঈশ্বর নিজের মোবাইলটা হাতে তুলে দেখে এই তিনদিনে কত ঝড় বয়ে গেছে আর ফোন করার পর বৃষ্টি ধারা ঝরে পড়লো ফোনের ওপার থেকে । অনেক কিছু বলার ছিল সেদিন কিন্তু কেউ আজ কিছুই বলতে চাইলো না । অনেক কথা এই তিনদিন ধরে জমেছিল বুকে । ঈশ্বর বা সত্যবতী কারুর পক্ষে এত বলা সম্ভব নয় আর বলতে গেলে গোটা তিনটে দিন লেগে যাবে । তবু কান্নায় ভেসে যাওয়া কথাগুলো পরপর সাজিয়ে মিনিট ত্রিশ কথা হয়েই গেল । 

সত্যবতী বা ঈশ্বর কেউই আজ ফোন কাটার পক্ষপাতী নয় । তবু একটা মুহূর্তে এসে থামতেই হল তাদের । সত্যবতী ফোন কাটার মিনিট দশেক এর ভেতরে তিনটে মেসেজ ছুটে এল হোয়াটসএপে । খুলে দেখে একটা কবিতা , একটা ছবি আর একটা ছোট্ট প্রশ্ন ---

" আজ আপত্তি না করলেই পারতে 

অনেক শখ করে কিছু চেয়েছিলাম 

ওগো তুমি বোঝ কি না জানিনা 

ওই একটা দিন আমাদের স্বর্গের মত হতো ।

পালিয়ে যেতাম অনেক দূরে 

রাতের গভীর অন্ধকারে 

নেশায় টলতে টলতে ফিরতাম ঠিকই 

কিন্তু ততক্ষণে আমরা চিনে ফেলেছি নিজেকে 

আমরা যৌবনে ঘর ছেড়েছিলাম , 

প্রাপ্ত বয়সে ফিরে আসবো সূর্য ওঠার আগে ....

ভেবেছিলাম একটা রাত তোমার সাথে প্রেম করবো 

শরীর মন সব উজাড় করে --- সেটুকুও দিলে না 

আজ আপত্তি না করলেই পারতে । "

তার নিচে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে তোলা একটি ছবি । নীচে লেখা তোমার অপেক্ষায় । 

কবিতা ও ছবিটা যে সত্যবতীর একটুও পছন্দ হয় নি , বরং বেশ রাগ হয়েছে দেখে তা তার চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট । তবু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফোনটা সুইচ অফ করে দিল আর সমস্ত রাগ জমা করে রেখে দিল ভবিষ্যতের জন্য ।

প্রায় ঘন্টা ছয় নিস্তব্ধ সব । কোন মেসেজ নেই , ফোন নেই ; ঠিক যেন কোন ঝড়ের পূর্ব নির্দেশ । এখন বিকেল পাঁচটা বাজে । আজ শনিবার । ঈশ্বর খুব জানে যে সত্যবতী আজ অভ্যাস মতোই সংকটমচনের পুজো দিতে যায় । আস্তে করে মিসড কল দিল সত্যবতীর মোবাইলে । মিনিট তিনেক পার এর পর ... কোন উত্তর এল না এখনো । আবারও দু তিনটে প্রচেষ্টা কিন্তু সব হতাশা শুধু । বোধহয় আজ প্রকৃতিও চায় নি বিরহ দিতে । তাই সুযোগ একটা এসে দাঁড়িয়েছে আবার । সন্ধ্যায় হোয়্যাটস্যাপ এ অনলাইন আছে দেখে সাহস করে দুলাইন লিখে পাঠালো সে –

" ও গো ভিনদেশিনী , চঞ্চলা হরিণী 

অপেক্ষায় দিন যে হচ্ছে পার 

রাগ যত ঝেড়ে ফেলো 

তোমার আদরের একুলে প্রচন্ড দরকার । "

