Become a PUBLISHED AUTHOR at just 1999/- INR!! Limited Period Offer
Become a PUBLISHED AUTHOR at just 1999/- INR!! Limited Period Offer

Debdutta Banerjee

Romance

3.7  

Debdutta Banerjee

Romance

দোলনচাঁপার গন্ধ

দোলনচাঁপার গন্ধ

6 mins
19K


-"আচ্ছা দিদুন, তোমাদের যুগে প্রেম ভালোবাসা ছিল না ? এই তোমায় দেখে কেউ চিঠি দেয়নি? লুকিয়ে ডেটিং করনি?" আমার প্রশ্নে আমার সত্তুরে গার্ল-ফ্রেন্ডের গালে টোল পড়ে। ফর্সা গালে গোলাপি আভা, দিদুন বলে -"পনেরো বছরে বিয়ে হয়ে গেছিল রে। প্রেম আর হল কোথায় ? "

-"পনেরো!! ইউ মিন বাল্য বিবাহ !! দাদানের জেল হয়নি !!" আমি হাসতে থাকি।

-"তখন তো তাই হত। বারো থেকেই বিয়ে শুরু হতো যে। পনেরো তো অনেক বয়স। "

-"তাহলে দাদানই তোমার জীবনে প্রথম প্রেম বলো ?"

-"তার সাথে আর প্রেম হল কোথায়? সারা জীবন আমার উপর ছড়ি ঘুরিয়েই গেলো লোকটা। রাশভারী প্রফেসর মানুষ।" দিদুনের গলায় কপট আক্ষেপ। অথচ আমি জানতাম দাদান আর দিদুন পারফেক্ট কাপল্। আজ দশ বছর দাদান নেই। দিদুন সেই স্মৃতি আঁকড়ে একা এখানে পড়ে রয়েছে। 

রাতে খাওয়ার পর সামনের ঢাকা বারান্দায় বসে গল্প হচ্ছিল। দিদুন বলছিল -"বিয়ের পর আমায় জোর করে কলেজে ভর্তি করেছিল তোর দাদান। নিজে থাকত বাইরে। আমি জলপাইগুড়িতে, একান্নবর্তী শ্বশুরঘরে। ধীরে ধীরে গ্ৰাজুয়েশন হল। আবার এমএ তে ভর্তি করে দিল। সেসব পাট চুকিয়ে ওর কাছে আসতে পেরেছিলাম।"

-"বাঃ, বেশ তো। " আমি হেসে উঠি।

-"বাড়ি এলেই সারাক্ষণ পড়া ধরত লোকটা। ঠিক যেন মাষ্টার মশাই। কোনো প্রেম ভালবাসার কথা নয়। সাহিত্যের প্রফেসর হয়েও রসকষ হীন ছিল বরাবর। "

-"কি বলছ ? দাদু তোমায় ভালো বাসত না !!" আমি আবার অবাক।

-"স্ত্রী হিসাবে কর্তব্য করত। ভালোও বাসত। কিন্তু প্রেম ছিল না। মানে বাবা যেমন মেয়েকে স্নেহ করে তেমন ছিল আমাদের সম্পর্ক। কোনো প্রেমিক সুলভ আচরণ কখনো করেনি। "

দিদুনের গলায় একটা আক্ষেপের সুর। আমি গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। -"তারমানে আমিই তোমার একমাত্র প্রেমিক দোলনচাঁপা দেবী!! দা ওয়ান এন অনলি....."

আমার মাথায় চাটি মেরে উঠে গেল দিদুন। এই বয়সেও যথেষ্ট শক্ত শরীর। বলল -" বিয়ের আগে প্রেম হয়নি বলেছি কিন্তু পরে কখনো হয়নি তো বলিনি সোনা !!" দিদুনের চোখে কৌতুকের হাসি। 

-"মানে..... ইউ মিন..... ঘরে বাইরে কেস !! গৃহ দাহ !! উফফ ....!! ফাটাফাটি .... তুমি তো কাঁপিয়ে দিলে ডার্লিং। পরকীয়া !!" আমি বিস্ময়ে খাবি খাচ্ছি।

চোখ বড় বড় করে দিদুন বলল -"পরকীয়া আর প্রেম কি এক ? তুই না আধুনিক !! অবশ্য তোদের কাছে প্রেমের মানে অন্য। সম্পর্ককে বিছানায় টেনে নিয়ে যাওয়াই কি প্রেম? আমাদের কাছে প্রেম ছিল একটা পবিত্র সম্পর্ক..."

আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি। চেনা দিদুনকেও অচেনা লাগছে হঠাৎ। এসব কথা সাহিত্যের পাতায় থাকে জানি।

ভাই বোনেদের মধ্যে আমিই দিদুনের সবচেয়ে কাছের । মা রা এক ভাই, এক বোন। মামা বাহরিনে থাকে। আমর মা দিল্লীতে। দিদুনের দেখাশোনা আমরাই করে এসেছি বরাবর। আমি চাকরী করি আইটিতে। কলকাতায়। দিদুনের কাছেই থাকি এখন।

থাকতে না পেরে বললাম -"তাহলে পেশ কিয়া যায়ে এক অানোখি প্রেম কাহানী, আপকে জবানী। "

দিদুনের পায়ের কাছের কার্পেটে বসলাম গুছিয়ে। বাইরে কুয়াশা আর পলিউশন মিলেমিশে এক আধা-অন্ধকার মায়াবী পরিবেশ। দিদুন একটু চুপ করে থাকলো। বোধহয় নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। 

আমাদের পাড়াতেই কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকত বিতান। কলেজের ভালো স্টুডেন্ট। আমার থেকে এক ক্লাস উপরে পড়ত। সম্পর্কে দেওর হলেও বন্ধুর মতোই মিশত। ও ছিল আমার ছায়া সঙ্গীর মত।শীতের দুপুরে বনকুল আর কৎবেল মাখা, আমের সময় কাঁচা আম মাখা সবেতেই ছিল বিতান।কলেজ কেটে সিনেমা, নাটক দেখা অথবা বিকেলে কখনো তিস্তার পারে বা বাবু ঘাটে আড্ডা, একমাত্র সঙ্গী বিতান। 

আমাকে বাড়ি থেকে টেনে বার করত ও। প্রথম প্রথম লজ্জায় কুকরে থাকতাম। কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়ি ছিল উদার ও আধুনিক। বিতান ছিল বাড়ির ছেলের মতোই। ওর সাথে সব জায়গায় যাওয়ার ছাড় ছিল। খুব ভালো গান গাইত বিতান। আমিও গাইতাম ওর সাথে। এভাবেই দিনগুলো কাটছিল ভালোই। এরপর ও চলে গেলো কলকাতায় পড়তে। এই প্রথম আমি অনুভব করলাম বিরহ যন্ত্রণা। এটা ছিল দু তরফেই। কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দিতে চাইতাম না। বিতান প্রতি মাসেই বাড়ি চলে আসতো। আমাদের বাড়ি আসত সময়ে অসময়ে। সবটাই বুঝতাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ভয় পেতাম সবাই কি ভাববে ভেবে।

একদিন বাড়ির সবাই গেছে এক বিয়েবাড়ি। আমার পরীক্ষা বলে যাইনি। সন্ধ্যায় বিতান এলো। এক পশলা বৃষ্টির পর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে আধ-ফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছিল সেদিন। দু জনেই চুপ করে বারান্দায় বসে ছিলাম। নিস্তব্ধতাও যে কত না বলা কথা বলে সেদিন বুঝেছিলাম। একদিকে যে মানুষটা আমার স্বামী হয়েও আমায় এত স্বাধীনতা দিয়েছিল তার প্রতি বিশ্বস্ততা, শ্বশুরবাড়ির সন্মান অন্য দিকে হৃদয়ের টান, যৌবনের প্রথম ভালবাসা......। 

কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। হঠাৎ দেখলাম ও উঠে চলে গেলো। আটকাইনি আমি।সেদিন অনেক রাতে তোর দাদান এলো। পরীক্ষা শেষ হতেই আমায় নিয়ে চলে গেলো নিজের কাছে। নতুন জীবন শুরু হল আমাদের। 

নাঃ, আর দেখা হয়নি বিতানের সাথে। শ্বশুরবাড়ি গেলেও কাউকে নিজে থেকে ওর কথা জিজ্ঞেস করিনি। শুনেছিলাম ও বাইরে চাকরী করছে। কয়েকবছর পর শুনলাম বিদেশ গেছে। ততদিনে আমি নিজের সংসারে ব্যস্ত। দায়িত্ব কর্তব্যর বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে ঐ নিষিদ্ধ পথে হাঁটতে পারিনি। শ্রান্ত দিনের শেষে ক্লান্ত আমি যখন বৃষ্টি ভেজা আকাশে ছেড়া মেঘের ফাঁকে এক ফালি চাঁদ দেখতাম মনটা কি একটা না পাওয়ার বেদনায় হু হু করে উঠত। এই আমার প্রথম ও শেষ প্রেম। "

 জলের বোতল নিয়ে অনেকটা জল খেল দিদুন। আমি তখনো স্তব্ধ, রূপকথার দেশে রয়েছি মনে হল। 

-"আর কখনো ওনাকে খোঁজো নি?" অস্ফুটে বললাম। 

-"ও আছে আমার মনে, প্রাণে। ...." দিদুনের মুখে এক স্বর্গীয় হাসি।

-"জলপাইগুড়ি যাবে ?" আমি বলি।

শত্তুরের চোখে কিশোরীর লজ্জা, রাঙ্গা গাল.... " কত বছর যাইনি । প্রায় পঁচিশ বছর। ঐ বাড়ি তো বিক্রি হয়ে গেছে। আর কেউ নেই ওখানে।"

-"আমি নিয়ে যাবো। চলো।" কেমন একটা আগ্ৰহ জন্মেছিল শেষটা জানার।

তিনদিন ধরে সোশাল সাইটে বিতান ব‍্যানার্জী কে খুঁজে চলেছি। কিন্তু ঐ বয়সী জলপাইগুড়ির কাউকে পাইনি। আজ বাগডোগরায় নামার পর থেকেই দিদুন খুব চুপচাপ। একটা চাপা উত্তেজনা চোখ মুখে ফুটে উঠেছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর গাড়ি যখন জলপাইগুড়ি শহরে ঢুকছে দিদুনের মধ্যে ফিরে এলো সেই কিশোরীর উচ্ছলতা। এত বছরে বহু বদল হয়েছে শহরের। তবুও দুটো চোখ খুঁজে চলেছে সেই চেনা ছবি। পুরানো বাড়ি আর রাস্তা ঘাট দেখে উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারছে না।

 কদম তলার কাছে একটা হোটেলে উঠেছিলাম আমরা। যদিও পুরানো আত্মীয়দের অনেকেই এখনো রয়েছেন ওখানে তবুও কাউকে ব্যস্ত করবো না বলেই এই সিদ্ধান্ত। বাবু পাড়ায় দিদুনের শ্বশুর বাড়ি দেখতে গেছিলাম বিকেলে। তবে পুরো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বাড়ি উঠেছে। চারপাশটা নাকি বদলে গেছে। দিদুনের চোখে ফুটে উঠেছিল এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। পায়ে পায়ে এই গলি সেই গলি ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়িয়েছিল এক পুরানো দোতলা বাড়ির সামনে। চারপাশে নতুন নতুন বাড়ির মধ্যে এই বাড়িটি বড্ড বেমানান। গায়ের রঙ চটে গেছে। পলেস্তারা খসে আগাছা জন্মেছে। শ্বেত পাথরের ফলকে ব‍্যানার্জী ভবন। লেখাটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। সামনের বাগানে দু একটা ফুলের গাছ। একটা দোলনচাঁপা গাছ এই জঙ্গলের মাঝে ফুলে ফুলে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে দেখে অবাক হলাম। করলা নদীর দিক থেকে এক ঝলক বাতাস বয়ে এসেছিল দোলনচাঁপার গন্ধ মেখে। দিদুন গেটে হাত রাখতেই ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলো। পরনে সাদা ফতুয়া, পাজামা, চোখে মোটা কাচের চশমা। দিদুন অবাক হয়ে দেখছে। দু জনেই চুপচাপ। নৈঃশব্দ্যকে সাক্ষী রেখে দীর্ঘ কয়েক যুগের না বলা কথা ফুটে উঠছে দু জনের চোখে। 

 ভেতর থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে । সদ্য যুবতি মেয়েটির চোখে কৌতূহল-"কে এসেছে দাদু?"

আমার সাথে চোখা চোখি হতেই হাল্কা হাসলো মেয়েটি।

ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম রূপসার সাথে। আজ এই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলো। রূপসারা ফিরে যাবে ব‍্যাঙ্গালোর। ওর দাদু চলে যাচ্ছেন আশ্রমে, ফুলবাড়ির কাছে দাদু একটা আশ্রম করেছেন অনাথ ও দুস্থ দের জন্য। বিয়ে করেন নি। রূপসা ওনার দাদার নাতনী। 

নিচের ঘরে দিদুন আর দাদুর গলা ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। আজ তিনদিন ধরে দিদুনকে দেখছি আর ভাবছি এই অচেনা মেয়েটা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল। রূপসার মুখেই বাকিটা শুনেছি। বিতান দাদু সারা জীবন বিদেশে কাটিয়ে দশ বছর আগে দেশে ফিরেছিলেন। ফুলবাড়ির কাছে জমি কিনে ঐ আশ্রমটা গড়ে তুলছিলেন নিজেই। সেবাই ওনার জীবনের মুল মন্ত্র। এই পৈতৃক বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে থাকতেন। একমাত্র রূপসার সাথেই সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ব‍্যাঙ্গালোর থেকে ও যোগাযোগ রাখতো বরাবর। ছুটিতে এসে থাকতো দাদুর কাছে। বাকি শরিকরা এদিক ওদিক ছিটকে গেলেও এই দাদুর জন্যই বাড়ি বিক্রিটা আটকে ছিল এতদিন। দিদুনের গল্পটা একমাত্র রূপসাই জানতো। এভাবে একজনের স্মৃতিতে জীবন উৎসর্গ করে দেওয়া আজকাল কেউ ভাবতেই পারবে না। এই দু দিনে মেয়েটা আমার ভালো বন্ধু হয়ে গেছিল। 

ফেরার পথে আমরাও গেছিলাম ফুলবাড়ির আশ্রমে। চারদিকে ফল ফুলের গাছের মাঝে দোলনচাঁপার ঝাড় গুলো নজর কেড়েছিল। দিদুন খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা কাজ মিটিয়ে ফিরে আসবে বলেছিল। দাদু ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন-" তুমি তো এখানেই রয়েছ, সর্বদা। আমার সাথে। "

আমিও টের পাচ্ছিলাম দুটো কাজলকালো চোখ আগ্ৰহ ভরে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। কয়েকদিনেই মেয়েটা মনের মাঝে জায়গা করে নিয়েছিল। কেমন একটা চিনচিনে অনুভূতি.....। আমার চোখে হয়তো কোনো আশ্বাস খুঁজে পেয়েছিল। মুখে না বললেও দোলন চাঁপার গন্ধ মেখে আমার হৃদয় হয়তো ওকে কিছু বার্তা দিয়েছিল। 

গাড়িতে বসে ভাবছিলাম দোলনচাঁপা আর বিতানের গল্প হয়তো এভাবেই নতুন পরিণতি পাবে। নতুন ভাবে লেখা হবে পরবর্তী অধ্যায়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance