ব-এ বুমেরাং
ব-এ বুমেরাং
সেই প্রত্যাশিত ইন্টার্নশিপের দিন এগিয়ে এলো কিন্তু অম্বালিকা যদি... সময়ের মধ্যে পৌঁছতে না পারে তবে ওর মায়ের স্বপ্ন চুরমার হয়ে ভেঙে যাবে। মায়ের যে আত্মস্বার্থত্যাগের ফলস্বরূপ আজ পর্যন্ত অম্বালিকা যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, সেখানে এসে অম্বালিকা ওর মা মাধবীর স্বপ্ন কিছুতেই ভাঙতে দেবে না। অথচ আজই অম্বালিকার কেমন অসহায় লাগছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হোলো, মা'কে একলা এই অবস্থায় ফেলে রেখে ও যায় কী করে? কিন্তু ঘড়িটা আজ ওকে কিছুতেই ওর একমাত্র ভরসা ও ভালোবাসার স্থল মায়ের পাশে আরেকটু সময় থেকে সমস্যা মিটিয়ে বেরোনোর অনুমতি দিচ্ছে না। হঠাৎ অম্বালিকার কানে কয়েকটি শব্দবন্ধ ঢুকলো, খেতে খেতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো অম্বালিকা সেন, মুখে পরের গ্রাসটা তুলতে গিয়ে। ট্রেনি জুডিসিয়াল অফিসার অম্বালিকার আজ ইন্টার্নশিপের প্রথম দিনেই বেরোনোর মুখে মনে হোলো জীবনের অর্ধেক লড়াই ও জিতে গেছে। অম্বালিকার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
এবার ক'বছর পিছোনো যাক।
অসবর্ণে অখিলেশকে মাধবী বিয়ে করেছিলো বাড়ীর অমতে। সেই বিয়ের পরে থেকে মাধবীর বাপের বাড়ীর কোনো অস্তিত্বই মাধবীর জীবনে নেই।
বিয়ের দু'বছর পরে মাধবীর কোল আলো করে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান.... অম্বালিকা এলো। অম্বালিকা মায়ের আদরের অমু। মাধবী বড়ো যত্নে অমুকে বড়ো করতে লাগলো নিজের মনের মতো করে, স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার উপযুক্ত করে। আসলে ততদিনে যে বিয়ের পরে মাধবীর মোহভঙ্গ হয়েছে। সবদিক দিয়েই ঘটেছে মোহমুক্তি।
সন্তানের আগমনের পরেও দিন মাস বছর পার হয়েছে নিজের নিয়মে। এমনকি তবুও, মাধবীর সন্তানের আগমনও মাধবীর মা-বাবার মন বিন্দুমাত্রও গলাতে পারে নি। ফলতঃ মাধবীও বাপের বাড়ীর বিপুল সম্পত্তির এককণাও পায় নি।
মাধবীর স্বামী অখিলেশ উচ্চশিক্ষিত, খুব বড়ো মাপের ভালো চাকরি করে। সুতরাং বিয়ের বাজারে তার উচ্চ দাম হাঁকাতে না পারায় অখিলেশের মা-ভাইরাও মাধবী ও তার কন্যার প্রতি বিরূপ। নিজেকে রুচিবান ভদ্রলোক বলে দাবী করা অখিলেশ আজকাল নিত্যদিন অকথ্য গালিগালাজ করে মাধবীর সাথে প্রেমালাপ করে। আজকাল অখিলেশ কথায় কথায় বলে, মাধবীর মতো ফালতু একটা মেয়েকে বিয়ে করাটাই নাকি ওর নিজের একটা মহাভুল ছিলো।
অসহায় মাধবী মূক-বধির সেজে মেয়ে অমুকে বুকে আঁকড়ে রাতের অন্ধকারে বালিশ ভেজায়। দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর। বছরের পর বছর গৃহবধু মাধবী পার করে ফেললো কৃতকর্মের জন্য নিজের হাত কামড়াতে কামড়াতে। মাত্র সাড়ে বাইশ বছর বয়সে পাওয়া ব্যাংকের করণিক পদের চাকরিটি মাধবী নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিয়েছিলো বিয়ের আগেই, অখিলেশের কথার ওপরে অগাধ আস্থায় ও ভরসায়। বাপের বাড়ীর প্রভূত সম্পত্তি থাকার পরেও মাধবীর মনের কোথাও একটা স্বাবলম্বী হওয়ার শিকড় পোঁতা ছিলো। স্কুলে - কলেজে শিক্ষিকাদের দেখে দেখেই এই ইচ্ছা মাধবীর মনে দানা বেঁধেছিলো। পড়াশোনায় অতি সাধারণ মানের হলেও কেবলমাত্র অধ্যাবসায়ের জোরেই চাকরিটা জুটিয়ে ফেলেছিলো মাধবী।
।
উচ্চপদস্থ চাকুরে অখিলেশ মাধবীর এই কৌলিন্যহীন সামান্য চাকরি বরদাস্ত করতে পারে নি চূড়ান্ত স্বার্থপর অহংবোধের কারণে। সুতরাং বাধ্য করেছিলো অখিলেশ মাধবীকে, চাকরিটি ছাড়তে। প্রেমিক ও হবু বরের মন ও মান রাখতে মাধবী মেনে নিয়েছিলো এই হঠকারী অত্যাচার।
বিয়ের পর থেকেই মাধবী দাঁতে দাঁত চিপেই চলছে। তবে মাধবীর তপ্ত জীবনে শীতল প্রলেপ হোলো অমু, মাধবীর মেয়ে। ছোট্টবেলা থেকেই মা'কে অমু যেন চক্ষে হারায়। লেপ্টে থাকে সারাক্ষণ মায়ের সাথে। অমু লেখাপড়ায় ভালো, স্কুলে বরাবরের ভালো রেজাল্ট, অমু নিজেই আইন পড়তে চাইলো। অনেক বাধা বিপত্তি টপকে, মায়ের সস্নেহ সহায়তায়, আইনে স্নাতকোত্তর করে মেধার জোরে এই জুডিসিয়াল অফিসারের চাকরি পেয়েছে অমু.... অম্বালিকা সেন।
মাধবীর মেয়ে অমু ক'বছর ধরেই মাধবীকে পইপই করে রোজ শেখাচ্ছে, "মা, তোমাকে যেই বাবা অকথ্য গালাগালি দেবে, তুমিও অমনি পাল্টা গালিগালাজ করবে।" কিন্তু বেচারী মাধবী কিছুতেই পারে না এই গালাগালি করতে।
ধীরে ধীরে মাধবীর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, মেয়েটাই ওকে কোনোরকমে খাড়া রেখেছে। আফশোসে মাধবী জর্জরিত, যে প্রেমের খাতিরে ও মা-বাবা, পরিবার, চাকরি সব ত্যাগ করেছে, সেই প্রেমের এই জঘন্য পরিণতিতে।
সবার অলক্ষ্যে মাধবীর মেয়ে অমু মাধবীকে সর্বক্ষণ শেখাচ্ছে, "প্রতিবাদটা মা তোমাকেই করতে হবে, আমি আছি তো তোমার সঙ্গে।"
সেদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময়, মাধবী খুব ব্যস্ত। অমুরও সেদিন থেকেই ইন্টার্নশিপ শুরু কিনা, তাই অখিলেশের আর অমুর জন্য টিফিন বানাচ্ছে মাধবী, অখিলেশ আর অমুকে খেতে দিয়ে।
খেতে বসে ভাত গলে যাবার অপরাধে অখিলেশ যখন মাধবীর বাপ-মা-চোদ্দোপুরুষ তুলে তুমুল গালাগালি দিচ্ছে, ঠিক তখনই মাধবী ঘুরে দাঁড়ালো। যা যা অখিলেশ বলেছে ঠিক তাই তাই বলে পাল্টা অকথ্য গালাগালিতেই উত্তর দিলো মাধবী।
অখিলেশের খাওয়া থেমে গেছে, চোয়াল ঝুলে পড়েছে, বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি।
মাধবীর জুডিসিয়াল অফিসার সার্ভিসের ইন্টার্ন মেয়ে অম্বালিকা খেতে খেতেই বললো, "বাবা, আঠাশ বছরের অবদমন আজ বুমেরাং হয়েছে অগ্ন্যুৎপাতের আকারে। এবার তুমিই ঠিক করবে, বুমেরাং-এর আঘাত খাবে প্রতিদিন, নাকি নিজেকে সংযত করবে।"
অম্বালিকা খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে মাধবীকে জড়িয়ে ধরে মায়ের কান্নাধোওয়া গালে চুমো খেয়ে বললো, "মা, আসি, নয়তো লেট হয়ে যাবে এবার।"
(বিষয়: নারীশক্তি)