অপেক্ষায় (প্রৌঢ়ের একাকীত্ব)
অপেক্ষায় (প্রৌঢ়ের একাকীত্ব)
সরকারি উদ্যোগে পুরোনো ঘাটের সংস্কার করে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা ভারী সুন্দর পার্ক হয়েছে। বাচ্চাদের খেলার নানান রাইড থাকায় অনেক নব্যমা শিশু সন্তানকে নিয়ে বিকেলে পার্কে আসে, বাচ্চারা খেলে, মায়েরা ছিমছাম বেঞ্চে বসে নিজেদের মধ্যে গল্পগাছা করে আড্ডায় আলাপে সময়টুকু কাটিয়ে আবার সন্ধ্যায় যে যার ঘরে ফেরে।
সকালের দিকে পার্ক দখলে চলে যায় তাদের যারা সকাল সকাল ধরাচুড়ো (গায়ে ট্র্যাক স্যুট পায়ে স্নিকার্স) চড়িয়ে মর্নিং ওয়াকে এসে বেঞ্চে বসে চা সহযোগে আড্ডায় মাতে। আর এছাড়া আরো একদল আছে .....প্রৌঢ়া মহিলারা ......সংসার জীবনের উপান্তে পৌঁছে তারা বাড়ী থেকে এটাসেটা রান্না করে টিফিনকৌটোয় ভরে নিয়ে পার্কতুতো ভগ্নীসমা বান্ধবীরা মিলেমিশে ভাগাভাগি করে খায়দায় আর জমিয়ে পিএনপিসি করে।
তবে পার্কের শেষ প্রান্তের ঝুপসি ছায়া ঘেরা বেঞ্চগুলো থাকে জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক প্রেমিকাদের দখলে। পার্কে আসা বাকী গোষ্ঠীর সদস্যরা পার্কের শেষ প্রান্তটার নাম দিয়েছে "কলির বৃন্দাবন"।
মণিময়বাবু এদের কোনো দলের সাথেই নিজেকে মিশ খাওয়াতে পারেন না, তাই তিনি সকাল বিকেল পার্কের চৌহদ্দির মধ্যে দু-চার চক্কর কেটে বেরিয়ে আসেন পার্কের বাইরে। পার্কের গেট দিয়ে বেরিয়ে ডাইনে ঘুরে ফুটপাত ধরে বিশ-পঁচিশ ফুট হাঁটলেই বেশ সুন্দর টুকটুকে লাল রঙের বিলিতি কায়দার এক টেলিফোন বুথ আছে। আর সেই বুথ পেরিয়ে কয়েক পা গেলেই রাস্তামুখী পরপর কটা কাঠের বেঞ্চ বসানো আছে ফুটপাত বরাবর। মণিময়বাবু পার্ক থেকে বেরিয়ে এর মধ্যেই প্রথম যে বেঞ্চটা বুথের একদম কাছটিতে সেইখানিতেই বসেন দুবেলা। বুথের সামনে টুল পেতে বসা কর্মী ছোকরা,
ভ্রাম্যমাণ চা-কফি বিক্রেতা, রাস্তায় জগিং করতে থাকা একঝাঁক খুদে খেলোয়াড়, পার্কের গেটের পাশে বসা খবরের কাগজ বিক্রেতা আর এরা ছাড়াও বোধহয় আরো অনেকেই মণিময়বাবুর মুখচেনা। তবে আলাপ পরিচয় কারুর সাথেই ঠিক তেমন নেই।
এবারে মণিময়বাবুর সম্পর্কে দু-চার কথা না জানলেই নয়। অধুনা অবসরপ্রাপ্ত মণিময়বাবু দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর দুই ছেলেই কর্মসূত্রে প্রবাসী........ নিজের নিজের পরিবার নিয়ে দেশেই দূর শহরে। মণিময়বাবুর স্ত্রী গত হয়েছেন বছর চারেক আগে এবং বর্তমানে বিপত্নীক মানুষটি বিশাল এক দোতলা বাড়ী আগলাচ্ছেন গুটিকয় পরিচারকের সহযোগিতায়। মাঝে মাঝে একান্তে আফশোষ করেন এতবড়ো একখানা বাড়ী বানিয়েছিলেন বলে। হাবেভাবে বোঝেন ছেলেরা আর এমুখো হয়তো হবে না। তারা চায় মণিময়বাবু পালা করে তাদের কাছেই থাকুন আর এখানকার বাড়ী তালাচাবির হেফাজতে থাক। তারপরে নাহয়...... ছেলেদের বাকী কথাটা আর মণিময়বাবু শেষ করতে দেন নি। স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন ছেলেদের যে তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বাড়ী বিক্রি করবেন না, বাড়ীর আনাচে কানাচে পরতে পরতে পরলোকগতা স্ত্রী রুক্মিণীর স্মৃতি এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে যে এ বাড়ী বিক্রি তিনি করবেন না এবং ছেলেদেরকেও দায়িত্ব কর্তব্যের শৃঙ্খল থেকে পুরোপুরি মুক্ত করে দিলেন। জানিয়ে দিলেন তিনি একাই বেশ থাকতে পারবেন এবং আছেনও তাই? একা একা নিজের মতো......শ্যামল, মালতী আর গুরুচরণের তত্ত্বাবধানে দিব্যি আছেন একেবারে।
এহেন মানুষ মণিময়বাবু রোজ সকাল বিকেল গঙ্গার ধারের পার্কে হেঁটে এসে পার্কের বাইরে ফুটপাতের একেবারে ধার ঘেঁষে টেলিফোন বুথের পাশে পাতা বেঞ্চটিতেই দীর্ঘকাল বসে আসছেন, ওখানে বসেই এককাপ লেবু চা, এমনকি কখনো সখনো এক কাপ কফিও খেয়ে বাড়ী চলে যান রোদের তেজ বেড়ে ওঠার আগেই।
এভাবেই মণিময়বাবুর নিস্তরঙ্গ দিনাতিপাত। রোজকার মতোই সেদিনও সকালে পার্ক থেকে এক চক্কর দিয়েই বেরিয়ে পড়লেন, বড্ডই ভ্যাপসা গরম, গঙ্গার ধারেও বাতাসের অভাব যেন, সূর্যদেব এখনো স্বমহিমায় প্রকট হন নি, তাতেই এই অবস্থা।
মণিময়বাবু ঘেমে নেয়ে একসা, এখন খানিকক্ষণ না জিরোলেই নয়। পায়ে পায়ে মণিময়বাবু তাঁর সেই পছন্দের নির্দিষ্ট বেঞ্চটির দিকে এগোতে গিয়ে একদম থতমত খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন একটু যেন জড়সড় হয়ে বেঞ্চের যেদিকটায় মণিময়বাবু রোজ বসেন ঠিক সেইখানটিতে। মণিময়বাবু একটু ইতস্তত করেই গিয়ে অপরপ্রান্তে বসে একবার আড়চোখে ভদ্রমহিলাকে আপাদমস্তক জরিপ করে নিলেন।
মধ্যষাটের ভদ্রমহিলার পরনে সুতির হালকা নীল রঙা শাড়ির আঁচল ঘিরে গাঢাকা। চুলের রূপোলী রেখার সংখ্যা যথেষ্ট বেশী, প্রায় নিরাভরণ দুটি হাতে সরু সোনালী চুড়ি দুগাছি আলাদা করে চোখে পড়ে না, পাকা গমের মতো গায়ের রঙে মিশে আছে। ধোয়া সিঁথিতে প্রমাণ হয় তিনি বৈধব্য বহন করছেন নতুবা অনুঢ়া। সোনালী ফ্রেমের অন্তরালে উদাস চোখদুটি ভদ্রমহিলার বিষণ্ণ অবয়বকে নিরুচ্চার সমর্থনরত..... যেন বলছে, "আমি ভালো নেই!"
মণিময়বাবুর কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো, মনটা ভারী 'চা চা' করছে, কিন্তু পাশে একজন অপরিচিত ভদ্রমহিলার উপস্থিতি মণিময়বাবুকে ভেতরে ভেতরে আড়ষ্ট করে ফেলেছে। এককাপ চা খাওয়ার সাবলীলতা হারিয়ে মণিময়বাবু যখন উঠি উঠি করছেন তখন শুনলেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা যেন বহু পরিচিত এক কন্ঠস্বর, "কটা বাজে?"
সামান্য দুটি শব্দ মণিময়বাবুর বাস্তবিক বাহাত্তুরে হৃদয়টিকে তোলপাড় মথিত করে ফেললো। তাঁর কানে অণুরণিত হচ্ছে লাগাতার দুটি শব্দ....."কটা বাজে?"
মণিময়বাবু শুনেছিলেন এই বিশ্বে প্রত্যেক মানুষেরই নাকি "আইডেন্টিকাল" মানুষ একাধিক থাকে, যাদের দেখলে আপাতভাবে একদম এক দেখতে যমজ মনে হতে পারে...... কিন্তু দেখা যায় তারা হয়তো দুই ভিন্ন প্রদেশ বা ভিন্ন মহাদেশের.... কারুর সাথে কারুর কোনো সম্বন্ধের সম্ভাবনা পর্যন্ত নেই, অথচ মানুষদুটি একে অপরের প্রতিরূপ ....আয়নায়
পরিস্ফুটিত প্রতিবিম্ব যেন। তবে এসবই চোখে দেখার বিষয়ে.....মণিময়বাবু তো হকচকিয়ে গেলেন
কানে শোনার বিষয় নিয়ে...... ভদ্রমহিলার মুখ দিয়ে যেন রুক্মিণী কথা বলছে! এও সম্ভব? এক কন্ঠস্বর!
আঠাশ থেকে আটষট্টি এই চল্লিশটি বসন্ত অতিক্রান্ত যার সাথে, মাত্র চারটি বছরে সেই কন্ঠস্বর ভোলেন কি করে? রুক্মিণীর কন্ঠস্বরের মাদকতাতেই তো বুঁদ ছিলেন মণিময়বাবু পাক্কা চল্লিশটি বছর....... রুক্মিণীর কন্ঠে সাক্ষাৎ সরস্বতীর বসত..........শুধু এইটুকুই বাবা জানিয়েছিলেন মণিময়বাবুকে বিয়ের পাকাকথা বলে, একেবারে দিনক্ষণ ধার্য্য করে।
সত্যিই তাই রুক্মিণী গান গাইলে মণিময়বাবুর পৃথিবী থমকে থাকতো, সম্মোহিত হয়ে থাকতেন মণিময়বাবু। আর গত চার বছর ধরে মণিময়বাবু সব থেকে বেশী "মিস্" করেন রুক্মিণীর কন্ঠ আর কন্ঠের সাতসুরের সেই ঝর্ণাধারাকে। মণিময়বাবু উঠতে পারলেন না, সম্মোহিতের মতো বসে পড়ে কব্জি উল্টে দেখে নিয়ে সময় বললেন, "পৌনে সাতটা।" আর সেইসাথেই তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়লো, "চা খাবেন?" ভদ্রমহিলা ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে উঠে পড়লেন আর ওঠার সময় ওনার মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো বেদনার ছাপ, দেহভঙ্গী আর পা ফেলার ধরণ বলে দিলো হাঁটুর বেদনা ভদ্রমহিলার নিত্যসঙ্গী। মণিময়বাবু নির্বাক দর্শক হয়ে দেখলেন ভদ্রমহিলা ধীরে ধীরে গঙ্গার ধারের রাস্তা থেকে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে রবীন্দ্রভবনের পাশের গলিতে ঢুকে মণিময়বাবুর দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেলেন।
এরপর থেকে প্রতিদিন দুবেলাই মণিময়বাবু উদগ্রীব হয়ে থাকেন একবার...... হ্যাঁ কেবলমাত্র একবার সেই কন্ঠস্বর শোনার জন্য। চারবছরের ক্লান্তিকর বিরহের পরে একঝলক পরিযায়ী বাতাস হয়ে আসা সে কন্ঠস্বরের একটি উচ্চারণে ঝংকৃত হয়ে ওঠেন মণিময়বাবু। আজকাল পার্কে আসা মানুষজনকে যেন স্বজন মনে হয় তাঁর। নিরালায় প্রেমালাপরত
যৌবনের দূতেদের কেমন যেন কপোত-কপোতী মনে হয়। পিএনপিসিতে যোগদান করতে ইচ্ছে হয়, এমনকি কুঁচো কাঁচাদের বলটা সামনে এসে পড়লে অজান্তেই বলে পা ছুঁইয়ে ফেলেন, ক্রিকেট বল দেখলে কব্জি আর আঙুলেরা কারসাজি দেখাতে চায়, বেবাক অবাক অপরিচিত গলদঘর্ম প্রাতঃভ্রমণকারীকেও হাত নেড়ে কুশল বিনিময় করতে ইচ্ছে হয়। মণিময়বাবু ভারী সংশয়ে, তিনি কি পাল্টে যাচ্ছেন? নাকি তাঁর সামনে ছড়ানো পৃথিবীটাই পাল্টে যাচ্ছে? বেজায় ধন্ধ..... নাকি কোনো নিষিদ্ধ গন্ধ?
মণিময়বাবু ভাবলেন, ধুত্তেরি! যাখুশি হোক গে, ভদ্রমহিলার নামটা জিজ্ঞেস তিনি করবেনই। হাঁটা শেষে মণিময়বাবু তাঁর.....না না......তাঁদের বেঞ্চ অভিমুখে। দুর্গাপুজোর আর খুব বেশী দেরী নেই, ভোরের বাতাসে সামান্য হিমেল ছোঁয়া, গাছের পাতারা সব সাফ সুতরো পরপর কদিনের বৃষ্টিতে, শিউলিরা অকৃপণ গন্ধ বিলিয়ে টুপটাপ ঝরে গাছের তলায় ঘাসের ওপর বিছিয়ে গায়ে এক-আধ ফোঁটা শিশির মেখে..... হঠাৎ মণিময়বাবুর পঞ্চেন্দ্রিয় ফুঁড়ে একটা শব্দ মস্তিষ্ক তরঙ্গ ছুঁয়ে বুকের বাঁদিকের লাল প্রকোষ্ঠটায় অবলীলাক্রমে ঢুকে পড়লো, "শবনম্"
......মণিময়বাবু মনে মনে ভদ্রমহিলার নামকরণ করলেন শবনম্........আজ মণিময়বাবু বদ্ধপরিকর শবনমের পোশাকি নাম জানতে।
এতদিন ধরে দেখছেন ভদ্রমহিলা..... উঁহু .... শবনম্ পায়রাদের চাল-গমের দানা এনে ছড়িয়ে খাওয়াচ্ছেন, পার্কের সামনের রাস্তা পেরোলেই উল্টোদিকের ফরাসি সাহেবদের পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ বেহাল বাড়ীটায় বসবাস করা গাদাগুচ্ছের পায়রার ঝাঁক নির্ভয়ে শবনমের হাত থেকে এসে শস্যদানা খেয়ে যায়। তবে ডানদিকের অচল পাখানি নিয়ে একজন বাদে বাকীরা মণিময়বাবুকে দেখলেই লক্ষ হাততালির আওয়াজ তুলে ডানা ঝটপটিয়ে স্থানত্যাগ করে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে। হয়তো মণিময়বাবু তাদের নজরে ভিনগ্রহী বিশ্বাসঘাতক!
ইতিমধ্যেই জেনেছেন ভদ্রমহিলার দুই মেয়েই অন্য গোলার্ধে স্বামী সন্তান নিয়ে ঘোরতর সংসারী, বছর দুই আগে ওনার স্বামী ইহলোক ত্যাগ করেছেন, স্বামীর পেনশন এবং বাড়ীর নীচের তলার ভাড়ার টাকায় সর্বক্ষণের পুরনো পরিচারিকা অনিতাকে নিয়ে তাঁর সংসার বেশ ভালোই চলে যায়। মেয়েদের কাছে কখনোই গিয়ে থাকার ইচ্ছে নেই তাঁর, আর তাছাড়া মেয়েরাও কখনো মাকে নিজেদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখার গরজ মোটেই দেখায় নি। রবীন্দ্রভবনের পাশের গলিতে কয়েক গজ গেলেই বাগানের চৌহদ্দির মধ্যে দোতলা বাড়ী তাঁর স্বামীর পৈতৃক সম্পত্তি। স্বামীর জীবদ্দশাতেই তাঁর বাঁহাটুতে রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি হয়েছে, বর্তমানে ডান হাঁটুও ভোগাচ্ছে। ভদ্রমহিলার বাপের বাড়ী দেওঘরে, তিন পুরুষের প্রবাসী বাঙালি সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে। আপাতত ডাক্তারের পরামর্শে উনি দুবেলা মুক্ত বায়ুতে ধীর পায়চারী করেন। আর হ্যাঁ, ভদ্রমহিলা এককালে মার্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন, সংসারের চাপে সেসব চাপা পড়লেও ভদ্রমহিলার প্রতিটি শব্দের নিক্ষেপ যেন সুরমাধুরীর লহরী তোলে।
আপনমনে মণিময়বাবু তাঁদের সেদিনের কল্পিত কথোপকথন আগাম নাড়াচাড়া করতে করতে এগোতে থাকলেন, ফুটপাত ধরে, দূর থেকেই দেখলেন বেঞ্চটি ফাঁকা, এমনকি পাশাপাশি অন্যান্য বেঞ্চও শুনশান ফাঁকা। খঞ্জ পায়রাটি কেবল বেঞ্চের ব্যাকরেস্টের ওপর ডানা গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছে, আহা, বেচারির হয়তো সকাল থেকে খাওয়া হয়নি। এদিক ওদিক তাকালেন মণিময়বাবু, নাহ্, কোথাও শবনম্ নেই। ভাবলেন কোনো কাজে আটকেছেন হয়তো, কিন্তু না, পরপর পাঁচদিন পার হোলো, শবনম্ আসছেন না। বেচারি পায়রাটা আর মণিময়বাবু রোজই বেঞ্চে অপেক্ষা করছেন। সাতদিনের দিন মণিময়বাবু পকেটে করে একমুঠো চাল এনে পায়রাটির সামনে প্রথমে ধরলেন, ঠিক যেমন শবনম্ ধরেন। পায়রাটি একরকম প্রত্যাখ্যানই করলো, বেঞ্চের কোণে চাল কটা রেখে বাড়ীর পথ ধরলেন মণিময়বাবু। মনে মনে ভাবলেন একবার শবনমের বাড়ীতে গিয়ে খোঁজ নেন, শরীরগতিক কেমন আছে তত্ত্ব তালাশ করেন, যেতেই পারেন, একই শহর শুধু পাড়ায় তফাৎ। তবে শেষ পর্যন্ত কী এক দুর্লঙ্ঘ্য সংকোচে পারলেন না যেতে শবনমের বাড়ীতে কুশল সংগ্রহে। পাছে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরী হয়, পাছে লোকে কিছু বলে, সর্বোপরি যদি শবনম্ কিছু উল্টো সিধে ভেবে বসেন, সেই ভয়েই মণিময়বাবুর উৎসাহে ভাটা পড়লো। পিছিয়ে গেলেন মণিময়বাবু, তবে হাঁটতে যাবার উৎসাহটাও কেমন যেন হারিয়ে গেছে, তবু শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার কারণে একবার বেরোতেই হয় সকালে।
পুজোর আর দিনকয়েক বাকী.... পার্ক থেকে বেরিয়ে হতাশ দৃষ্টি মেলে শূন্য বেঞ্চটাতে অশক্ত খঞ্জ পায়রাটা গুটিশুটি বসে আছে দেখে মণিময়বাবু চোখ ফিরিয়ে বাড়ীর পথে পা বাড়ালেন। দু-চারপা এগোতেই ভ্রাম্যমাণ চাওয়ালাটির সাথে দেখা। তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ছেলেটি। মণিময়বাবু আর শবনম্ রোজই চা বা কফি খেয়ে থাকেন ছেলেটির কাছ থেকে। গত একবছরে রোজ দেখা হয়েছে ছেলেটির সাথে, সেদিন তার মুখ থেকে পরিচিতের হাসিটুকু উধাও। খানিক ইতস্ততঃ করে ছেলেটি বলেই ফেললো, "রাধিকা মাসীমার কাজের লোক অনিতাদির কাছে শুনলাম উনি আর নেই.....মেয়েরা বিদেশ থেকে এসেছিলো পুজো উপলক্ষে........" আর কিছু কানে ঢুকছে না মণিময়বাবুর....... ছেলেটির ঠোঁটের নড়াচড়াটাও এবার ঝাপসা হয়ে উঠলো............ কথাগুলো তো কানে আগেই মাছির ভিনভিনানি হয়েছিলো।
মণিময়বাবু আর হাঁটতে যান নি, দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেন দূরের দিকে দিশাহারা চাউনি চেয়ে। শবনম্........না না রাধিকাও চলে গেলো .....
মণিময়বাবু যে রুক্মিণীকেই অনুভব করতেন রাধিকার কন্ঠস্বরে। মণিময়বাবু মনে মনে যেন দ্বিতীয়বার বিপত্নীক হলেন। আর তাঁকে একলা ফেলে রুক্মিণী আর রাধিকা একই দেশে কেমন বাস করতে চলে গেলেন নিশ্চিন্তে!
মণিময়বাবু ভাবেন, আচ্ছা, খঞ্জ পায়রাটিও কী আজো বসে আছে রাধিকার হাতের শস্যদানা খাবার অপেক্ষায়?