উত্তর আসবে কি না তা নিয়ে ঈশ্বর রীতিমতো টেন্সড । এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মোবাইলে যখন , ঠিক তখন ই বেজে ওঠা রিংটোনে হত্চকিয়ে উঠলো সে । সত্যবতী ইস কলিং । ফোন ধরে মিষ্টি করে ঈশ্বর বললো , " আই এম সরি । " কিন্তু প্রত্যুত্তরে পেল কিছু চিৎকার -- এক ভালোবাসাময় অধিকারের চিৎকার --

" জাস্ট শাট আপ ..... ছবিতে মুখে কি রয়েছে তোমার ? এই সব ছাইপাশ কত দিন .... " আর কিছু বলতে না দিয়েই মাঝ পথে রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়ে ঈশ্বর বলে উঠলো , " না , মানে , পুরোনো অভ্যাস । তবে ছেড়ে দিয়েছিলাম । সেদিন তুমি যেতে মানা করেছিলে তাই মন খারাপ হয়েছিল আর ... " 

" আর । শুরু করে দিলে । " সত্যবতী বলে উঠলো । আবার এক প্রকার শাসন করার সুর তুলে সত্যবতী বলে চললো , " কথা দাও এসব ছাইপাশ আর কোনদিন খাবে না তুমি " ।

" কথা দিলাম " , আস্তে করে বলে উঠলো ঈশ্বর । প্রায় মিনিট পনেরোর এই মান অভিমানের খেলার মধ্যে দিয়ে প্রেমের মিষ্টি একটা সম্পর্ক আবার গভীরতা পেল , পূর্ণতা পেল । এই ভাবে যখন ঈশ্বর সত্যবতীর প্রেম এগিয়ে যাচ্ছিল , তখন অন্যদিকে প্রকৃতির মনে পরিবর্তন না এসে পারে কি ? একদিকে মিউচুয়াল এর খোঁজ জোরালো হল আর অন্যদিকে শীত দরজায় প্রায় কড়া নাড়া দিয়ে গেল । ঈশ্বরের মনে এক অদ্ভুত তৃপ্তি আজ । সকাল সকাল চায়ের কাপে চুমুক চুমুক দিতে দিতে সত্যবতীকে সে বলল ,

" শীতের শীতলতা তুমি , তুমি লাবন্যা

পাতা ঝরার প্রকৃতির মধ্যে তুমি , তুমি বসন্ত কন্যা 

তোমার অপেক্ষায় দিন কাটে , রাত হয় 

প্রেম যেন এটাই , স্বার্থক এক গল্প চিরকালীন ।

এসো এ গোটা দিন বসে থাকি পাশাপাশি 

এসো এ গোটা দিন কথা বলি প্রাণ খুলে 

যৌবন ফুরিয়ে আসার আগে চলো 

জীবনকে যৌবনময়ী করে তুলি দুজনে । "

সেদিন সোমবার । দিন গড়িয়ে চলেছে নিজের মতো । আর প্রতিটা দিনের সাথে বেড়ে চলেছে একটা চাপা উৎকণ্ঠা । মিউচুয়াল করার একটাও মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না । আর যাও বা পাওয়া যায় তারা হয় এস সি নয় এস টি আর সেই মুহূর্তে দিল্লির অফিসে সংরক্ষিত আসন একটাও খালি নেই । আজও সেই রুটিনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না । একদিকে বাড়ি ফেরার জন্য পাগল মন আর অন্য দিকে নিজের ভালোবাসার সাথে দেখা করার আগ্রহ --- সব মিলিয়ে ঈশ্বর মেন্টালি বেশ চিন্তিত । আর এই অবস্থায় ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু কবিতাও সঙ্গে নেই । প্রায় বেশ কিছুদিন ধরে কবিতা আসছে না আর । 

এ অবস্থা বেশিদিন সহ্য করা যায় না । অন্যদিকে ঈশ্বরের ভেঙে পড়া দেখে সত্যবতীও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল এবং একদিন একটা চিঠি লিখে পোস্ট করে দিল ঈশ্বরের ইনবক্সে –

" বেশ বুঝছি তুমি চিন্তিত । কিন্তু এ তো কাম্য নয় !

তুমি আমায় ভালোবেসেছো ঈশ্বর । দাবি সব মেনে নিতে হবে 

তাই বলে আমার । 

জোড় গলায় বলতে পারো না , আমি কেন আসবো না প্রবাসে 

আবদার নয় আদেশ করতে পারো , আমি কেন পারবো না থাকতে 

তোমার কাছে গিয়ে । 

জানি তুমি কষ্ট পাও এসব বলতে । কিন্তু এই ঘাত প্রতিঘাত ই প্রেম ।

সোনা , 

আর একটা কথা বলার ছিল । তুমি কি জানিয়েছো তোমার বাড়িতে 

আমাকে নিয়ে ? আগে জানাও । নাহলে বেকার হতেও পারে তোমার ফিরে আসা 

বাড়ির সম্মতি ছাড়া এ মিলন কোনদিন হবে না । "

চিঠিটা দেখা মাত্রই ঈশ্বরের চিন্তা আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল । একটা সমস্যা সমাধান হচ্ছে না , তার ওপর বাড়িতে জানাতে হবে !! উত্তরে শুধু লিখে পাঠালো ঈশ্বর –

" এ কেমন পরীক্ষা তোমার , এ কেমন তোমার নিয়ম 

চিঠিটা পড়ে আমার করুন অবস্থা -- সে আমি জানি আর জানে 

নারায়ণ । "

গতবার সে কোনরকমে এড়িয়ে গেছিল বাড়িতে বলার ব্যাপারটা , কিন্তু এবার ?? আর তো কোন উপায় নেই । একদিকে সাহসে কুলাচ্ছে না অন্যদিকে আজ সন্ধ্যা হতে না হতেই সত্যবতী ফোন করল তাকে । ঈশ্বর তখন অফিস থেকে বেড়িয়ে বাইক সওয়ার করে বাড়ি ফিরছিল , আকাশের লাল সূর্য তখন পশ্চিমগামী । বুকপকেটে বেজে ওঠা মোবাইলের আওয়াজ শুনতে পেয়ে সে বাইকটি রাস্তার একপাশে দাড় করিয়ে মোবাইলটি পকেট থেকে বের করলো । তার ধারণা একেবারে নির্ভুল ছিল । সত্যবতী ওয়াস কলিং । 

" কি হল ফোন ধরতে এত দেরি হলো কেন ? " , সত্যবতী বেশ রেগে প্রশ্ন করলে ঈশ্বর একদম ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিল , " বাইক চালাচ্ছিলাম । " 

~ তার মানে তুমি বাইক চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলছো । 

~ না । রাস্তার ধারে বাইক স্ট্যান্ড করে কথা বলছি । 

~ ও । ঠিক আছে । বাড়ি যাও । তারপর একটা কল করো । কথা ছিল কিছু । 

শুধু এই টুকু বলেই সত্যবতী ফোন কেটে দিল । ঈশ্বরও বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে রওনা দিল নিজের গন্তব্যের দিকে । এদিকে পথে এগিয়ে চলেছে তার বাহনটি কিন্তু ড্রাইভারের মন একদমই রাস্তার দিকে নেই । ফলত্ব .... একসিডেন্ট । যাই হোক তেমন সিরিয়াস কিছু না । প্রেমে পড়লে ওরকম একটু আধটু হয়েই থাকে । সাধারণ লোকজনদের দ্বারা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো আর তার সাথে তার কিছু কলিগদের ঈশ্বরের মোবাইল থেকে ফোন করে জানালো হলো যে ঈশ্বরের একসিডেন্ট হয়েছে । তাকে রাজীব গান্ধী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে । খবর যেতে না যেতেই আরিফ , রজত , দীপালি ও অজিত আরিফের মারুতি নিয়ে ঘটনাস্থলে রওনা দিলো --- যতই হোক কলিগ বলে কথা । আর অন্যদিকে সারারাত ফোনে ঈশ্বরকে না পেয়ে সত্যবতীর অবস্থা কি হলো সে মুখে বলা যায় না ... 

চোখে ঘুম নেই । আর মোবাইলে অন্তত ১৩২ বার মিসড কল । তবু ঈশ্বর কথাও বললো না , কথা শুনলোও না । আর তার কলিগরা এক একটা ফোনকল কেটে চললো সারা রাতজুড়ে অনবরত । পরেরদিন সূর্য একটা মান অভিমান নিজের সাথে বয়ে নিয়ে আসছে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু ওপরওয়ালা এর সাথে আরো কিছু অতিরিক্ত যোগ করে রেখেছিল এবার । অবশেষে দুপুর দুটো নাগাদ জ্ঞান ফিরলো ঈশ্বরের । মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে যায় সে । চারদিকে একবার তাকালো দুচোখ ভরে তারপর ফোনটা খুঁজতে শুরু করলো পাগলের মতো । 

ফোনের ওপাশ থেকে যে গলাটা ভেসে এলো সেটা বেশ করুন । গলা কাঁপছে তার । সারা রাত মনের মানুষের খবর না পেলে এরকমই হওয়া স্বাভাবিক । সেই অবস্থায় প্রশ্ন করলো সত্যবতী - " কোথায় ছিলে সারারাত ? " ঈশ্বর তখনও চুপ । কি বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না কিছুই । তার এই নীরবতা সত্যবতীকে আরও বিচলিত করে তুলছে । ওপাশ থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এলো এবার ,

" সব ঠিক আছে তো ? কিগো , কিছু বলছো না কেন ? তুমি ঠিক আছো তো ? " কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আস্তে করে ঈশ্বর উত্তর দিল , না । 

" কেন ? কি হয়েছে ? কি গো কি হয়েছে তোমার ? " , সত্যবতী চিৎকার করে চললো মোবাইলের ওপাশ থেকে । 

" কাল আমার একসিডেন্ট হয়েছে । আমি এখন হাসপাতালে ভর্তি । মাথায় চোট লাগে তাই জ্ঞান ছিল না সারা রাত " , এটুকু বলেই চুপ করে গেল ঈশ্বর । ফোন চালু রইল নিজের মতো ।

অনেক বার চিৎকার করেও কোন সারা না পেয়ে সত্যবতী ফোন কেটে দিল । দু একবার ফোন করলো তার পরেও , কিন্তু ফোনটা তুলে কথা বলতে কেউ সাহস পেল না - কি উত্তর দেবে এই ভেবে । অবশেষে কোন উত্তর না পেয়ে সত্যবতী একটা মেসেজ পাঠালো ঈশ্বরকে । মেসেজে লেখা –

" সত্যবতী আজ ক্লান্ত , ঈশ্বরের খোঁজে 

ঈশ্বর আজ চুপ , ঐশ্বরিক কাগজের ভাঁজে 

সংকটে যে পাশে থাকে আমি তার ঘরে চললাম 

তুমি উঠবে আবার , উঠতেই হবে , ভালোবাসা বলে গেলাম । 

সংকটহরন মঙ্গলমুর্তি হনুমান , রক্ষা করুক তোমায় 

বাঁধা যত কেটে যাক , যন্ত্রণা যত আঘাত করুক আমায় 

আমি পাশে না থেকেও পাশে আছি , কান্না পাও না বুঝি শুনতে 

গলু , গুলটি আমি , শুধু তোমারই , ওঠ , মন চাইছে ভীষন তোমায় দেখতে । "


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance