Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debdutta Banerjee

Inspirational

3  

Debdutta Banerjee

Inspirational

অতন্দ্র প্রহরী

অতন্দ্র প্রহরী

11 mins
813


-'' সব পাহাড়েই আর্মিরা এমন একটা গল্প তৈরি করে। ওটা একটা মিথ। '' জ‍্যাকেটের চেনটা গলা অবধি তুলে দিতে দিতে জিয়া বলে।

-''এমন বলিস না। সরকার অবধি ওনার অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে। মায়না দেয়, প্রমোশন হয় বছর বছর।ট্রেনের সিট রিজার্ভ করে সসম্মানে বাড়ি পাঠানো হয় ওনার বুটকে। '' রিভান বলে।

-''শোন, একজনের মায়না আর সারা বছর এসব টুকটাক সুবিধা দেওয়ার বদলে যদি এই দুর্গম প্রান্তরে পাহারারত হাজার জওয়ানের মনে একটা বিশ্বাস কে জিইয়ে রাখা যায় ক্ষতি কি? এটা করা হয় বাকি জওয়ানদের কথা ভেবে। '' জিয়া কিছুতেই মানবে না।

-''আচ্ছা বাবা, তোকে কেউ মানতে বলে নি। যারা বিশ্বাস করে করতে দে না। আমরা না হয় ঘুরতেই যাচ্ছি। '' অর্চি ওদের চুপ করানোর জন‍্য বলে ওঠে।

-''প্রনয়ের সামনে আবার এ সব কথা বলিস না। ও কিন্তু বাবা বলতে অজ্ঞান। '' হিন্দল বলে ওঠে।

শ্রীদত্তা আপন মনে পাহাড় আর বরফ দেখতে ব‍্যস্ত। প্রচুর তুষার পাত হয়েছে এ বছর। ছাঙ্গু লেক জমে বরফ হয়ে গেছে। রাস্তায় পুরু বরফ। সকালে ওদের গাড়িটা যখন ছাঙ্গু পৌঁছালো চাকায় চেন জড়াতে হয়েছিল। না হলে স্কিট করছিল। আপাতত ওরা নাথুলা দেখে শেরথাং হয়ে চলেছে বাবা হরভজন সিং মন্দির দেখতে। 

হঠাৎ শ্রীদত্তা বলে -''তোরা এসব বাদ দিয়ে বাইরের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখ। বরফ গলে পড়তে পড়তে আবার বরফ হয়ে গেছে দেখ। ঝরণা গুলো সব ক্রিস্টালের মত। ''

অস্মিত ফটো তুলতেই ব‍্যস্ত। ফ্রন্ট সিটে বসে কখনো মুভি কখনো স্টিল ক‍্যামেরায় ও ধরে রাখছে হিমালয়ের এই স্মৃতি। 

পাভেল হঠাৎ বলল -''ঐ দেখ দূরে, চাইনিজ বাঙ্কার, আমাদের ওরা দেখতে পাচ্ছে। ''

-''হ‍্যা, পাহাড়ের গায়ে লেখাও রয়েছে যে আপনি ওদের নজরে রয়েছেন। খেয়াল কর। '' শ্রীদত্তা বলে। 

জিয়া, রিভান, অর্চি, অস্মিত, পাভেল আর শ্রীদত্তা একসাথে শিলিগুড়ি এসআইটিতে পড়ে। খ্রীসমাসের ছুটিতে হঠাৎ করেই ওরা এসেছে সিকিম ঘু্রতে। প্রনয় ছেত্রী ওদের বন্ধু , তিন বছর আগে হঠাৎ আর্মি জয়েন করেছিল। ব‍্যঙ্গডুবিতে ছিল যখন মাঝে মধ‍্যেই দেখা হত। গত বছর প্রনয় ছিল আসামে, এ বছর আবার সিকিম গোর্খা রেজিমেন্টের সাথে ও এসেছে এই অঞ্চলে। গত সপ্তাহে শিলিগুড়ি গেছিল প্রনয়। তখনি এক ঘরোয়া আড্ডায় ও বলেছিল এ সপ্তাহ থেকে ওর ডিউটি বাবামন্দিরে। বাবার সেবা করা ওদের সৈনিকদের ভেতর একটা বড় সম্মানের কাজ। চাকরি জীবনে এই কাজ সবাইকে একবার করতে হয়। তখনি প্ল্যান করেছিল ওরা এবার এখানে ঘুরতে আসবে। 


প্রনয় ওদের প্রথমেই কফি খাওয়ালো, বাইরের টেম্পারেচার -২, ভেতর পর্যন্ত কাঁপন ধরে যাচ্ছিল। তারপর ওদের ঘুরিয়ে দেখালো বাবার বাঙ্কার। সিঁঁড়ি ভেঙ্গে উঠে বাবার ঘর, বাবার ব‍্যবহৃত জুতা, ডাইরি। ওদের বিশ্বাস বাবা এখন সিমান্তে অতন্দ্র প্রহরী। বাবাকে ভয় পায় লাল মুখো চীনা সৈন‍্য। এখনো কোনো সৈনিক বর্ডারে যদি কর্তব‍্যে গাফিলতি করে বাবা হরভজন সিং এর থাপ্পর তার প্রাপ‍্য। এমন অনেক ছোটছোট ঘটনার সাক্ষী বর্ডারের সেনারা। 

বাবার প্রসাদ খেতে খেতে জিয়া বলে -''বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে এই ২০১৯ এর দরজায় দাঁড়িয়ে তুই এসব বলছিস !!''

-''এখানে সবাই বলে। সবাই বিশ্বাস করে। '' প্রনয় বলে।

-''আমি অরুনাচলের তাওয়াং যাওয়ার পথে যশবন্তগড়ে এমন গল্প শুনেছি। যশবন্ত সিং বলে এক সৈনিক একা প্রায় ৭২ ঘন্টা চীনের সৈন‍্যদের আটকে রেখেছিল। তিনটে বাঙ্কার থেকে একাই লড়াই চালিয়েছিল। তাকেও এখনো ওখানে ডিউটিরত দেখা যায়। স্বপ্নে এসে সে বিপদের কথা জানায়। চীনা সৈন‍্যরা মেনে নিয়েছে ওনার উপস্থিতি। ওনাকেও সরকার মায়না দেয়, প্রমোশন হয় বছর বছর। পুরস্কার পায়। এসব গল্প বর্ডারের সৈনিকদের অনুপ্রাণিত করে। '' জিয়া বেশ বিজ্ঞের মত বলে।

-''এয়সা মত বলে ম‍্যাডাম জি, বাবা হ‍্যয়, হাম সবকা উপর উনকা কৃপা হ‍্যায়। '' এক জওয়ান যে ওদের কথা শুনছিল এতক্ষন জিয়া খেয়াল করে নি। 

বাইরে ঝড়ো হাওয়া আর হাল্কা তুষার পাত শুরু হতেই টুরিষ্টরা মেতে উঠেছে আনন্দে। 

প্রনয় ভ্রু কুঁচকে বলে -''আবহাওয়া খারাপ হবে মন বলছে। তোরা নেমে যা এবার‌।''

-''আমরা নতুন বাবা মন্দির যাচ্ছি এখন। '' অস্মিত বলে।

ড্রাইভারটা একটু দোনামনা করছিল, আকাশের অবস্থা ভালো না। ওরাও মানবে না। মাত্র কয়েক মাইলের ব‍্যপার। রিভান আর অর্চি ওকে মানিয়ে নেয় ।

অবশেষে ওরা পৌঁছে গেল নতুন বাবা মন্দিরে। জিয়া আবার বলতে শুরু করেছে -''আর্মিতেও ব‍্যবসা শুরু হয়েছে। ওটা বেশি উঁচু বলে বাবাকে নামিয়ে এনেছে একটু নিচে। ''

-''তা না, ঐ আসল বাঙ্কারটা চিনা সীমানায়। এত টুরিষ্ট ওখানে প্রতিদিন যায়। তাদের নিরাপত্তার জন‍্য এটা করা হয়েছে। '' পাভেল বলে।

-''দেখ, এখানে আর্মি থেকে দোকান বানিয়েছে, কত কি সেল হচ্ছে। ঐ দূরে হরপার্বতির মুর্তি , সুন্দর ঝরণার নিচে প্রকৃতির কোলে ... সব টুরিষ্টদের জন‍্য। পর্যটন ব‍্যবসা বুঝলি। '' জিয়া কোন যুক্তি মানবে না।

-''চল নিচে নেমে ঐ মুর্তির কাছে যাই। '' অর্চি বলে।

-''অনেকটা দূর কিন্তু। বাতাসে অক্সিজেন কম, তার মধ‍্যে ওয়েদার ভালো না। যাবি ?'' শ্রীদত্তা বলে। 

-''ঘুরতেই তো এসেছি। চল চল। '' অস্মিত বলে। রিভান ও সায় দেয়।

-''আমার হাল্কা শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। অত হাঁঁটবো না। তোরা যা। আমি ঐ মিলিটারিদের স্টলটায় থাকছি। '' শ্রীদত্তা বলে। 

-''আমিও থাকছি শ্রী এর সাথে। '' পাভেল বলে। 

-''ওকে, আমরা ঘুরে আসছি। '' জিয়া অস্মিত রিভান আর অর্চি নেমে যায় উতরাই পথে। বেশ দূরে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এসেছে ঝরণা, আর তার মাঝে বসে রয়েছে সুবিশাল হরপার্বতি। শ্রীদত্তা ওর মোবাইলে ফটো তুলতে থাকে জুম করে। 

পাভেল কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখছিল একটা পাতলা সরের মত কুয়াশার চাদর ঢেকে ফেলছে গোটা উপত‍্যকা। শ্রীদত্তা কেনা কাটায় ব‍্যস্ত। 

অর্চি ফিরে এসেছে হাঁফাতে হাঁঁফাতে। একটা কফি নিয়ে চুমুক দিয়ে বেঞ্চে বসে পড়ে ও। বলে -''দেখে যতটা ইজি মনে হচ্ছে ওটা ততটা কাছে নয়। আমি অর্ধেক হেঁটে ফিরে এলাম। বুকে চাপ পড়ছিল খুব। নামার সময় লোকে টের পায় না। উঠতে জীবন বেরিয়ে যাবে। ''

-''আমি তো তাই গেলাম না। তিন বছর আগে একবার এসেছিলাম বাবা মা কে নিয়ে। সে বার গেছিলাম। খুব কষ্ট হয়েছিল। '' শ্রীদত্তা বলে।

সদ‍্য শেষ করা কফির কাপটা ফেলে উঠে দাঁড়ায় পাভেল। বলে -''ওয়েদার খারাপ হচ্ছে। এই দেখ আবার বরফ পড়ছে। ওরা যে কখন ফিরবে ? ''

হঠাৎ রিভান ফিরে আসে। বলে -''ওয়েদার খারাপ হচ্ছে, তুষার পাত শুরু হয়েছে । ওরা আসছে। চল বেরিয়ে যাই। ''

একটা একটা করে সব গাড়ি বেরিয়ে গেলো। মিলিটারিরা এসে ওদের তাড়া দেয়। ছাঙ্গুর রাস্তায় প্রবল তুষার পাত শুরু হয়ে গেছে। যে কোনো সময় রাস্তা বন্ধ হবে। 

অর্চি আর পাভেল চিন্তিত হয়ে বাইরে তাকায়। এক হাত দূরের কিছু আর ঠাহর হয় না। ঘন ফগ এসে গেছে। চিনির দানার মত মিহি তুষারের চাদর ঢেকে ফেলছে অঞ্চলটাকে। দোকান মন্দির সব বন্ধ হল একে একে। ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে। আর একটাও গাড়ি নেই। ড্রাইভার বলছে এপথে একা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া বিপদ। কিন্তু জিয়া আর অস্মিতের দেখা নেই কোথাও। মোবাইলের টাওয়ার নেই। হঠাৎ কুয়াশার বুক চিড়ে একটা কমলা জ‍্যাকেট এগিয়ে আসে, অস্মিত ফিরেছে। কিন্তু জিয়া ? 

-''ও তো আমার আগেই ফেরার পথ ধরেছিল। আমি ঝরণার নিচ অবধি গেছিলাম। কিন্তু ওয়েদার এত খারাপ যে ফটো আসে নি। '' অস্মিত বসে পড়ে বেঞ্চে। 

-''ভাই লোগ,ওউর দের করণে সে গাড়ি স্টার্ট নেহি লেগা। -৬ হো গেয়া ভাইলোগ। আব তো চলো। তেল জম জায়গা তো রাত ভর পড়ে রহনা ইধর। '' ড্রাইভার বলে ওঠে।

-''আরে আমাদের একটা মেয়ে ফেরেনি। ঐ ঝরণায় গেছিল। ওকে ফেলে কি করে যাই?'' শ্রীদত্তা বলে ওঠে।

-''ঘড়ি দেখো ম‍্যাডাম জি। আভি নেহি নিকলোগে তো অন্ধেরা ছা যায়েগা। ইস পাহাড়িমে অন্দেরা কা মতলব জানতে ভি হো!! '' ড্রাইভারটা একটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। 

অর্চি পাভেল আর অস্মিত অসহায়ের মত একে অন‍্যের দিকে তাকায়। রিভান চলে গেছে জিয়ার খোঁজে। পাভেল একটা মিলিটারির অফিসারকে সবটা খুলে বলে সাহায‍্য চায়। সাথে সাথে চারজনকে পাঠনো হয় জিয়ার খোঁজে, পাভেল আর অস্মিত সাথে যায়। 

কিন্তু এক ঘন্টা পর সবাই ফিরে আসে, জিয়া নেই কোথাও। প্রবল তুষার পাত শুরু হয়ে গেছে বাইরে। ওরা পাঁচজন ঠকঠক করে কাঁপছে। মরে এসেছে দিনের আলো। একজন মেজর এসে বলে নিচে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। ছাঙ্গু এব‌ং নাথুলায় আটকে পড়েছে বহু টুরিষ্ট। বহু গাড়ি ফেঁসে রয়েছে মাঝ পথে। ওদের ফিরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ। 

শ্রী এর শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছিল আগেই। এবার অর্চির ও বুকে চাপ ধরছিল। মাথা ছিড়ে যাচ্ছে পাভেলের। রিভানের সর্দি আগেই ছিল। মনেয়হয় জ্বর এসেছে। কাঁপছিল ঠকঠক করে। যে ছোট্ট মন্দিরটার বারান্দায় ওরা বসে ছিল তির চারদিকে পুরু বরফের আস্তর। বুট ছাড়া হাঁটা যাবে না। 

মেজর ওদের বলে -''চার কিলোমিটার কি দূরি পর কুপুপ ক‍্যাম্প হ‍্যায়। টুরিষ্ট কে লিয়ে ইধার রাত কো রুকনা মানা হ‍্যায়। আপলোগ উধার চলো। বাকি সুবহ দেখেঙ্গে। ''

-''আমরা জিয়াকে ফেলে এ ভাবে চলে যেতে পারি না। ও হয়তো কুয়াশায় পথ হারিয়ে ফেলেছে। '' রিভান বলে।

-''ইয়ে বর্ডার হ‍্যায়। কুছ রুল মাননা পড়তা হ‍্যায় ভাই। রাতমে ইধার মাইনাস পন্দরা ষোলা হো যায়গা। জম যাওগে। আব চলো।''

ওরা সবাই অসহায়ের মত তাকায়। অস্মিত বলে -''আমি বলেছিলাম দু মিনিট দাঁড়া। একসাথে ফিরি। ও বলল পারবে আসতে। '' কেঁদে ফেলে ও। 

ওদিকে হাওয়ার কামড় বাড়ছে। চোখ মুখ কেঁটে যাচ্ছে।শ্রী শুয়ে পড়েছে বারান্দায়। দু জন জওয়ান ওদের তাড়াতাড়ি একটা বড় মিলিটারি ভ‍্যানে উঠতে বলে। এখানে থাকলে সবাই মারা পড়বে। 

ঝুর ঝুর করে বরফ পড়ছে। পথ সাদা বরফে ঢাকা। ওদের গাড়িতে উঠতে বলে মেজর রানাবত। 

পাভেল বলে -''আর একটু দেখি। ওরা যাক, আমি ওয়েট করবো। ''

-'' তুমলোগ সমঝতে কিউ নেহি। ইধার রহনা এলাউ নেহি হ‍্যায়। চাইনিজ বাঙ্কার দিখা নেহি ক‍্যায়া। ঠান্ডা সমঝমে নেহি আতা? আব চলো। ''

প্রায় জোর করেই ওদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। ওদের গাড়ি রেখে ড্রাইভার ও চলেছে ওদের সাথে। 

ক‍্যাম্পে পৌঁছে দেখে শুধুই ওরা নয়। আরো কয়েকটি টুরিষ্ট পরিবার আটকে পড়েছে প্রবল তুষার পাতে। জওয়ান রা চা কফি গরমজন ম‍্যাগি খাইয়ে সবাইকে চাঙ্গা করতে চাইছে। রিভানের মনে পড়ে জিয়া এদের কফি বিক্রিকে ব‍্যবসা বলেছিল। ওদের জন‍্য কম্বল ও ফায়ার প্লেসের ব‍্যবস্থা করে সেনারা। শ্রীকে অক্সিজেন দিতে হবে বলে পাশেই মেডিক‍্যিল ইউনিটে নেওয়া হলো। প্রত‍্যেককে ওষুধ দিয়েছিল ডাক্তার বাবু। 

ওরা চারজন পাথর হয়ে গেছে, জিয়া একটু বেশি যুক্তিবাদি ছিল বটে। তবে মনটা খুব ভালো ছিল। লোকের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেই মেয়েটা এভাবে ঘুরতে এসে হারিয়ে যাবে ওরা ভাবে নি। 

-''এই ঠান্ডায় বাইরে থাকলে ও জমে বরফ হয়ে যাবে। '' পাভেল বলে।

-''ওর সাথে জল বা খাবার নেই। জল তেষ্টা পেয়েছিল বলছিল তখনি। '' অস্মিতের চোখের জল বের হলেও শুকিয়ে বরফ হয়ে যাচ্ছে ঠান্ডায়। সাদাটে দাগ দু গালে। 

রিভানের জর এসেছিল। মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। বাকি সব টুরিষ্টরা অসুস্থ। 

সেনারা দৌড়াদৌড়ি করে ওদের সাহায‍্য করছে। রাতের খাবার গরম জ‍্যাকেট কম্বল, শিশুদের দুধ ওষুধ সব দিয়ে সাহায‍্য করছে। ছোট ক‍্যাম্প হলেও ওরায়সাধ‍্যের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। 

ওদের পাশের এক ভদ্রলোক হঠাৎ হাত জোড় করে বলেন -''সবাই বাবা হরভজন কে ডাকুন, উনিই পারবেন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। এদের দেখুন, এই বিশ্বাস নিয়েই ওরা এই ঠান্ডায় বেঁচে থাকে। ''

-''বিপদে পড়লে সব বিশ্বাস অবিশ্বাস মিশে যায় । এখন আর কি লাভ এসব কথায়। '' রিভান পাশ ফিরে শোয়।

-''রাত টুকু না হয় এই বিশ্বাস নিয়েই কাটাই। উনি ঠিক বলেছেন। '' অস্মিত বলে।

-''ভাই আমার আট বছরের মেয়ে কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বরফের মাঝে খেলতে খেলতে পা পিছলে নিচে পড়ে গেছিল আজ বিকেলে। আট জনের গ্ৰুপ আমাদের। কুয়াশার চাদর আর হাল্কা তুষার পাতে চারপাশ ঢেকে গেছে ততক্ষণে। আমরা পাগলের মত খুঁজছিলাম। হঠাৎ দেখি মেয়ে গাড়ির সামনে বসে রয়েছে। মেয়ে বলল এক পাগড়ী পরা মিলিটারি ওকে তুলে এনেছে। গাড়িতে রেখে গেছে। ড্রাইভার ও বলল এক শিখ মিলিটারি ওকে গাড়িতে রেখে গেছে। তবে কুয়াশায় ড্রাইভার মুখ দেখেনি তার। ''

-''এখানে প্রচুর শিখ মিলিটারি দাদা, তাদের কেউ হয়তো ...''

-''এক মিনিট, তাদের কেউ একটা বাচ্চাকে পেলে গাড়িটা চিনবে কি করে ? সব গাড়ি এক রকম। আমরাই চিনতে হিমসিম খাচ্ছি। নম্বর দেখে চিনছি। আর আমার মেয়ে গাড়ি চিনত না। '' মেয়েটা ঘুমোচ্ছে পাশেই। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভদ্রলোক বলেন -''আমরা বাবাকে ডেকেছিলাম। বাবা ফিরিয়ে দিয়েছে পিকাই কে। বাবার অশেষ কৃপা। ''


সারাটা রাত বরফ পড়েছে, ভোরের সূর্যের আলোয় চারপাশের দুধ সাদা বরফ ঝলসে উঠছে। পাশেই বরফ সরিয়ে মাটি বের করে জুম চাষের চেষ্টায় ব‍্যস্ত গ্ৰাম বাসি। জওয়ানরা ছোটাছুটি করে কাজ করছে। কিন্তু ঐ সুন্দর দৃশ‍্য দেখতে আর ভালো লাগছে না কারো। 

শ্রী এর অবস্থা অনেক ভালো হলেও ও জিয়ার জন‍্য কান্নাকাটি করে চলেছে। পাভেল আর অর্চি স‍্যাটেলাইট ফোনে প্রনয় কে সব জানিয়েছিল রাতেই। ও সকালেই এসেছিল, ওরা বেরিয়ে গেছে কিছু জওয়ানের সাথে জিয়ার খোঁজে। 

অস্মিত আর রিভানের শরীর ঠিক নেই। ডাক্তার ওদের দ্রুত নিচে নামাতে বলেছেন। উচ্চতা জনিত কারণে অসুস্থদের ধীরে ধীরে নিচে নামানো শুরু হয়েছে। পথ তুষারে ঢাকা। বড় বড় মিলিটারি ট্রাকের চাকায় চেন জড়িয়ে বরফ কেটে নামার ব‍্যবস্থা হচ্ছে। 

অস্মিত এক মনে ডেকে চলেছে বাবা হরভজন সিং কে। শেষ আশাটুকু নিয়ে পথের দিকে চেয়ে রয়েছে ওরা দু জন।


বাবা মন্দিরে এসে প্রণাম করে পাভেল আর অর্চি , প্রনয়ের সঙ্গে দুজন জওয়ান কে নিয়ে এগিয়ে যায় ঝরণার দিকে। পথ বরফে ঢাকা। একটা ভুল পদক্ষেপে হাত পা ভাঙতে পারে। এমনকি মৃত‍্যুও ওত পেতে রয়েছে পদে পদে। ঝরণার ওধারে খুঁজতে চেয়েছিল অর্চি। প্রনয় সাবধান করে বলল ওদিকে মাইনস আছে। এল ও সি ও ধারেই। যাওয়া বারণ।

কিন্তু অবুজ মেয়েটা যে এসব জানত না। কুয়াশায় পথ ভুলে যদি ওদিকে চলে যায় !!

পথে দুটো পরিত‍্যক্ত বাঙ্কারে ঢুকে দেখেছে ওরা। না, জিয়া নেই। ওর ব‍্যাগটা পড়ে ছিল একটা বাঙ্কারের ভেতর। একটু আশার আলো দেখে ওরা। 

তন্নতন্ন করে গোটা এলাকা খোঁজা হল, শ্রান্ত ক্লান্ত দু টো শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু যতক্ষণ মেয়েটাকে পাচ্ছে না মনের কোনে একটু আলো টিমটিম করে জ্বলছে তবু। 

একটা বড় পাথরের উপর বসে ওরা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। কম অক্সিজেনের জন‍্য বুকে চাপ ধরে। ভারি শীতের পোশাক পরে আরো কষ্ট হয়। 

একটু পরেই একে একে গাড়ির কনভয় নামতে থাকে ছাঙ্গুর দিকে। রিভান অস্মিত শ্রীদত্তাকে নামিয়ে আনা হয়। মন খারাপ আর একরাশ হতাশা নিয়ে অর্চি আর পাভেলকেও নিয়ে আসা হয় ছাঙ্গু। প্রনয় থেকে যায় ওপরে। এখানের ট্রানজিট ক‍্যাম্পে রয়েছে আগের দিন আটকে পড়া পর্যটকেরা। শেরথাং, নাথুলা ছাঙ্গুতে যারা আটকা পড়েছিল তারা রয়েছে এখানে। কেউ কেউ নেমে গেছে গ‍্যাংটকের পথে। 

এক রাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে অর্চি আর পাভেল একবার মেডিক‍্যাল ক‍্যাম্পটা ঘুরে দেখবে ভেবে নেমে আসে। চারপাশে বিপর্যস্ত পর্যটকের দল। অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিবারের সদস‍্য বা বন্ধুদের খুঁজছে। ভারতিয় সেনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে এদের ঠিকঠাক ফেরত পাঠানোর জন‍্য। বিফল মনোরথ দু বন্ধু এগোতে পারে না গাড়ির দিকে। কি বলবে বাকিদের ? কোথায় জিয়া। 

হঠাৎ একটা ক্ষীণ কন্ঠ কানে আসে , -''পা.. ভেল, অর..চি... আমি ....'' দু জনেই ডাক অনুসরণ করে ছুটে আসে কোনের গাড়িটার কাছে। 

জিয়া বসে রয়েছে একটা সিটে, পায়ে ক্রেপ ব‍্যান্ডেজ। ওকে নামানো হচ্ছে গ‍্যাংটকে। চোখের জল আর বাধ মানে না। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ওরা জিয়াকে। 

-''কোথায় ছিলিস তুই? কত খুঁজেছি জানিস?"

-''আরে পা মচকে গেছিলরে। তারপর পথ হারিয়ে ফেলি। অসহ‍্য ব‍্যাথায় ঠান্ডায় জলতেষ্টায় মনে হচ্ছিল মরেই যাবো। তুষার পাতে কিছুই দেখা যায় না। একটা বাঙ্কারে ঢুকেছিলাম কোনরকমে। ঠান্ডায় বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল এক শিখ জওয়ান খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে আমায় নিয়ে চলেছে ক‍্যাম্পের দিকে। ঠান্ডায় কথা বন্ধ হয়ে গেছিল আমার। বেশ কিছুক্ষণ পর সেই জওয়ান আমায় একটা ক‍্যাম্পের কাছে নামিয়ে দেয়। সেই ক‍্যাম্পের লোকেরা আমায় আবার মাঝ রাতে এখানে নিয়ে আসে। তবে আমি এদের যত বলছি খচ্চরের পিঠে করে এক জওয়ান আমায় উদ্ধার করেছে এরা বলছে এই দুর্যোগে খচ্চর নিয়ে কেউ টহল দিতে বের হয় নি। আজকাল খচ্চর নিয়ে টহল দেয় না কেউ। এরা মানতেই চায় না আমার কথা। এক পা হাঁঁটার ক্ষমতা নেই আমার। অথচ বাবা মন্দিরের থেকে দশ কিলোমিটার দূরের ক‍্যাম্পে আমি যে খচ্চরে চরে এলাম এরা মানবে না। ''

-''ও ম‍্যাডাম জি, এয়সা নেহি বলতে। আপকো বাবা নে বাচায়া। এক বাবা জি তো হ‍্যয় যো রাতভর খচ্চরকা সওয়ারি করতে হ‍্যয় ইধর। আপনে বাবাজি কো দেখা ম‍্যাডাম জি। আপ তো বড়ে কিসমত ওয়ালী হো। '' পাঞ্জাবী সেনা ড্রাইভার দু হাত জোড় করে মাথায় ছোঁওয়ায়। 

আশেপাশের সব সেনাদের একি কথা, বাবা সারা রাত এভাবেই অতন্দ্র পাহারা দেয়। চীনা সৈন‍্যরাও জানে সে কথা। রিটায়ার মেন্টের পর ও বাবা রয়েছেন সীমানায়। দেশের সেবায় এভাবেই তিনি নিবেদিত প্রাণ। 

হঠাৎ জিয়া দু হাত জোড় করে প্রণাম জানায় কারো উদ্দেশ‍্যে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational