Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Debdutta Banerjee

Classics

3  

Debdutta Banerjee

Classics

মহানগরের একটি রাত ও মেয়েটা

মহানগরের একটি রাত ও মেয়েটা

7 mins
795


রাতের কলকাতা দিনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর রাতের এই ঘুমন্ত শহরে ট্যাক্সি চালাতেই ভালো লাগে আজাদের। রাতের বেলা শহরের আসল রূপটা দেখা যায়, আলোয় ঝলমলে শহরের ভেতর আরেকটা শহর জেগে ওঠে।

প্রথম কলকাতায় এসেছিল আজাদ ভাইজানের সাথে, হাওড়া ব্রিজ , ভিক্টোরিয়া, পাতাল রেল, জাদুঘর আর চিড়িয়াখানার গল্প বহুবার সে শুনেছিল ভাইজানের কাছে। ভাইজান বছরে দু বার বাড়ি যেত। আর মুঠো মুঠো সুখ কিনে নিয়ে যেত ওদের জন্য। ভাইজান আসলে আম্মি বিরিয়ানি বানাত, ফিরনীর গন্ধে ম ম করত ওদের মহল্লা। উৎসব ছাড়াই ওদের ভাই বোনের গায়ে উঠত নতুন জামা। কলকাতা তখন থেকেই আজাদের কাছে স্বপ্নের শহর। ভাইজানের মোবাইলে কত ফটো দেখেছিল ওরা কলকাতার। মিনারা আর ওকে সে বার ভাইজান নিয়ে এসেছিল কলকাতায় দুর্গাপূজা দেখাতে। শহরটা নাকি তখন নতুন করে সেজে ওঠে। লাখ লাখ টাকার প্যান্ডেল আর ইয়া বড় বড় মাটির পুতুলকে পূজা করে এই শহরের লোকেরা। তারপর সব জলে ফেলে দেয়। মিনারা আর আজাদ অনেক ঘুরেছিল ভাইজানের সাথে। চারদিকে তখন মেলা আর খাবার। কত কি যে খেয়েছিল ওরা , কিন্তু এই শহর বোধহয় মুচকি হেসেছিল ওদের দেখে। বিসর্জনের ভিড়ে মিনারা কোথায় হারিয়ে গেলো আজাদ আজ ও বোঝে নি। ভিড়ের চাপে ভাইজানের হাত ছুটে গেছিল বোধহয়। তারপর বহু খুঁজেও নিজের এক বছরের ছোট বোনটাকে ও খুঁজে পায় নি। ষোল বছরের ছেলেটা পাগলের মতো ছুটে বেরিয়েছে গঙ্গার ঘাটে তার পনেরো বছরের বোনের খোঁজে। সারাটা রাত কেঁদেছে বোনের জন্য। রাত শেষে উৎসব শেষ হলে ভাইজানের সাথে অলিগলি ঘুরেছে বোনের খোঁজে। একা ফিরতে চায় নি গ্ৰামে। কিন্তু এ শহরের কোনো এক অন্ধকার গলিতে হারিয়ে গেছিল ওদের সুখের দিন।

ভাইজান এরপর ওকে রেখে আসতে চাইলেও ও যায় নি গ্ৰামে ফিরে। প্রথমে সিটি বাসের হেল্পার হয়ে কাজ শুরু করেছিল। আর অবসরে একটু একটু করে শহরটাকে চিনছিল। চোখ ধাঁধানো আলোর বিপরীতে যে একটা অন্ধকার শহর লুকিয়ে আছে তা বুঝতে শুরু করেছিল। মিনারাকে খুঁজতে সে সব পাঁক ঘেঁটেও দেখেছিল আজাদ, কালীঘাট থেকে সোনাগাছি, বোনের খবর পায়নি ও। দিন কেটে, মাস, বছর পার হয়েছে। মহানগর আয়তনে বেড়েছে। অন্ধকারকে ঢাকতে আরও আলোর মালায় সেজেছে কল্লোলিনী তিলোত্তমা। কিন্তু তাতে বস্তির আঁধার দূর হয় নি। বস্তির ঘরে ঘরে আলো জ্বললেও পাঁকের দুর্গন্ধ চলে যায় নি। দিন বদলেছে, আজাদ কিশোর থেকে যুবক হয়েছে কিন্তু মিনারার খোঁজ পায় নি।

রাতের ট্যাক্সি চালানোর সাথে যুবক আজাদ এখনো মহানগরীর বুকে নিজের বোনকে খুঁজে বেড়ায়। ভাইজান দুবাই চলে গেছে দু বছর আগে। আজাদ মিনারার জন্য পরে রয়েছে এ শহরের বুকে। তবে মিনারার মতো বেশ কিছু মেয়েকে ঘরে ফেরাতে পেরেছে আজাদ।

কলকাতা স্টেশনের বাইরে দু একটার বেশি গাড়ি থাকে না রাতের বেলায়। রাতের ট্রেনের যাত্রী নামিয়ে বেরিয়ে আসছিল আজাদ। সস্তার ট্রলি হাতে মেয়েটাকে দেখে গাড়ির গতি কমায়। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটি এ শহরের নয়। একটা মাটির গন্ধ লেগে রয়েছে এখনো মেয়েটার গায়ে।

কলকাতা স্টেশনের বাইরেটা বড্ড শুনশান, যশোর রোডে না ওঠা পর্যন্ত জায়গাটার বদনাম আছে।মেয়েটা ভীরু পায়ে হেঁটে চলেছে সে দিকে। আজাদ আবার ওর পাশে গিয়ে ব্রেক করে। বলে -''কোথায় যাবেন? পৌঁছে দিচ্ছি, উঠে আসুন। ''

ইতস্তত করে মেয়েটা, বলে - ''হাতি বাগান যাবো। কত লাগবে ?''

-''বেশি নেবো না। যা উঠবে .. তাই'' পেছনের দরজাটা খুলে ধরে আজাদ। মেয়েটা উঠে বসে। একটা কুঁচকানো কাগজ এগিয়ে দেয় আজাদের দিকে, বলে -''এটা ঠিকানা ..''

আজাদ গাড়ি চালাতে চালাতে বা হাতে কাগজটা খুলে দেখে নেয়। রাত বারোটা বেজে পাঁচ, শ্যাম বাজারের ঘোড়াকে ডানদিকে ফেলে ট্রাম লাইন বরাবর ছুটে চলে আজাদের পঙ্খী রাজ, হাতি বাগানের বাজার ছাড়িয়ে এক বড় সেকেলে বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করায় সে। উল্টোদিকের বড় বাড়িটা ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হচ্ছে। আর কদিন পরেই বহুতল মাথা তুলবে ওখানে। মেয়েটা সেদিকে তাকিয়ে বলে -''আরে, এই বাড়িটাই তো ছিল ... ভেঙ্গে ফেলেছে!! এখন ? '' আজাদ ওর সাথেই নেমে এসেছে। ভেজা গলায় মেয়েটা বলে -''এটাই তো দাদুর বাড়ি, মায়ের সাথে দু বার এসেছি। কিন্তু ... বিক্রি করে দিয়েছে মনে হয়...'' দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখের জল আটকাতে যায় ও। কিন্তু বড় বড় ফোঁটা নেমে আসে দু গাল বেয়ে।

আজাদ বোঝে মেয়েটা বিপদে পড়েছে, বলে -''আর কেউ নেই এ শহরে?''

মেয়েটা অবাক হয়ে ভেজা চোখে তাকায়। বলে -''বাবার বাড়ি , মৌলালী, বড় জেঠু আছেন

। তবে ঠিকানা তো নেই। ''

-''মৌলালী গেলে চিনতে পারবেন ?''

ওর মাথা নাড়াতে তেমন জোর নেই। তবু আজাদ বলে উঠে বসতে। আড় চোখে ভাড়া দেখে আবার মিটার ডাউন করে আজাদ, যদিও বাকি রাতটা বেগার খাটতে হবে বলে ওর মনে হয়।

মৌলালীর বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর আলো জ্বালিয়ে বাইরে এলো এক ভদ্রলোক ও একটি মহিলা। মেয়েটি নিজেকে ঐ বাড়ির ছোট ছেলের মেয়ে বলে পরিচয় দিতেই ওরা চিনতে পারছেনা বলে ভেতরে ঢুকে গেলো। বেশ কয়েকবার ডেকেও আর কেউ এলো না বাইরে। আজাদ মেয়েটিকে বলে - '' চলে আসুন, আর কেউ আছে এই শহরে?''

মেয়েটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বলে -''প্রবীর দা ... পাড়ার দাদা ... এখানে চাকরী করে, টালিগঞ্জে থাকে, বহুবার যেতে বলেছে। ''

-''ফোন নম্বর আছে ওনার ? আগে ফোন করে দেখুন আছে কি না ?''

একটা সস্তার মোবাইল বের করে মেয়েটা একটা নম্বর বের করে। ওপাশে দু বার রিং হয়ে সুইচ অফ হয়ে যায়।

মেয়েটি আরও দুটো নম্বরে ফোন করে কিন্তু লাইন পায় না। এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।

-''আরে .. মাঝ রাতে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে আমায় পুলিশ ধরবে যে। নিজেকে সামলান। এভাবে রাতের বেলা অচেনা শহরে একা এসেছেন যখন বিপদে পড়েছেন বুঝতেই পারছি। কি হয়েছে বলবেন একটু?''

মেয়েটা ফুঁপিয়েই যাচ্ছে। গাড়ি থেকে জলের বোতল বের করে দেয় আজাদ। মিনারাও এভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদত, থামতে সময় নিত অনেক। মিনারার বয়সী হবে মেয়েটা।

দু ঢোক জল খেয়ে মেয়েটি বলে -''কত টাকা হয়েছে আপনার ?''

-''আগে বলো এখন কি করবে?''

-''শিয়ালদায় ছেড়ে দিন আমায়, স্টেশনে বসে থাকবো রাতটুকু। ''

চোখ মোছে মেয়েটা।

-''সেটা বোধহয় খুব একটা সুখের হবে না। তোমার নাম কি ?''

-'' রাই, আমার আর কেউ নেই এখানে। ''

-''এভাবে এসেছিলে কেনো ?''

-''আমি আর মা রায়গঞ্জে থাকতাম, বাবা মারা গেছিল ছোটবেলা। মা ও চলে গেলো কিছুদিন আগে। ভাড়া বাড়িও ছাড়তে হল। মামাদের ফোনে পাই নি। চলেই এলাম তাই। ট্রেন লেট করায় এতো রাতে পৌঁছেছি। বাকিটা তো ....''

-''এখন উপায় ? '' আজাদ ভেবে পায় না কি বলবে।

-''জানি না, একটা কাজ আর থাকার জায়গা পেলে ঠিক চালিয়ে নেবো। কিন্তু এতো রাতে ...''

এত বড় শহরে একটা মেয়ের একা টিকে থাকার লড়াই যে কতটা কঠিন আজাদ খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু এই মেয়েটাকে কোনো অন্ধকারে পা বাড়াতে দিতে মন চায় না। থানায় নিয়ে গেলে হয়তো কোনো হোমের ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু সেটা কেমন হবে কে জানে। আজাদ নিজেও একা থাকে বেলে ঘাটায়। একটা যুবতিকে নিয়ে সেখানে তোলা যায় না। চোদ্দ ভাড়াটের বাড়ি সেটা। রাতটা অবশ্য ট্যাক্সিতেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু তারপর ...

হঠাৎ মেয়েটা বলে -''আমায় স্টেশনেই ছেড়ে দিন আপনি। ''

ঘড়িতে রাত আড়াইটা। আজাদ বলে -''উঠে বসো, দেখছি ।''

ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলে নিজের গতিতে। পার্ক সার্কাস পেরিয়ে বালিগঞ্জের দিকে যেতেই রাই বলে -''কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? বললাম তো স্টেশনে ছেড়ে দিতে ? এ তো অন্য কোথাও যাচ্ছি আমরা। ''

আজাদ উত্তর দেয় না।

-''আপনাকে বিশ্বাস করে সব কথা বললাম আর আপনি... নামিয়ে দিন বলছি। ''

রাতের কলকাতায় ফাঁকা রাস্তায় সব সিগন্যাল অটো, তাই দাঁড়ায় না আজাদ।

অসহায় রাই বলে -''আমি চিৎকার করবো বলছি। নামিয়ে দিন। গাড়ি থামান। '' কিন্তু জোড় পায় না গলায়। গড়িয়া হাট ব্রিজ পার করে গাড়ি তখন গোল পার্কের কাছে।

আজাদ বলে -''চুপ করে বসো। ভালো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি তোমায়। ''

ঢাকুরিয়ায় ঢুকে একটা বড় বাড়ির সামনে গাড়ি থামায় আজাদ। জোরে দুবার হর্ন দিয়ে নেমে এসে বেল বাজায়, একটু পরেই এক মাঝ বয়সী মহিলা বেরিয়ে আসে ঘেরা বারান্দায়। রাই ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে গাড়িতেই বসে রয়েছে।

-''আজাদ, এতো রাতে!! কি ব্যাপার ?'' মহিলা প্রশ্ন করেন।

-''বিপদে পড়ে এসেছি ম‍্যাডাম। আমার এক বোন হঠাৎ করে বিপদে পড়ে কলকাতা এসেছে, ওকে কোথায় রাখবো ভেবে পাচ্ছি না। '' আজাদ রাইকে ইশারায় নামতে বলে।

ভীত রাই নেমে আসে, কলকাতায় মেয়েদের কত রকম বিপদ হয় ও শুনেছে। ওর জীবনে এমন বিপদ নেমে আসবে ভাবে নি কখনো। ড্রাইভারটা কি ওকে বিক্রি করে টাকা নেবে এবার ? তাই এতো ভালো মানুষের মতো ব্যবহার করছিল ? ভাড়াও নেয় নি!! কিন্তু কি করবে রাই ?

মহিলা তালা খুলে ওদের ঢুকতে দেয়। প্রথম ঘরটা অফিস ঘরের মতো। রাই ভাবে এ শহরে কি মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নেই !! মহিলা রাইকে ভালো করে দেখে বলে -'' এভাবে এত রাতে ..!! ঠিক কি হয়েছে খুলে বলো তো ?''

-'' আমি এ শহরে একা, যাওয়ার জায়গা নেই। বিপদে পড়েছি খুব। ''

রাই আস্তে আস্তে সবটাই খুলে বলে। আর তো উপায় নেই।

-''তোমার ভাগ্য ভালো, আজাদের সাথে দেখা হয়েছিল। আমি একটা এনজিও চালাই তোমার মত মেয়েদের নিয়ে। আজাদ আগেও অসহায় মেয়েদের এখানে পৌঁছে দিয়েছে। রাতটা থাকো, সকালেই সব খুলে বলব। ''

রাই ঘরের চারদিকে দেখছিল নানা বয়সের একদল মেয়ের ছবি। তারা হাতের কাজ করছে, সবলা মেলায় স্টল দিচ্ছে, খাবার বানাচ্ছে। কোথাও পতাকা তুলছে মেয়েরা। এই ম‍্যাডাম বক্তৃতা দিচ্ছেন। এটাই এনজিওর অফিস মনে হয়।

আজাদ উঠে পড়ে। বলে -''আমি চলি ম‍্যাডাম। আপনাকে বিরক্ত করলাম, পরে খবর নেবো। ''

রাই আর ম‍্যাডাম কে বিদায় জানিয়ে ঘুমন্ত শহরের বুকে নেমে পড়ে ও। দূরে কোথাও ঘড়িতে চারটে ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। বিহারী দারোয়ান বাঁশী বাজায় পেছনের রাস্তায়। ভোরের প্রথম ট্রেন ছুটে চলে শহরতলীর দিকে। দূরের বড় রাস্তায় মিলিয়ে যায় আজাদের গাড়ি।

হঠাৎ করে রাইয়ের মনে হয়, এই মহানগর খারাপ নয়, নিজের লোকেরা দূরে ঠেলেছে ঠিক কিন্তু এক অচেনা লোক এই শহরেই এতটা আপন হয়ে গেছে কয়েক ঘণ্টায়। শহরটাকে আর অচেনা লাগে না রাইয়ের।

রাত জাগা চোখে আজাদ দেখে একটু একটু করে জাগছে তার প্রাণের শহর। মিনারাকে না পেলেও রাইকে একটা নিরাপদ ঠিকানা দিতে পেরেছে ও আজ। অন্ধকার কেটে পূব আকাশে ফুটছে এক কমলা আলোর রেশ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics