Become a PUBLISHED AUTHOR at just 1999/- INR!! Limited Period Offer
Become a PUBLISHED AUTHOR at just 1999/- INR!! Limited Period Offer

Sukdeb Chattopadhyay

Abstract

5.0  

Sukdeb Chattopadhyay

Abstract

আপনজন

আপনজন

5 mins
829


নানা কাজে আটকে গিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে বিমলের বড় দেরী হয়ে গেল। দোগাছিয়া স্টেশনে নামল প্রায় রাত আটটায়। শীতের বেলা, বিকেল গড়াতে না গড়াতেই ঝুপ করে দিনের আলো নিভে যায়। তখনো ইলেকট্রিক ট্রেন আসেনি। ধোঁয়া ছেড়ে হুস হুস করে গাড়িটা চলে যেতেই চারিদিক কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অল্প যে কজন প্যাসেঞ্জার নেমেছিল তারা ততক্ষণে নিজেদের বাড়ির দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। স্টেশনের অফিস ঘরে কয়েকটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছে, বাইরেটা অন্ধকার। বিমল যাবে অনেকটা দূরে, নপাড়ায়। ওর বাবার দূরসম্পর্কের এক দিদির বাড়ি। মনোরঞ্জন মাঝে মাঝেই ছেলেকে বলেন অপু পিসির বাড়িতে একবার ঘুরে আসতে।

-- মানুষটা একা থাকে, বয়স হয়েছে, এক আধবার গিয়ে একটু খোঁজখবর নিয়ে আসতে পারিস তো! বাল্য বিধবা। একটা ভাই ছিল, সেটাও অকালে মারা গেল। আমরা ছাড়া অপুদির আর কে আছে বল? গেলে খুব ভাল লাগবে। কত বিশাল ফলের বাগান, পুকুর, আগের আমলের বড় বাড়ি, আর মানুষটাও বড় ভাল। সময় করে একবারটি যা। বিমলের নিজের কোন পিসি নেই। অপু পিসি বাবার কেমন দিদি হয় তা ওর ঠিক জানা নেই। মানুষটাকে ভাল করে চেনেই না, তাই তাঁর ওপর ওর কোন টানও নেই। বাবাও যে নিয়ম করে যেত তা নয়, তবে নমাসে ছমাসে হলেও যেত। শরীর ভেঙে যেতে সে পাটও চুকে গেছে। এখন সারাদিন শুয়ে বসে থাকে আর অতীত হাৎড়া়য়। বাবার পীড়াপীড়িতে খানিকটা বাধ্য হয়েই আসতে হল।

সেই কোন ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার এসেছিল। কিছুই চেনে না। রিক্স বা গরুর গাড়ি, যা হোক একটা কিছুতে করে যেতে হবে। স্টেশনের বাইরে এসে কিছুই পেল না। লোকজনও নেই যে জিজ্ঞেস করবে। এদিক ওদিক খানিক ঘোরাঘুরি করার পর কোনার দিকে একটা গাছের পাশে ছোট একটা চায়ের দোকান দেখতে পেল। দোকানি বিমলের গন্তব্য শুনে ঝাঁপ বন্ধ করতে করতে কোন পথে যেতে হবে বাতলিয়ে বলল—সে তো মেলা দূর। রেতের বেলায় এই অন্ধকারে চিনে যেতি পারবেন তো?

যাওয়ার রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যানবাহন কিছু পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বিমল ফিরে দেখে দোকানি নেই। এইত মানুষটা ছিল হঠাৎ উবে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার। টর্চ জ্বালিয়ে লোকটার নির্দেশ মত গুটি গুটি এগোতে লাগল। একে গ্রাম তায় শীতের রাত, চারিদিক একেবারে শুনশান। দূরে একটা হালকা আলো চোখে পড়ল। কিছুটা এগোবার পর দেখে রাস্তার ধারে একটা গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আলোটা আসছে গাড়ির পেছনে ঝোলান একটা লম্ফ থেকে। কিন্তু গাড়োয়ান ফাঁকা রাস্তায় গরুর গাড়ি রেখে এই রাতে গেল কোথায়? বিমল চালক আসার জন্য একটু অপেক্ষা করবে কিনা ভাবছে এমন সময় কানে এল, “বাবু যাবেন নাকি?” চমকে তাকিয়ে দেখে ছই এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একজন পাগড়ী বাঁধা মাঝ বয়সী লোক। এগিয়ে এসে হেঁসে বলল, “বাইরের মানুষ, এই রেতের বেলায় একা একা না যাওয়াই ভাল। চিন্তা কইরেন না উঠি পড়েন”। 

বিমল হাতে চাঁদ পেল। দেরী না করে গন্তব্য জানিয়ে উঠে পড়ল। লোকটি জানাল ওর নাম নিমাই।

-- বাবু কি রাস্তা চিনেন নাকি? ঠিক পথেই তো আসতিছিলেন।

-- না না। আমি এখানকার কিছুই চিনি না। স্টেশনের বাইরে চায়ের দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে ও বলে দিল।

-- অ্যাঁ, কি বলতিছেন?

-- অমন চমকে উঠলে কেন?

-- চায়ের দোকানের লোকটার কথা কইলেন তো তাই। সে তো জলে ডুবে কবেই মইরে গেছে বাবু।

-- বলো কি? আমি যে ওকে স্পষ্ট দেখলাম। আমার সাথে কথা বলল। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করছিল। অবশ্য হঠাৎই ও কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

--ও নিয়ে আর ভাইববেন না। আমার গাড়িতে উঠি পড়িছেন আর কোন ভয় নাই। গাড়ি চালাতে চালাতে দেশ গাঁয়ের নানান গল্প জুড়ে দিল। জীবনে প্রথমবার গরুর গাড়িতে উঠে বিমলের বেশ লাগছে। গাড়ির ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ, ঝাকুনি, নিমাইয়ের গল্প আর মাঝে মাঝে গরুদের উদ্দেশ্যে হ্যাট হ্যাট আওয়াজ, সবটাই বেশ উপভোগ করছিল।

-- বাবু নামেন, এসে গেছে।

নিমাইকে অনেক ধন্যবাদ দেওয়ার পর কত দিতে হবে জিজ্ঞেস করতে বলল—ছি ছি, এ আমার আপনার লোকের বাড়ি। ভাড়া নেব কি? আর আমি তো এপথেই আসতিছিলাম, বেপদে পড়েছেন মনে হল তাই ডাকলাম। ওই সামনে তেনাদের বাড়ি। কড়া নাড়তে ভেতর থেকে আওয়াজ এল—ক্যারা?

-- আমি বিমল।

-- সেটা ক্যা?

--মনোরঞ্জনের ছেলে।

-- ও, মনার ব্যাটা। দাঁড়া খুলছি।--আয় বাবা ভেতরে আয়। তোর বাপ এলোনা?

--বাবার শরীর ভাল নয়। আজকাল তেমন একটা বেরোয় না।

--একটা খবর দিয়ে আসবি তো! এতটা পথ রেতের বেলায় এই ঠাণ্ডায় এলি কি করে?

-- নিমাই বলে একজন লোক নিজে থেকেই তার গরুর গাড়িতে আমায় নিয়ে এল। পয়সাও নিল না।

-- ওমা বলিস কিরে? সে তো কবে ওপারে চলে গেছে। যাক বাবা ভালয় ভালয় বাড়িতে এসে গেছিস আর কোন চিন্তা নেই। আজ অমাবশ্যা তো, রাত বিরেতে গাঁয়ে অপদেবতারা মাঝে সাঝে ঘোরাঘুরি করে। তবে নিমাই আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিল। ও নিয়ে আর চিন্তা করিসনি, যা হাত পা ধুয়ে ঘরে যা আছে খেয়ে নে। শীতের রাত বেশি জল ঘাঁটিসনি। নিত্যদিনের একঘেয়ে খাবারের বদলে খই, দুধ, পাটালি আর মোয়া খেয়ে বিমলের মনটা জুড়িয়ে গেল। খাওয়ার পর অনেক গল্প হল। শোয়ার আগে পিসি একটা মোটা খাম হাতে ধরিয়ে বলল—এটা তোর বাপকে দিস।

তারপর বিমলের গায়ে লেপ চাপা দিয়ে, হ্যারিকেনটা একটু কমিয়ে দিয়ে পিসি চলে গেল। মাতৃহারা বিমল বহুকাল বাদে যেন মায়ের সান্নিধ্য পেল, মনটা খুশিতে ভরে গেল। ঠিক করল পিসির কাছে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বিমল পিসিকে কোথাও দেখতে পেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন সাড়া পেল না তখন সামনের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারল যে পিসি দিন কুড়ি আগে মারা গেছে। ঠিকানার অভাবে কোন আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। প্রতিবেশীরাই সব কাজকর্ম করেছে। কাল স্টেশনে নামার পর থেকে চায়ের দোকান, নিমাইয়ের গরুর গাড়ি আর সবশেষে পিসি, সবটা যেন অদ্ভুত এক স্বপ্ন। এখানে আসার পর থেকে রাতটা ছিল এক অলৌকিক মায়ার জগৎ। কিন্তু খামটা, ওটা তো স্বপ্ন নয়, ঘোর বাস্তব। বাড়ি ফিরে পিসির নির্দেশ মত বিমল খামটা বাবাকে দিল।

বিমলের বাবা খামটা খুলে দেখেন ওর ভেতরে রয়েছে ওনার অপুদির সম্পত্তির দলিল। তাতে স্থাবর অস্থাবর সমস্ত কিছু ভাই মনোরঞ্জনের নামে উইল করা রয়েছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—জনম দুঃখী দিদিটাকে জীবনে কিছুই দিতে পারলাম না আর সে তার সবকিছু এই অযোগ্য ভাইকে দিয়ে চলে গেল। বিমল তখনও সেই মায়াবী রাতের ঘোরে আচ্ছন্ন। অপার্থিব ওই জগতে বিমল অনুভব করেছিল সনাতন মাতৃস্নেহকে । সম্পর্কের নৈকট্য খুঁজে না পাওয়ায় এমন এক আপনজনের সাথে সে কখনও যোগাযোগই রাখেনি। অনুতাপ হলেও প্রায়শ্চিত্তের আর কোন পথ নেই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract