বন্যেরা বনে সুন্দর
বন্যেরা বনে সুন্দর
মেয়ের পরীক্ষা হয়ে গেছে। অতএব আবার নতুন ক্লাসের সিলেবাসে উঠেপড়ে লাগার জন্য একটু এনার্জি প্রয়োজন। এনার্জি অর্থে একটু খোলামেলা হাওয়া বাতাস গায়ে লাগানো, দুদিন একটু রুটিন মাফিক যান্ত্রিক জীবন হতে মুক্তির শ্বাস ফেলা আর কি! এমনিতে থাকি দিল্লীতে, এখানে তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন কাছাকাছি না থাকায় ঘরের মধ্যেই কেটে যায় দিনগুলো। তাই একটু ফুরফুরে মুডে নিজেকে লোড করার জন্য ছোটোখাটো হলেও, একটা ট্যুর প্ল্যানিং করতেই হয়। তাই ঠিক হল, তিনদিনের জন্য নৈনিতাল যাবো। কথাটা ঘরে আলোচনা হওয়া মাত্র আমার সাত বছরের কন্যা খুশিতে একেবারে গদগদ হয়ে উঠল। আর বেড়াতে যাওয়ার গন্তব্য নিয়ে হাজার রকম প্রশ্ন করতে লাগল। আমিও ঘরের কাজ সামলাতে সামলাতে সাধ্যমতো ওর কৌতুহল নিরসন করতে লাগলাম।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনে চেপে আমরা কাঠগোদাম পৌঁছলাম। সেখানে স্টেট গভরমেন্টের বাস টার্মিনাসে গিয়ে আমরা বাস ছাড়ার আগে কিছু টুকটাক খেয়ে নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমার মেয়ে হিয়া উত্তেজনায় চিল্লিয়ে উঠে বলল আমায়
"মা দেখো কত রঙবেরঙের পাখি। আমি বাড়ি নিয়ে যাবো।"
আমি ওর ছোটো হাতের অঙ্গুলিসংকেত অনুসরণ করে দেখলাম, এক পাখি বিক্রেতা কয়েকটি খাঁচায় করে বেশ কয়েকটি বদ্রী পাখি, টিয়া পাখি আর নাম না জানা রঙবেরঙের পাহাড়ি পাখি এনে বাসস্ট্যান্ডের এককোণে বসে আছে। আর তাই দেখেই মহারাণী নাকি কান্নায় বায়না জুড়েছে। এরকম আগেও বহুবার হয়েছিল। শিশু মন যা কিছু দেখে, তাকেই নিজের খেলার সঙ্গী করতে চায়। এর আগে তাই একবার একটা পেটস শপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, হিয়া সাদা ধবধবে খরগোশ আর রঙবেরঙের মাছ নিতে চেয়েছিল। সেবার অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেই প্রস্তাবকে ওর মাথা থেকে নামিয়েছিলাম আমরা। তারপর থেকে আর কোনোভাবেই সেই দোকানের সামনের পথ ভুলেও মাড়াই নি। এছাড়াও রাস্তার কুকুরের বাচ্চা, বাছুর, বিড়ালের বাচ্চা সবই হিয়ার বাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। সেগুলো শুনে শুনে আমাদের কাছে সেসব বায়না এখন জলভাত হয়ে গেছে। আমি শুধু একটাই কথা বলি, ওদের মায়ের থেকে সরিয়ে আনাটা ঠিক নয়।
এরপর ঘুরতে এসেও, সেই উটকো বিপদ জুটল। অগত্যা তখন আমি পরিস্থিতি বুঝে হিয়াকে কোলে বসিয়ে বোঝালাম "ওই পাখিওয়ালা ওদেরকে ওদের মায়ের কাছে দিয়ে আসতে যাচ্ছে।"
মেয়ে আমার এতোটাও বোকা নয়। ও বুঝে গেছিল, পাখিওয়ালা পাখিগুলোকে বিক্রি করতেই এনেছে সেখানে।
তখন আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম যে "পাখিরাতো খোলা আকাশে ঘুরে বেড়ায়, তাকে খাঁচার ছোট্ট জায়গায় আটকে রাখলে সে কষ্ট পায়। তারপর ওদের বাড়িতে নিয়ে এলে, ওরা রোজ কান্নাকাটি করবে। ওদের মায়ের কাছে যেতে চাইবে। তুই আমায় ছেড়ে থাকতে পারবি বল? তাহলে ভাব ওরাই বা ওদের মাকে ছেড়ে কিকরে থাকবে?"
হিয়া আমার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে রইল ওই পাখিওয়ালার দিকে চেয়ে। তারপর আমায় জড়িয়ে ধরে বলল "না, আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না।"
আমি তখন ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম "এইজন্যই তো লেখক বলেছিলেন 'বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।"
হিয়া প্রশ্ন করল "সেটা আবার কি কথা মা?"
আমি ওকে বাসে উঠে বসে সে গল্প বলবো বলে বাসের দিকে হাঁটা লাগালাম। হিয়ার বাবাও ততক্ষণে বাসের টিকিট নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন। অত:পর আমরা কাঠগোদাম থেকে বাসে চড়ে বসলাম, নৈনিতালে যাওয়ার জন্য।
বাসটা ছাড়তেই, মেয়ের সাথে আমি গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম। বাসটা পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। পথের দুদিকে অপূর্ব সুন্দর পাইন ওকের বন। তাদের সবুজ ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের বেলাশেষের আভা ঝিলিক মারছিল অসাধারণ এক চিত্রের মতো। যেন কোনো শিল্পী তার নিপুণ হাতে প্রকৃতির অপরূপ রূপকে এঁকে চলেছেন অপূর্ব দক্ষতায়। এমন সময় বাসটা হঠাৎই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। কানাঘুঁষা শোনা গেল, সামনে হাতির পাল এসে পড়েছে। এই পাহারিয়া পথে এটা মাঝেমধ্যেই হয় নাকি। জঙ্গলি হাতির দল লাইন করে রাস্তা টপকে এদিক ওদিক করে। তখন সামনে পেছনের সব যানবাহনকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়।
আমি মেয়ের সাথে বাস থেকে নেমে দেখি, আমাদের বাস থেকে প্রায় দশ হাত দূরে তিন চারটে দাঁতাল হাতি শুঁড় তুলে গর্জন করতে করতে রাস্তা পাড় হচ্ছে। যেন হুশিয়ারি দিচ্ছিল, আমাদের নিরাপদে পার হতে দাও বলে। হিয়া তখন ওদের দেখে বিস্ফোরক চোখে চেয়ে রয়েছে। চিড়িয়াখানার বাইরে এরকমভাবে রাজকীয় আমেজে হাতিদের কখনো দেখেনি ও। হঠাৎ আমার ওড়না টেনে ও বলে উঠল, ওই দেখো মা ... একটা ছোট্ট হাতির ছানা। আমি ওর কথাটা শুনে চেয়ে দেখলাম, একটা ছোট্ট হাতির শাবককে ওর মা শুঁড়ের বেড়ি দিয়ে সংযোগ স্থাপন করে আগলে রেখে রাস্তা পার করাচ্ছে।
দৃশ্যটা দেখে হিয়ার বাবা কৌতুক করে বলে উঠল হিয়াকে "এই ছানাটাকে বাড়িতে নিয়ে যাবি নাকি?"
হিয়া তখন বড়দের মতো হাবভাব নিয়ে উত্তর দিল ওর বাবাকে "ওমা, তুমি জানো না? বন্যেরা বনে সুন্দর আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।"
হিয়ার শিশুমনের বোধগম্যতাতে তখন বড়ই তৃপ্ত হল আমার মাতৃহৃদয়।
(সমাপ্ত)