শোধ
শোধ
ঘর মুছতে মুছতে আমি সুবলের কথাই ভাবছি ।রাগ কষ্ট দুটোই হচ্ছে । বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন সুবল সারারাত্রির রাস্তার ধারে মদ খেয়ে বেহেড হয়ে পড়েছিল। রিক্সাটা চুরি হয়ে গেছে । মানুবাবুর রিক্সা ।
মানুবাবু এসেছিল বাড়িতে ।আমার সামনেই সুবলকে দুটো থাপ্পড় দিয়েছে।আমি মানুবাবুর পা ধরেছি। কেঁদেছি।
-ওকে মেরে ফেলবেন না, মানুদা। আমার দুটো দুধের বাচ্ছা ।মানুবাবু আমার বুকের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেয়েছেন।
-আমার শাশুড়ি মা খুব অসুস্থ ।আমি লোকের বাড়ি কাজ করে খাই । আমি মানুবাবুর করুণা পাওয়ার জন্যে খুব চেষ্টা করেছি ।মানুবাবু হেসেছেন।
-পাঁচ হাজার টাকা । ধার করে, ভিক্ষে করে কাজের বাড়ি থেকে নিয়ে আয় ।যেভাবে আমার পায়ে পড়েছিস সেভাবে ওদের পায়ে পড় । কাল সন্ধের মধ্যে না পেলে রাত্রে সুবলের দুটো...
লোকটার অসভ্য কথাগুলো মনে পড়ে গেল আমার।আমি মনে জোর আনার জন্যে জোরে জোরে ঘর মুছতে থাকি ।কাকিমা নিশ্চয় দেখছে ।
-কাকিমা!আমি ডাকি।
-হ্যা বল।
-ঘরটা ভালো মোছা হচ্ছে তো?
-হুঃ
-বড় বিপদ আমার কাকিমা।
-ভালো।
-কী ? আমি অবাক হয়ে কাকিমার দিকে তাকাই ।কাকিমা আসলে ফোনে কথা বলছে ।আমি কাজ করতে থাকি । একসময় কাজ শেষও হয়ে যায় । ফোনটা কথা বলেই চলেছে ।কাকিমা ইশারায় আমায় চলে যেতে বলে ।আমি তবু তাকিয়ে থাকি কাকিমার দিকে ।কাকিমা আবার হাত নাড়ায় যেন মশা তাড়াচ্ছে । আমি আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসি । কাকিমা দরজা বন্ধ করে । বড়লোকেদের দরজাগুলো ওদের মত শক্ত হয় ।
আমি সারাদিন সাতবাড়িতে কতভাবে চেষ্টা করেছি ।পারলাম না। ভয়ে সুবল বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না ।আমায় বলেছে, ‘ কলি, আমি পালিয়ে যাই।’
আমি ওকে জড়িয়ে কেঁদেছি। কান্না ছাড়া আমার যে কিছু নেই ।বাবা,মা,দাদা কেউ নেই ।আমার শুধু সুবল আছে। আমার দুটো ফুলের মতো বাচ্ছা ছেলে মেয়ে শুভ আর সোনা আছে। একটা কোমড় ভাঙা অবোধ শাশুড়ি মা আছে । যে তাকিয়ে থাকে আর তাকিয়ে থাকে।
সন্ধেবেলায় আমি মানুবাবুর দরজায় গিয়ে বেল বাজালাম। দরজা খুলেই মানুবাবু হাত পাতলো।
-টাকা?
-পাইনি, কেউ দিচ্ছে না। আমার চোখ দিয়ে জল নেমে এল।
-আয়, অন্য কিছু দিয়ে শোধ দে ।আয় ভেতরে । আমি ভেতরে ঠাসা অন্ধকারে ঢুকে গেলাম।
বাড়িতে ফিরে চান করে সুবলের সামনে বসেছি। সুবলের দিকে চোখ রেখে বলি , ভয় পেও না ধার শোধ হয়ে গেছে ।
-কী করে করলে কলি?
-ভালবাসলে সব পারা যায় সুবল। আমি সুবলকে জড়িয়ে ধরে বলি । আমরা কাঁদি। আমি সুবল একসঙ্গে অনেকদিন কাঁদিনি ।