Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Mausumi Pramanik

Drama

4.0  

Mausumi Pramanik

Drama

এ কেমন ভালবাসা......

এ কেমন ভালবাসা......

9 mins
59.4K


তখন সবে অফিস থেকে ফিরেছি; ভীষন ক্লান্ত; কাজের এত প্রেশার; ইন্টারন্যাল অডিট চলছে; এমন সময় ফোনটা এল। রাত তখন ন’টা। মা’-ই ফোনটা রিসিভ করেছিলেন; দু-একটা কথা বলেই হঠাৎ করে কেমন যেন ককিয়ে উঠলেন। “কি হল তোমার?” বাবা’র আর্তনাদ আমার কানে এল। আমি নিজের ঘরেই ছিলাম। ছুটে এলাম বসার ঘরে। বাবা মায়ের চোখে মুখে জল দিতে থাকলেন; আমি রান্নাঘর থেকে চিনির ডাব্বাটা নিয়ে এলাম। মায়ের ডায়াবেটিস আছে, ভেবেছিলাম সুগার ফল করেছে। কিন্তু এবার মা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকলেন। আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। ‘যাক গে...শরীর ঠিক আছে...যেভাবে কাঁপছিলেন এতক্ষন...’

“কাঁদছো কেন, মিনু...কি হয়েছে? তোমার দাদা ঠিক আছেন তো...?”

“এ কি সর্ব্বোনাশ হয়ে গেল গো...?”

“কি হয়েছে বলবে তো?” বাবা এবার রেগে গেলেন।

আমি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “মা...শোন...শান্ত হও...বলো কি হয়েছে...”

“ওরে মা...কি বলবো...ফাগু’টা আর নেই রে...”

“নেই মানে...?”

“বিষ খেয়ে...মরেছে ছেলেটা...”

“কি?” বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

মা’কে স্বান্তনা দেওয়া দূরে থাক, আমি নিজেই হতভম্ভ হয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। ‘ভাবতেও পারছি না এমন একটা ব্যাপার কি করে হল? অবশ্য এটা হবারই ছিল...কিন্তু...ওর মতো একটা জলি ছেলে এভাবে শেষ হয়ে গেল?’

ক’দিন ধরেই ও আমায় ফোন করছিল, “তুই কবে আসবি মিতুদি?” ও আমাকে দিদি বলতো যদিও আমার থেকে মাত্র ছ’মাসের ছোট। সাত মাস হল বিয়ে হয়েছিল ফাল্গুনীর। বিয়েতে আমি যাই নি। কাজের চাপ তো ছিলই, তাছাড়াও অন্য কারণও একটা ছিল। আমি চাইছিলাম না যে ও বিয়ে করুক। কিন্তু বাধা দেওয়ার সাধ্যও আমার ছিল না।

ফাল্গুনী ও দেবেশ ছোটবেলা থেকেই প্রিয় বন্ধু। ফাল্গুনী আমার নিজের মামাত ভাই, কিন্তু দেবেশ দুঃসম্পর্কের। ওদের দুজনের বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা একটু বেশিই চোখে লাগার মতই। একসাথে শোয়া, বসা, খাওয়া। সেই সময় আমি গ্র্যাজুয়েশান করছি; সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলো বুঝতে শিখছি। তখনই ওদের সম্পর্কটা আমার একটু অন্যরকম লেগেছিল। ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়। দুটি ছেলের মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব হয়, তেমনটা নয়।

একবার আমরা সিনেমা দেখে রাতের বেলা চাঁদের আলোয় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম সকলে। দুই দিদি, জামাইবাবু আর ওরা দুজন ছিল। আমরা গল্প করতে করতে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ওরা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। একটু অন্ধকার দেখে সরে গেল। ফাল্গুনী দেবেশের হাতটা এমনভাবে ধরে পথ চলছিল ঠিক যেমন এক বান্ধবী তার বয়ফ্রেণ্ডের হাত ধরে চলে। আর ফিস ফিস করে কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে।

তারপর একদিন দেখলাম যে ফাল্গুনী রান্নাঘরে কাঠের উনুনে শামুক চচ্চড়ি রাঁধছে; দেবেশ এসে সটান সেখানে ঢুকে গেল। দিদি, বৌদি কলে জল আনতে গেছে; আমার ভীষন জল তেষ্টা পেয়েছিল। রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম ফাগু দেবেশের গলা দু হাত ধরে জড়িয়ে ধরে কি একটা আবদার করছে। দেবেশ এদিক- ওদিক তাকিয়ে ওর ঠোঁটে আলতো চুমু খেল।

খুব ছোটবেলা থেকেই ফাল্গুনী একটু মেয়েলী ছিল। ও ফেয়ারনেস ক্রিম মাখত, ব্যাগের ভেতর সবসময় আয়না রাখত, বারবার আয়নায় নিজের ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলগুলো পার্ট পার্ট করে আঁচড়াত। মুখে, গলায় সুগন্ধি পাউডার লাগাত, আতর মাখত যা গ্রামের একটা চাষীর পরিবারের ছেলে কখনোই করত না সেই সময়ে। কতবার দেখেছি ওকে যে মামীমার শাড়ি পরে অভিনয় করতে; মানে আমরা যখন স্কুলের ছুটিতে মামার বাড়ি যেতাম, তখন ওই সব থেকে বড় এন্টারটেনার ছিল। সেইসময় ছেলেরা মেয়ে সেজে যাত্রায় অভিনয় করত। আমিও ভেবেছিলাম যে ও নকল করে আমাদের দেখাচ্ছে। আর কসমেটিকসের কথা জিজ্ঞেস করলে বলত, “ওসব তো আমি মিতুদির জন্যে কিনে রেখেছি...” আরও একটু বড় হবার পর দেখলাম যে রান্নাঘরের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রথমে ভাবতাম বৌদিকে সাহায্য করছে। মামীমা রুগ্ন, কিছুই তো পারেন না। পরে দেখলাম যে ওটা ওর হবি নয়, স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। আর আমি গেলে তো কথাই নেই। কোথা থেকে আতা নিয়ে আসত; পুকুর থেকে শামুক কুড়িয়ে রান্না করত আমার জন্যে। কিন্তু দেবেশের জন্যে আলাদা করে তুলে রাখতে ভুলত না। উঠানে শাক সবজি বুনেছিল; অন্যের ছাগল বা মুরগী ওর চারার ক্ষতি করলে গাল পাড়ত একেবারে ঠাকুমার মত, “তোদের মরণ নাই..ওলাওঠা হয়ে মরবি রে..” ইত্যাদি ইত্যাদি। বাড়ীতে সকলে বলত ও নাকি আমার দিদিমার স্বভাব পেয়েছে। কিন্তু আমি চুপ করে ওকে ওয়াচ করতাম। ওর এই মেয়েলি স্বভাবটা মোটেই আমার স্বাভাবিক লাগত না।

আমাকে ও খুব ভালবাসত। তাই হয়তো চলে যাবার আগে কিছু বলতে চেয়েছিল, দেখতে চেয়েছিল একবার আমাকে; কিন্তু আমি পারিনি। অফিসে কাজের চাপে যাব যাব করে যাওয়াই হয়ে উঠল না আর! কিন্তু ও যে এমন একটা কাণ্ড করে বসবে তা কি জানতাম? দু’মাস আগে মা মামারবাড়ি থেকে ফিরে বলেছিলেন বটে, “জানিস মিতু...ফাগুটা কেমন যেন হয়ে গেছে...আমার সঙ্গে ভাল ভাবে কথাই বলল না...কি রোগা হয়ে গেছে...”

“বিয়ে করে হ্যাপি নয় নিশ্চয়...তখনই বারণ করেছিলাম...” আমি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলাম।

হ্যাঁ। আমি সাবধান করেছিলাম। বছর খানেক আগে যখন গিয়েছিলাম শীতকালে মামার বাড়িতে, তখন ওর বিয়ের দেখাশোনা চলছে। আমি মামীমাকে বলেছিলাম, “ওর বিয়ে দিও না মামীমা...”

“মারে! আমরা চোখ বুঝলে ওকে কে দেখবে বল দিকি..? ওর ভাইবৌরা কি দেখবে?”

কিন্তু গ্রামের সাধারণ ঘরের এক অল্প-শিক্ষিত বয়স্ক মহিলা বা পুরুষকে আমি কিভাবে বলবো যে ও আর পাঁচটা ছেলের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে না...ওদের দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মত। বললেও কে বুঝবে আমার কথা। আর বুঝলেও কে মানবে?

