সন্দেহ আর সম্পর্ক
সন্দেহ আর সম্পর্ক
দীপেন , অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিল আর আজ একটি ভালো কম্পানিতে চাকরি করছে। দীপেন-এর ছোট থেকে সব গুনই ভালো ছিল শুধু সন্দেহ করা এক বাতিক ছাড়া। কোনো বিষয় নিয়ে দীপেন সন্দেহ করলে তা যেনো অসুখের মতো ওকে ঘিরে থাকে। একবার এই রকমই একটা সন্দেহ করে বসে দীপেন, নিজের পিসেমশাইকে নিয়ে । আর সেই নিয়ে পিসির সঙ্গে তুমুল অশান্তি পরে অবশ্য সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। কলেজে পড়ার সময় দীপেন একবার তার এক বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে সন্দেহ করে আর তখন সেই বন্ধুর সম্পর্কটাই পুরো ভেঙে যাচ্ছিল। শেষে পর্যন্ত আবার সমস্যাটা ঠিক হয়ে যায়। দীপেন এর সব অদ্ভুত অদ্ভুত সন্দেহ মাথায় চাপে। দীপেন-এর কিছু বন্ধু তার এই স্বভাবের জন্য তাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানোর পরামর্শ দেয়। কিন্তু দীপেন তা শুনে তো ভীষণ রেগে গিয়ে তদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। যাইহোক এখন দীপেন-এর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তাই বাড়িতে ভীষণ ব্যস্ততা ।
সাধারন বাড়ির মেয়ে ইলা,কলেজ পাশ করে চাকরি করার স্বপ্ন দেখে কিন্তু হঠাৎ তার মাসি এই দীপেন-এর সঙ্গে বিয়ের সমদ্ধটা নিয়ে আসে। ইলা বিয়েতে রাজি ছিল না প্রথমে। তখন তার মাসি বলে , "এই ছেলেটা ভালো চাকরি করে । ভালো বাড়ির , এদের অবস্থা খুবই ভালো। তাছাড়া ওরা বিয়ের পর তোকে চাকরি করতে দেবে । তাই এই বিয়েতে তুই রাজি হয়ে যা আর অমত করিস না"। ইলা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। কয়েক মাস পর ইলার সঙ্গে দীপেন-এর বিয়েটা ও হয়ে গেল।
দীপেন-এর মা বাবার ব্যবহার খুবই ভালো। দীপেনকে ইলার বেশ ভালোই লেগেছে । স্বামী হিসেবে ইলার প্রতি বেশ যত্নশীল, সব কিছুর খেয়াল রাখে। ইলার চাকরি করা নিয়ে ও কারোর কোনো আপত্তি নেই। তাই ইলা এখন বেশ নিশ্চিত তার জীবন নিয়ে। একদিন দীপেন বললো, "আচ্ছা আজ আমরা বাইরে থেকে লাঞ্চ করতে পারি না? তুমি যাবে তো?" ইলা বললো, "হ্যাঁ আমি যাবো।" রেস্টুরেন্টের টেবিল বুক করাই ছিল ইলা আগে পৌঁছালো আর দীপেন বলেছে তার সামান্য দেরি হবে অফিস থেকে আসতে। ইলা বসে অপেক্ষা করছিল দীপেন-এর জন্য হঠাৎ তার কলেজের বন্ধু অয়নের সাথে দেখা হয়ে গেলো। এতদিন পর দেখা তাই ওখানেই বসে অনেক কথা হলো। ফোন নম্বর আদান-প্রদান, হোয়াটসঅ্যাপ এ বন্ধুদের গ্রুপটাতে ইলাকে এড করা তাছাড়া ইলার চাকরির ব্যাপারে অয়ন হেল্প করবে তা অয়ন জানালো। এ সময় দীপেন এলো। দীপেন ও সবটা শুনলো। দীপেন-এর সাথে অয়নের আলাপ হলো। অয়ন কলেজ এ পড়াকালীন সবার সাথেই খুব ইয়ার্কি করতো আর ভীষণ মিশুকে। ইলার সঙ্গে হওয়া অয়নের প্রত্যেকটা কথাই আজ দীপেন গভীর ভাবে ভাবতে লাগলো এমনকি অয়নের ইয়ার্কি গুলো ও। আর ওমনি চেপে বসলো সন্দেহ। সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ি ফেরার পর দীপেন যেন অন্য মানুষ ।ভীড় করে আসা সন্দেহ তাকে নানা কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার নির্দেশ দিচ্ছে। আর তাই শুরু হয়ে গেলো ইলার সমস্ত কিছু ফলো করা। কিছু মাস পর দীপেন বুঝলো অয়ন ইলার জন্য একটা চাকরি প্রায় জোগাড় করে ফেলেছে। দীপেন ডিসিশন নিলো সে ইলাকে চাকরি করতে দেবে না। অয়ন ছেলেটা ঠিক সুবিধার নয় , ইলার প্রতি হয়তো দূর্বলতা আছে তার তাছাড়া ইলাও হয়তো কলেজে এই ছেলে টির সাথে..... এই সব অযৌক্তিক সাতপাঁচ ভাবতে থাকলো আর ঠিক করলো সে অফিস থেকে ট্রান্সফার নেবে আর ইলাকে নিয়ে সে কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকবে। যেমন ভাবা তেমন টাই দীপেন করলো। আসানসোল এ ট্রান্সফার নিল।ইলা বিষয়টা অনেকখানি আন্দাজ করলো। কিন্তু তার মনে হলো হয়তো দীপেন বেশি পসেজিভ তার প্রতি, বিষয়টা নিয়ে ততটা চিন্তা করলো না।
কিছুদিন পর....
আসানসোল নতুন জায়গা ,নতুন ফ্ল্যাটে সব কিছু ঠিকমতো গোছানো শুরু করলো ইলা। কিন্তু সে কখনই একা মার্কেট এ যাবার সুযোগ পেতো না। দীপেন ছাড়া কোথাও কোনো দরকারে যাবার কোনো সুযোগ পেতো না। যাবার কথা ভাবলেও দীপেন নানা অছিলায় বাধা সৃষ্টি করতো। কারোর সাথে কথা বললে বিশেষত কোনো পুরুষ ইলার সাথে কথা বললেই দীপেন তা অপছন্দ করতো । আর এই সমস্ত কিছু নিয়ে ইলার সাথে প্রায়ই দীপেন-এর ঝগড়া শুরু হতে থাকলো। ইলার মনে হলো সে যেন কয়েদখানায় বন্দি। একদিন দীপেন এর কলিগরা এলো বাড়িতে। মিঃ কাপুর এবং মিঃ সেন তার ফ্যামিলি নিয়ে এলো আর এদের মধ্যে প্রবাল ব্যচেলর ছিল । ইলার হাতের রান্না খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করতে লাগলো। তারপর জমিয়ে আড্ডা চলছে। প্রবাল ইলার সঙ্গে কথা বলছে আর তাই নিয়ে শুরু হয়ে গেলো দীপেন-এর মনে অশান্তি। অন্য দের সাথে হাসিমুখে কথা বললেও দীপেন সবসময় নজর রাখছে ইলা আর প্রবালের কথাগুলোতে। সবাই চলে যাবার পরই দীপেন ইলার সঙ্গে প্রায় ঝগড়াই করে ফেললো। দীপেন জানালো ইলার উচিত ছিলো মিসেস কাপুর এবং সেনকে বেশি সময় দেওয়া। প্রবাল এর সাথে এত কথা বলা ঠিক হয়নি।
এরমধ্যে ইলার মাসি ইলাদের খবর নেওয়ার জন্য ফোন করলো । ইলা জানালো সে ভালো নেই। দীপেন এর সন্দেহ বাতিক স্বভাব তার ভালো লাগছে না। ইলার মাসি বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিয়ে বললো, "দীপেন তার মানে তোকে বেশি ভালোবাসে তাই এত সন্দেহ করে হয়তো"। ইলা বললো, "হ্যাঁ তা যদি হয়ও তবে এ ভালোবাসা রীতিমত গলার ফাঁস যেনো। আমার নিজের কোনো বক্তব্য থাকতে পারবে না , কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারবে না, কারোর সাথে কথা বলতে পারবো না, এটা কি একটা জীবন হতে পারে ? এভাবে কি কেউ বাঁচতে পারে? আমার এখন এই সম্পর্কটা অসহ্য লাগছে।" ইলার মাসি কোনো উত্তর দিতে পারলো না এসব কথার। চিন্তিত হলো।
দু'মাস পর দীপেন -র কলিগরা সবাই মিলে পিকনিক অ্যারেঞ্জ করলো। দীপেন এবং ইলা ও গেল। এই পিকনিক এ ইলার সাথে প্রবাল এর আলাপ গভীর হলো। ইদানীং ইলা প্রবালের সাথে ফোনে বেশি চ্যাট করে। কথা ও বলে। ধীরে ধীরে প্রবাল এবং ইলা একেঅপরের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়লো। কিছু মাস পর দীপেন সবটাই বুঝতে পারলো আর ইলাকে প্রশ্ন করলো কেন সে এরকম করছে?এই বিশ্বাসভঙ্গের মানে কি? কেন ইলা তাকে ঠকালো প্রবাল-এর জন্য এভাবে ? ইলা জানালো , "তুমি সুস্থ নও। মানসিক অসুখে ভুগছো। সবসময় সন্দেহ করা এটা বিরক্তিকর। আমাকে বন্দি করে রাখতে চাইছো। এভাবে কি কেউ বাঁচতে পারে? আর যে সম্পর্কে কোনো বিশ্বাস ছিলই না কোনোদিন, সেই সম্পর্ক থাকা না থাকা সমান আমার কাছে। তুমি আজ আমায় ঠকানোর কথা বলছো ,আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো কিন্তু ভেবে দেখো -----আদৌও কোনো দিন আমায় বিশ্বাস করেছিলে তুমি? এই সম্পর্কটাই তো অবিশ্বাস এ দাঁড়িয়ে ছিলো। এতটুকু ভালোবাসা কি ছিলো? আমি মুক্তি চাই , আমি তোমার সাথে থাকতে চাই না।" দীপেন রাগে বিরক্তিতে ছটফট করতে থাকলো। প্রবাল এর সঙ্গে ফোনে ঝগড়া শুরু করলো।
ওইদিন তখন বিকেল-এর সূর্য নিভে আসছে আকাশে । চারিদিকে রং ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ইলা আনসোল থেকে কলকাতায় যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলো। আর যাবার আগে দীপেনকে বললো , "প্রবাল এর জন্য এই সম্পর্কটা ভাঙেনি , ভেঙেছে তোমার অবিশ্বাস আর সন্দেহ এর জন্য । প্রবাল আমার বন্দি জীবনে একমুঠো খোলা হাওয়া মতো"।