বন্ধু
বন্ধু
গল্প - বন্ধু
কলমে - সায়নদীপা পলমল
হুইসেলটা কানে লাগতেই ক্যানাল পাড়ে ছুটলো আলতাফ। ন’টা দশের লোকালটাকে দেখার মধ্যে এক অদ্ভুত সুখ অনুভব করে সে। ভাবে কোনো একদিন মাকে নিয়ে সেও ট্রেনে চেপে চলে যাবে অনেকদূর, যেখানে থাকবেনা পেটের জ্বালা, থাকবেনা এমন কষ্ট। রোজ খিচুড়ি ইস্কুলে গেলেও ছুটির দিনগুলোতে আলতাফ আর রঘু মিলে বাবুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ড্রেন, বাগান এসব পরিষ্কার করে দেয়; বিনিময়ে এক ঠোঙা করে মুড়ি আর কুড়ি টাকা পায়। কিন্তু মায়ের শরীরটা ক’দিন ভালো যাচ্ছেনা, কাজে যেতে পারেনি। আলতাফেরও তাই ইস্কুল যাওয়া হয়নি ক’দিন। মা অবশ্য জোরাজুরি করছিল স্কুলে যাওয়ার জন্য কিন্তু আলতাফই মাকে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি ইস্কুলে। আজকে তাই আলতাফ ঠিক করেছে বাবুদের বাড়ি যাবে কাজের সন্ধানে, সেখানে টাকা পেলে মাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনবে।
কাঁধের কাছে অচেনা স্পর্শ এসে লাগতেই ছোট্ট মনের পরিকল্পনাগুলো আচমকাই বাধা পায়। পেছন ফিরে আলতাফ দেখে একটা লোক দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে তার দিকে চেয়ে। লোকটা পুরোপুরি অচেনা নয়, বড্ড চেনা চেনা লাগছে তাকে কিন্তু কিছুতেই আলতাফের মনে পড়েনা কোথায় দেখেছে।
“কিরে খিদে পেয়েছে?” লোকটার প্রশ্নে চমকে ওঠে আলতাফ, টের পায় সত্যিই তার পেটে ছুঁচোর দৌরাত্ম শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। সকাল থেকে খাবার জোটেনি আজ। মাথাটা ওপর নিচে নেড়ে লোকটার কথায় সম্মতি জানাল সে। লোকটা আবার নরম গলায় বলে, “শুনলাম তোর মা নাকি অসুস্থ।” এই বলে লোকটা একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। চমকে ওঠে আলতাফ; মা তাকে শিখিয়েছেন শুধু শুধু কারুর থেকে টাকা নিতে নেই। সে তড়িঘড়ি বলে, “না না আমার টাকা চাইনা।”
লোকটা প্রত্যুত্তরে বলে, “এমনি দিচ্ছি না রে, বিকেলের দিকে একটা কাজ করে দিতে হবে আমার। করবি তো?”
এতো মেঘ না চাইতেই জল। এতক্ষণে মনটা বেশ ভালো লাগে আলতাফের। সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়ব, “হ্যাঁ নিচ্চই। কি কাজ গো।”
লোকটা এরপর ঝুঁকে পড়ে ওর কাঁধের কাছে তারপর কানে কানে বলে কয়েকটা কথা।
সব শুনে অবাক হয়ে লোকটার তাকিয়ে থাকে আলতাফ, লোকটা ওর চুল ঘেঁটে দিয়ে বলে, “যা, এখন মাকে ডাক্তার দেখিয়ে আন।”
★★★★★
দিনটা শেষের মুখে, নীলাভ আকাশ তার রং হারাচ্ছে ক্রমশ। প্যান্টের দড়িটা বাঁধতে বাঁধতে আলতাফ ভাবে শুধু মন্দিরের পেছনে হিসু করার জন্য পার্টির বাবুটা তাকে একশো টাকা দিলো! সাত বছরের ছোটো মাথাটা এর কোনো কারণ ভাবতে পারার আগেই লাঠি নিয়ে রে রে করে তেড়ে আসে কিছু লোক। প্যান্টের দড়িটা আর বাঁধা হয়না, উল্টে পড়ে আলতাফ, মাথার ফেটে চলকে পড়ে রক্ত। সব কিছু অন্ধকার হওয়ার আগে সে শুধু দেখে তারই মতন দুটো কচি হাত এসে জড়িয়ে ধরছে তাকে। রঘু…
রতন পালের উন্মাদের মত চালানো লাঠির বাড়িটা গিয়ে পড়ে দ্বিতীয় শরীরটার ওপরেও… তারপরেই আচমকা দ্বিতীয় শরীরটার পরিচয় আবিষ্কার করে স্তব্ধ হয়ে যায় রতন পাল। তার সঙ্গীদের আগ্রাসী আঘাতের হাত থেকে নিজের আত্মজকে রক্ষা করতে রতন পাল নিজের শরীরটাকে পেতে দেয় ছেলে দুটোর ওপর; আর তখনই শুনতে পায় রক্তে ভেজা শরীর দুটো ক্ষীণ স্বরে একটাই কথা আওড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, “বন্ধু… বন্ধু…।”