আমি ওদের এক বিছানায় এক চাদরের নীচে জড়াজড়ি করে শুতে দেখেছি। ওদের একসাথে স্নান করতে দেখেছি পুকুরে। একে অন্যকে সাবান, তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। একে অন্যের জন্যে পছন্দ করে জামা-কাপড় কিনেছে কতবার। পূজোতে একে অন্যের বাড়ির সদস্যদের উপহার দিয়েছে। ফাল্গুনী নব বধুর মত লাজুক লাজুক স্বরে কথা বলতো দেবেশের সঙ্গে। আমি সামনে এলে ওরা চুপ করে যেত। কি জানি হয়তো ওদের মধ্যে শারীরিক সম্বন্ধও ছিল; রাতে একসাথেই তো শুত ওরা; তাও আবার গোয়াল ঘরে। কেন? কে জানে?

আমি অনেক বছর আগে থেকেই ওদের এই সম্পর্কটার গভীরতা আঁচ করতে পেরেছিলাম। জামাইবাবুদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হয়েছিল আমার। ওরা তো ইয়ার্কি ঠাট্টা করত। কিন্তু বড় মিষ্টি ছিল ওদের এই সম্পর্কটা। যখনই ওদের একসাথে দেখতাম, মনে হত একজোড়া সাদা পায়রা পাশাপাশি বসে বকবকম করে চলেছে।

দুজন দুজনকে খুবই ভালবেসেছিল ওরা। সেটা কি দোষের? ওরা তো কারোর ক্ষতি করছিল না। সারা গ্রামের নয়নের মণি ছিল ওরা, বিশেষ করে আমার ভাই। সে প্রতিবছর ঠাকুর গড়ত, লক্ষী, মনসা, গনেশ আরো কত কি। আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িতে বিয়ে, শ্রাদ্ধ তো বটেই, শীতকালে পিঠে বানানোর জন্যেও সবার আগে ফাল্গুনীর ডাক পড়ত। ঢেকিতে পাহার দিয়ে কি সুন্দর করে চাল কুটত ও। আর যত মা মাসীর কাছে সারা গ্রামের গল্প করত ঠিক মেয়ে-বৌদের মত। অনেকে ওর রকম সকম দেখে মুখ টিপে হাসত, তবে সামনে কিছু বলত না। নিজে যেমন খেতে ভালবাসত, তেমনিই সকলকে খাওয়াতে ভালবাসত। কিন্তু খেত অনেক রাতে, দেবেশ কাজ থেকে ফিরে এলে, ঠিক যেমনটি করে মধ্যবিত্তের বাড়ির বউ। দেবেশ ওর নিজের বাড়িতে না খেয়ে প্রায় দিনই আমার মামার বাড়িতেই খেত। কোনদিন যদি নিজের বাড়িতে খেত, তো সেদিন ও বাড়ির রান্নাও ফাল্গুনীই করত।

পূজোর সময় স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা যখন যাত্রা পালায় অভিনয় করত, মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে আর্টিস্ট ভাড়া করে নিয়ে আসা হত চিৎপুর থেকে। আর ফাল্গুনীকে সমস্ত মহিলা চরিত্রের পাঠ মুখস্থ করিয়ে রাখা হত, পাছে কেউ যদি মিস করে তাহলে ব্যাক আপ তো রইল। ও তাতেই মহাখুশী; মেয়ে হতে পারলে ও যেন আর কিছু চায় না। ডায়লগ থ্রো থেকে আরম্ভ করে হাসি, কান্না সবেতেই সমান পারদর্শী ছিল সে। যেমন পারদর্শী ছিল সেলাই, উল বোনা এবং ঘরের যে কোন মেয়েলি কাজ; সে বঁটিতে সবজী কাটা হোক আর বাটনা বাটা হোক। বৌদিদের হয়েছিল বেশ মজা; কাজ কমে গিয়েছিল; ফ্রীতে অমন হেল্পিং হ্যাণ্ড কোথায় আর পাওয়া যাবে? এমনকি গ্রামের যে কোন অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ বাড়িতে সবার আগে ওকেই ডাকা হত; হলুদ কুটতে, মুড়ি ভাজতে অথবা খই ভাজতে; কিংবা আলপনা দিতে।

ও পুরুষ হলেও যে ওর মধ্যে একটি মেয়ে সত্ত্বা কাজ করছে, এই অতিবড় সত্যটাকে কিভাবে সকলে অস্বীকার করে গেল কিংবা দেখেও অদেখা করে গেল সেটা আজও আমার মাথায় ঢোকে না। যে ছেলেটা সকলের জন্যে এত করত, এত ভাবত তার এই করুণ পরিণতি কেন হল? এটা কি ফাল্গুনীর অভিমান না আত্মত্যাগ, কে বলে দেবে?

দেবেশের কাছে শুনেছি যে অনেকদিন ধরেই দেবেশের মা দেবেশকে বিয়ে করার জন্যে চাপ দিচ্ছিলেন। বড় ভাইয়ের স্ত্রী বেশিরভাগ সময়েই অসুস্থ থাকে কিংবা বাপের বাড়িতে থাকে। তাই বুড়ো মা’কে ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্যে পরিবারে একজন বউমানুষের আশু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দেবেশ কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না।

“ওসব আমার দ্বারা হবে না....আমায় জোর করলে আমি ঘর ছেড়ে পালাবো এ বলে দিলুম...”

তখন আর উপায়ন্তর না দেখে দেবেশের মা ফাল্গুনীকে বকাঝকা শুরু করলেন, “তুই বাছা যত নষ্টের গোড়া...আমার ছেলেটাকে হাতের মুঠোয় করে রেখেছিস.. টাকা পয়সা যা রোজগার করে সব তো তোদের ঘরে তুলে দিয়ে আসে...” সত্যিই দেবেশ ফাগুর ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করত। বন্দকী কারবার ছিল ওদের। যত বন্দকী জিনিষ সব ফাগুর আলমারীতেই রাখা ছিল।

ফাল্গুনী কাকীর কথায় আহত হয়। যথেষ্ট অভিমানী সে। যদিও বুক ফেটে গেলেও তা প্রকাশ করে না। সে দেবেশকে রাজী করাল বিয়ের জন্যে। ওরা মেয়ে দেখতে গেল। ফাল্গুনীর পছন্দের মেয়ের সঙ্গেই দেবেশের বিয়ে হল। বিয়ের পর থেকে স্বাভাবিক কারণেই দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ল। রাত জেগে আর তারা গোনা হত না। আদর করে স্নান করিয়ে দেওয়াও বন্ধ হল। ভালবেসে গাল করে খাইয়ে দেওয়া আর হল না। আরো কত কি ভালবাসার কাজকর্ম ছিল, সব বন্ধ হয়ে পড়ে রইলো।

ক্রমে ক্রমে ফাল্গুনী ইর্ষান্বিত হয়ে পড়ছিল। সুযোগ পেলেই দেবেশকে খোঁটা দিয়ে কথা বলতো। চোখের কোণে জল চিকচিক করত তার তবুও মোটা ঠোঁটে হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। ওকে দেখে আমার করুণা হচ্ছিল; বুঝতে পারছিলাম যে এই পরিবেশে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ভেবেছিলাম ওকে কলকাতায় নিয়ে এসে কোন সংস্থায় ভর্ত্তি করে দেব যেখানে হাতের কাজ শেখায়। ও নিজের মন থেকে ফুল পাখী, হাতি কত কি যে বানাত। জঙ্গল থেকে ফুল, পাতা নিয়ে এসে তাই দিয়ে লাল, সবুজ, নীল প্রভৃতি রং বানাত আর হাড়ির নীচের কালো কালি দিয়ে মাটির প্রতিমার চোখ আঁকত।

কিন্তু সেই কালিতে যে তার নিজের জীবন ডুবে যাবে তা সে কল্পনাও করেনি। জেদের বশে সে একদিন স্থির করল যে সেও বিয়ে করবে। আমি বললাম, “ভাই তুই এই ভুলটা কেন করছিস...?”

“কেন? ও যদি বিয়ে করতে পারে আমি কেন করব না?”

বুঝলাম অভিমান হয়েছে। “তবে তুই ওর বিয়ে দিলি কেন?”

“তবে কি রোজ ওর মায়ের কাছে গাল খাব?”

হা ঈশ্বর! কি অসহায় ওরা। এই সমাজ, এই নিয়ম কানুন ওরা সব কিছুর বাইরে! ওরা যে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা, সেটা বোঝার মত কি কেউ নেই? আমার চোখে জল চলে এসেছিল, বললাম, “যা পারিস কর...কিন্তু এতে কারোর ভাল হবে না...দেখিস...”

কথাটা যে একদিন সত্যিই হয়ে যাবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কেন হল, কি করে হল এসব প্রশ্ন কাকে করব? সন্তান হারা মা’কে? না বাবাকে? ভ্রাতৃহারা বোনেদের না দাদাদের? কতটা কষ্ট পেলে সদাহাস্য একটি মানুষ নিজেকে শেষ করে দেয়, তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের মত জীবন্ত মমিদের বোধহয় নেই। তবে মৃত্যুর দিন সকালে সে একটা চিঠি লিখেছিল দেবেশকে,

“প্রিয়তম বন্ধু,

আমি চলে যাচ্ছি। তোকে ছেড়ে, তোদের ছেড়ে। আশা করি এবার তুই সুখী হবি। আমার সুখ যে তোর সুখ নয় তা আগেই বুঝেছি। তুই বুঝিয়েছিস বারবার। তনয়া আজ তোর হৃদয়ের সবটা অধিকার করে বসে আছে। তবে, আমি কোথায়? আমার তো আর জায়গা রইল না। তোর ঘর থেকে তোর মা তাড়িয়েছে; তোর জীবন থেকে তোর বউ দূর করে দিয়েছে, আর তোর মন থেকে তুই। কিন্তু কেন করলি এমন? তবে যা করেছিস, ভাল করেছিস আর আমি যা করছি ঠিক করছি। আজকের পর আমার বাড়িতে কান্নার রোল উঠবে আর তোর বাড়িতে মচ্ছব। ভাল থাকিস বন্ধু।

ইতি

তোর অভাগা বন্ধু/ অধুনা শত্রু ফাল্গুনী ”

চিঠিটা পড়ে আমার চোখে জল আসে নি কারণ এক বিশাল শূন্যতা আমাকে গিলে খাচ্ছিল। আমি ডোবার পাড়ে পাথরের ওপর বসে জলের মধ্যে মাছ ও ব্যাঙের খেলা দেখছিলাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলাম। দেবেশ এসে বসল আমার পাশে।

“ও তোমায় ফোন করেছিল...তুমি এলে না যে!”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। ‘ও জানে? মানে ফাল্গুনী ওকে সেটাও বলেছিল!’

“তোমায় কিছু বলতে চেয়েছিল...”

“কি হয়েছিল? এ বিয়েতে যে তোমরা সুখী হও নি, সেটা না বোঝবার মত বোকা আমি নই...”

“আমি তো বিয়ে করতে চাই নি? ওই তো জোর করল...”

“ওর বিয়ের পর...? ঠিক ছিল সব...?”

“না। সে নিয়েই তো অশান্তি। রোজ রাতে আমাকে ডেকে পাঠাত...বারোটা, একটা অবধি আমাকে থাকতে হত ওর সাথে...”

“আর ওর বউ?”

“জানি না। ও খুব ভাল মেয়ে, কিছু বলতো না, বাইরের ঘরে শুয়ে থাকত...তারপর আমি গেলে উপরে যেত...”

“বাড়ির লোকেরা কেউ কিছু বলতো না?”

“আমার সামনে তো বলতো না...তারপর...”

“ওকে। তাহলে তো মিটেই গেল...সমস্যাই ছিল না...”

“ছিল। আমার বউ। সে সন্দেহ করতে শুরু করল যে ফাল্গুনীর বউয়ের সঙ্গে আমার অবৈধ সম্পর্ক চলছে...”

“ও গড!...”

কি অসহায় তনয়া! গ্রামের এই সরল মেয়েটা বোধহয় জানেই না যে দুটি পুরুষের মধ্যেও ভালবাসার সম্পর্ক থাকতে পারে। আর তাতে কোন পাপ নেই। যদি জানত বা বুঝত, তাহলে হয়ত একটা প্রাণ অকালে চলে যেত না।

ওকে দোষ দিয়ে কি লাভ যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, রাজনৈতিক দল কিংবা ধর্মগুরু, কেউই তো এখনও সমকামীতার পক্ষে সহমত পোষন করেন নি আজও। কিছুদিন আগে এক অভিনেত্রীও একই পথ বেছে নিয়েছে।

প্রত্যেক মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্টি; তাদের মন, মনের অনুভূতি সবই তো তাঁরই দান। তবে কেন এইভাবে একের পর এক ফাল্গুনীকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে? যদি শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর কৃষ্ণ-প্রেম পূজিত হতে পারে তবে কেন সমকামীদের ভালবাসা স্বীকৃত হবে না; সম্মানিত হবে না?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama