Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debdutta Banerjee

Inspirational

3.6  

Debdutta Banerjee

Inspirational

বানপ্রস্থ

বানপ্রস্থ

7 mins
3.4K


-" হ্যালো, বাবাই, শুনতে পাচ্ছ? কেমন আছো?"

-"ভালোই আছি। বৌমনী কেমন আছে ? আর দাদুভাই?"

-"ওরা ভালো। বলছি এবার তাহলে তোমাদের ভিসার ব্যবস্থা করে টিকিট কেটে পাঠাই। সময় তো হয়েই এলো।"

-"না রে, তোর মায়ের শরীরের যা অবস্থা, এতোটা জার্নি সহ্য হবে না বুঝলি। তারপর তোদের ওখানে মারাত্মক ঠাণ্ডা। আমার হাঁপের টানটা যদি বেড়ে যায়? "

-'বাবাই, সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা বাইরে। তোমরা থাকবে ঘরের ভেতর।গাড়িতে ঘুরবে। ঠাণ্ডা লাগবে কেন? এ সময় তোমাদের দরকার এখানে আসা। রিও কে দেখে রাখতে হবে! তন্নি বেবি নিয়ে ফিরলে ওর একটু রেস্ট দরকার। নতুন বাচ্চাটার মুখ দেখবে না তোমরা ?"

-"দেখবো তো দেবু, যখন তোরা দেশে আসবি তখন। তিনবছর হয়ে গেলো দেশে আসিস নি। এ বার সব ঠিকঠাক মিটে গেলে ঘুরে যাস।"

-"বাবাই, তন্নি খুব চাইছিল তোমরা আসো। রিও র জন্য আসো।" খুব করুন শোনায় অনিকেত বাবুর বড় ছেলে দেবুর গলা। 


ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে ওঠে অনিকেত বাবুর। মুখে বলেন,

-"না রে, শেষ কটা দিন নিজের দেশের মাটিই ভাল। এই বুড়ো বুড়ির শরীরে সেই জোর আর নেই বুঝলি? ভাল থাকিস তোরা, ভালভাবে বৌমনী সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাক।"


পিছনে দাঁড়িয়ে মোহর দেবী ওঁর সহধর্মীনী পুরোটাই শুনতে পাচ্ছিলেন। চোখের কোণটা কেমন জ্বালা করে ওঠে। অনিকেতবাবু ওঁর দিকে একবার তাকিয়ে ছেলেকে বলেন,

-"এই নে, মা এর সাথে কথা বল।" ফোনটা বাড়িয়ে দেন মোহর দেবীর হাতে। 

-"হ্যাঁ দেবু, বল, মা বলছি ...."

-"মা, বাবাইকে বোঝাও। এবার তোমাদের খুব দরকার। রিও কে যদি একটু দেখতে এ সময়, তন্নির একটু সুবিধা হতো। যা দুষ্টু হয়েছে রিও।"

-"না রে, আমাদের আর হবে না যাওয়া। তা রিও বাবু কোথায় ? দে একটু।"

-"এখন তো ও স্কুলে । জানো, ও নিজের বোনের নাম রেখেছে রিয়া। এখানে বেবির ডেলিভারির আগেই নাম জানিয়ে দিতে হয়। ও খুব এক্সাইটেড, রোজ ঘর গুছায় বোনের জন্য।" মোহর দেবীর চোখ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। বলেন,

-"ভাল থাকিস সবাই। তন্নির যত্ন করিস। রিও দাদুভাই আর তোর হবু মেয়ের জন্য অনেক ভালবাসা।"


ফোনটা কেটে অনিকেত বাবুর সামনে এসে বসেন। বলেন,

-"এত করে বলছে ছেলেটা, তোমার ঐ এক জেদ, যাবো না তো যাবো না! কি হতো একটি বার ঘুরে আসল ?"

-" তুমি যেতে চাইলে যাও বেগম। আমি যাবো না।"

-"তুমি ভাল মত জানো তোমায় ছাড়া আমি সগ্গেও যাবো না। যেখানে যাবো একসাথে যাবো। তাই তো তোমার তালে তাল দিতে নিজেদের এতবছরের গোছানো সংসার ফেলে এখানে এসে রয়েছি।" 

-" এখানে খারাপ রয়েছ বলো ? তোমার ভাল লাগে না এখানে ?" একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করেন অনিকেত। 

-"আঃ, তা আবার কখন বললাম। কিন্তু মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ঐ নাতি নাতনি গুলোকে একটু আদর করি!!" একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন উনি।

-"ঐ জন্যই যাবো না। মায়া বাড়াতে নেই বেগম, ওরা কাকের বাসায় কোকিল ছানা। মায়া বাড়ালেই মরেছ।"


আস্তে আস্তে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান । হেমন্তের বাতাসে শীতের আগমন বার্তা। এখনো দু চারটে শিউলি ফোটে পাশের গাছটায়। তার হাল্কা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে।


ওদিকে দেবু ফোনটা রাখতেই ওর আসন্ন প্রসবা স্ত্রী বলে উঠে,

-" আসবে না তো? আমি জানতাম। এই বয়সে ওনাদের কিসের এতো তেজ, এতো অহংকার আমি বুঝি না। আগের বার আমার মা এসেছিলো বলে ওঁদের আনা হয়নি। এ বার আমার মা বোনের বাচ্চাদের দেখছে বলেই না ওঁদের ডাকছি!! ওঁরা কি সব রাস্তার অনাথদের নিয়ে চ‍্যারেটি করছেন।"


দেবু চুপ করে থাকে। তন্নির উপর কথা বলার অভ্যাস নেই ওর। আর বাবাই কেও চেনে। একবার না বলেছে মানে আসবে না। জানালা দিয়ে দূরের গাছটার দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে সে।


অনিকেত বাবু ওঁর চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনের সাথী মোহর দেবীর মনের উচাটনটা টের পান। কিন্তু আর মায়ায় জড়াতে চান না। যেদিন ছেলে কানাডায় উড়ে গেছিল সেদিন তিনি বুঝেছিলেন আগামী দিনগুলোর জন্য নিজেদের শক্ত হাতে তৈরি করতে হবে। মনকে শক্ত করতে হবে। তার পাঁচ বছর পর মেয়েও যখন বিয়ে করে বিদেশে চলে গেছিল সেই দিন নিজের 'বেগম' কে বুঝিয়েছিলেন শক্ত হতে। বন্ধু মতি বাবু আর বাদলদার সঙ্গে আলোচনা করে সোনার পুরের পৈতৃক বাড়িটার সংস্কার করিয়েছিলেন। একে একে তারক বাবু এবং পাঠক-দাও খবর পেয়ে এসেছিলেন। সবাই মিলে একটা ট্রাষ্ট করেছিলেন প্রথমে। পাঠক-দার ডিভোর্সি মেয়েটাই উদ্যোগ নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করে এনজিও টার ফর্ম করেছিলো। কয়েকজন অল্প বয়স্ক দায়িত্ববান ছেলে মেয়েকে মাসিক মায়নায় রাখা হয়েছিল দেখাশোনার জন‍্য‍। বাকি হিসাব পত্র নিজেরাও দেখতেন । যে যার সাধ্য মতো কাজ করতেন। আসলে কাজের মধ্যে থাকলে সময় কেটে যায়। আর অসুখ পালিয়ে যায় এটা ওনারা মানতেন। কয়েকটা অনাথ বাচ্চা নিয়ে যে কাজ ওনারা শুরু করেছিলেন তা আজ তিন বছরে দেখতে দেখতে তিরিশটা শিশুর আশ্রয়। এছাড়া ওনাদের মতো বেশ কিছু বৃদ্ধ বৃদ্ধাকেও শুধু আশ্রয় নয় এক সুন্দর পরিবেশ দিতে পেরেছেন এই সুখের নীড়। 


প্রথম যেদিন তিন বছর আগে ছেলে শেষবার ঘুরে যাওয়ার পর অনিকেত বাবু মোহর দেবীকে বলেছিলেন গড়িয়ার বিলাস বহুল ফ্ল্যাট ছেড়ে এখানে আসার কথা মোহর দেবী অবাক হয়েছিলেন। মেয়ের বিয়ের পর ঐ ফ্ল্যাটে আর ভাল লাগতো না একথা সত্যি, তবু ঐ একাকীত্বকেই মানিয়ে নিচ্ছিলেন ধীরে ধীরে, সুগার, প্রেশার, কোলষ্ট্রয়েলের সাথে হার্টের অসুখটা ছিল ফ্রি । রোজ ওদের ফোনের আশায় বসে থাকা, আর ঐ টিভির বস্তাপচা সিরিয়াল ভাল না লাগলেও দেখে দেখে যখন স্বভাবটা কেমন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল তখন খেয়াল করতেন কয়েকটা বুড়ো মিলে প্রবল উৎসাহে কিছু একটা করছেন সোনারপুরে। তাই বলে সেখানে এসে একত্রে বসবাস, এ আবার কেমন আব্দার!!!

অনিকেত বাবু বলেছিলেন,

-"গিয়ে দেখোই না, ভালো না লাগলে ফিরে এসো। সর্বক্ষণের কাজের লোক রবি তো রইলই ফ্ল্যাট পাহারায়।"


মতি বাবুর স্ত্রী, তারকদার স্ত্রী সবাই গিয়েছিল একে একে। সোনারপুরের পৈত্রিক বাড়িটা কুড়ি কাঠার উপর বড় পুকুর আর বাগান নিয়ে। অনিকেত বাবুর মনে হয়েছিল সারা জীবন যাদের মানুষ করবেন বলে এই বাড়ি ছেড়ে শহরে গিয়ে থাকলেন তারাই যখন বিদেশে উড়ে গেল এই গ্ৰামের বাড়িতেই শেষ কটা দিন থাকা যেতেই পারে। 

সবাই বৃদ্ধাশ্রম শুনলে আঁতকে ওঠে, কিন্তু ছেলেমেয়ে দূরে চলে গেলে ওটাই বোধহয় নিরাপদ আশ্রয়।


এখন আর মোহর দেবীর একা লাগে না। নাতি নাতনীর কথাও মনে পরে না। অনাথ আশ্রমের বাচ্চা গুলো মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে সকলকে। তারকদার স্ত্রী মিতাদি সারা জীবন শিক্ষকতা করে অবসরের পর যখন নাতনী কে পড়াতে বসতেন বৌ মনে করিয়ে দিত নাতনি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। তাকে পড়ানোর যোগ্যতা ঐ সরকারী বাংলা স্কুলের দিদিমণির নেই। মতি-বাবুর স্ত্রী ইলা দি ভাল গান গাইতেন। কিন্তু নাতিকে ও সব প্যানপ্যানে গান শেখাতে বারণ করেছিল ছেলে। এক বাড়িতে থেকেও ছেলে বৌ নাতি ওনাদের থেকে সহস্র যোজন দূরে থাকতো যেন।


এভাবেই একে একে আরও অনেকেই এসেছিলেন সুখের নীড়ে শান্তির সন্ধানে। অনিকেত বাবু সবাইকেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। অনেকের অনেক অসুখ পালিয়ে গিয়েছিল এখানে এসে। এই খোলা মেলা সবুজের মাঝে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে, সবার সাথে হেসে খেলে আনন্দ করে মনের অসুখ গুলো আগেই ভাল হয়ে গেছিল। তাছাড়া এখানে হাটাহাটি, যোগা, বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা, বাগান পরিচর্যা, পুকুরে মাছ চাষ, সন্ধ্যায় গান, গল্প বিনোদনের প্রচুর উপকরণ ছিল।অবসরে লাইব্রেরি ঘরে বই পড়ে, এক সাথে বসে ক্রিকেট ফুটবল দেখে আনন্দে দিন কাটতো সবার। 


এখানে এসে মোহর-দেবী আর ফেরার কথা ভাবেন নি। ছেলের ঘরে নাতনী এসেছিল তন্নির কোল জুড়ে, খবর পেয়ে সেই খুশি এখানে সবার সাথেই ভাগ করে নিয়েছিলেন।মাঝে একবার মেয়ে এসেছিল বলে কয়েকদিনের জন‍্য ফ্ল্যাটে গিয়ে কেমন পাগল পাগল লেগেছিল।

অনিকেত বাবু সবাইকেই বোঝাতেন এর নাম বাণপ্রস্থ। একে একে সবাই একদিন ঐ উপরে চলে যাবে। এখানে কেউ একা হবে না কখনো। সবাই সবার মাঝে সুখ দুঃখ ভাগ করে নিয়ে শেষ দিন গুলো কাটাবে। নিজের অত বড় সম্পত্তি ট্রাষ্টের নামে করে দিয়েছিলেন। সকলেই ট্রাষ্টকে সাধ্য মত সাহায্য করতো। বারিণ দা লন্ডনে গিয়েছিলেন ছেলে বৌ এর সাথে থাকবেন বলছ। ছ মাস পর পালিয়ে এসেছিলেন এক প্রকার। ছেলে আর বৌ অফিসে চলে গেলে এই বয়সে ওনাকে বাড়ির অর্ধেক কাজ করতে হত। ব‍্যস্ত জীবনে বৌমা রান্নাটুকু কোনরকমে করে চলে যেত। বাকি কাজ করতে করতে একা হাঁফিয়ে উঠতেন উনি। কথা বলার একটা লোক পেতেন না। সুখের নীড়ে এসে শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন শেষে। 

অনাথ ছেলে মেয়ে গুলো হেসে খেলে গান গেয়ে সবাইকে নিয়ে বড় হয়ে উঠছিল। ওদের মাঝেই সময় কেটে যেত বুড়ো বুড়ি গুলোর।আত্মার আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল সবার সাথে। এই বৃদ্ধাশ্রম তখন বাড়ির থেকেও বেশি আপনার মনে হতো।


প্রকৃতির নিয়ম মেনে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অনিকেত বাবু একদিন ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন। কিন্তু ওনার চল্লিশ বছরের ঘরণী 'বেগম' ভেঙ্গে পড়েন নি। দীর্ঘদিন ধরে মোহর-দেবীর মনকে অনিকেত বাবু এজন্য শক্ত করেছিলেন নিজে হাতে। যে কোনো একজন যে আগে যাবে সেটা উনি বুঝতে পেরে মেনে নিয়েছিলেন।

ছেলে মেয়ে ছুটে এসেছিল । সব কাজ মিটে যাওয়ার পর ছেলে মাকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু উনি বলেছিলেন,

-"আমাকে তোদের 'বাবাই' যেখানে রেখে গেছেন, উনি আমার অণুপ্রেরনা আর এই আমার স্বর্গ, এখান থেকে আবার উনি এসেই আমায় নিয়ে যাবেন ঐ ওপরে। হয়তো এখন আমার জন‍্য ওখানে সব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছেন। ঠিক যেমন এই জায়গাটা সাজিয়ে নিয়ে তারপর আমায় এনেছিলেন একদিন।" 


সন্ধ্যার প্রার্থনা সঙ্গীতের জন‍্য একে একে সবাই গিয়ে জড়ো হচ্ছিল মুক্ত উপাসনালয়ে। একটা একটা করে আলো জ্বলে উঠছে চারদিকে। আস্তে আস্তে সেদিকে এগিয়ে গেলেন মোহর দেবী। ছেলের মনে হল মায়ের অবয়বের পাশে যেন আরেকটা হাল্কা ছায়া ভেসে চলেছে। মা একা নেই।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational