Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sheli Bhattacherjee

Romance

3.6  

Sheli Bhattacherjee

Romance

রজনীগন্ধা

রজনীগন্ধা

17 mins
3.6K


(১)

অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথের সারাটা সময় জুড়ে সুবাসের শুধু অদ্রিজের কথাই মাথায় ঘোরাফেরা করছে। আজ এতোগুলো বছর পর পুরানো পাড়ার, পুরানো স্কুলের, পুরানো খেলার সঙ্গীকে নতুন করে পেয়ে যে আনন্দটা হওয়া উচিৎ ছিল, সেটা কিন্তু সুবাসের ঠিক হচ্ছে না। আজ সকালে ডি এল এফ অফিস চত্বরে যখন অদ্রিজ সুবাসকে দেখতে পেয়ে সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে, তখনও সুবাসের মধ্যে কী যেন একটা অস্বস্তিদায়ক অনুভূতি কাজ করছিল। কিন্তু বাইরে থেকে বুঝতে দেয় নি তা। যতটা পেরেছে স্বাভাবিকই থেকেছে। অফিস ঢোকার তাড়াকে কিছুক্ষণের জন্য অবজ্ঞা করে দাঁড়িয়েছিল দুই বাল্যকালের বন্ধু। সামান্য সময়ের কথাবার্তায় উঠে এসেছে ওদের বর্তমান পরিস্থিতি, টুকরোটুকরো অতীতের ঘ্রাণ আর ভবিষ্যৎ যোগাযোগের প্রতিশ্রুতি। সেইসূত্রে সুবাস জানতে পেরেছে, অদ্রিজ আগের সপ্তাহেই একটা ক্যাপটিভ ইউনিটে চাকরি পেয়ে গুরগাঁও এসেছে। তার আগে একবছর নাকি নয়ডাতে ছিল। ও একাই থাকে এখন এখানে। বাকি সবাই কলকাতায় আছে। কলকাতার নামটা উঠতেই এখনো সুবাসের ভেতরে কেমন একটা শিহরণ হয়। সে শিহরণ ওকে এক ঝটকায় মনে করিয়ে দেয় অনেকগুলো অনুভূতি ঘেরা দিনের কথা। স্মৃতির বুলডোজারে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েও সেই টুকরোগুলো কখনোকখনো ওর জীবনপথে চলতে গিয়ে পায়ে কাটার মতো বেঁধে। ও চেষ্টা করেও পারে না, সেই পথগুলোকে এড়িয়ে চলতে। এক একটা সময়ের একাকীত্ব ওকে বশীভূত করে অজান্তেই নিয়ে চলে যায় সেই পথে।

অদ্রিজের মুখে ওর মা বাবা বৌ মেয়ের কথা শোনার পর, হঠাতই সুবাসের মনে পড়ে যায় ওর মায়ের কথা। বিগত নয় বছর ধরে যে মা ওকে অক্লান্তভাবে বুঝিয়েই চলেছেন, 'বাবু তোর বিয়ের বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছে। আর কবে করবি?' মায়ের এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর অতীতের যে গিটে জড়িয়ে আছে, তাকে খোলা বা খুলতে গিয়ে আরো জট পাকানোর ইচ্ছা ... কোনোটাই যে সুবাসের আর নেই। তাই এসব প্রসঙ্গ উঠলে একটাই গাঝাড়া কমন অজুহাত দিয়ে চলে সে ঘরে ও বাইরে 'আরেকটু শক্ত করেনি নিজের পা দুটোকে, তারপর'। 

কিন্তু সুবাস মনে মনে এটা আপ্রাণ জানে যে সেই শক্তি সঞ্চয় আসলে হয়তো অন্যকাউকে আজীবন ভঙ্গুর অবস্থায় ফেলে আসার পাপবোধ হতে মুক্ত হওয়ার অজুহাত। এসব ভাবতে ভাবতে সুবাস আবার নিজেই যুক্তি খোঁজে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য। তবে যে মোহন সেই ঘটনার কমাস পর সুবাসকে বিদেশে ফোন করে জানিয়েছিল যে, অদ্রিজই এখন ওই বাড়ির হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছে। তাহলে আর সুবাসের কী দরকার ছিল ওখানে। ভাবনার মাঝে মনের দ্বিধাগুলো এসে সুবাসকে ধাক্কাধাক্কি করে। কর্ণকুহরে যেন ফিসফিসিয়ে বলে, 

এতো বড় একটা ঘটনা শোনার পরও কি একবার ফোন করে খবর নেওয়া উচিৎ ছিল না সুবাসের?

নেবে কীকরে, ফোন নাম্বারটা যে টানা সুইচড অফ বলছিল। তার মানে নিশাও চায় নি আর যোগাযোগ রাখতে। এমনিতেই ওর সুবাসের বিদেশ যাওয়া নিয়ে হাজাররকমের আপত্তি ছিল। ঝগড়াঝাঁটি করে আসার আগের দিনটাকেও পুরো মাটি করে দিয়েছিল নিশা। বড্ড জেদি মেয়ে। নিজের মত মতো না চললেই মাথা গরম থাকত ওর। এমনকি ফ্লাইট ছাড়ার আগে একবার ফোন পর্যন্ত করেনি সেদিন। এরকম আগেও হত। ঝগড়া হলেই সাতদিন কথা বন্ধ থাকত ওর। তারপর রাগ ভাঙাতে হত সুবাসকে। কিন্তু তাই বলে, যেদিন ও এক বছরের জন্য বিদেশ যাচ্ছিল, সেদিনও? রাগ যেন ওর পৈতৃক সম্পত্তি।


পকেটে বাজতে থাকা ফোনের রিংটোনে চিন্তার তারগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো সুবাস। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মায়ের নম্বর। হাত ঘড়ির দুটো কাটার দিকে চেয়ে দেখে সুবাস বুঝল স্মৃতির কাটাকুটিতে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফিরতে। তাই হয়তো মা চিন্তায় ফোন করেছেন।


(২)

"মানি তুই সত্যি আমায় সারপ্রাইজটা বানিয়ে দিবি তো?"

"আরে দেব রে, দেব। তুই মন দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আয়।"

"লাভ ইউ মানি" বলে নিশার গলা জড়িয়ে ধরে দুগালে কিস করতে থাকে ছোট্ট সাড়ে চার বছরের পিকু। ওদিকে পিকুর মায়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে ডাইনিং রুম থেকে 'কীরে, দুধ ফিনিশ করিস নি? কটা বাজে জানিস? আরে বাস এসে পড়বে তো? পিকু, এই পিকুওওও ....'

পিকু মায়ের তাড়া খেয়ে আরেকবার মানির কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করে "কী সারপ্রাইজ দিবি বলনা মানি"।

নিশা এবার নিজের হাসিটা ঢোক গিলে চেপে রেখে চোখ ঈষৎ গরম করে বলে "তোকে মা ডাকছে না। যা শিগগির। নইলে কিন্তু ..."। কথাটাকে শেষ করতে হয় না, পিকু দৌড় লাগায়। ওর শিশু মনে ভয় কাজ করে, পাছে মানি চটে গেলে, ওর সারপ্রাইজটা যদি মিস হয়ে যায়।


সকালের এ দৃশ্য নিশার পরিচিত। রোজ সকালে পিকু স্কুল যাওয়ার আগে ড্রেস, চিরুনি নিয়ে রেডি হতে চলে আসে মানির কাছে। ওর মাকে মানে নিশার বোন এশাকে রান্নাঘর সামলাতে হয়। টিফিন তৈরি করতে হয় নিজের আর মেয়ের জন্য। তারপর নিশা আর মা বাবার জন্য খাবারগুলোকে যতটা সম্ভব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখে যায় এশা। যদিওবা এখন নিশা অনেকটাই গৃহস্থালিতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। তাও এশা চেষ্টা করে যতটা করে রাখা যায়। তাছাড়া ওদের মা বাবারও বয়স হয়েছে। এমিনিতেই দশ বছর আগের দুর্ঘটনাটার ধাক্কায়, বাবার দুবার পরপর স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল। ফিজিওথেরাপি করে এখন চলাফেরাটুকু নিজে নিজে করতে পারেন, এটুকুই যা। আর মা শরীরে সুস্থ থাকলেও, মনের দিক থেকে কী অবস্থায় আছেন, তা নিশা ও এশা দুবোনই বোঝে। তাই নিশা ঘরে ও এশা বাইরে আপ্রাণ নিজেকে সাবলীল শক্তসমর্থ রাখবার চেষ্টা করে যায়।


তাছাড়া নিশার দিনের বেশিরভাগ সময় জুড়েই তো থাকে পিকু। ওকে খাওয়ানো, পড়ানো, স্কুলের জন্য রেডি করা, ওর সাথে খেলা, ওর বায়না মেটানো সবকিছুতেই মানি। নিশাও বোঝে বাড়ির সবাই এমনকি এশার স্বামীও নিজের মেয়েকে ওর মাসি মানে ওর প্রিয় মানির কাছে রাখতে চায়। সবাই চায় নিশার জীবনের অন্ধকারময় সময়গুলো ও পিকুর সাথে কাটানো ঝলমলে আনন্দঘন সময়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে উঠুক। এভাবে নিশাও অবশ্য তা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। শুধু মাঝেমধ্যে ও অজান্তেই নিজের এককালীন তৈরি করা অতীতের গর্তে স্মৃতির পিচ্ছিল পথ বেয়ে প্রবেশ করে ফেলে। ভুলে যেতে চেয়েও, মন ও মাথায় ভেসে ওঠে কিছু ভীষণ প্রিয় মুহূর্ত। আর একলা ঘরের জানলার পাশে বসে নিশা গুনগুন করে ওঠে আনমনে

"তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন রে মন আমার।"


"টিফিন দেব নিশা?" মায়ের ডাকে সম্বিত ফেরে নিশার। ভেজা গলাটা কাচিয়ে শুকনো করে নিয়ে উত্তর দেয় "দিয়ে যাও মা। আমি পিকুর জন্য সারপ্রাইজ গিফট বানাচ্ছি।"


(৩)

রাতের খাবার টেবিলে বসে সুবাসের মা ওঁর দিদির প্রসঙ্গ তুললেন। মাসতুতো বোন রিতার বিয়ে ঠিক হয়েছে। খবরটা কালকেই পেয়েছিল সুবাস। আর এও জানত যে মা এবার ভুবনেশ্বর যেতে চাইবেন। সুবাসের কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। বিদেশ থেকে ফিরে এসে কলকাতাতেও একবারের জন্য যায় নি সুবাস। পাছে সেই চেনা পরিবেশ, চেনা মুখগুলো কৌতুহলী হয়ে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করে। কেউ না জিজ্ঞেস করলেও যেন, সুবাসের মনে হত সবাই ওদের সম্পর্কটা নিয়েই জানতে চাইছে। একটা সময় ছিল নিশা আর সুবাসের সম্পর্কটা সুবাসের আশপাশের মোটামুটি সবাই জানত। নিশা কলেজ ফেরত পথে অনেকবার সুবাসের মায়ের কাছেও এসেছিল। তাতে করেই, প্রেমের কলি ফোটবার আভাসটা কারো উদ্যোগ ছাড়াই চারপাশের কৌতুহলী বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত। আর মায়ের নিশাকে পছন্দ হয়েছিল বলে, সুবাসের উচ্ছ্বসিত আবেগ কখনো সে আভাসকে বন্ধ দরজার ঘরে আটকে রাখতেও চায় নি তখন। কিন্তু সুবাসের মা যখন ছেলের বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর সুবাসের কাছ থেকে দুর্ঘটনার কথাটা শুনেছিলেন, তখন হঠাতই কেমন যেন নিরুত্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন নিশার ব্যাপারে। সবটা পরিষ্কার করে না জানলেও, হয়তো নিশার নির্ভরতাকেন্দ্রিক কিছু অনিশ্চয়তা ভিড় করেছিল সুবাসের মায়ের চিন্তায়। তাই ছেলে বিদেশ ফেরৎ কলকাতায় আসতে না চাওয়ায় উনিও আর জোর করেন নি। তারপরের প্রথম সাতটা বছর মুম্বাইতে কাটিয়েছিলেন ছেলের সাথে। আর এখন গুরগাঁওতে। তবে বিয়ের প্রসঙ্গে এখনো মা ছেলের মধ্যে স্বচ্ছতা গড়ে ওঠেনি। কারনটা হয়তো প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে উভয়েরই জানা। তাই, এতোবছর দুজনেই একবারও কলকাতায় না গিয়ে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন বিষয়টিকে। এখন নিজের বড়দির ছোটো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে ভুবনেশ্বরে। তাই যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছে। তাছাড়া ভুবনেশ্বর যাবেন মানেই তো সেখান থেকে কয়েক ঘন্টার পথে কলকাতার দিকে যাওয়া নয়। সেকথাও ছেলেকে হাবেভাবে বুঝিয়েছেন সুবাসের মা অনিতা দেবী। সুবাস যদিওবা প্রসঙ্গটাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে প্রথমেই, অফিসে ছুটি না পাওয়ার বাহানা তুলেছিল। কিন্তু মায়ের প্রবল ইচ্ছার চাপে সুবাসকেও শেষে মাথা নোয়াতেই হল। অবশেষে ঠিক হল, সুবাস মাকে দিয়ে পরেরদিন চলে আসবে। আর মায়ের দিল্লী ফেরার টিকিট করে দেবে। শুধু মাসির বাড়ির থেকে কেউ অনিতা দেবীকে ভুবনেশ্বর থেকে ট্রেনে উঠিয়ে দেবেন।


ভুবনেশ্বর থেকে কয়েক ঘন্টার গাড়ি ড্রাইভ করে পুরীর বিচের পাশের চওড়া রাস্তাটায় এসে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল সুবাসের 'কতদিন সমুদ্র দেখা হয় নি'। কী এক বিস্তৃততর ভাঙাগড়ার নিরন্তর ঢেউয়ের খেলা ওকে আকর্ষণ করছিল নিকট হতে নিকটতর হতে। সুবাস কোনোদিকে না দেখে বালুচরে লম্বা পায়ের স্টেপ ফেলে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল সামনে। নোনা জলরাশির গর্জনরত তরঙ্গ যেন অভিমানী হয়ে বলছে সুবাসকে 

'আমায় ছুঁতে ছুটে আয়, পাবি ফিরে সব।

কেন এতো দূরে তোর হৃদয় কলরব?'


সুবাসের চোখেমুখে লবণাক্ত বাতাসের চিটচিটে ছোঁয়া। দুচোখ ভিজে আসছে অজানা ব্যাকুলতায়। মন বলছে 'কিসের দূরত্ব? কী পাওয়ার তাগিদ টানছে আমায়?' কে যেন খুব পরিচিত ভেজা গলায় ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে বলে চলেছে কবিগুরুর কবিতার কটি লাইন ...

'ওরে, তুই যাহারে দিলি ফাঁকি

খুঁজে তারে পায় কি আঁখি?

এখন পথে ফিরে পাবি কিরে

ঘরের বাহির করলি যারে?'

মুহূর্তে চমকে ওঠে সুবাস। মাথাটা সজোরে ঝাঁকিয়ে পেছন ফিরে দেখতে গিয়েই ঘুমটা ভেঙে যায় ওর। অসময়ের নিদ্রাভঙ্গের অস্থিরতার চেয়েও সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ওকে কৌতুহলে বেশি অস্থির করে তোলে। সুবাস খেয়াল করে দেখে ওর জেগে থাকা দুটো চোখও এখন নোনাজলে ভেজা। কিন্তু কেন?


(৪)

একটানা প্রাকৃতিক নিম্নচাপে নেট কানেকশন বড্ড ঢিলেঢালা অবস্থায় চলছে। পিকু যতক্ষণ ঘরে থাকে না ইউটিউব চালিয়ে বসে নিশা ওর জন্য সারপ্রাইজ গিফটটা বানাতে থাকে। ডলের কিচেন, ড্রয়িং রুম, বেডরুম, হ্যাঙ্গিং ব্যালকনি সব কী সুন্দর করে দেখানো হয় এক একটা ডাই মিনিয়েচার ভিডিওতে। এগুলো দেখে রূপকথার রাজকন্যার ঘর সংসার গড়তে গিয়ে নিশাও হারিয়ে যায় অন্য এক দুনিয়ায়। যেখানে সুখের চাঁদোয়ার তলায় আনন্দের ঝকঝকে ঘর তৈরি হয়। সে ঘরে থাকে স্বপ্নের মতো সাজানো এক জগত। এক রাজকন্যে সে বাড়ির স্মৃতির চাদরে ঢাকা ব্যলকনিতে তার রাজপুত্রের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকে। অতঃপর অজস্র ভালোবাসার মোড়ক খুলে সেই রাজপুত্র রাজকন্যের জন্য বের করে একটি প্রেমের অঙ্গুরি। ভাবতে ভাবতেই নিশার সমস্ত শরীরে শিহরণ হয়। মনে হয় যেন এক স্বপ্ন বাস্তবিক হতে ছটফট করছে।

"মানি, আমি এসে গেছি।" পিকুর জোরালো আদুরে ডাকে সম্বিত ফেরে নিশার। অন্তরের অব্যক্ত চাওয়াগুলোকে বাস্তবতার কঠিন ঢাকনায় জবরদস্তি মুখ বন্ধ কৌটার মতো আটকে দেয় নিশা। ধীরে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের দিকে চেয়ে দেখে ভাবে, এই দশ বছরের ছাব্বিশটা অপারেশনে কী হাল হয়েছে চেহারার। গত তিন মাস আগেও হল শেষ অপারেশনটা। অবশ্য বলা যায় না, হয়তো আরো হতে পারে। মেরুদণ্ড বরাবর সাজানো স্নায়ুকোষগুলো যখনতখন ঝামেলা করে এখনো। তখন পায়ের থেকে স্নায়ুকোষ অপারেট করে স্থানান্তর করাতে হয়। আর এই করে দিন কে দিন নিশার পা দুটোতে হওয়া মাঝেমধ্যের ব্যাথাটা আরো বাড়তে থাকে। নিশা আপনমনে নিজেকে বিদ্রুপ করে হেসে ভাবে, সারাটা শরীর ঘিরে বসানো চারটে লোহার পাত ঘিরে শরীরে কাঠিন্য তৈরি হলেও, বেহায়া মনটা এখনো নরম। এখনো তার নরম অনুভূতির মাটিতে ভালোবাসার ঘর বাঁধার স্বপ্ন। ভঙ্গুরতা যে শুধু শরীরে নয়, বাস্তবিকতাতেও করাঘাত করেছে, তাকে ভুলে যেতে চায় মন।


"জানিস মানি, বাবা বলেছে বাবাও একটা সারপ্রাইজ দেবে।" পিকু এসে নিশাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে দুচোখ বড় বড় করে ভুরু নাচিয়ে বলতে থাকে। পিকুর ছোঁয়াতেই মুহূর্তের মন ভালো করা বাতাসে নিশা সব ভুলে যায়। ওর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ভেসে যায় এক শিশুর সারল্যভরা হাসির লহমায়। 

"তাই?" পিকুকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে নিশা।

"হ্যাঁ রে। তবে সারপ্রাইজটা শুধু আমার জন্য নয়। সবার জন্য।" 

"সবার জন্য মানে?" পিকুর কথার পিঠে অবাক প্রশ্ন নিশার।

"মানে, বাবা বলেছে সবার জন্য একটা ট্যুর প্ল্যানিং করবে এবার। আমার এক্সাম ফিনিশ হলেই, আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাব।"

এবার নিশা পিকুর কথাগুলো কিছুটা বুঝতে পারে। আগেরবার পিকুর পরীক্ষার পর ওদের সবাইকে সারাদিনের জন্য ইকো পার্কে নিয়ে গিয়েছিল পিকুর বাবা। খুব মজা করেছিল সবাই মিলে। এবারও হয়তো তেমন কিছু চিন্তা করেছে। 

"মানি, তার আগে আমার সারপ্রাইজটা তুই দিবিতো?" পিকুর সন্দিগ্ধ প্রশ্নের সরল প্রকাশ। 

নিশা ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে "দেব রে সোনা, দেব।"


(৫)

লাঞ্চব্রেকে অফিস বিল্ডিং থেকে বেড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাচ্ছিল সুবাস। মুখের সামনে লাইটারে ক্লিক করে কেউ একটা এগিয়ে ধরল। সুবাস দুঠোঁটের মধ্যে সিগারেটটা চেপে ধরে আড়চোখে দেখল অদ্রিজ দাঁড়িয়ে পাশে। সুবাস বুঝল এবার থেকে এই অফিস চত্বরে যখনতখন দেখা হয়ে যাবে ওর অতীত স্মৃতিগত ছায়ার সাথে।

"সিগারেটটা আর ছাড়তে পারলি না তাহলে?" অদ্রিজের মৃদু শাসনীয় প্রশ্ন।

"কেন, তুই ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?" একটু যেন কড়াভাবেই বলে ফেলল সুবাস।

"ঠিক ছেড়েছি বললে ভুল হবে। বরং ছাড়িয়ে ছেড়েছে বলাটা ভালো।" 

"মানে?" সুবাসের অবজ্ঞাসূচক প্রশ্ন।

"আরে বন্ধু, বৌয়ের জ্বালায় কী আর নিজের সখ সুবিধাগুলো বেঁচে থাকে রে।" বলে কৌতুকে সুবাসের পিঠ চাপড়ে বলে উঠল অদ্রিজ। তারপরেও সুবাসকে চুপ থাকতে দেখে বলল

"তা তোর সহধর্মিণী বুঝি ওনার ধর্ম পালন করেন নি?" অদ্রিজের কথায় ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে তাকায় সুবাস বন্ধুর দিকে। অদ্রিজ কিছু একটা আন্দাজ করে বলে "মানে পতির কর্মে সতীর পুণ্য কিনা। তাই তেনারা খেয়ে না খেয়ে আমাদের ভালো চাইতে যায়।"

অদ্রিজের কথাটা শেষ হতে না হতেই সুবাস বিরক্তির সুরে বলে ওঠে "আমি বিয়ে করিনি।"

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অদ্রিজ। তারপর কিছুটা আঁচ করতে পারে বন্ধুর মনের অবস্থা। আর সেটা অনুভব করে হয়তো বন্ধুর জন্য কতকটা গর্বও বোধ করে। তারপর ভারী আবহাওয়াটাকে কিছুটা হাল্কা করে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে অদ্রিজ "আর কবে করবি বন্ধু। চুল দাড়ি যে সব পেকে যাচ্ছে।"

বন্ধুর কৌতুকে বিন্দুমাত্র রেসপন্স না করে অফিসে ঢোকার তাড়া দেখায় সুবাস। বুঝতে পেরে অদ্রিজ বলে "সামনের সোমবার তোকে একটা ছবি দেখাব। এখন সাথে নেই।" 

বন্ধুর কথায় নিরুত্তাপ থাকে সুবাস। গম্ভীরভাবে জানায়, ও মাকে নিয়ে ভুবনেশ্বর বেড়িয়ে যাবে সামনের শনিবার। রবিবার থেকে সোমবার ফিরে আসবে। তাই সোমবার অফিস আসাটা অনিশ্চিত।

"আচ্ছা, মাসিমা এখানে তোর সাথেই থাকে?"

"হুম। এখন আসি। এতোক্ষণ ব্রেকে থাকাটা বসের নাপসন্দ।" অদ্রিজকে রীতিমতো কথাগুলো ছুঁড়ে বলেই গটগট করে অফিসের দিকে এগিয়ে গেল সুবাস।


(৬)

হোটেল রুমের পূবদিকের জানলার পর্দাটা সরাতেই সমুদ্রসৈকতের দিক থেকে একটা ঝকঝকে সকালের রোদ এসে জড়িয়ে ধরল নিশাকে। গতকাল রাতে ট্রেন জার্নির ক্লান্তিতে ক্যাব থেকে নামার সময় আর তেমন করে সমুদ্রের দিকে চেয়ে দেখেনি নিশা। কত বছর পর শরীরের এতো ধকলের পর এরকম ট্রেন জার্নি করল নিশা। সেই কলেজের ফাস্ট ইয়ারের শেষে মা বাবা বোনের সাথে ওয়ালটেয়ার গিয়েছিল নিশা। এশা সেবার উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছিল। একটা রিফ্রেশমেন্ট দরকার ছিল। ওদের দুই বোনেরই সমুদ্র খুব প্রিয় বলে নিশার বাবা অল্টারনেট বছরে সমুদ্রসৈকতের ট্যুর প্ল্যানিং করতেন। কত মজা হত তখন ঘুরতে গিয়ে। বালুতটে বসে দুই বোন মিলে ঘর বানাত, ঝিনুক কুড়ানোর কম্পিটিশন করত। মায়ের সাথে হোটেল রুমে বসে অন্তাক্ষরি খেলত। গানের গলাটা দুজনেই মায়ের মতোই পেয়েছিল। কিন্তু বরাবরই নিশার গানের প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। এখনো তাই ও গুনগুন করে ওঠে অবসরের একাকীত্বে। পূবের অরুণালোয় সমুদ্রকে বহুবছর পর দেখে, নিশার ভেতরের আঁধারগুলো যেন সহসা গুমরে ওঠে। মনে হয় ছুটে চলে যায় ওর ভালোবাসার প্রকৃতির কাছে। নিশার অভিমানী কণ্ঠে গুণগুণিয়ে ওঠে সুরের লহমা ...

'তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ, ও মোর ভালোবাসার ধন, তোমায় নতুন করে পাবো বলে ...

দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন ও মোর ভালোবাসার ধন ...'।


'মানি তুই কাঁদছিস?' পিকুর কথায় এক ঝটকায় গান বন্ধ করে মানস জগত থেকে ফিরে আসে নিশা। চেয়ে দেখে দরজায় বোন এশাও দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। ওর ছলছলে চোখদুটো লুকাতে মেয়েকে বকে উঠল এশা "দিলিতো মানির গানটাকে থামিয়ে"।

"আরে না না। আয় মা, আমার কাছে আয়। আজ তোর সাথে বালির ঘর বানাব। সমুদ্রে স্নান করব। অনেক মজা করব আমরা।" নিজের সমস্ত যন্ত্রণাগুলোকে কর্পূরের ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে চটজলদি নিজেকে স্বাভাবিক করে পিকুকে জড়িয়ে ধরে নিশা।


সকাল তখন প্রায় সাড়ে ছটা। অরুণের স্নিগ্ধ আলো পড়ে ঝলমল করছে সমুদ্রের জলরাশির স্ফীত অংশভাগ। বালুতটে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসে আছে নিশা আর এশা। পিকু ওর মানির তৈরি ডলহাউসকে কারো মানা না শুনে খেলবার জন্য নিয়ে এসেছে সাথে করে। সেটি তার বড্ড মন পছন্দের হয়েছে যে। এমন সময় অদ্রিজকে দূর হতে দেখে পিকু এশাকে বলতে লাগল "মা বাবার সাথে ও কে আসছে?" পিকুর প্রশ্নে সেদিক ফিরতেই চমকে উঠল দুই বোন। নিশার যেন সারা শরীর অবশ লাগছে তখন। বুকের বাঁদিকটা মুহূর্তে সজোরে স্পন্দনশীল হয়ে উঠেছে। নিজের দুটো চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ও। সে পরিস্থিতিতে এশাও সমানভাবে অবাক। কারন ওর স্বামী অদ্রিজ সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য সমস্ত ব্যাপারটাকে কারোর সাথে আগে আলোচনাই করেনি। পাঁচদিন আগে বাল্যবন্ধু সুবাসের সাথে কথা বলার পর নিজে মনে মনে পরিকল্পনা করে প্রথমে গিয়েছিল সুবাসের গুরগাঁওয়ের ঠিকানায়। যে ঠিকানার কথা প্রথমদিন সুবাসই ওকে কথাপ্রসঙ্গে জানিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সুবাসের আর ওর নিজের শ্যালিকা নিশার ব্যাপারে সুবাসের মায়ের সাথে কথা বলে ও। কথায় কথায় জানতে পারে মোহনের কথা। মোহন সুবাস আর অদ্রিজের কলেজ বন্ধু ছিল। সেই কলেজেই জুনিয়ার ছিল নিশা। মোহন ইউনিয়ন করত, মিটিং মিছিলে কড়া কড়া ভাষা বলত বলে নিশা ওকে তেমন পছন্দ করত না। কিন্তু শুরুর দিন থেকেই মোহনের নিশার উপর নজর ছিল। যখন সুবাসের সাথে নিশার সম্পর্কটার কথা কলেজে ছড়িয়ে পড়েছিল, মোহন খুব জ্বলত। নিশার বোন এশাও পড়ত ওই কলেজেই। আর কীভাবে যেন অদ্রিজ বন্ধু সূত্রে নিশার সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর এশার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করেছিল। কিন্তু কখনো সেভাবে সবার সামনে এমনকি এশার সামনেও প্রকাশ করে নি তা। তারপর যখন সুবাসের এম এন সিতে চাকরি হয়ে যাওয়ার দেড় বছরের মাথায় বিদেশ যাওয়ার সুযোগ এসেছিল, নিশা খুব আপত্তি করেছিল। অদ্রিজ মধ্যমণি হয়ে বোঝাতে অনেকবার নিশাদের বাড়িতেও গিয়েছিল সে সময়। হয়তো ভেতরে ভেতরে এশার সাথে দেখা হওয়ার একটা টানও ছিল তার। কিন্তু যেদিন নিশার সাথে সুবাসের চরম মনোমালিন্য হয়েছিল, সেদিন অদ্রিজ বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। পরে সেসব কথা শুনেছিল এশার কাছে। এশাই জানিয়েছিল অদ্রিজকে যে নিশার অভিমানী মন বড্ড জেদি হয়ে গিয়েছিল তখন। আর সুবাসের বিদেশ যাওয়ার দিন নিশা ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে একমনে কাঁদছিল। আর সেই সময়েই আকাশে একটা ফ্লাইট দেখে অন্যমনস্কভাবে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল দোতলার ন্যাড়া ছাদ থেকে। মুহূর্তে ঘটে গিয়েছিল একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ভাবতেই এখনো অদ্রিজ শিউরে ওঠে। এশার কাঁপা গলায় ফোন পেয়ে সেদিন যখন হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল অদ্রিজ, তখন ডাক্তারের ভাষায় 'নিশার যেকোনো মুহূর্তেই যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে'। আই সি ইউ এর বাইরে টেনশনে একটানা বসে থেকে পরের দুদিনের মধ্যে নিশার বাবার এটাক হয়েছিল। বিপদের ঘন জেদি ছায়া যেন নিশাদের বাড়ির উপর লোভী থাবা বসিয়েছিল সেসময়। অদ্রিজ সুবাসের মায়ের কথায় বুঝেছিল, সেসময় মোহন ওকে অদ্রিজের নিশাদের বাড়িতে বারংবার যাওয়ার কথাটাকে অন্যভাবে পরিবেশন করেছিল। অথচ নিশার এক্সিডেন্টের ব্যাপারে বললেও, তার গুরুত্ব অনেক কমিয়ে বলেছিল। আর নিশা দীর্ঘ তিনমাস হাসপাতালে থাকায়, সুবাসকে কল করতে পারেনি। তারপরেও সুবাস আর কল না করায়, নিজেকে কারো উপর অসহায় নির্ভরশীল হতে চায় নি নিশা। আর এই মিস কমিউনিকেশন, মোহনের ষড়যন্ত্র, দুজনের ভুল বোঝাবুঝি, অভিমানী মনের জেদ ... সবকিছুর মিলিত কারনে সুবাসও তারপর নিজের সমস্ত কনট্যাক্ট নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলেছিল। দেশে ফেরার পরের এক বছরের মধ্যে মোহন নাকি জানিয়েছিল সুবাসকে, অদ্রিজ নিশাদের বাড়ির জামাই হয়ে উঠেছে। ওই পরিবারের হর্তাকর্তা এখন অদ্রিজ। সে সময় মোহন অবশ্য কথাটা মিথ্যা বলেনি। এশা আর অদ্রিজের মধ্যে তখন নির্ভরতা আর বিশ্বস্ততা ভিত্তিক ভালোবাসার সেতুটা দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। নিশার তখন দু-তিন মাস অন্তর অন্তর এক একটা অপারেশন হচ্ছিল। এদিকে এশার বাবা প্রায় বিছানায় পড়ে গিয়েছিলেন। তাই কলেজ পাশ করে চাকরি পেয়ে দেড় বছরে নিজেকে একটু মজবুত করেই অদ্রিজ এশাকে বিয়ে করে নিয়েছিল। অদ্রিজের মা বাবাও নিশাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সে সময়। এমনকি বিয়ের পরেও ওরা নিজেদের একমাত্র পুত্রবধূ এশাকে তার মা বাবা আর দিদির খেয়াল রাখতে নিজের বাড়িতেই থাকতে বলেছিলেন।

আজ প্রায় দশ বছর পর যখন অদ্রিজ সুবাসের কাছে শুনেছিল, ওর বিয়ে হয় নি। আর দেখতে পেয়েছিল বন্ধুর ভেতরের গভীর ক্ষতকে। তখন বুঝেছিল, এই দশ বছরে চারপাশের অনেককিছুই বদলেছে, কিন্তু সুবাসের মনের গভীরে নিশা আর নিশার মনের গভীরে সুবাসের জায়গাটার আদৌ কোনো বদল হয় নি। যেটুকু রাগ অভিমানজনিত বহিরাগত পরিবর্তন হয়েছে, তার মূলে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো মোহনের কথা মনে করেই সুবাস এখনও ওর বন্ধু অদ্রিজকে ঠিক আগের মতো মেনে নিতে পারছে না। সুবাসের হয়তো মাথায় আছে এখনো, অদ্রিজ নিশাদের বাড়িতে যাওয়ার হুজুগ তুলতো। কিন্তু কারনটা সেদিনও ওর অজানা ছিল, আর আজও। তবে সুবাসের অদ্রিজকে আজ ভুল বুঝে সহজভাবে মেনে না নিতে পারাটা আরো প্রমাণ করছে যে, ও নিশার প্রতি এখনো কতটা অভিমানী। এতো গভীর দীর্ঘস্থায়ী অভিমান যে প্রেম ছাড়া আর কিছুতেই সম্ভব নয়। এই প্রেম নিশার শারীরিকভাবে দুর্বলতা বা সবলতা ভিত্তিক মোটেই নয়, বরং বিশ্বাসের মজবুত ইমারতে চির ধরার প্রকাশ মাত্র।


অত:পর সব চিন্তা করে অদ্রিজ সুবাসের মায়ের মতামত নিয়ে তৎকালে ওর পুরী যাওয়ার আর এশা নিশা সহ পিকুর পুরীতে আসার টিকিট করেছিল। এমনিতেই মেয়েকে কথা দিয়েছিল একটা ট্যুর করবে। তো সেটা পুরীতেই হবে। অদ্রিজের ভেতরের প্রবল ইচ্ছা ওকে চুপিচুপি জানান দিচ্ছিল, বন্ধু সুবাসকে তার প্রেমের সাথে সমুদ্রসৈকতেই মিলিয়ে দেবে সে। একবার কলেজে ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষ্যে যখন সুবাসকে নিশার সামনে বন্ধুরা ক্ষ্যাপাচ্ছিল 'কোথায় যাবি হানিমুনে?', তখন নিশার লজ্জায় রাঙা মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল সুবাস 'পুরীর সমুদ্রসৈকতে'। সবাই ব্যাঙ্গ করছিল তখন 'বাঙালির ওই এক রয়েছে ... পুরী'। নিশা কিন্তু আবেগময় শিহরণে ধীর গলায় বলেছিল তখন 'তাতে কি, সমুদ্রতো আমার প্রিয় জায়গা'। 

কথাগুলো মনে পড়তেই আবেগে দুচোখ ভিজে এসেছিল অদ্রিজের। ও সুবাসকে এতোগুলো বছর ধরে চোখের সামনে দেখেনি, কিন্তু নিশাকে দেখেছে। জেদি ছটফটে মেয়েটা কেমন যেন সবার হ্যাঁ তে হ্যাঁ, আর সবার না তে না মিলিয়ে চলে এখন। শরীরের উপর দিয়ে বয়ে চলা এতো বড় ঝড়কে সামলে, পাঁচটা বছর হুইল চেয়ারে থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েও নিশা কেমন যেন নির্লিপ্ত 'জীবন' নামক শব্দটাকে ঘিরে। শুধুমাত্র পিকুকে বুকে আগলে রেখে ও সবকিছুকে ভুলে থাকে। থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে।

অদ্রিজ সুবাসের মাকে সেদিন গুরগাঁওতে বসে অনুরোধ করেছিল, সুবাসকে নিয়ে এইদিনে সকালে সমুদ্রের পাড়ে আসতে। উনি তাই এসেছেনও। আর সুবাসের মাই ছেলেকে অদ্রিজের বলা সব কথাগুলো জানিয়েছেন। সেসব জানার পর থেকে গতরাতে অদ্রিজকে কতবার ফোন করেছে সুবাস, ক্ষমা চেয়েছে ওর এককালীন প্রাণের বন্ধুর কাছে।


(৭)

এই মুহূর্তটা শুধু প্রেমের পুনর্মিলনের মুহূর্ত। একজোড়া প্রেমের কলির একসাথে সৌরভিত হওয়ার মুহূর্ত। সুবাসকে নিয়ে সমুদ্রতীর বরাবর হেঁটে আসতে গিয়ে ভাবছিল অদ্রিজ। নিশার সামনে যখন দুই বন্ধু এসে দাঁড়িয়েছিল, মনে হচ্ছিল বাইরের সমুদ্রের চেয়েও উত্তাল ঢেউ তখন দুই প্রেমিক প্রেমিকার অন্তরে আবেগ আর বিষ্ময়কর কৌতুহলের উর্মিমালায় গড়ে উঠছে। ধীরে ধীরে এতোগুলো বছরের গোচর অগোচরের ঘটনাজাত সমস্ত জট সবার সামনে খুলে অদ্রিজ সেই তরঙ্গকে শান্ত করল। এই দশ বছরের অজানা অবিশ্বাসের পর্দাগুলোকে এক এক করে ছিঁড়ে, উভয় তরফের প্রকৃত সত্যটাকে প্রকাশ করল সে।


সেখানে সবচেয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন ছোট্ট পিকু। ওর ডল হাউসে থাকার জন্য একটা বার্বি ওর বাবা এখান থেকে কিনে দেবে বলেছিল। সেই অপেক্ষার সাথে সে বাবার বলা গল্পটাকে না বুঝেই গিলছিল। এমন সময় অদ্রিজ মেয়ের হাতে তুলে দিল, একজোড়া পুতুল। পিকু খুশিতে হাততালি দিয়ে বলে উঠল "কী মজা বাবা, এতো প্রিন্স আর প্রিন্সেস"। 

"হ্যাঁ তো, শীঘ্র সত্যিকারের রাজপুত্র আর রাজকন্যেরও বিয়ে হয়ে হবে। তারপর ওরা একটা সুন্দর সাজানো বাড়িতে খুব খুব আনন্দে একসাথে থাকবে। ঠিক তোমার ডল হাউসের মতোই।"

বাবার কথায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে পিকু বলে উঠল "এটার নাম তো ডল হাউস। তাহলে ওই বাড়িটার কী নাম হবে বাবা?"

"রজনীগন্ধা" একসাথে বলে উঠল নিশা আর সুবাসের আনন্দঘন ভেজা গলা। ওরা যে বহুবছর আগেই এই নামটা ঠিক করে রেখেছিল ওদের স্বপ্নের বাড়ির জন্য। নিশার নাম থেকে 'রজনী' আর সুবাসের নাম থেকে 'গন্ধ' শব্দের মিলনে গড়ে উঠেছিল সেদিন সেই প্রেমের প্রাসাদের নাম। ওদের একসাথে বলা শব্দটা শুনে এশা আর অদ্রিজ মুগ্ধ হয়ে তখন আবার নতুন করে অনুভব করল 'প্রেম' শব্দটাকে।


সুবাস স্বপ্ন দেখেছিল, সমুদ্র ওকে ডাকছে তার বালুচরে। উপহার দিতে চাইছে ওর মানসজগতের চাওয়াকে। ভোরের আধো আলোর স্বপ্ন আজ এভাবে ঝলমলে অরুণের আলোয় পূরণ হবে, স্বপ্নেও ভাবেনি সুবাস। কিচুক্ষণের নীরবতা ভেঙে নিশা আর সুবাস মিলিত হল প্রেমের বাঁধ না মানা প্রলয়ে।


অদ্রিজ দূর হতে দেখতে পেল সমুদ্রতীরের বালিতে এক জোড়া আঙুল তার আনন্দঘন সঞ্চালনের মধ্য একত্রিত হয়ে করছে ভালোবাসার প্রকাশ। আর নিশার কণ্ঠের সঙ্গীত তরঙ্গমালার মতোই বায়ুতে আছড়ে পড়ছে দূর হতে দূরান্তরে ....

'আজ যেমন ক'রে গাইছে আকাশ, তেমনি ক'রে গাও গো।

আজ যেমন ক'রে চাইছে আকাশ, তেমনি ক'রে চাও গো।।

আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,

তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো।।'


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance